গন্তব্য


আকাশের রঙটা গাঢ় লাল, সিঁদুর মাখা, আমার মনের রঙ বয়েসের ভারে ধূসর বর্ণ । জীবনের সমস্ত রঙ, স্বপ্ন রোদে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বর্ণহীন । গিয়েছিলাম আমার‌ই এক খুব নিকটাত্মীয়ের বাড়ি । পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরছি, তখনই নজরে এলো আকাশটা । দিনের শেষবেলায়‌ও কী আশ্চর্য রকমের লাল, সতেজ । আর তার‌ই ছোঁয়া লেগেছে গোটা আকাশটায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য টুকরো টুকরো মেঘে । আমি দেখছিলাম আর ধীর পায়ে ফিরছিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে ।
আমার আত্মীয়ের বাড়ি প্রান্তিক শহরের একটা গলির শেষ প্রান্তে । বাড়ি থেকে সদর রাস্তা অনেকটা পথ । যদিও অনায়াসে গাড়ীতে আসা যাওয়া করতে পারে, আমি পায়ে হেঁটেই সদর রাস্তার দিকে এগুচ্ছি । দূরে দু'টো বাচ্চা মেয়ে উল্টো দিক থেকে আমার‌ই দিকে আসছিল । দূর থেকে দেখছিলাম, একটা মেয়ে অন্য মেয়েটিকে কী যেন বললে, আর সাথে সাথেই দু'টো মেয়েই হেসে লুটোপুটি । রাস্তায় লোক নেই বললেই চলে, ফাঁকা । দুপাশের বাড়িগুলো দুপুরের ভাতঘুম সেরে সবে আড়মোড়া ভাঙ্গতে ব্যস্ত । আকাশ থেকে নজর নেমে এলো মাটিতে । আমি বাচ্চা মেয়ে দু'টোর আনন্দ উপভোগ করছিলাম । একটা সময়ে আমরাও এই বয়েসটা পেরিয়ে এসেছি ।কত হতে পারে বয়েস, তেরো বড় জোর চোদ্দ । আমি তখন স্কুলে পড়ি । রোজ বিকেলে বন্ধুরা মিলে মাঠে খেলতাম, আম চুরি, কাঁঠাল চুরি করে খাওয়া । জীবনের জটিলতা সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই, দিব্যি কাটছিল দিনগুলো । কত হাসি ঠাট্টা আমোদ আনন্দ অবহেলায় অপচয় করেছি । এখন তার‌ই ছিঁটেফোঁটার জন্যে হাপিত্যেশ করি ।
ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চলেছি । মেয়ে দু'টো তখন‌ও এক‌ই ভাবে মিমিক্রী করে হাঁটছে আর খুব হাসছে । আমি কাছে আসতেই বললে, আংকুল তুমি কিলা হাঁটো জানোনি, ওউ অলা অলা । বলেই মেয়েটি আবারো আমার হাঁটার মিমিক্রী করে দেখালো ।
এতক্ষণে বোঝা গেল মেয়ে দু'টো এত সময় আমাকেই মিমিক্রী করছিল । আমি প্রত্যুত্তরে হালকা হাসলাম । উপায় নেই । কিন্তু মুহূর্তে বিষয়টা অনুধাবন করা মাত্রই, আমি যতটা সম্ভব সচেতনভাবে হাঁটার চেষ্টা নিলাম । ফলে যা হবার, এই সচেতনভাবে হাঁটতে গিয়ে ফল হলো বিপরীত । নিজেই বুঝতে পারছি অতিরিক্ত সচেতনতায় আমার পা ঠিকঠাক পড়ছে না । আমার হাঁটা যতটা না হাস্যকর ছিল, এখন সেটাই দ্বিগুণ হাস্যকর হয়ে গেছে । কিছুতেই ঠিকঠাক পা ফেলতে পারছি না । কলেজ জীবন ছাড়ার পর এই প্রথম রেগিং । পায়ে গতি বাড়িয়ে দিলাম, যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই মঙ্গল । খুব অস্বস্তি লাগছিল । অথচ আমার প্রতিপক্ষ দু'টো পুঁচকে মেয়ে । 
ঠিক যখন ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন আগের সেই মেয়েটি আমাকেই সরাসরি বললে, আংকুল, তুমারে আমার বড় পসন্দ হ‌ইছে, আমি তুমারে বিয়া করতাম । বলেই আবার দুই বন্ধু খুব হাসতে লাগলো ।
আমি খুবই অপ্রস্তুত । কী বলে মেয়ে ! আমার ছোটর ছোট তস্য ছোট" , সে কিনা আমাকে বিয়ে করতে চায় ? কী দুঃসাহস ! হয়তো ঠাট্টা করেই বলছে, কিন্তু এ কী ধরনের ঠাট্টা । জানা নেই শোনা নেই, আগে কখনো দেখেছি তেমন‌ও মনে পড়ছে না । এই বয়সে বিয়ের ওরা কী বোঝে ? জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণাই নেই, থাকার কথাও না । তবু এই পুঁচকে মেয়েটার কথাগুলো কানে গরম সীসার মতো প্রবেশ করলো । আমি হাসবো, কাঁদবো, রাগ করবো নাকি উপভোগ করবো - কোন কিছুই মাথায় কাজ করছে না । এক নিমিষে চারপাশটা একবার দেখে নিলাম । কেউ শুনতে পেলে হাসির খোরাক হয়ে যাবো । মুহূর্তে স্থির করলাম, আমি থামবো না, পেছন ফিরে তাকাবো না । তাকালেই ওরা আরও পেয়ে বসবে । এই অবান্তর কথাগুলোর উত্তর দিতে গেলে, সমস্যা আরো ঘোলাটে হতে পারে ।
আমি তাই না শোনার ভান করে সবে সামনের দিকে পা ফেলেছি, ঠিক তখনই সাথের মেয়েটি চিৎকার করে আমাকে ডাকতে লাগলো, আংকুল, আংকুল, হুনো, তাই তুমারে কিতা কয় ।
প্রথম ডাকে উত্তর দিলাম না । কিন্তু যখন মেয়েটি বারবার পেছন থেকে ডাকতে শুরু করলে, তখন আমি নিরুপায়, থামতে বাধ্য ।
পিছন ফিরে তাকাতেই, সঙ্গের মেয়েটি বললে, তাই তুমারে বিয়া করত কয় ।
কথাগুলো বলেই পাশের একটি বাড়ির গেটের ভিতর ঢুকে গেল ।
আমি স্তম্ভিত । কী চায় মেয়েটি ? মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে রইলাম এক‌ই জায়গায় । তারপর মুচকি হেসে সবটাই আমার কপালের লিখন মেনে নিয়ে, আমি অজান্তেই আমার অদৃষ্ট গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম ।

Comments