গল্প
*****
সুপ্রদীপ দত্তরায়
****************


হাতের বিড়িটাতে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল মহেশ পাশের ঝোপটায় ।কথায় বলে "বিড়ির সুখটান", হয়তো তাই । আসলে সুখ শান্তি কিছু নয়, একটা তৃপ্তি । যার মনে শান্তি অঢেল তারজন্য সুখ কথাটা হয়তো সত্যি, মহেশ বিড়ি খায় স্রেফ নেশার টানে । সুখ-টুক তেমন কিছু বুঝতে পারে না । বিড়ি খায়, না খেলে চলে না তাই । মাঝে মাঝে বিড়ি না খেলে মাথাটা ধরে আসে মহেশের । তখন গলাটা শুকিয়ে যায় । একসময়ে যখন ট্রেনে ট্রেনে ব‌ই বিক্রি করতো তখন দুটো পয়সা হাতে এলে সিগারেট খেয়েছে কখনো কখনো । তবে চুরুট খায়নি কখনো । এখন সেইসব দিন স্বপ্নের মতো । লকডাউনে সব শেষ । হাতে যা পুঁজি ছিল সেটাও শেষ । শুধু পেটের ক্ষিধেটা দিন দিন বাড়ছে । 

      আজকাল আর সিগারেট খায় না । কেউ দিলেও না । ভয়, চরিত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে ।হাতের বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মহেশ । কিছু একটা উপায় করতে হবে । আজ তিনদিন একটাকা রোজগার নেই । সকাল বেলা হাত পেতে চেয়ে নিয়েছে একটা টাকা পার্বতীর কাছ থেকে । পার্বতীর কাছে টাকা চাইতে বরাবরই অস্বস্তি মহেশের । ‌‌ বিশেষ করে গতরাতের ঘটনাটার পর ‌। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল । বেচারী এমনিতেই প্রায় একার চেষ্টায় সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই বড় ছেলে মধুটা হয়েছে গলার কাঁটা । সঙ্গ দোষে যা হয় । মহেশ একটু আধটু চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বৃথা । শুধু একটা ছেলের জন্য সংসারে টালমাটাল অবস্থা । সকাল বেলা কাপড়ের খোঁট থেকে একটা টাকা দেবার সময় পার্বতী যে ভাবে তাকিয়ে ছিল তারপর আর কোন কথার প্রয়োজন হয় না । নেহাত বিড়ির জন্যে টাকা তাই হাত পেতে নিয়েছে। ভাতের থালা হলে কখন ছুঁঁড়ে ফেলে দিত । বিড়ি ছাড়া যে চলে না । 

ইচ্ছা নদীর পাড়ে ঢেঁকিশাকের ঝোঁপ । অযত্নে অবহেলাতেও বেশ নাদুসনুদুস । দেখে বোঝার উপায় নেই, সব আগাছার দল । স্কুলের মাস্টার বলতেন, চেহারা দেখে মানুষ চেনা যায় । মহেশ অজান্তেই একটু হাসে । ভুল, যা শিখেছে সবটাই ভুল । মানুষ চেনা কি চারটিখানি কথা । মানুষের মনটা গিরগিটির মতো । কখন যে কোথায় মজে যায় বোঝা দায় । 

      আজকাল পার্বতীকে আর বিশ্বাস করতে পারে না মহেশ । শুধু ঠিকে কাজ করে কি করে এতবড় সংসার টানছে ঈশ্বর জানেন ! ইদানিং নিজের জন্যে আলাদা বিছানা করেছে । কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দেয় না । বলে, দু'টাকার মুরোদ নেই সখ ষোল আনা । ছেলে মেয়েগুলো বড় হচ্ছে, বেশি কথা বলা যায় না । কিন্তু না, এখন মহেশকে পার্বতীর কথা ভাবলে চলবে না। তাকে ইচ্ছা নদীর পাড় থেকে কিছু ঢেঁকিশাক তুলে বিকেলের হাটে বসতে হবে । যদি বড়াতজোরে দুই একজন পাইকার এসে যায় তাহলে মেরে কেটে এককুড়ি টাকা পেতেও পারে । তবে সব হাটে আজকাল পাইকাররা আসে না । লকডাউনে সবার হাত‌ই শুকিয়ে গেছে । যদি আসে কপাল খুললো, ন‌ইলে বৃথা পরিশ্রম । গ্রামের লোক ঢেঁকিশাক কিনে খেতে চায় না । কিনবে কেন ? এমনিতেই পাওয়া যায় । মাগনা দিতে গেলে বলবে, তুমি বরং আমার বাড়িতে এসো, নিয়ে যেও খানিকটা । সেই ফাঁকে বাড়িটা যদি সাফ হয় । মহেশের তেমন তেমন জমিই নেই, আবার ঢেঁকি আর পুঁই । তবে সবটা বৃথা যাবে না । বাড়িতে সেটাই সেদ্ধ করে খাওয়া যেতে পারে । প্রথম প্রথম পার্বতী খুব আপত্তি করতো । সে অনেক দিন আগের কথা, তখনও গণশার জন্ম হয়নি । পার্বতি বলেছিল, সধবা মেয়েছেলেদের শুধু শাক খাওয়া বারণ, সোয়ামীর অকল্যাণ হয় । 

মহেশ সেই রাতে হেসেছিল খুব । বলেছিল, আমরা কি আর বেঁচে আছি রে পাগলি, যে সধবা আর বিধবা বলছিস ? 

পার্বতী ফোঁস করে উঠেছিল । লক্ষ্মী ঠাকুরণের সামনে বসে কি সব অলুক্ষুণে কথা ! মুখে কোন কথা আটকায় না । তিনবার মঙ্গলচণ্ডীর উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠুকে বলেছিল, মাগো মঙ্গলচণ্ডী, এই কপালপোড়াটার কথায় কান দিও না তুমি । সবাইকে দুধে ভাতে রেখোগো মা।
মহেশ আবারও হেসেছিল খুব ।
পার্বতী প্রথমে একচিমটি সাদা ভাত দাঁতে কেটে বাকিটা শাক দিয়েই খেয়েছিল সেই রাত্রে । সেই প্রথম । তারপর অনেক রাত্রি কেটে গেছে ‌। ‌ ইদানিং অভাবে অনেকটাই পালিশ হয়ে গেছে সে । আজকাল যেদিন সবাইকে ভাগ করে দিয়ে ভাত জোটে না কপালে সেদিন শুধু ঢেঁকি সেদ্ধ খেয়েই রাত কাটায় পার্বতী । মহেশ বুঝতে পারে সব, তবু বুঝতে দেয় না । মাথায় কড়কড়ে রোদ নিয়ে মহেশ চললে সোজা ইচ্ছা নদীর পাড়ে । 

ঘড়িতে তখন ক'টা বাজে, দশটা । পার্বতীর হাতে এন্তার কাজ । সবে দু'টো বাড়ি শেষ হয়েছে । এখনো তিনটে বাকি । তারপর নিজের বাড়িতে কাজ । কলতলায় বাসন ধুতে ধুতে হাতের উলটো পিঠে কপালের ঘামটুকু মুছে নিল পার্বতী । সবটাই অদৃষ্ট । পার্বতী নিজের ভাগ্যের জন্যে কাউকে দোষারোপ করে না । বাপ মা দেখেশুনে তাদের পছন্দের ছেলের সাথে পার্বতীর বিয়ে ঠিক করেছিলেন । ছেলে স্কুল মাস্টার, ঘরে সারা বছর চাল থাকে, তবে দোজবর । তা হলোইবা দোজবর, পুরুষ মানুষের আবার সতীত্ব কি ! ভাত কাপড় দিতে পারলে যথেষ্ট । পার্বতীকেও তাই বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু পার্বতীর পছন্দ মহেশ ।
বাপ ক্ষেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, চাল নেই চুলো নেই কি আছে এই ছেলেতে ?
পার্বতী তার মায়ের কানে কানে চুপিচুপি বলেছিল, ওর গানের গলাটা ভারী সুন্দর ।
বাপ রেগে আগুন । বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, যাত্রা পালা করে এই ছেলে মোটেই মেয়ের পাত্র হতে পারে না । 

কিন্তু এই ছেলেই মেয়ের পাত্র হলো । বিয়ের ঠিক কয়েকদিন আগে পার্বতী পালালো মহেশের সাথে । 

একটুখানি অন্যমনস্ক হয়েছিল পার্বতী । বৌদিদির গলার আওয়াজে চমক ভাঙ্গলো তার।
-- দেখ্ না পার্বতী, তোর দাদা এখন এতগুলো মাছ নিয়ে এসেছে । এখন কে কাটবে বল ? তুই একটু সময় করে করে কেটে দিয়ে যাস লক্ষ্মীটি।
পার্বতী মুখের উপর না বলতে পারে না । এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, এবার মাছ কাটাতে বসলে হয়েছে । বাকি বাড়িগুলোর গিন্নিদের গাল ফুলে লাল হয়ে যাবে। আজ বিকেলে একবার থানাতেও যেতে হবে । পার্বতী অসহায় দৃষ্টিতে বৌদিদির দিকে তাকালো একবার । তারপর নিঃশব্দে ঘাড় কাত করে বললে, ঠিক আছে । 

মুহুর্তে বৌদিদির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল । খুশি মনেই ফিরে যাচ্ছিলেন, পার্বতী পেছন থেকে ডাকলে, বৌদিদি --
-- কিছু বলবি ?
-- বলছিলাম, দুশো টাকা দাও নাগো । সারদার মাস্টারের বেতন আর কিছু ব‌ই কিনতে হবে ।
-- দুশো ?
-- হ্যাঁগো দাও না প্লিজ ।
-- ওহ, ঘুরিয়ে মাছ কাটার টাকাটা তুলে নিচ্ছিস?
-- না গো বেতন থেকে কেটে নিও, খুব দরকার ।
-- একশো টাকা নে -- ।
-- না না, আমার দু'শোই চাই, প্লিজ ।
-- এমাসের বেতন থেকে কেটে নেব কিন্তু ।
-- এমনটা করো না বৌদিদি । চার মাসে পঞ্চাশ টাকা করে কেটে নিও । রাগ করোনা লক্ষ্মীটি ।
-- ঠিক আছে, যাবার সময় নিয়ে যাস ।
তারপর একটু থেমে বললে, ভালো কথা, তোর ছেলের কি হয়েছে রে ?
-- কি আর হবে ? পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেছে ।
-- সেকি কেন ?
-- কেন আবার ? আবার শুরু হয়েছিল, আমিই তুলে দিয়েছি দারোগাবাবুর হাতে ।
-- ওঃ বাবা, এত কান্ড, আমাকে তো বললি না কিছু ।
-- থাক বৌদিদি অন্য একদিন হবে ক্ষণ । আজ বড় তাড়া আছে ।
টাকা পাওয়ায় পার্বতীর কাজে আলাদা শক্তি ফিরে এসেছিল, কিন্তু ছেলেটার প্রসঙ্গ আসতেই মনটা দমে গেল । এতক্ষণে হয়তো কোর্টে চালান হয়ে গেছে মধু । 

গতকাল থেকেই এই টাকা ক'টার জন্য ভাবনা হচ্ছিল । সারদার মাস্টারের বেতন দুই মাস বাকি । একমাস দিয়ে দিলে হাতে আরো কিছুটা সময় পাওয়া যাবে । পাড়ার মুদির দোকানেও অনেক বাকি জমে আছে । ওখানেও কিছু টাকা দিতে হবে । পার্বতী ব্যবস্থা রেখেছিল কিন্তু ঘরের শত্রু বিভীষণ । কখন যে ছেলেটা লুকিয়ে টাকা সরিয়ে নেয় পার্বতী টেরও পায়না । ঘরের এমন কোন জায়গা নেই যেখান ছেলেটার হাত পৌঁছোয় না । পার্বতী অনেক চেষ্টা করে দেখেছে, লাভ হয়নি । আসলে ওর সঙ্গী ছেলেগুলো মোটেই ভালো না । কি সব পাউডার নেয়, নেশা ভাঙ করে সব কিছু পার্বতী ভালো বুঝতে পারে না । তবে ছেলেটা ওই সময়ে কেমন একটা অমানুষ হয়ে যায় । হাতের কাছে সময়মতো টাকা না পেলে বাড়িতে উপদ্রব করে। দা নিয়ে কাটতে আসে । পার্বতীর ভীষণ ভয় হয় তখন । আজকাল ইচ্ছে করেই অল্প টাকা চোখের সামনে রেখে দেয় । উপায় নেই, অন্তত বাড়িতে শান্তি থাক । 

পূজো এসে গেছে । কিছুটা থোক টাকা নগদে প্রত্যেক ঘর থেকেই দেয় । প্রত্যেক ঘর বলতে যে সব ঘরে রোজ রোজ গতর খাটে পার্বতী । নির্দিষ্ট কিছু না, তবে মন্দ নয় । পুরো টাকাটাই বাড়তি পাওনা । মাসান্তে কিস্তিতে কাটা নয় । অবশ্য তার বদলে কায়দা করে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নিতে ছাড়ে না কেউ । কড়কড়ে টাকা বলে কথা । কেউ কেউ আবার ঠিক পূজোর আগেই কাজ ছাড়িয়ে দেয় নানা বাহানায় । ওই বাড়তি ক'টা টাকা দিতে হবে যে । পার্বতীর অবশ্য তেমন কোন ঘর নেই । মোটামুটি সব ক'জন মালিক‌ই ভালো । একটু আধটু মুখ ঝামটা, সেতো খেতেই হবে । কপালে লেখা নিয়ে জন্মেছে । ওই টাকাটা পেলে একটা শার্ট কিনবে মধুর জন্য। ছেলেটাকে এককাপড়ে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ । 

পাঁচ বাড়িতে পার্বতীর রোজগার কম নয় । টেনে হ্যাঁছরে চলে যাওয়ার কথা । বড় মেয়ে চপলাও টুকটাক রোজগার করে । আগে একটা ব্লাউজের ফেক্টরীতে কাজ করতো, তখন কামাই ভালো ছিল, কিন্তু মালিকটার নজর ভালো ছিল না । এখন ঘরেই মেশিনে সেলাই করে । কয়েকটা দোকান বাঁধা আছে, কাপড় ওরাই দেয় । ব্লাউজ প্রতি একটা নির্দিষ্ট টাকা । ডিজাইন আর সেলাই বুঝে পয়সা । 

পার্বতীর সংসার মা ষষ্ঠীর কৃপায় ভরা ভাদর । তিন ছেলে, দুই মেয়ে । বড় মেয়ে চপলা, ছোটটি সারদা । সারদা এবার ক্লাস নাইনে । পড়াশোনায় ভালো, বাপের গানের গলাটিও পেয়েছে বেশ । দিদিমণিরা স্নেহ করেন খুব । আর ওই জন্যেই দুই একমাস বেতন বাকি থাকলেও মুখে কিছু বলেন না তারা । তাই বলে পার্বতী কারো টাকা মেরে দিতে পারে না । মেয়ের একটা সম্মান আছে ! কাউকে অনুযোগ করার সুযোগ দিতে চায় না পার্বতী । 

মেয়েদের নিয়ে পার্বতীর মাথা ব্যথা তেমন নেই । চপলার চোখ পড়েছে ব্লাউজের দোকানে কাজ করা একটা ছোকরার উপর । পার্বতী পরষ্পর খবর পায় সব । মুখে কিছু বলে না । বাপ চেয়েছিল মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিতে, পার্বতী দিতে দেয়নি । সবে আঠারো হয়েছে, এখন কিসের বিয়ে । আগে নিজের পায়ে দাঁড়াক, তারপর বিয়ে । নিজের জীবন দিয়ে অনেক কিছু শিখেছে পার্বতী । আবারও ভুল করতে চায় না সে । ছেলে তিনটের মধ্যে ছোটটিও ভালোই । সবসময়ে পার্বতীর ন্যাওটা । সুযোগ পেলেই ছুট্টে কোলে এসে বসে । এখন যে সে বড় হচ্ছে সেই বোধ‌ই নেই । মধ্যম ছেলেটাও সখ করে নাম রেখেছিল বিশাখ । কার্তিকের মতো দেখতে সুন্দর । তবে ইদানিং স্কুলে যায় না । বন্ধুদের সাথে থেকে কি সব কসরত করে । সকালে উঠে দৌড়ায়, তারপর জিম না জিন - কি যেন একটা মাথায় চেপেছে । ছেলে নাকি ফৌজে যাবে । ওই নিয়েই মেতে আছে সারাদিন । পার্বতী টিভিতে দেখেছে । একরকম পোষাকে ফৌজিদের দেখতে ভারি ভালো লাগে তার । তবে বুকে একটা ভয় সবসময় । আজকাল দিনকাল ঠিক না, সবসময়ই যুদ্ধ লেগে আছে, ছেলেটা বেঁচে থাকবে তো ! 

পার্বতীর সমস্ত দুশ্চিন্তা বড়ছেলেটাকে ঘিরে । ওর সঙ্গীগুলো ভালো না । পড়াশোনায় একসময়ে মন্দ ছিল না । কি করে যে কুসঙ্গে জড়িয়ে গেল পার্বতী বুঝতে পারেনি । যেদিন পুলিশ এসে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন প্রথম জানতে পারে সব । অনেক হাতে পায়ে ধরে ছাড়িয়ে এনেছিল ছেলেকে, কিন্তু সঙ্গ ছাড়াতে পারেনি । বাড়িতেও আজকাল উপদ্রব করে । বাপটা সারাদিন ঘুরে বেড়ায় বনে বাঁদাড়ে । ছেলে এদিকে ঘরের জিনিস বেঁচে পাউডার খায় । কত বুঝিয়েছে মধুকে, কিছুতেই কিছু হবার নয় । 

গত মাসেই দশ বারো তারিখ হবে, মেয়ের অনলাইন ক্লাসের জন্য মোবাইল কিনে দিয়েছিল, সকাল থেকে সেই মোবাইল পাওয়া যাচ্ছে না । কথাটা শুনেই মাথা গরম হয়ে গেল পার্বতীর । আবার কম করেও হাজার দুয়েকের ধাক্কা । এর কমে পুরনো ভালো মোবাইল পাওয়া যায় না । সহ্যের‌ও একটা সীমা থাকা উচিত । সারাদিনের এতটা পরিশ্রমের পর কার এসব হাঙ্গামা রোজরোজ ভালো লাগে । পার্বতী তখন রান্নার জন্য সব্জি কাটছিল । হাতের সেই দা-টি তক্ষুনি তুলে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল রাস্তায় । যেখানে যেখানে মধুর আড্ডা, এক এক করে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ছিল সব ক'টা ডেরা, পায়নি । মধু ততক্ষণে হাওয়া । কেউ বা কারা খবর দিয়েছে হয়তো । ভয়ে দুদিন বাড়ি ফেরেনি। কোথায় ছিল, কি খেয়েছে কিছুই জানে না পার্বতী । তিনদিনের মাথায় মহেশ ধরে এনেছিল ছেলেকে । মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে । মায়ের মন, পাষাণ হয়না সহজে । একথালা ভাত বেড়ে দিয়েছিল ছেলেকে । তারপর কিছু দিন শান্ত ছিল । শান্ত বলতে বড় ধরনের কোনো ঘটনা নেই । অল্পস্বল্প টাকা সরাত সবটাই নীরবে । পার্বতী বুঝতো সব‌ই, মুখে কিছু বলতো না । 

গতকাল আবার নতুন করে উপদ্রব শুরু । 
পার্বতী সবে কাজ থেকে ফিরে গা ধুয়ে ঘরে রান্না চাপিয়েছে । তখনি সারদা কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে এসে হাজির । খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সারদা টিউশনে যাচ্ছিল, সাথে মায়ের দেওয়া মাস্টারের এক মাসের বেতন। মহেশ দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায় সুযোগের অপেক্ষায় । কি করে যেন সে জানতে পারে আজ সারদা মাস্টারকে বেতন জমা দেবে ! আর সে সেই সুযোগটাই নেয় । প্রথমে টাকা ধার চায়, সারদা টাকা দিতে অস্বীকার করলে জোর করে ব্যাগ থেকে কেড়ে নিয়ে যায় সবক'টা টাকা । কাড়াকাড়িতে মেয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ে রক্তারক্তি কান্ড । মুখে এক ফোঁটা জল না দিয়েই পার্বতী সোজা চলে গেল থানায় । একটা নালিশ ঠুকলো ছেলের বিরুদ্ধে । একটা হেনস্থা হ‌ওয়া দরকার । দারোগাবাবু সব শুনলেন, লিখে রাখলেন খাতায়, বললেন, দেখছি । 

রাতে সবে মধু খেতে বসেছে, তখনই পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল তাকে । বেচারা সবে প্রথম গ্রাস ভাত মুখে দিয়েছিল । ছেলেটা ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল পার্বতীর দিকে। যদি মা চেষ্টা করে একবার । পার্বতীর বুকে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তখন, কিন্তু নিরুপায় । এভাবে রোজ চলতে পারে না । দারোগা সাহেব বলেলেন ওকে কি একটা হোমে পাঠিয়ে দেবেন । ওখানে নাকি বাচ্চা ছেলেদের চিকিৎসা হয় । দারোগা সাহেব এও বললেন, ওখানে থাকলে আর পাউডার খাবে না ছেলে । ঈশ্বর জানেন ! ভালো হোক মন্দ হোক ছেলেতো ছেলেই হয় । দশমাস দশদিন পেটে ধরেছে তাকে । নিজের রক্ত মাংস দিয়ে গড়া । গলা টিপে তো মেরে ফেলা যায় না ।ওকে ওর ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে পার্বতী । ওর জন্যেই আজ আবার টাকা ধার করতে হলো । বিকেলে একবার থানায় যেতে হবে তাকে । কি জানি ছেলেটা এখন কি করছে কে জানে । 

বাড়ি ফেরার পথেই সাবিত্রীর সাথে পার্বতীর দেখা। সাবিত্রী নিজেও বাড়ি বাড়ি ঠিকা কাজ করে । হাত পা ছাড়া সংসার ‌। পার্বতীদের ঠিক পাশের বাড়িটাই ঘর । সময়ে অসময়ে এসে পার্বতীর কাজেও হাত লাগায় । আজ দেখা হতেই বললে, কি গো তোর শিবঠাকুর কোথায়? বাড়ি ফিরেছে ?
-- জানি না । পার্বতী তখন সবে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল । সে কি করে জানবে মহেশ বাড়ি আছে কিনা । তবে সাধারণত এই সময়ে মহেশ কোনদিনই বাড়ি থাকে না । বললে, কেন? কোন কাজ ছিল ?
-- এবার পূজোয় পালাগান হচ্ছে কি ? তুই কিছু জানিস ?
পার্বতী মাথা নেড়ে বললে, না ।
-- শুনেছি মন্ডপে নাকি দূর্গার কাঠামোতে কাজ শুরু হয়ে গেছে । একবার দেখে আসতাম ।
-- তাই ? বেশ জিজ্ঞেস করবো । পার্বতী কথা আর দীর্ঘ করলে না ।
-- কেন তুই যাবি না ?
পার্বতী কোন উত্তর দিলে না । ‌‌মনে মনে বললে, আমার ঘরের কাঠামো কে দেখে তার নেই ঠিক। আবার দল বেঁধে কাঠামো দেখতে যাওয়া ।


ভর দুপুরে শেষ ভাদ্রের সূর্যের তেজ তখন সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে । পার্বতীর মন পড়ে আছে থানায় । সকাল থেকে ছেলেটাকে কিছু খেতে দিয়েছে কিনা কে জানে । মহেশ তখনও ইচ্ছা নদীর পাড়ে ঢেঁকিশাক তুলতে ব্যস্ত । সময় এগিয়ে চলে নিজের গতিতে, ফিরেও তাকায় না। 

*****************************************

Comments