রাত ১২.৩৪ মিনিট

কলেজ চত্বরে তখন সন্ধ্যা নামছে । আলো আর অন্ধকারের মাঝামাঝি যে মূহুর্ত, তাকে বলা হয়, ভরসন্ধ্যা । লোকে বলে এই তখনই জীবিত আর মৃতেরা মুখোমুখি হয়, একে অন্যের কথা শোনে । আসলে জীবিত আর মৃতদের অবস্থান দেখতে গেলে একই প্লেটফর্মে । মধ্যে একটা সুক্ষ পর্দার বেড়াজাল।  যদি কোনভাবে কোন এক ফাঁকফোকর গলিয়ে ওপারে যাওয়া যায়, সে এক অনন্য অনুভূতি ।

আকাশ গুহ, বর্তমানে এই ইস্টার্ন কলেজের লাইব্রেরিয়ান। প্রাচীন কলেজ,  প্রায় শতাব্দী কালের।  খুব নামডাক ছিল একসময়ে । স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরেশ্বর চৌধুরী, রামগোপাল গুণ, অভিনেতা মলয় সরকার-- সবাই এই কলেজেরই প্রাক্তনী। এখন আশেপাশে অনেক স্কুল কলেজ খুলে যাওয়ায় সেই জৌলুস আর নেই।  তবে ইস্টার্ন কলেজের লাইব্রেরির সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। 

বিশাল চত্বর জুড়ে এই লাইব্রেরি, দুটো ভাগে ভাগ করা । একটা ভাগে জেনারেল লাইব্রেরি তার পাশেই বিশাল আর্কাইভ। তবে আর্কাইভটা দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ। এখানেই কাজ করতেন ডঃ বসন্ত সেন। নামকরা অধ্যাপক,  রাতদিন পড়ে থাকতেন এই আর্কাইভে । তারপর একদিন সকালে নিখোঁজ । তারও বছর দুয়েকের আগে তারই দুই প্রিয় ছাত্র।  সেই থেকেই আর্কাইভ বন্ধ। পর পর তিন তিনটে ঘটনা ঘটে যাবার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ আর সাহস দেখাতে রাজি নন।

ইদানিং ভারত সরকারের একটা স্কীমে পুরো লাইব্রেরিটাই ভেঙ্গে নতুন করে গড়া হবে । আকাশ গুহ এখন ভীষণ ব্যস্ত।  আঠার বছর পর আবার আর্কাইভের দরজা খোলা হয়েছে।  ভেতরে ধুলোর পাহাড়, মাকড়সার জাল আর একটা উৎকট গন্ধ। ভেতরে কোন আলোর ব্যবস্থা নেই, সাময়িক একটা ব্যবস্থা হয়েছে বটে তবে প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই সামান্য।  

পুরো দুটো দিন কেটে যায় সাফ সাফাই-এ । তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয় মূল কাজ । একটা একটা সেল্ফ নির্দিষ্ট করে, তার প্রত্যেকটি তাকের একটা একটা বই পরিষ্কার করে লিস্টিং করা -- অনেক কাজ । কাজ জানা লোক ছাড়া এসব কাজ সবাইকে দিয়ে সম্ভব নয় । আকাশ একটি টিম তৈরি সকাল থেকেই কাজে লেগে গেছে । প্রিন্সিপাল আকাশকে অফিসে ডেকে বলেছিলেন, তোমার কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং আগ্রহ দুটোই প্রসংশনীয় । তবে প্রত্যেক জায়গাতেই একটা নিজস্ব নিয়ম থাকে । এখানেও তাই।  নিয়ম অনুযায়ী লাইব্রেরি বন্ধ হয় বিকাল চারটা, তোমার জন্য ছয়টা অবধি এলাউড।  কিন্ত তারপর আর থাকতে যেও না । 
তারপর একটু হেসে বলেছিলেন, না ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই,  আমি গুজবে কান দিই না, তবে নিজের শরীরটার প্রতি খেয়াল রাখা প্রত্যেকেরই উচিত। তাই না ?

আকাশের শরীরের দিকে তাকাবার সময় নেই । যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে এখন । 
বিশাল হল ঘর,  চারপাশে সারিসারি আলমারি, বই-এ ঠাসা । মধ্যে জায়গায় জায়গায় বসার ব্যবস্থা । আকাশ ধীরে ধীরে ভিতরের দিকে এগিয়ে যায় । সবকিছুই পরিপাটি সাজানো, শুধু ব্যবহারের অভাবে ধূলোয় ধূলোময় । 
  আকাশ লক্ষ্য করে হলঘরের প্রায় শেষপ্রান্তে একটা টেবিল,  তাকে ঘিরে চারটে চেয়ার। হলে চেয়ার টেবিল আরও আছে কিন্ত এই চেয়ার টেবিলটি একটু যেন আলাদা । পরিষ্কার ঝকঝক করছে, রোজ ঝাড়পোছ করলে যেমনটা হয় । টেবিলের উপর একটা বড় বাঁধানো খাতা আর একটা টেবিলবাতি। খাতা দেখে আকাশের খুব অবাক লাগে । জায়গাটা ভীষণ অন্ধকার।  সমস্ত আর্কাইভে এই একটিমাত্র বই যা সঠিক স্থানে রাখা নেই । আকাশ কৌতুহল বশে খাতাটা টেনে নিয়ে চেয়ারে বসতে যায় আর তক্ষুণি টেবিল বাতিটা হঠাৎই জ্বলে ওঠে ।
আকাশ চমকে ওঠে, ভয় পায় । উঠে দাঁড়াতেই বন্ধ। 
মূহুর্তেই সশব্দে হেসে ওঠে আকাশ। তার মনে হয় নিশ্চয়ই সেন্সরের কোন কারসাজি হবে হয়ত।
আবার চেয়ারে বসতেই বাতিটা আবারও জ্বলে ওঠে । এবার আর ভয় পায় না আকাশ। বাতির আলোতে চোখে পড়ে খাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখা -
"Journal 1997, Dr. Basanta Sen "

খাতার মলাটে হাত লাগতেই আকাশের সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠে । একটা ঠান্ডা চোরাস্রোত বুকের গভীর থেকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে গেছে ।
এই সেই জার্নাল যা লিখতে লিখতে ডঃ বসন্ত সেন একদিন নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। তারও বছর দুয়েকের আগে আরও দুটো ছাত্র নিখোঁজ হয়েছিল ।এই নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয় ।তারপর বসন্ত সেন  নিখোঁজ হতেই এই আর্কাইভ বন্ধ।  সেই সময়ে এই জার্নাল জ্বলিয়ে দেওয়ার একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কিন্ত সেটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি । আজ এভাবে জার্নালটি যে তার হাতে এসে যাবে,  আকাশ কল্পনাও করেনি কখনো ।

হাতের ভেতর খাতাটা হঠাৎ যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। আলতো করে মলাট উল্টাতেই প্রথম পাতায় লিখা - 
“আমার ভিতর গহীন গহ্বর, পড়তে যেও না।”

প্রথম পাতার লেখা পড়েই গা কাঁটা দেয় । অদ্ভুত হেয়ালি।  খাতা হাতে নিয়ে সে বসে রইল খানিকক্ষণ।  তার নিজেকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে । এই খাতা হাতছাড়া করা যায় না । একবার মনে হল প্রিন্সিপালকে জানান উচিত।  পর মূহুর্তেই মনে হল  না, তাহলে খাতাটাই হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে । তক্ষুণি ওঠে খাতাটা নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রাখল আকাশ। 

ঘড়িতে যখন রাত সাড়ে এগারোটা, সমস্ত হোস্টেল গভীর ঘুমে, আকাশ একটা টর্চ হাতে বেড়িয়ে গেল আর্কাইভ-এর উদ্দেশ্যে । চাবি তার কাছেই থাকে, তাই কোন অসুবিধা নেই। টর্চের আলোয় খাতাটা নামাতে গিয়ে আকাশ অবাক।  ওখানে কোন খাতা নেই। আকাশের স্পষ্ট মনে আছে খাতাট সে কোথায় রেখেছিল। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে আকাশ দেখে খাতাটা সেই আগের টেবিলেই রাখা । আশ্চর্য ! ওখানে তো  খাতাটা থাকার কথা নয়, তাহলে ?
চেয়ারে বসতেই আলো জ্বলে উঠল। আকাশ অবাক,  খাতাটা খোলা । জ্বলজ্বল করছে প্রথম পাতার সেই লেখাগুলো -
“আমার ভিতর গহীন গহ্বর, পড়তে যেও না।”

আকাশ এক মিনিট সময় নেয়, মন স্থির করতে । তারপর বইটা টেনে নেয় ।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে সে দ্বিতীয় পাতায় উল্টায়।দ্বিতীয় পাতায় আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে লেখা—

"২৭ মার্চ, ১৯৯৭"
"আজ থেকে শুরু হলো আমার পরীক্ষা। এখানে যা লুকানো আছে, মানুষ জানে না। জানলে হয়তো মেনে নিতে পারবে না। এখানে সময় অন্যভাবে চলে, শব্দগুলোও বেঁচে থাকে। আজ রাতে ওরা আবার ডেকেছে আমাকে। ওদের ভাষা আমি বুঝি না, কিন্তু ওদের ব্যথা আমি টের পাই।"

পাশের পাতায় আঁকা ছিল অদ্ভুত কিছু চিহ্ন—চক্রের মধ্যে কয়েকটি চোখ, আর মাঝখানে পোকামাকড়ের মতো কুঁকড়ে থাকা একটি অজ্ঞাত আকৃতি।

আকাশ থমকে গেল। তার মনে হলো যেন পাশের অন্ধকার কোণ থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি চারপাশে তাকাল। কেউ নেই। গা ঝমঝম করছে । আর তক্ষুণি টেবিলের আলোটা নিভে গেল । ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার। ঘরে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি। হঠাত করে ঘরময় একটা দমবন্ধ করা আঁশটে গন্ধ। আকাশের মনে হল কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, 
"কি খুঁজছো ? শেষ পাতাতে যাও । তোমার জন্য আমরা বসে আছি।"

আর থাকা ঠিক নয় ।আকাশ বই বন্ধ করে হাতের টর্চটা জ্বালানোর চেষ্টা করল, কিন্ত কিছুতেই জ্বলল না । দূরে দরজার ফাঁক দিয়ে চাঁদের এক চিলতে আলো । আকাশ সেই আলো নিশানা করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল।  আর্কাইভ থেকে বের হতেই টর্চটা জ্বলে উঠেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়িটা ঠিক ১২.৩৪ মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে ।

পরদিন সারাদিন ব্যস্ততায় কাটল। তারই ফাঁকে একবার টেবিলের পাশে গিয়ে দেখে খাতাটা টেবিলে নেই। একটু খুঁজতেই খাতাটা সেই সেল্ফে লুকিয়ে রাখা । আকাশ বুঝতে পারছে সে ছাড়াও আরও কেউ একজন আছে যে এই খাতা নিয়ে পড়াশোনা করছে ।
রাত গভীর হতেই আকাশ আবারও আর্কাইভে আসে । খাতা যথারীতি টেবিলে চলে এসেছে । তার মানে কেউ একজন এই অবসরে আর্কাইভে ছিল । 
চেয়ারে বসতেই যথারীতি আলো জ্বলে উঠল।  অবাক কান্ড,  খাতাটা খোলা, ঠিক যেখানে গত রাতে পড়া শেষ করেছিল আকাশ ।

সে পরের পাতাটি উল্টায়।

"২৮ মার্চ, ১৯৯৭"
"ওরা আমাকে রাতে ঘিরে ধরেছিল। এই আর্কাইভের নিচে যা আছে, ওরা সেটারই পাহারাদার। কেউ যেন নিচে না নামে। আমি নামলাম। আমার পায়ের নিচে প্রতিটা ধাপ যেন পচে যাওয়া মাংসের মতো নরম। আর ওরা আমার কানে কানে বলে চলল — ‘আরও নিচে… আরও কাছে…’"

আকাশ পাতায় আঙুল বুলিয়ে যায়। কালি এখনও ভেজা মনে হয়।
আকাশ অন্ধকারে নিঃশ্বাস চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। খাতার পাতা এখন বন্ধ, কিন্তু তবু যেন ভেতর থেকে শোঁ শোঁ শব্দ আসছে।
তার হাত অজান্তেই আবার খাতার উপর চলে যায়।
প্রথমে একটু ভয় পায়, কিন্তু কৌতূহল যে ভয়কে ছাড়িয়ে গেছে।

তারপর পরের পৃষ্ঠা।
"৩০ মার্চ"
"আজ আমি প্রথম শুনতে পেলাম গহ্বরের গান। তা ভয়ঙ্কর, অথচ মোহময়। ওরা বলে এই গানই আসল সত্য। যে একবার শুনে, সে আর ফিরে যেতে পারে না।"

আকাশের কানে যেন দূর থেকে আসা এক সুর ভেসে আসে। খুবই অচেনা, ভাঙাচোরা, করুণ সুর।
সে কেঁপে ওঠে।

পরে পাতায় লেখা —

"২ এপ্রিল"
"গহ্বরের নিচে যা আছে, সেটা এখন আমার ভেতরেও জন্ম নিচ্ছে। আমার রক্তে, আমার শ্বাসে। আমার স্বপ্নেও ওরা আসছে।"

পাতার পাশে লাল রঙের আঙুলের ছাপ। যেন কেউ রক্তমাখা হাত দিয়ে ছুঁয়ে গেছে।
আকাশ তবু পড়ে চলে।

"৩ এপ্রিল"
"যদি কেউ এটা পড়ে, তাকে বলছি— থেমে যাও। শেষ পৃষ্ঠায় যা লেখা আছে, সেটা জানলে তোমার নিজের ভেতরও ওরা ঢুকে যাবে।"

এবার আকাশের হাত কেঁপে যায়। বাতাসটা হিমশীতল হয়ে আসে। চারপাশে ছায়া নড়াচড়া করছে যেন।আকাশের মনে হয় এখানেই থেমে যাওয়া উচিত।  ঘরময় গতকালের সেই পচা আঁশটে গন্ধ । সে জানে এক্ষুণি ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে । ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় আকাশ। কিন্ত সারারাত ঘুম আসে না । খাতাটির প্রতি দিন দিন আকর্ষণ বাড়ছে ।
খাতা জুড়ে শুধু নিষিদ্ধ হাতছানি । ঠিক সেই কারণেই তো তার পড়তে আরও ইচ্ছে হয়।
প্রতিদিন রাতে আকাশ আবারও আর্কাইভে যায় । আজ খাতার পাতায় যেন কিছুটা আঁধার নেমে এসেছে।অক্ষরগুলো ক্রমশ জ্বলজ্বল করছে।

"ওরা আজও আছে। গহ্বর এখনও খোলা। আর আমি… আর আমি ফিরে যেতে পারবো না।"

হাত কাঁপতে লাগল আকাশের। তবু সে আবারও উল্টে দিল পাতা।

হঠাৎ খাতার ভেতর থেকে একটা ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এসে অন্ধকার করে দিল সব।আলো নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে সে স্পষ্ট শুনল—
“তুমি আমাকে পড়লে, তুমি আমাকে জাগালে…”

তারপর আকাশের চোখের সামনে খাতার ভেতর থেকে ভেসে উঠল এক জোড়া লালচে চোখ, আর সেই চোখের নিচে আবারও ভেসে উঠল কয়েকটা নতুন অক্ষর—

“শেষ পৃষ্ঠা উল্টাও । আমি বলছি তুমি শেষ পৃষ্ঠা উল্টাও, আমাদের অনেক কথা জমা, তুমি কি শুনতে চাও না ?”

আকাশ খাতা বন্ধ করে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায় ।

পরদিন আবার সেই এক জায়গাতেই খাতা রাখা তাও খোলা অবস্থাতে । আকাশ এই একটা বিষয় কিছুতেই বোঝে উঠতে পারে না । কি করে খাতাটা আগের রাতে যতটুকু পড়া হয়েছে, সেখানেই আটকে থাকে ।

আকাশ পাতা ওল্টায় । পরের পাতায় শুধু একটা লাইন লেখা - "আবার এলে - ডুবে গেলে ।"

অদ্ভুত কথা । আকাশ আরও কয়েকটি পাতা উল্টোয়—
কেবল আঁকাবাঁকা অক্ষর, অদ্ভুত প্রতীক, কিছু অচেনা ভাষায় লেখা বাক্য।
 আকাশ একের পর এক পাতা উল্টে যায় । ক্রমশ নেশায় পেয়েছে তাকে । প্রতিটি পাতার শেষে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই কথা -
“শেষ পৃষ্ঠা উল্টিও না। ওরা ওখানেই আটকে আছে।”

আকাশ তবু পাতার পর পাতা উল্টে যায় । এভাবে কয়েক পাতা গেলে, হঠাৎ আর কোনো লেখা থাকে না। ফাঁকা পাতা। আকাশ তবু পাতা উল্টাতে থাকে । এখন শুধু অদ্ভুত অদ্ভুত ছবি । ছবিগুলো ক্রমশ জীবন্ত মনে হচ্ছে ।
এবারে একেবারে শেষ পাতার আগের পৃষ্ঠা । আকাশ প্রচন্ড একসাইটেড। শেষ অবধি সে শেষ পৃষ্ঠা অবধি পৌঁছতে পেরেছে । আকাশ পড়তে থাকে—

"যদি শেষ পাতায় পৌঁছাও, আর যদি সাহস থাকে— আলো নিভিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকাও। ওরা অপেক্ষা করছে।"

আকাশের শ্বাস ভারী হয়ে আসে। তার হাত শেষ পাতার কাছে থেমে থাকে।
পেছন থেকে সমবেত স্বরে কারা যেন ফিসফিস করে বলছে —
“উল্টাও… উল্টাও… তুমি ভাগ্যবান … তুমি মুক্তির দূত ...”

আকাশের হাত থেমে গেল।
কিন্তু পেছন থেকে আবারও সমবেত কণ্ঠস্বর বলে উঠল—
“উল্টাও… হাতে সময় ভীষণ কম ... উল্টাও ”

আকাশের শ্বাস ভারী হয়ে এসেছে।
পেছন থেকে অজস্র কণ্ঠ ফিসফিস করছে —
"উল্টাও… উল্টাও… তুমি ভাগ্যবান … তুমি মুক্তির দূত ...”

তার হাত কাঁপতে কাঁপতে শেষ পৃষ্ঠায় পৌঁছায়।
অন্ধকারে বাতি আর জ্বলে না, চারপাশ নিঝুম।
আকাশ শেষ পৃষ্ঠাটি উল্টিয়ে দেয়।

সাথে সাথেই চারপাশের বাতাসে এক ভয়ানক শোঁ শোঁ আওয়াজ ওঠে। অন্ধকার আরও গাঢ় হয়। খাতার শেষ পাতায় জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে অক্ষর —

“সুস্বাগতম বন্ধু।”

তারপর এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, যেন মেঝে কেঁপে উঠল।
খাতার ভেতর থেকে একটা কালো কুন্ডলী বেড়িয়ে এল । আকাশের শরীর ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে । খাতার ভেতর থেকে একটা শক্তি তাকে ক্রমশ ভেতর দিকে টানছে । আকাশ শক্ত হাতে টেবিল আঁকড়ে ধরে । কিন্ত কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না । আকাশের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ওখানে আঁশটে দুর্গন্ধ। আকাশ শেষবারের নিজেকে বাঁচাতে চিৎকার করে ওঠে । অকস্মাৎ প্রচন্ড অট্টহাসিতে সব চিৎকার হারিয়ে যায় । তারপর… 
তারপর  শুধু নিস্তব্ধতা।
খাতাটা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়।
মলাটের উপর অদ্ভুত আলোকরেখায় লেখা হয়ে যায়—

Journal 2025 A.G.

 হলঘর নিঃস্তব্ধ। টেবিলের উপর রাখা কেবল আকাশের চশমা আর তার ঘড়ি। ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে আছে ১২:৩৪–তে।

পরদিন সকাল। আকাশকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
খাতাটাও আবার নিপাত্তা । আর্কাইভে আবারও নতুন করে তালা ঝোলানো হয়েছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
___









Comments