- Get link
- X
- Other Apps
চায়ের কাপটা হাতে তুলে দিয়ে মনোরমা দেবী বললেন, রাজা ফোন করেছিল ---।
রাজা মনোরমা দেবী আর অমরেশবাবুর একমাত্র সন্তান । দীর্ঘদিন চাকরীর সুবাদে বাইরে আছে । বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ টেলিফোনে আর বছরে একবার । তাও সব বছর সম্ভব হয়ে ওঠে না । ছেলে বিবাহিত । একমাত্র নাতি অর্ক ক্লাস সিক্সে পড়ে ।
মনোরমা দেবীর কথা শুনে অমরেশবাবু একবার তাকালেন, তারপর নির্লিপ্ত গলায় বললেন, কেন ?
-- ওদের এখানকার অফিসে নাকি ইদানিং জায়গা খালি হয়েছে । রাজা বলছিল, ও নাকি চাইলে, এখানকার অফিসে আসতে পারবে । তোমার কী ইচ্ছে জানতে চাইছে ।
-- আমার আবার কী ইচ্ছে ? অমরেশবাবু পত্রিকাতে মুখ গুঁজে থেকেই বললেন ।
-- আহা পত্রিকাটা মুখের সামনে থেকে সরাও দেখি ।
ভালো করে কথাই বলা যায় না । তারপর একটু থেমে বললেন, তুমি কি চাও, আসা উচিত কি না ?
অমরেশবাবু পত্রিকাটি ভাজ করে পাশে রাখতে রাখতে বললেন, দুনিয়ার কিছুই তো খবর রাখো না । রাস্ট্রীয় ইস্পাত নিগম বিক্রী হয়ে যাচ্ছে ।
-- কী বিক্রী হয়ে যাচ্ছে ?
-- আহা, রাস্ট্রীয় ইস্পাত নিগম । আমাদের নবরত্নের একটি ।
-- কারা বিক্রী করে দিচ্ছে ?
-- কারা আবার ? তোমার আমারই লোক ।
-- ওই শুরু হয়ে গেল তোমার । আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নিয়ে পড়েছো । রাখো তোমার ওই সব কথা । যা হচ্ছে, আমাদের ভালোর জন্যেই হচ্ছে। তোমাকে যা জিজ্ঞেস করছি, তার ঠিকঠাক উত্তর দাও ।
অমরেশবাবু একটু মুচকি হাসলেন । বললেন, তোমাদের মতো লোকেরা আছে বলেই এই সরকারটা টিকে গেল ।
-- ভালো, খুব ভালো । তোমাকে ওই নিয়ে ভাবতে হবে না । তুমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও ।
-- কী ?
-- ছেলেকে এখানেই বদলি নিতে বলে দিই ?
অমরেশবাবু চায়ের কাপে আয়েশ করে একটা চুমুক দিতে দিতে মনোরমা দেবীর দিকে তাকালেন । ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় বয়েস অনেকটাই । আগের সেই টানটান ছিপছিপে শরীর আর নেই, অনেকটাই ভারী হয়ে এসেছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো বারবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে । এই যে সকালের স্নান সেরে পূজো পাঠ শেষ । এখন চা নিয়ে এসে পাশে বসেছেন । পড়নে আটপৌঢ়ে শাড়ী, চুলের কোণায় বিন্দু বিন্দু জলের ফোটা, অপূর্ব ! দীর্ঘ দিনের ঝড় ঝাপটার পরও গায়ে ধূলো লাগতে দেননি । এখনো সতেজ, প্রাণবন্ত আর অবশ্যই মনের দিক থেকে পবিত্র ।অমরেশবাবুর মনে অনেক কথার ভীড় । স্মৃতি থেকে টুকরো টুকরো কথা তার ভাবনাকে সাজিয়ে দিচ্ছে ।একটু সময় নীরব থেকে ধীর শান্ত গলায় বললেন, আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলবো, না ।
-- কেন ? মনোরমা দেবী চমকে উঠলেন ।
-- এখানে এসে ওরা এডজাস্ট করতে পারবে না ।
-- তোমার মাথাটা গেছে একদমই । আমাদের ছেলে আমাদের সাথে এডজাস্ট করতে পারবে না ? এতদিনে তাহলে এই চিনলে ছেলেকে ? ছিঃ, তুমি না দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছো !
-- বললাম তো, আমার যা মত, বলে দিয়েছি। বাকিটা তোমাদের মর্জি ।
-- জানি না ওসব কথা, আমি ওদের বলে দিয়েছি তোর বাবা বলেছেন এখানেই বদলি নিতে ।
তারপর একটু থেমে আবার বললেন, আমার কতদিনের ইচ্ছে, ছেলে, বৌ, নাতি নিয়ে ঘর ভর্তি সংসার করবো । নিজে কোন কিছুতেই মাথা ঘামাবো না, ওদের হাতে সব সমঝে দিয়ে আমি এবারে বিশ্রাম নেব ভাবছি। আমারো তো শরীরে বিশ্রাম চায়, নয় কী ?
অমরেশবাবু অল্প হেসে বললেন, তাহলে আর কী ? সুপ্রিম কোর্ট থেকে রায় বেরিয়ে গেছে, এখন আমার সাথে আলোচনা করে কী লাভ ? যা ভালো মনে করেছো, তাই করো । এই নিয়ে আর ভেবো না ।
তার পর প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, কিন্তু রাস্ট্রীয় ইস্পাত নিগমের মতো সংস্থা যদি ব্যাক্তি মালিকানায় চলে যায়, তাহলে আগামীতে আমাদের সত্যি সমূহ বিপদ ।
মনোরমা দেবী চেয়েছিলেন, ছেলে আসার খুশিতে একটু প্ল্যানিং করবেন, কিন্তু এই লোকটা সত্যিই বেরসিক । সংসারের কোন কিছুতেই মাথা ঘামাতে চান না । তবে একদিকে ভালোই, অশান্তি নেই । মনোরমা দেবী সেই শুরু থেকেই নিজের মতো করে সাজিয়েছেন সংসার । কোথাও বাঁধা পেতে হয়নি তাকে । কিন্তু ওই যা, কোন পরামর্শ চলে না ।
মনোরমা দেবীর ভেতরে ভীষণ তাড়া, এক্ষুনি ছেলেকে ফোন করে বলতে হবে । যত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ততই মঙ্গল । চায়ের খালি কাপটা তুলে নিয়ে মনোরমা দেবী চলে গেলেন রান্না ঘরে । অমরেশবাবু ওখানে বসেই হাতে পত্রিকা নিয়ে ভাবতে লাগলেন, এই দেশটার ভবিষ্যত কী হতে পারে । একটা একটা করে সব রাস্ট্রায়ত্ব সংস্থা যদি ব্যক্তি মালিকানায় চলে যায় তবে দেশটা চলবে কী করে ? লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ কি ? তারা কোথায় এসে দাঁড়াবে ?
বাড়িতে এখন সাজসাজ রব । মনোরমা দেবী অমরেশবাবুকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত । ছেলে, তার ছেলে, সাথে বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে । প্রায় একত্রিশ বছর পর । মাঝে এত গুলো বছর তো হোটেলে থাকার মতো । বছরে একবার সপরিবারে, কখনো বা একা আবার কখনো বা দুবছরে একবার বাড়িতে এসেছে । দুই রাত্রি কাটিয়ে, শরীরটা ভালো করে বিছানায় লাগলো কী লাগলো না, ফিরে গেছে নিজের জায়গায় । এই এতদিন পর আসছে থাকতে । মনোরমা দেবীর মনে অনেক স্বপ্ন । এবার সংসার পুরোটাই বৌমার কাঁধে তুলে দিতে চান । সংসারের চাবি নিজের কাছে আগলে রেখে খবরদারি করা উনার একদমই পছন্দ না ।
নিজেদের এতদিনের ব্যবহার করা ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে ছেলের জন্যে, সাথে অমরেশবাবুর বিয়েতে পাওয়া মেহগনী কাঠের পালংক । এই শয্যাতেই প্রথম সোহাগ রাত হয়েছিল । মনোরমা দেবীর বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে ছিলেন, খুব সৌখিন লোক ছিলেন তিনি । আলমারীটি অবশ্য অমরেশবাবুর বাবার আমলে তৈরি । অমরেশবাবুর জন্মের দু'বছর আগে । মায়ের আঁচলে এই আলমারীটির চাবি ঝুলতো সবসময় । মা বলতেন, সেই ছোট্ট বয়সে আঁচলে চাবি বেঁধেছি, অনভ্যাসে চাবির ঘায়ে পিঠে ব্যাথা করতো । এখন সেই চাবির গোছা মনোরমা দেবীর আঁচলে শোভা পায় । অনেক অনেক স্মৃতি । এইসব আসবাদপত্রে এখনো অমরেশবাবু মায়ের সেই স্পর্শ অনুভব করেন । পুরনো বটে তবে জিনিস খাঁটি ।
পাশের ঘরটা নাতির জন্যে ছেড়ে দেওয়া উচিত । ওখানেই রাজা ছোটবেলায় পড়াশুনা করেছে । এই ঘরটাই আপাতত ওর ছেলের জন্যে বরাদ্দ । অমরেশবাবুর বাবার চেয়ারটি, যেইটিতে এখনো রোজ সকাল বিকেলে অমরেশবাবু বারান্দায় বসেন, যে চেয়ারটিতে বসে রাজা পড়াশুনা করেছে সেই ছোটবেলা থেকে, ওইটাই ওর ছেলের পড়ার টেবিলের পাশে রাখা হয়েছে । খুব মজবুত আর মায়ামাখা । নিজের জন্য ভাবছেন সুযোগ করে একটা প্লাস্টিক চেয়ার কিনে নেবেন । সবটাই মনোরমা দেবীর পরিকল্পনা ।
নিজেদের জন্যে কোণার মায়ের ঘরটাই যথেষ্ট । মা মারা যাবার পর আর ব্যবহার হয়নি । তবে ঝার পোছ করে রাখা । এবার আরো একপ্রস্ত হলো । ঘরটাতে গেলেই কেমন যেন বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে সবসময় । অনেকদিন মা এই ঘরেই শয্যাশায়ী থেকে জীবনের শেষ দিনগুলো গুনছিলেন, কিন্তু বারবার গুলিয়ে যাচ্ছিল । মৃত্যু এসেও আসে না । বারবার ফিরে ফিরে গেছে আর মায়ের সেকি আকুতি । এই ঘরটাতে এলেই অমরেশবাবুর সেইসব কথা মনে পড়ে যায় । কেন যেন মনে হয়, তারও দিন ফুরিয়ে এসেছে । মৃত্যু যেন এই ঘরটাতে জাকিয়ে বসা, এতদিন থেকে তারই অপেক্ষায় । ছেলে বাড়ি ফিরছে সত্যি, তবু কোথায় যেন সেই উত্তাপ নেই ।
দেখতে দেখতে সেই দিন এসে গেছে । মাঝখানে কিছুদিন ব্যস্ততায় কেটেছে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই । সবগুলো ঘর আবার নতুন করে সাজানো হয়েছে । এতদিন পর ছেলে বাড়ি আসছে বলে কথা । গতবছরই রঙ করানো হয়েছিল তবু আবার নতুন করে করানো হলো । ঘরের পর্দা পাল্টানো হয়েছে ঘরের রঙের সাথে কনট্রাস্ট করে । খুব খাটা খাটনি গেছে মনোরমা দেবীর উপর । আজ দুদিন থেকে হাঁটুতে ভীষণ ব্যাথা, তবু তাই নিয়েই ছোটাছুটি চলছে । রাতে ভালো ঘুম হয় না । কিছুটা উৎকন্ঠা, কিছুটা বয়েসের ভারে । না চাইতেই অনেক গুলো ব্যামো শরীরে তাবু গেড়ে বসা সেই কবে থেকে ।আমৃত্যু ছাড়বে তেমন আশা ক্ষীণ । মনোরমা দেবী বুঝতে দেন না কাউকে । এবার ছেলে এলে অমরেশবাবুর ইচ্ছে মনোরমা দেবীর বুকটা ভালো করে পরীক্ষা করে পেসমেকার বসিয়ে নেবেন ।পাড়ার ডাক্তার অনেকদিন থেকেই বলছে, কিন্তু তিনি ভরসা পাচ্ছেন না ।
বেলা তিনটে নাগাদ উবের এসে গেইটে দাঁড়াতেই গাড়ি থেকে একে একে নামলো ছেলে-রাজা, বৌমা-পিয়া সাথে দাদুভাই - অর্ক । বাড়িটা নিমেষে উৎসবের মেজাজ । অমরেশবাবুর সাথে মনোরমা দেবীও ছুটে গেলেন গেইটে । কেমন যেন শুকিয়ে গেছে ছেলেটা । অফিসে নিশ্চয়ই কাজের ভীষণ চাপ । একটা ছেলে ঠিক করা ছিল মালপত্রগুলো ঘরে তুলে রাখার জন্যে । মনোরমা দেবীর ব্যস্ততা বেড়ে গেল দ্বিগুণ ।
রাতে খাবারের টেবিলে সবাই একসাথে বসেছেন । অনেক কিছু রান্না করেছেন মনোরমা দেবী । টুকটাক আলোচনা চলছে ।মনোরমা দেবী থেমে থেমেই ছেলের ছোটবেলার গল্প দাদুভাইকে আগ্রহ নিয়ে শোনাচ্ছিলেন, বাকিরা শ্রোতা । নাতির ওসবে খুব একটা আগ্রহ নেই । তারই ফাঁকে খাওয়া চলছে । কথা প্রসঙ্গে বাড়ির কথা উঠতেই রাজা বললে, মা, বাড়িটাকে কী করে রেখেছো ? এতো রীতিমতো জঙ্গল, সাপখোপের আড্ডা । একটা লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে পারতে ।
-- জঙ্গল কোথায় দেখছিস ? সবগুলো দরকারী গাছ । তোর বাবা কত জায়গা থেকে জড়ো করেছেন, তুই ভাবতে পারবি না ।
-- এইসব গাছ ?
-- হ্যাঁ, নিমগাছের পাশেই দেখিস অনেকটা একই রকমের পাতা, ওটা কারি পাতা, অনেক ধরনের খাবার তৈরিতে প্রয়োজন পড়ে । এপাশটায় ধনিয়া, থানকুনি আরো কত কি আছে ।
-- থাক মা, প্লিজ, আমাকে এখন গাছ দেখাতে হবে না । বাজারে দশ টাকায় অনেকটা ধনেপাতা পাওয়া যায়, তারজন্যে এই জঙ্গল পুষে রাখার প্রয়োজন নেই ।
অমরেশবাবু লক্ষ্য করলেন, বৌমা কিছু একটা বলতে চায় । অমরেশবাবু প্রসঙ্গ পাল্টানোর অছিলায় সুযোগ করে দিতেই বললে, আমি না বাবা ও-ই আপনাকে কিছু বলতে চায় ।
অমরেশবাবুর কপালে একটা ভাঁজ দেখা দিলে ।
-- হ্যাঁ, বাবা, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল -- । রাজা বললে ।
অমরেশবাবু একবার তাকালেন । মুখে কিছু বললেন না ।
-- আমি ভাবছিলাম বাবা বাড়িটা একবার রেনোভেট করা দরকার । কথাগুলো রাজা সবাইকে শুনিয়েই বললো ।
-- বেশ তো করো । কিন্তু তার আগে তোমার মায়ের চিকিৎসার প্রয়োজন ।
কথাগুলো মাটিতে পড়ার কোন সুযোগ পেল না, তার আগেই পিয়া বললে, হবে বাবা আমরা তো এসে গেছি, তবে তার আগে ---
-- হ্যাঁ, আমিও তাই বলি । মায়ের চিকিৎসা অবশ্যই হবে, সাথে ঘরটাও একটু ঠিক করা দরকার বাবা ।
-- যেমন ? অমরেশবাবু জল মাপতে চাইছিলেন ।
-- এই যেমন ধরো, আমার কোঠায় যে আলনা, আলমারী এসব রেখেছো, এগুলো একদমই আউট ডেটেড বাবা । এখন কেউ ব্যবহার করে না । পালংকটা এতটাই উঁচু যে বসতে কষ্ট হয় । ভাবছি ওগুলো ঘর থেকে বের করে দেব ।
-- সেকি ! এত জিনিস কোথায় রাখবো ? অমরেশবাবু আঁতকে উঠলেন ।
-- না, না ওই কাজটি করিস না বাবা। প্রত্যেকটি জিনিস খুব মজবুত আর ভালো কাঠ দিয়ে তৈরি । ওগুলো ফেলিস না, অনেক দামী। মনোরমা দেবী অমরেশবাবুর সমর্থনে এগিয়ে এলেন ।
-- ফেলছি কোথায় ? ওয়েলয়েক্সে বিক্রি করে দেব ভাবছি ।
-- না, অসম্ভব । প্রত্যেকটি জিনিসের সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে । আমার মা, আমার বাবা -- । অমরেশবাবু একটু জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করলেন ।
-- রাখো তো বাবা তোমার ওসব মেয়েলি সেন্টিমেন্ট । তোমার মা চলে গেছেন সেই কবে, তাকেই ধরে রাখতে পারলে না, তার স্মৃতি আঁকড়ে বসে আছো ।
অমরেশবাবু এতটা আশা করেননি নিজের ছেলের কাছ থেকে । হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ । তারপর থালায় জল ঢেলে উঠে পড়লেন খাবার থেকে ।
মনোরমা দেবী ছুটে এসে বললেন, কী হলো, বাকি খাবারটুকু খেলে না ?
অমরেশবাবু কোন উত্তর দিলেন না ।নিঃশব্দে চলে গেলেন নিজের কোঠায় । যেতে যেতে শুনলেন নাতি তার বাবাকে বলছে, বাবা আমার পড়ার চেয়ারটাও ওয়েলেক্সে দিয়ে দিও কিন্তু । নইলে আমি পড়তেই বসবো না ।
একা বসে আছেন অমরেশবাবু বিছানায় এক কোণে । আনমনে টিভিটা চালিয়ে দিয়েছেন, নিউজ চলছে । মনোরমা দেবী খানিক বাদেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ঘরে ।
-- মন খারাপ করো না । মনোরমা দেবী অমরেশবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন ।
-- কেন বলতো ?
-- না, বলেছিলাম, ছেলে বড় হয়েছে, মাঝে মাঝে ওদেরও মন রেখে চলতে হয় ।
-- তাই ? অনেক বড় হয়ে গেছে বুঝতে পারছি । তবে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না ।
-- হচ্ছে তো, আমি দেখতে পাচ্ছি । কেমন যেন চুপ করে গেছ ।
অমরেশবাবুর অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা হেসে বললেন, না, এই একটু নিউজ দেখছিলাম । তুমি শুনলে কিছু ?
-- কী ?
-- ভারত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন নাকি প্রাইভেট হয়ে যাবে ! ভাবতে পারো, এতো এতো কর্মচারীর ভবিষ্যত -- । তারপরই হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, রমা, তুমি আজকাল চুলে রঙ দাও না ?
-- দিই তো ।
-- না, অনেকদিন দাওনি । আমি এই কম আলোতেই তোমার পাকা চুল গুলো দেখতে পাচ্ছি ।
-- আর থাক, এখন আর ভালো লাগে না ।
-- না, না রমা ওইটা ভুল ।অমরেশবাবু মনোরমা দেবীকে কথার মাঝে থামিয়ে বললেন, সব সময় ফিটফাট থাকবে, তাতে মন ভালো থাকে । কদিনেরই জীবন বলো ? জীবনটাকে উপভোগ করো । কাল সকালে প্রথমেই চুলে রঙ দেবে কিন্তু ।
পরদিন সকালেই নতুন চেয়ার এসে গেছে । দামী চেয়ার । অমরেশবাবুর পৈতৃক চেয়ার আবার যথাস্থানে । বারান্দায় যে জায়গাতে বসে অমরেশবাবু বিকেলের চা খেতেন ওখানেই চেয়ারটি আবার ফিরে এসেছে । অমরেশবাবু কোনো উচ্চবাচ্যে গেলেন না, অযথা অশান্তি ।
ছেলে এসেই কাজে যোগ দিয়েছে । সারাদিনে দুবার দেখা হয়, কথা আরো কম । অমরেশবাবু নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন ।নাতি পড়ার অবসরে সারাদিন তার ঘরে সবেই ভিডিও গেম খেলে । দাদু ঠাম্মার কাছে ঘেঁষা, গল্প শোনা, এইসবে আগ্রহ কম, অভ্যাসও নেই । বরং বিরক্ত হয় । প্রথম দুই একদিনের পর নিজেরাই নিজেদেরকে শুধরে নিয়েছেন । আদিখ্যেতা অনেকটাই কম ।
দিনের পর রাত আসে, রাতের শেষে ভোর । এমনি করেই এগিয়ে চলে দিন ধীরে ধীরে আবার সম্পর্কটা সহজ হতে থাকে । তখনই একদিন অমরেশবাবু বারান্দায় সেই চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে সকালের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন, অনেকদিনের অভ্যাস । একট ভ্যান গাড়ি এসে গেইটে দাঁড়ালো । অমরেশবাবু একবার উৎসুক দৃষ্টিতে গাড়িটা দেখলেন, ফাঁকা গাড়ি । তার পত্রিকায় মন দিলেন । দুটো লোক গাড়ি থেকে নেমে সোজা গেইট খুলে ভিতরে । অমরেশবাবু কোন কালে ওদেরকে দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না ।
গাড়ির আওয়াজ শুনে ভেতর থেকে রাজা, পিয়া দুজনেই বেরিয়ে এলো । ওদেরকে সাদরে ভিতরে নিয়ে গেল দুজনে । তারপর অল্প কিছু সময় পর, একে একে আলনা, কাঠের আলমারী, তারপর পালংকটাও তুলে নিয়ে গাড়িতে রাখলো ওরা। অমরেশবাবু স্থম্ভিত হয়ে সব কিছু দেখছেন ।এত সখের জিনিস গুলো একবার মুখের কথা না বলেই বিক্রি করে দেওয়া হলো ! অমরেশবাবু ভাবতে পারছেন না । বুঝতে পারছেন না, এই মুহুর্তে তার কী করা উচিত । বুকের ভিতরে একটা চিনচিন ব্যাথা । অনেক কষ্টে নিজেকে সম্বরণ করলেন ।
সব জিনিস গাড়িতে উঠে গেছে । এমনিসময় বৌমা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললে, বাবা, আপনি একটু কষ্ট করে এই চেয়ারটিতে বসবেন ?
অমরেশবাবুর বুকের ব্যাথাটা বেড়েছে । চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে । মাথায় কিছু কাজ করছে না । হঠাৎ করেই শরীরের সমস্ত শক্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াতেই পা'টা কেঁপে উঠলো । পড়েই যেতেন, যদিনা বৌমা ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্ত করে ধরতো । মনোরমা দেবী পাশেই ছিলেন। আওয়াজ শুনে ছুটে এলেন ।
-- কী ? শরীর খারাপ লাগছে ?
অমরেশবাবু একবার তাকালেন মনোরমা দেবীর দিকে । তারপর অসহায় দৃষ্টিতে বললেন, কই না তো !
-- না বললেই হলো ? আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তোমার পা কাঁপছে --
-- ওঃ, ও কিছু না । আজকের খবরের কাগজ দেখেছো ?
-- নাঃ , কী আছে ওতে ?
-- ভারত প্রেট্রোলিয়ামও শেষ অবধি বিক্রি হয়ে গেল ।
মনোরমা দেবী অদ্ভুত চোখে তাকালেন অমরেশবাবুর দিকে ।
Comments
Post a Comment