সময়টা ২০১৫ সালের অগাস্ট মাসের শেষভাগ । সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চল জুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে । এক সপ্তাহ ধরে ঝরছিল মুশলধারায় বৃষ্টি । পাহাড়েই হয়েছিল সমতল থেকে তুলনামূলক ভাবে বেশি । ধ্বস নেমে অনেক জায়গায় ঘর বাড়ির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল । যতদূর মনে আছে ওই সালের ২৭শে অগস্ট জী নিউজ এ খবরটি ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল । তারই কিছুদিন পরের কথা । আমাকে অফিস থেকে আদেশ করা হলো লুংথেলাই যাওয়ার জন্যে । স্ন্যাপ অডিট, খুব বেশি সময়ের কাজ না । তবে শিলচরে বসে এই রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়, যাওয়াটা জরুরী । এমনিতে আমার ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে । শুধু সময়টা বর্ষাকাল, রাস্তা ঘাটের শোচনীয় হাল আমাকে কিছুটা দ্বিধায় রেখেছিল । বস যখন আমাকে প্রশ্ন করলেন, " কবে যেতে চান--।"
আমি তখন দোটানায় আছি, তবু উত্তর দিলাম - "এনিটাইম"
---"গুড, তাহলে আজ বিকেলেই চলে যান।" বস খুশী হলেন ।
---"আজই---"
----"হ্যাঁ, কোন অসুবিধা আছে কি? "
---" না না কোন অসুবিধা নেই ।" আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম ।
---"বেশ, তবে আজ বিকেলের সুমোতে আপনি আইজল চলে যান । ওখানে আইজল ব্রাঞ্চ এর ম্যানেজার দাসবাবুকে বলা আছে, উনি আপনাকে আজ রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন। কাল সকালে ওখান থেকে একটা গাড়ি রিজার্ভ করে লুংথেলাই চলে যাবেন ।"
---"ও কে স্যার ।"
---"আপনি এখান থেকেও গাড়ি ভাড়া করতে পারেন, তবে আমার পরামর্শ আপনি আইজল থেকে গাড়ি ভাড়া করুন। স্থানীয় ড্রাইভার সঙ্গে থাকার অনেক সুবিধা ।" আমার বস আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ।
---"ঠিক আছে স্যার - - " আমি বাধ্য ছেলের মত তার পরামর্শে সায় দিলাম।
বিকাল বেলা পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি তিনটার সুমোতে চেপে বসলাম । বাড়িতে আমার মালিকনী কোনদিনই আমার এই হুটহাট যাওয়াটা সহজ ভাবে মেনে নেন নি, এ যাত্রায়ও তার কোন ব্যাতিক্রম হয় নি । বিশেষ করে আমার ছোট মালিকনী মানে আমার একমাত্র কন্যাটিতো ভীষণ বিরক্ত । আসা অবধি মায়ের প্রক্সি দিয়ে গেল । "এই ঘোর বর্ষায় না গেলে কি হয় ", "অফিসে আর কেউ নেই নাকি?" - - ইত্যাদি ইত্যাদি । বেরোনোর আগে "দুর্গা দূর্গা", "সাবধানে যেও, " " ফোন করবে" ইত্যাদি সব কিছুতেই ঘার নেরে ঠিক সময়েই গাড়িতে বসেছি। এক মিনিট চোখ বন্ধ করে ভেবে নিলাম, জরুরী কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা। অফিসের চিঠি, আই কার্ড - ওটা ছাড়াতো মিজোরামে ঢুকতেই দেবে না, আমার ডি এস এল আর ক্যামেরা, চশমা, মোবাইল আর আমার সুপুরির কৌটা। নাঃ সবই ঠিক আছে, কিছুই ফেলে যাচ্ছি না । কাপড় ব্রাশ ঔষধ এসব নিয়ে কখনোই আমার মাথাব্যথা নেই, কোন দিন ছিলও না কারন ওসব আমার মালিকনী খুব যত্ন সহকারে গুছিয়ে দেন, একচুল ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই । শুধু সমস্যা আমার সুপুরির কৌটা নিয়ে । আসলে আমার সুপুরির কৌটাতে সুপুরির টুকরোর সাথে জর্দা মেশানো থাকে, আর ওদের আপত্তি ওই জর্দাতে।বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে আমি জর্দা খাই না, কিন্তু ওরা মানতে রাজি নয় । ফলে যা হবার তাই হয়, কৌটা থাকে, সুপুরি থাকে শুধু জর্দা হাওয়া হয়ে যায় । আমিও, শালিক যেমন তার বাচ্চাটাকে আগলে রাখে শিকারী কাকের কাছ থেকে, তেমনি আমার কৌটাটি ওদের কাছে থেকে আগলে রাখি। কি করা যাবে ।
প্রায় সাড়ে তিনটেতে গাড়ি ছাড়লো। সবাই বলে বর্ষায় বেরোনো উচিত নয়, পথের ঝক্কি অনেক বেশি । আমি বলি বর্ষাতে যদি কেউ উত্তর পূর্বাঞ্চল না বেড়ায় তবে তার জীবন বৃথা । প্রকৃতি এসময় ভর যৌবনা । সামনের দুটো সীটই আমার নেওয়া। পাশে বসে কেউ আমার উপর ঘুমে ঢলে পড়বে, এ আমি ঠিক পছন্দ করতে পারি না।গাড়ি ছুটছে শহর থেকে শহরতলির দিকে । শহর ছাড়ার সাথে সাথেই রূপবতী প্রকৃতি তার রূপের ডালি নিয়ে পথের পাশে অপেক্ষায় । পথ চলছে তার আপন বাঁকে। দুপাশে জল, তারই বুক চিরে পীচ করা পথ। আকাশে তুলোর মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেঘ আর যতদূর চোখ যায় জল শুধু জল। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে শেষবারের মত জ্বলজ্বল করছে পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে, আর তারই প্রতিচ্ছবি বিস্তীর্ণ জলরাশি জুড়ে । যেন অস্ত যাওয়ার আগে শেষ প্রনাম গ্রহণে ব্যস্ত দিনমনি । নিলীমায় রামধনুর বাহার। ঘন ঘন পাল্টে যাচ্ছে তার রঙিন শোভা। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল ক্যামেরায় । কিন্তু হলো না, এত স্পীডের গাড়িতে এ দৃশ্য শুধু চোখের ক্যামেরায় ধরে রাখা সম্ভব হাতের ক্যামেরায় নয় । ক্যামেরাটা আবার বক্সে ঢুকিয়ে রেখে দিলাম । মন ভরে উপভোগ করছিলাম এই দৃশ্য । কখন যে সন্ধ্যা নামলো বুঝতে পারিনি ।কখনো জঙ্গল কখনো জনবসতি, তারই ফাঁকে পরম নিশ্চিন্তে ছুটছে আমাদের গাড়ি । দু তিন জায়গায় ধস নেমেছে সত্যি তবে পথ চলার কোন অসুবিধা নেই । সারাদিনের ক্লান্তিতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যখন ভাঙ্গল ততক্ষণে গাড়ি আইজল পৌঁছে গেছে । দাসবাবুর লোক স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল । ভালো হোটেলেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে । যাবার আগে ছেলেটা বারবার কাল সকালের জন্য গাড়ি লাগবে কিনা জানতে চাইছিল, আমিই বরং বারন করলাম । শুধু শুধু অফিসের টাকা খরচ করে লাভ নেই । খবরাখবর নিয়ে যা বুঝেছি তাতে রাস্তার অবস্থা খুব ভাল মনে হলো না। তাই ছোট গাড়ির চেয়ে সুমো জাতীয় উঁচু গাড়িতে যাওয়াই শ্রেয় । মধ্যে দাসবাবু একবার ফোনে আমার খোজ খবর নিলেন । কোন অসুবিধা হলে জানানোর জন্য পীড়াপিড়ি করলেন, আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম ।
হোটেলে আগে থেকেই খাবার বলা ছিল । ডাল ফ্রাই, ফিস ফিঙ্গার সঙ্গে মেথি চিকেন । নাইস ডিশ । ড্রেস পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে ফটাফট গরম গরম খাবার নিয়ে বসে পড়লাম । সত্যি বলতে কি এমনিতেই খিদে পেয়েছিল, খাবারের বর্ণে আর গন্ধে সেই খিদে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে । ভালোই করেছে প্রিপারেশনটা। খাওয়া শেষে একটা সিগারেট ধরিয়ে বেলকনীতে এসে দাঁড়ালাম। অপূর্ব সুন্দর, এক কথায় অসাধারণ । পাহাড়ের খাজ কেটে একটা বাড়ির উপর আরেকটা, তার উপর আরেকটা । রাতে যখন সবগুলো বাড়িতে আলো জ্বলে, সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য । সারি সারি বাড়ি তারই ফাঁকে ফাঁকে গির্জার সুউচ্চ চূঁড়া ঝলমল করছে, এক কথায় অপূর্ব । চোখ জুড়িয়ে যায় । শুতে যাওয়ার আগে অনেকগুলো ছবি তুললাম ।
সকাল বেলা ছটার মধ্যেই স্ট্যান্ডে চলে এসেছি । পাহাড়ী শহরের এই এক মজা । এখানে শহর জাগে সূর্যোদয়ের সাথে আবার ঘুমিয়ে পড়ে সেই সূর্যের অস্তাচলের সাথে সাথেই । ঠিক ছয়টাতেই গাড়ি ছাড়লো । পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি । একপাশে খাড়া পাহাড় অন্যপাশে গভীর খাদ । ভুল বললাম, খাদ নয় অন্য পাশে শ্বেত শুভ্র মেঘনদী । ধীর গতিতে ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে পাহাড়ের খাজ বেয়ে এগিয়ে চলেছে মেঘের নদী, মেঘনদী । আর তারই পাশে রেলের ট্রেকের মত সমান দুরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি । একটা সিগারেট খেতে গিয়েও ধরাতে পারলাম না । এরকম একটা স্বর্গীয় পরিবেশে নিকোটিনের ধোঁয়া খুব বেমানান মনে হলো । স্পোর্টস মুডে বেশ কিছু ভালো ফটো তুলে নিলাম । বেলা বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে মেঘ কেটে যেতেই সবুজ পাহাড় তার অপরূপ সাজে সেজে উঠলো। সবুজ গাছ, ঘন সবুজ নানা জাতের নাম না জানা গাছ। আর তারই ডালে ঝুলে আছে থোকা থোকা ফুল। যেন বিধাতা তার নিপুণ হাতে কোথাও লাল তো কোথাও হলুদ আবার কোথাও বা বেগুনি ফুলের কার্পেট দিয়ে মুড়ে রেখেছেন পাহাড়টাকে। মনে হবে যেন প্রকৃতি তার ডালি সাজিয়ে বলছেন, "এসো অতিথি এসো, আমার কোলে এসো।"
দুপুর দু’টো নাগাদ লুংথেলাই পৌঁছলাম । ছোট্ট শহর, খুবই পরিষ্কার । গাড়ি আমাকে ব্রাঞ্চ এর সামনেই নামিয়ে দিল । ফাঁকা অফিস, আমাকে দেখে ম্যানেজার মেয়েটি ছুটে এলো। - - - "গুড আফটার নুন স্যার ।"
---" ইয়েস , গুড আফটার নুন। হাও আর ইউ, মেলোডি।"
---"ফাইন স্যার ।" ব্রাঞ্চ ম্যানেজারটির নাম মেলডি , আমি ওকে আগে থেকেই চিনি ।
---"এন্ড ইওর ব্রাঞ্চ - - - " আমি প্রশ্ন করলাম ।
---" নাইস স্যার, ইটস্ রানিং ভেরি ওয়েল। আই হেবন্ট ফেস এনি প্রবলেম স্টিল নাও।
---"দ্যটস্ গুড, অলওয়েজ বি পজিটিভ । ভালো লাগলো ওর উত্তর শুনে ।
---"ওকে স্যার, থ্যাঙ্কু ।"
আগেই খবর দেওয়া ছিল । মেলডি লাঞ্চে কি নেব জিজ্ঞেস করাতে আমি খুব হালকা ওর্ডার দিলাম । পাতলা ডাল ভাত আর ডিমের ওমলেট ।
খাওয়া শেষে কিছু লোকের ফাইল নিয়ে বসলাম ।
বর্তমানে সমগ্র ব্যাঙ্ক শিল্প এক দ্রুত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । আর তারই মধ্যে হাল ধরে আছেন একদল প্রবীণ প্রজন্মের সনাতনী ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় প্রাজ্ঞ দল আর আছেন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ নবীন প্রজন্মের তুর্কীরা। মেশিনের সাথে পাল্লা দেয় ওদের প্রাণশক্তি । প্রবীণেরা গ্রাহকদের বিচার করতেন তার সততা, কর্মদক্ষতা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদিতে। ভালো গ্রাহক নির্বাচন করতেন ব্যাঙ্কের কর্তা ব্যক্তিরা তাদের বিচার শক্তি দিয়ে আর অভিজ্ঞতা দিয়ে । হয়তো সেখানে প্রশ্রয় পেত কিছুটা আবেগ, কিছুটা অনুকম্পা হয়তো বা কিছুটা পক্ষপাতিত্ব। আজকের ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় আক্ষরিক অর্থে এসব কিছুই নেই, নেই কোন কর্তা ব্যক্তি । যিনি যত ভাল ডাটা অপারেটর তিনি তত বড় অফিসার । এখন ভালো গ্রাহক নির্বাচন করার দায়িত্ব বর্তেছে কম্পিউটারের উপর । বিচারের মাপকাঠি বিগত জীবনের ক্রিয়াক্রমের পরিসংখ্যান । এখানে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের আলাদা কিছু করার থাকে না । দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, অনভিপ্রেত পরিস্থিতির প্রভাব এসব এখানে মূল্যহীন ।
কাজ শেষ হতে হতে ছয়টা বেজে গেছে । ক্যামেরাটা কাঁধে ফেলে হাত ব্যাগটা হাতে তুলে নিলাম । এবারে হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিতে হবে । রেস্তোরাঁ কাম হোটেল রেম্বোতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে । ব্রাঞ্চ থেকে হোটেল কিছুটা পায়ে হাঁটা পথ, আমি আর মেলোডি পাশাপাশি যাচ্ছি, মেলোডিই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল । হঠাৎ একটা লাল রঙের ওয়াগনার এসে আমাদের পাশে ব্রেক কষে দাঁড়ায় ।আমর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভারটি মুখ বাড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, " কাঁহা জানা হ্যায় স্যার, আইজল?"
এসময় গাড়ি পাওয়ায় কোন কথাই নেই । পাহাড়ে সন্ধ্যা অনেক আগেই নেমেছে । দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তায়ও লোক চলাচল নেই বললেই চলে । আমার কপাল ভালো বলতে হবে । মেলোডিকে জিজ্ঞেস করলাম হোটেলের বুকিং বাতিল করা যাবে কিনা ।
---"অবকোর্স স্যার বাট হওয়াই? "
---" একচ্যুয়েলী আই ওয়ান্ট টু লীভ টুডে ইফ পসিবল।"-"বাট হওয়াই স্যার, ডোন্ট ইউ ফিল কমফোর্ট হেয়ার ? "
---" নো নো দ্যাটস্ নট দ্য ইসু মাই চাইল্ড, একচ্যুয়েলী আই ওয়ান্ টু সেভ মাই টাইম।" আমি মেলোডিকে আশ্বস্ত করে ড্রাইভারটিকে জিজ্ঞেস করলাম, " ভাড়া কিতনা?"
---"কাঁহা জানা হ্যায় স্যার? "
----" আইজল "
---" দো হাজার স্যার "। হিসেবে করে দেখলাম খুব একটা বেশি বলেনি। তবু অভ্যাসের তাড়নায় বললাম, "থোরা কম।"
---" নেহী হোগা---।" বলেই সে গাড়ি স্টার্ট দিল ।
---"রুকো - - ।"
বেচারী মেলোডি হঠাৎ করে এই পরিস্থিতিতে কি করবে বুঝতে পারছিল না । তাই আমি যখন ওর কাছে বিদায় চাইলাম তখন সে বারবার আপত্তি জানাতে লাগলো, "ডোন্ট গো স্যার, ডোন্ট গো।"
--"বাট হওয়াই? " মেয়েটিকে দেখে কষ্ট লাগছিল । একটা মায়া মায়া ভাব।
--" দিস রোড ইজ নট গুড স্যার, উই পিপুল নেভার মুভ এট নাইট ইন দিস রোড ।"
--"ডোন্ট ওয়ারি, বেবী"।এই বলে গাড়ির দরজা খুলে ব্যাগটা রাখলাম । - - "বাই মেলোডি, সি ইউ ভেরী সুন।"
---"জাস্ট এ মিনিট স্যার ।" ও পকেট থেকে চট করে একটা ক্রস আঁকা চাবির রিং আমাকে দিয়ে বললো, "কিপ ইট উইদ ইউ, ইটস এ মেমেন্টো অন বিহাব অব আস। বাই স্যার, সেভ জার্নি।"
আমি গাড়িতে উঠে বসলাম । গাড়ি চললো আইজলের পথে । বেশ ক্লান্ত লাগছিল নিজেকে। ড্রাইভার ছেলেটা মিজো, তবে হিন্দি ভালোই বুঝে। গাড়িতে একটা চডা় সুরে ইংরেজী গান বাজছে । বিচ্ছিরি লাগছিল । ইংরেজী গান যে আমি শুনি না তা নয় । বোহেমিয়ান বা রেপসডি এসব ইংরেজি গান আমি অনেক শুনেছি । কিন্তু এই মুহূর্তে এই গানগুলো ভালো লাগছিল না । বললাম, "তোমারা পাস কোই পুরানা হিন্দি গানা হ্যায়।" দু তিন বার জিজ্ঞেস করার পর ঘাড় নেরে যা ইঙ্গিত করলো তার অর্থ হচ্ছে আছে । আমি ভাবলাম বোধ হয় পাল্টে দেবে, কিন্তু তার কোন লক্ষণই নেই । খানিক অপেক্ষা করে ওকে আবারো অনুরোধ করলাম । ড্রাইভারটি বিরক্ত হয়েছে মনে হলো। পেন ড্রাইভ পাল্টে দিতেই কিশোর কুমারের গান, স্যাড সংস্ অফ কিশোর কুমার । আমার অনেকবার শোনা। রাজেশ খান্নার লিপে কালজয়ী সব গান । এমনি এক নিঝুম পরিবেশে ভালোই লাগছিলো শুনতে ।
চোখ বন্ধ করে আইজল. শহরের কথা ভাবছিলাম । আইজল শহরের ইতিহাস খুব পুরনো নয় । লোকে বলে " আই" হচ্ছে এক ধরনের গাছ জল মানে সমতল ভূমি । অর্থাৎ আই গাছে ভরা সমতল ভূমি । কিন্তু সমগ্র আইজলের আমি কোথাও সমতল ভূমি দেখিনি । হতে পারে আগে ছিল এখন নেই কিংবা এখনো আছে আমার দুর্ভাগ্য আমি দেখিনি । যাই হোক ১৮৭১-৭২ সনে তৎকালীন মিজো উপজাতি নেতা খালকোম এর উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশ বাহিনী প্রথম এখানে আস্তানা গাড়ে। তারপর ১৮৯০ সনে ডাল্লীর নেতৃত্বে আসাম রাইফেলের ৪০০ জন জওয়ান এর একটি দল এখানে আসে সেই ব্রিটিশ বাহিনীকে সাহায্য করতে । তারাই এখানে ঘর বাড়ি, রাস্তা ঘাট তৈরি করে মুল শহরের গোড়াপত্তন করেন । পরবর্তী ইতিহাস তো সবার জানা । ১৯৬৬তে এম, এন, এফ এর উত্থান, মিজোরামে বিমান হামলা, সবই ইতিহাস ।
কখন চোখ বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক মনে নেই । যখন ঘুম ভাঙ্গল দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে । ড্রাইভার ছেলেটি চুপচাপ বসা । সামনে বিশাল ধ্বস, রাস্তা বন্ধ । জিজ্ঞেস করলাম কত সময় লাগবে। ড্রাইভার ছেলেটি মুখে কোন উত্তর দিল না শুধু অঙ্গ ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে কোন নিশ্চয়তা নেই । তাড়াহুড়োতে জল সঙ্গে আনা হয় নি । অল্প খিদেও পেয়েছিল । ড্রাইভার ছেলেটি বড় বেয়ারা প্রকৃতির ।এই বিপদে ওর কাছে কতটা সাহায্য পাবো বুঝতে পারছিলাম না । গাড়িতেও বসে থাকতে ভালো লাগছিল না । বৃষ্টি একটু থামতে গাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে পড়লাম । হালকা বাতাস সঙ্গে অল্প শীত, ভালোই লাগছিলো । একটা সিগারেট ধরিয়ে অল্প এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলাম । আকাশ এখন পরিষ্কার । কাস্তের মত একটা একফালি চাঁদ ঝুলে আছে তাতে । নিঃপ্রভ প্রাণহীন মরা চাঁদ । তুলনায় তারা গুলি অনেক বেশি জ্বলজ্বল করছে । যেভাবে ধ্বস নেমেছে, সকালের আগে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই । দুরে একটা বাড়িতে আলো জ্বলছে দেখতে পেলাম । এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় বলেই মনে হচ্ছে । ড্রাইভার ছেলেটিকে ঐ আলো দেখিয়ে বললাম, "চলো উহা জানা হ্যায়"
---" কিউ? "
---" দেখতে হ্যায় কুছ খানা মিলতে হ্যায় ক্যায়া।" আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে ওকে বোঝানোর চেষ্টা নিলাম ।
--- "আপ যাও ম্যায় নেহি যায়ুঙ্গি।" কি উপদ্রব, এমন গোয়ার ছেলে বহুদিন দেখিনি। সাথের লোকটি বেয়ারা হলে, বেড়ানোর পুরো আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যায় । মাথাটা খারাপ হয়ে গেল । রাগ করে গাড়ি থেকে ব্যাগ আর ক্যামেরা নিয়ে নিলাম । থাক ও এখানে পড়ে, আমার নিজের ব্যাবস্থা নিজেই করে নেবো । মেলোডির কথা শুনে না আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। ভুল হয়ে গেছে । মোবাইল এর টর্চ জ্বালিয়ে রাস্তা খুঁজে খুঁজে আলো জ্বালানো ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম । খুব বেশি পথ নয় । এক থেকে দেড় মাইল দূরে হবে । কিছু কম বেশি হতে পারে । রাত্রির অন্ধকারে অনুমান করা কষ্টকর । পিছনের দিকে কিছুটা এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে । পাথর বসানো সিঁড়ি তবু খুব পিচ্ছিল । সাবধানে চড়তে হচ্ছে , যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে । আমি পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে ঐ ঘরটির দিকে গেলাম । আশেপাশে কোন ঘরবাড়ি নজরে এলো না । হয়তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তাই বাড়িগুলিতে আলো নিভে গেছে । বাড়িটি অনেকটা বাংলো বাড়ির মতন। সামনে খুব দীর্ঘ না হলেও সাজানো গোছানো বাগান । রাতের আলোতে যতটুকু দেখা যায় তাতে মালীর যত্নের ছাপ স্পষ্ট । একটা মিষ্টি গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে । ক্লান্তি দূর করতে এরকম জায়গার তুলনা হয় না । গেট খুলে ভিতরে ঢুকে দরজায় কলিংবেলে দু বার চাপ দিতেই ভেতর থেকে একটি মহিলা গলা ভেসে এল, --" হু ইজ দেয়ার ?"
--- "ইজ দেয়ার এনিবডি ইনসাইড ?"
---" ইয়েস, হুম ডু ইউ ওয়ান্ট স্যার? " দরজা খুলে যিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন তাকে সুন্দরী বললে কম বলা হবে । মহিলার উগ্র পোশাকের সাথে সাজ প্রথম দর্শনে আমাকে ঘাবড়ে দিয়েছিল । মনে হচ্ছিল এই মুহুর্তে তিনি হয়তো কোথাও যাবার জন্যে তৈরী হয়েছেন ।ভুল জায়গায় আসিনি তো।
---" ইয়েস স্যার ।" ভদ্রমহিলার ডাকে সম্বিত ফিরে এলো। আমি নিজের পরিচয় দিলাম সাথে এই আকস্মিক বিপদের কথা বিশদ জানিয়ে একবোতল খাবার জল চাইলাম ।
---"আপনি বাঙালি? " চমকের পর চমক । প্রথমে পান্ডব বর্জিত এলাকায় এত সুন্দর বাংলো, সেই বাংলোয় সুন্দরী মিজো মহিলা, এবার সেই মিজো মহিলার মুখে বাংলা বুলি। " আপনি বাংলা বলতে পারেন? " আমি প্রশ্ন করলাম ।
--- " লিটল বিট, বাট আই ক্যান আন্ডারস্যান্ড বেংগলী, আমি বুঝতে পারি । আসুন ভেতরে আসুন ।"
---"না না ভেতরে আসবো না । আমাকে এক বোতল খাবার জল দিন, তাতেই অনেক উপকার হয় ।" আমি বললাম ।
--- "ওঃ শিওর । এনিথিং এলস্?"
---" নো থ্যাঙ্কস, "
---" আমার যতদূর মনে হয় আজ রাতে রাস্তা পরিষ্কার হবার কোন কারণ নেই তাই ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ইউ ক্যান টেক রেস্ট হেয়ার অলসো ।"
---" থ্যাংকু সো মাচ ম্যম , বাট এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না ।" মিজোরা খুব অতিথপরায়ণ হয় । তবু অচেনা অজানা জায়গায় রাত কাটানো উচিত নয় বলেই আমার মনে হয়েছিল ।
ভদ্রমহিলা হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলেন, তাই বললেন, " স্যার ডোন্ট হ্যসিটেট, এটা আমার হোটেল কাম রেস্তোরাঁ।" --- "ইজ ইট?" আমি খানিকটা আশ্বস্ত হলাম । তাহলে রাতের ডিনার না পাই কিছু লাইট খাবার এখান থেকে কিনে নেওয়া যেতেই পারে । তবু রাত অনেক হয়ে গেছে, যদি ভদ্রমহিলা বিরক্তি বোধ করেন ।
ভদ্রমহিলার পীড়াপিড়িতে ওনার ঘরে ঢুকে বসতে হলো।বেশ গোছানো ঘর। মিজো বাড়িতে সাধারণতঃ ঢুকেই রান্না কাম বসার ঘর হয় । এখানেও তাই । বেশ বড় হল ঘর । একপাশে কিচেন, তারই সামনে ডাইনিং টেবিল । অন্য পাশে বিশাল বসার ব্যবস্থা, পেছনের দেওয়ালে দামী দামী মদ সাজানো । কোনায় একটা ডিভাইন । সোফার সেন্টার টেবিলে এক বোতল জেক ডেনিয়েলস আর একটা গ্লাসে তার থেকে কিছুটা মদ ঢালা। আমাকে সোফায় বসিয়ে ভদ্রমহিলা ভিতর থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে এলেন । কিন্তু আমিতো এক বোতল জল আমার সাথে নিয়ে যাবার জন্য চেয়েছিলাম ।--- "বাই দ্য ওয়ে, আমি পুই , মিসেস লালথেংপুই।" জলের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে ভদ্রমহিলা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন । আমি অল্প উঠে করমর্দন করলাম ।
--- "আপনি তো বাংলা ভালই বলেন, কোথায় শিখলেন এত সুন্দর বাংলা ।"
আমার কথা শুনে মিসেস পুই হেসে উঠলেন, ঠিক মেপে মেপে ততটাই যতটুকু প্রয়োজন । আমি, উঠবো ভাবছি, ঠিক তখনই মিসেস পুই আমার সামনের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন, "রাতে ডিনারে কি নেবেন, চিকেন মাটন নাকি পর্ক ।"
অদ্ভুত এই মহিলা, এমনভাবে কথা বলছেন যেন অনেক দিনের চেনা । - - - "না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না । আমি রাস্তায় খেয়ে এসেছি, ।"
---"আপনি না----" কথাটা পুরো না করে মিসেস পুই একটু মুচকি হাসলেন ।"
--"আমি কি? "
---" আপনি ভালো করে গুছিয়ে মিথ্যেও বলতে পারেন না ।"
---"না মানে আমি - - - " আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম ।
---" আমি বুঝে গেছি, আপনাকে কিছুই বলতে হবে না ।" মিসেস পুই চট করে উঠে একটা গ্লাস নিয়ে এলেন । - - - "আইস কতটা দেব?"
---" প্লিজ, আমার এসব চলে না ম্যাডাম ।"
---"ডোন্ট বি সিলি ।"
---"বিলিভ মি ম্যাম, আই হ্যাব নেভার টেস্টেড - - "
---" সো ওয়াট? " আমাকে থামিয়ে মিসেস পুই বললেন । আমি নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ভদ্রমহিলা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না । আমি সত্যি সত্যিই কোনদিন মদ স্পর্শ করিনি । তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে পরিবেশিত পানীয়টি খুবই দামী। মিসেস পুই আমাকে অফার করা গ্লাসটাতে অনেকটা জল মিশিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন । ---"প্লিজ দত্ত ডোন্ট বি এফ্রেইড ।"
আমি দোটানা পরে গেছি ।বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করা উচিত । ভয় হচ্ছে আবার লোভও হচ্ছে । যদি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাই, যদি নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে উল্টো পাল্টা বলি বা বমি করে ঘর নষ্ট করি কিংবা মিসেস পুই এর সাথে কোন অসভ্যতা করে বসি, তখন? লোক জানাজানি হলে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাবে ।এদিকে একজন সুন্দরী মহিলা পাশে বসে বারবার অনুরোধ করছেন আর আমি সেই অনুরোধ হেলায় ঠেলে যাচ্ছি এটাও ঠিক শোভনীয় নয় । ভদ্রমহিলার অনুরোধে একটা ঠান্ডা আদেশ আছে । আমার হাতে গ্লাসটি গুজে বললেন, " চিয়ারস্ মিস্টার দত্ত, দিস ফাস্ট পেগ ইজ টু মেমোরাইজ আওয়ার ফাস্ট মিট।"
অগত্যা আমিও চিয়ারস্ বলে গ্লাসে গ্লাস টোকা দিলাম । এক পেগ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । মনে মনে নিজেকে সাবধান করলাম। ছোট্ট করে একটা চুমুক দিয়েছি। নাটক সিনেমায় দেখেছি মদ খেতে অভিনেতারা মুখের নানা ভঙ্গি করে থাকেন । আমার কিন্তু খেতে খারাপ লাগলো না । বেশ কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব । কোন নেশা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না । একটা মিজো ছেলে আমাদের চার পিস মাছ ভাজা দিয়ে গেল । মাইক্রোওভেন দিয়ে গরম করা কড়া করে রহু মাছ ভাজা । মাছ ভাজা মুখে পুরে নিজের অজান্তেই বা হাত গ্লাসে চলে গেল । হালকা করে একটা চুমুক দেবো ভেবেছিলাম, কিন্তু একটু বেশি হয়ে গেল নাকি । মিসেস পুই আমাকে সাবধান করে বললেন, "স্লো মিস্টার দত্ত, প্রথম বার নিচ্ছেন তাই আস্তে আস্তে নিন।" খুব লজ্জা পেলাম । পকেটে থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম । ভাবলাম একটা সিগারেট খাই, নার্ভাস ভাব কেটে যাবে ।আমি কিছু করার আগেই মিসেস পুই আমার হাত চেপে ধরলেন । কি বিভৎস ঠান্ডা আর নরম হাত । সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলো ।
--"কিপ ইট ইন ইওর পকেটে । আজ আপনি আমার অতিথি, আমি খাওয়াবো। এটা নিন।" রথম্যানস্ সিগারেটের নাম শুনেছি, কোনদিন চেখে দেখেনি। একটি সিগারেট আমি আর একটা উনি নিলেন। বিদেশি সিগারেট তাই ফিল্টার খুব ভালো, আমাদের ফিল্টার উইল্স এর মত এত ঝাঝ নেই । হালকা কথা বার্তা হচ্ছে আমাদের মধ্যে । ।মিসেস পুই আমার গা ঘেঁষে বসা। এরই মধ্যে আমার দু পেগ হয়ে গেছে । ওনার চড়া পারফিউমের গন্ধ নাকি পেটে যাওয়া দু পেগের একশন জানি না তবে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমি উঠতে যাবো, আমার পা কাঁপছে কি। আমি কেন পায়ে জোর পাচ্ছি না । আবার বসে পড়লাম ।
---"হোয়াট হেপেন স্যার? "
--" নাথিং, আপনাদের ওয়াস রুম কোনদিকে? "
মিসেস পুই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন । আমি আবার উঠার চেষ্টা নিলাম কিন্তু কিছুতেই সুবিধা হচ্ছে না । মিসেস পুই পাশেই ছিলেন, আমার ডান হাত ওনার কাঁধে রেখে আমার কোমর জড়িয়ে আমাকে উঠতে সাহায্য করলেন । আমার শরীরের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ওনার স্পর্শ । এক ঝলকের জন্য মনে পড়লো আমি এক বিবাহিত পুরুষ । বাড়িতে আমার স্ত্রী কন্যা আছে। আমি একজন বিশ্বস্ত স্বামী। আমার পরিবার আমাকে খুব ভালবাসে, বিশ্বাস করে।আমি বোধহয় ঠিক পথে চলছি না । আবার পর মুহুর্তে মনে হল আমি আমার শরীরের মত আমার মনের উপরও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা দ্বিগুণ গতিতে লাফাতে শুরু করেছে ।অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম ।
খাবার টেবিলে খাবার সাজানো । মিজো ছেলেটা খাবার রেখে চলে গেছে । রুটি আর কশা মাংস । আমি মিজো বাড়িতে আগে খেয়েছি, ওরা মসলা খুব কম খায় । আজকের প্রিপারেশন সেরকম নয় । খেতে বসেছি, মিসেস পুই নিজেই আন্তরিক ভাবে যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন । কিন্তু জানি না মদ খেলে মানুষের মনটা নষ্ট হয়ে যায় কিনা, আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল ভদ্রমহিলা ইচ্ছে করেই নানা অছিলায় আমার ঘনিষ্ঠ হতে চাইছেন । আমি বারবার কারণে অকারণে ওর স্পর্শ পাচ্ছিলাম । আমি বুঝতে পারছিলাম না যে এটা নেহাতই অনিচ্ছাকৃত নাকি আমাকে উত্যক্ত করা। মাথায় ভুত চেপেছে, কিছুতেই কাজ করছে না। শরীর মন ভীষণ ভাবে বিদ্রোহ করতে চাইছে । নিয়ম ভাঙার আনন্দ আলাদা । কি হবে যদি আমি একদিন নিজের মত করে বাঁচতে চাই । মিসেস পুই এর সাথে আমার পরিবারের কোন পরিচয় নেই ।আজকের রাতটা কাল ভোরের সূর্যের সাথে চাপা পড়ে যাবে এই পাহাড়ের খাজে । হে প্রভু অপরাধ নিও না । নেশাটা খুব চড়েছে।
---"আপনি এখানে রেস্ট নিন। " মিসেস পুই আমাকে ডিভাইনটি দেখিয়ে দিলেন । আমিও মনে প্রাণে চাইছিলাম আজ রাতে এখানেই কাটাতে ।
---" কিন্তু আপনি? "
---" নটিবয়, একদম দুষ্টুমি না, এত ছোট বিছানায় দুজনের জায়গায় হবে কি? "
কি সাংঘাতিক মহিলা, কত সহজে এই কথাগুলো বলে দিল।আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি । কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না । ভদ্রমহিলাই আমাকে উদ্ধার করলেন," ডোন্ট ওরি মিস্টার দত্ত, আমি আপনার পাশের ঘরেই আছি । এনি প্রবলেম ইউ ক্যান কল মি।"
আমি ধীরে ধীরে ডিভাইনটিতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম । চোখ মুজে মিসেস পুই এর কথাই ভাবছি । মনের মধ্যে কাল বৈশাখীর ঝড়। ভাবছিলাম, যা ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে তাতে আমার কোন বিপদ হবে নাতো।
খানিক বাদে মিসেস পুই আবার আমার পাশে ফিরে এলেন । ওর পারফিউমের গন্ধেই ওনার উপস্থিতি বুঝতে পারছিলাম । আমার পাশে বসলেন । আমার ভেতরে যেন ৪৪০ ভোল্টেজ কারেন্ট বইছে ।
--- "আর ইউ স্লীপিং মিস্টার দত্ত?"
--- " নো নো - -" । আমি অল্প উঠে বসলাম ।
-- " উই হ্যাব স্পেন্ট এ গুড টাইম"
--- "রাইট ম্যাম, এন্ড দিস ইজ ওনলি বিকজ অব ইউ ।"
-- "নট দ্য, একচ্যুয়েলী আই হ্যাব এনজয়ড ইওর কোম্পানি । ইউ আর এ নাইস গাই।"
--- " থ্যাংকু ম্যম, ।"
--- "আই ডোন্ট নো, আমাদের আর দেখা হবে কিনা বাট আপনাকে খুব মনে পড়বে।"
--- " আপনার অতিথিতেয়তাও কোনদিন ভুলতে পারবো না ম্যম।"
--- " আপনি আপনার বাড়িতে আমার কথা গল্প করবেন? "
--- "অবশ্যই - -" ডাহা মিথ্যা কথা বললাম ।
- - - "ইউ আর টেলিং লাই ।" মিসেস পুই হেসে বললেন ।
--- "নট এট অল ম্যম ।" আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম ।
--- "সব কথা? আজকের সব কথা আপনার মিসেসকে বলতে পারবেন? " আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম ।
--- "নো আই থিংক ইউ ক্যান্ট ।"
--- " বিলিভ মি ম্যাম ।"
--- " ওকে ওকে ওনি যদি আপনাকে বিশ্বাস না করেন , কোন প্রমাণ চান?"
কে বোঝাবে এই মহিলাকে । আমি কোনদিনই বাড়িতে এসব আলোচনা করতে পারবো না, বিশ্বাস করা না করা তো অনেক দূরের কথা ।
-- " ওকে যদি সত্যি সত্যি বলেন তাহলে অবশ্যই আমার বেস্ট উইশেস জানাবেন প্লিজ ।"
--- "শিওর "
--- " ফাইন।," তারপরই একটু ইতস্তত করে মিসেস পুই এক অদ্ভুত বায়না ধরে বসলো ।--- " দত্ত ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড লেট আস টেক ফিউ সেলফি এজ এ মেমোরি । প্লিজ ।"
--- " ও নিশ্চয়ই " । মুখে বললাম বটে, কিন্তু মনে মনে নিশ্চিত জানি ফটোগুলো দেখলে বাড়িতে তুলকালাম কান্ড ঘটতে পারে । বুঝতে পারলাম না হঠাৎ সেলফির কি প্রয়োজন । সত্যি মেয়েদের মন বোঝা বড় দায় ।পুই নিজেই আমার মোবাইল দিয়ে অনেক গুলো ফটো তুললেন । খুবই ঘনিষ্ঠ ছবি, এরকম ছবি আমি আমার পরিবারের সাথে শেষ কবে তুলেছি মনে করতে পারছিলাম না । অধিকাংশতেই আমি আধশোয়া ক্লোজ ছবি ।আমার মনের অবস্থা অবর্ননীয়।
হঠাৎ কি মনে হতেই আমার চুলে হাত বুলিয়ে পুই উঠে দাঁড়ালো । - - - " গুড নাইট দত্ত, সুইট ড্রীম।" কি আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা নরম হাত । বুকের রক্ত পর্যন্ত ছলকে উঠে ।
মদের নেশা, পারফিউমের নেশায় আমার শুভবুদ্ধি উবে গেছে । আমি যা কল্পনা করতে পারি না তাই করে করে বসলাম । এক ঝটকা়য় পুই এর হাতটা টেনে নিয়ে কাছে ডাকলাম ।বললাম, " ইউ আর সো সুইট...."
ঘুম যখন ভাঙ্গল আমি বিছানায় শুয়ে । মাথায় অসহ্য ব্যাথা । সমস্ত শরীরে অদ্ভুত অস্বস্তি । চারপাশে তাকিয়ে দেখি জায়গাটা অপরিচিত লাগছে । একটা লোক বসা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, "এটা কোন জায়গা? "
--- "আইজল সিভিল হাসপাতাল ।" ভদ্রলোকটি উত্তর দিলেন । তারপর নিজে থেকেই প্রশ্ন করলেন -- "কেমন আছেন মিস্টার দত্ত?"
--- "আপনি ?"
--- " আমি ডি. এস. পি. আইজল, সুব্রত বসু । আজ সকালে আমাদের পেট্রোল টিম আপনাকে আইজল লুংথেলাই রোডে বেহুশ অবস্থায় পেয়েছে ।"
--- "কোথায় বললেন? "
--- " আইজল লুংথেলাই রোডে একটি কবরস্থানে আপনি বেহুশ হয়ে পড়ে ছিলেন ।"
--- " কি বলছেন? "
--- " হ্যাঁ তাই, আপনার মোবাইলে কবরের উপর আধশোয়া কিছু সেলফি দেখলাম । একচ্যুয়েলী কি হয়েছিল বলুনতো ।"
আমি কিছুই মনে করতে পারছি না । মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা । আমি খুব চেষ্টা করলাম কিন্তু না কিছুই মনে পড়ছে না । মিস্টার বসু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলেন । আমাকে বিশ্রাম নিতে বলে উনি বিদায় নিলেন । জায়গাটি হাসপাতালই বটে । আমি বেল টিপে সিস্টারকে ডাকলাম । একটা পেন কিলার নিতে হবে। একটা মিজো নার্স কেবিনে আসতেই একটা পেন কিলার চাইলাম । অল্প পরে নার্স মেয়েটি একটা টেবলেট এনে দিলে আমি ঔষধ খেয়ে পিছন ফিরে শুয়ে পড়লাম । নার্স মেয়েটি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার ছলে স্পর্শ করা মাত্রই এক নিমেষে আমার গতকালের সমস্ত কিছু মনে পড়ে গেল । সেই ভয়ংকর ঠান্ডা নরম হাত । এ হাত আমার খুব পরিচিত ।আমি চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার মাথায় পাশে মিসেস পুই দাঁড়িয়ে । আমি নতুন করে সেই উগ্র পারফিউমের গন্ধ পেলাম ।
Comments
Post a Comment