বাগান বাড়ি


বাগান বাড়ি

রাজধানীর শিড়দাঁড়া ছুঁয়ে সে সড়কটি সোজা এগিয়ে গেছে তার পোষাকী নাম মহাসড়ক । হুটহাট গাড়ি ছুটছে যেন অনেকটাই বিয়ে বাড়ির মতো । সবাই তার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, অন্যের দিকে তাকাবার সময় কোথায় ? আলোর হেরফের না হলে বোঝা মুশকিল কখন দিন আর কখন রাত্রি । ঠিক ওই মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেলে যে শহরটি প্রথমেই চোখে পড়ে তার নাম নিশ্চিন্তপুর । আপনি ভাবছেন এখানেও সেই জমজমাট ভাব, লোকজন, গাড়ি ঘোড়ায় গমগম করছে, আজ্ঞে না । এখানে তেমন ভীড়ভাট্টা নেই, আলোর ঝকমারি, বিজ্ঞাপনে বিলাপ অনেকটাই কম । নেহাতই মহাসড়কটি শহরের পেট ফুঁড়ে চলে গেছে তাই যা কিছু উন্নতি, ন‌ইলে নামের মতোই শহর । কোন কিছুতেই হেলদোল নেই ।সরকারী নথিতে হাল আমলে তাকে শহর বলা হয়েছে যদিও আসলে তালুক ।ওই যাকে বলে জমিদারি । পুরুষানুক্রমে হাত বদল হতে হতে বর্তমানে যিনি জমিদার, তার নাম রামগোবিন্দ সহায় । দেশ স্বাধীন হবার পর আইন পাশ করে জমিদার নেই আর, তবে জমিদারি আছে । এখন ওরা আমজনতার মালিক এবং আক্ষরিক অর্থেও তাই । লোকে ওই নামেই ডাকে তবে আদতে ওদের জমিদারি রক্ত ।
রামগোবিন্দবাবু আজ দশ বছর নিশ্চিন্তপুরের মালিক । ভীষণ প্রতিপত্তি । আওয়াজ দিলে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায় । সরকারী বড়কর্তা থেকে তস্য তস্য পর্যন্ত ভীষণ খাতির করেন । আর করবে নাইবা কেন ? নিশ্চিন্তপুরে তিনিই তো শেষ কথা । লোকে আড়ালে বলে রামগোবিন্দে স্বহাঃ । সমস্ত ভোগের প্রথম ভাগটা তিনিই যে খান !

সেই নিশ্চিন্তপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র ঘেঁষে রামগোবিন্দ বাবুর বিশাল বাগান । ওখান থেকেই যে জমিদারির কলকাঠি নড়ে । জায়গাটা নির্জন, সহজে ভেতরে যাওয়া যায় না। খাস মানুষ আর কিছু কর্মচারী রোজ নিয়ম মেনে যাতায়াত করেন । রামগোবিন্দবাবু খুবই খেয়ালী লোক, সব সময়ে মন মেজাজ ঠিক থাকে না । তাই মাঝেমধ্যেই অনেক কিছু কানাঘুষা শোনা যায় । অথচ তাতে কারো কিছু আসে যায় না । প্রতিদিন নিয়ম মেনে সকাল হয়, তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তারপর রাত্রি । রাত্রি হলেই শহর ঘুমিয়ে যায় । যাদের চোখে ঘুম আসেনা তাদের প্রায় সবার চোখ জুড়ে আতঙ্কের বাস । শুধু মুষ্টিমেয় কিছু লোক রাত জেগে আতঙ্কের চাষ করে, প্রতিরাত নিয়মের কাটা মেনে নিয়ে । রাত পোহালেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে নিশ্চিন্তপুরের লোকেরা ভীষণ ভাবেই নির্লিপ্ত । কানাঘুষা কানে এলে একবার চোখ তুলে কখনো কখনো বাগানবাড়ির দিকে তাকায়, তারপর নীরবে কেটে পড়ে । দূর্জনে অনেক কথাই বলে তবে এই কথাটিও সত্যি, মন ভালো থাকলে রামগোবিন্দ বাবুর মতো কোনো লোক হতে পারে না । সময়ে অসময়ে মূল ফটকের পাশে টেবিলে পেতে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লোক ডেকে ডেকে 'কলাটা, মূলোটা', যখন যেমন সময় বুঝে বিতরণ করেন । কথাগুলো না বললে সত্যের অপলাপ হয় সত্যি । আবার ইচ্ছে হলেই সব বন্ধ করে ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন, তখন মাথা কুটলেও সিকিটিও জোটে না । প্রথম প্রথম মনে হতো দান করার এত কিছু থাকতে কলা মূলো কেন ? পরে সময় যেতেই বুঝতে পারি যার জন্যে যেমন পথ্যি, ঘোড়ার জন্যে মাসকালাই । রামগোবিন্দ বাবু খুবই বিচক্ষণ ব্যাক্তি, সৌখিন‌ও বটে । মালীকে দিয়ে নানা ধরণের সুস্বাদু ফল, শব্জী সবসময়েই ফলিয়ে থাকেন আর তাই দিয়েই দান দক্ষিণা । পাশের সড়ক ঘেঁষে যেতে যেতে নজরে পড়ে অনেকেরই, তবে ভাগ্যে লেখা না থাকলে ভাগ পাওয়া মুশকিল । লোকে জানে তবু লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় । এই কিছুদিন আগেই মরণ মুন্ডার জোয়ান মেয়েটার খুব ইচ্ছে হয়েছিল বাগানের পাকা কলাগুলো খাওয়ার , দূর্জনে অবশ্য অন্য কথা বলে । যাই হোক সেই কলা খেতে গিয়ে মেয়েটির উপরে মালিকের নজর পড়েছিল । সত্যি মিথ্যা বলা অসম্ভব । তবে শোনা যায় যোগিনী একাদশীর রাতে ওই বাগানবাড়িতেই মেয়েটিকে ঝুলতে দেখা গিয়েছিল । সবটাই শোনা কথা, কানাঘুষা । প্রত্যক্ষদর্শী নেই, থাকলেও কেউ ঝামেলায় জড়াতে চায় না । তবে মেয়েটির সাথে তার লাশটিও যে বেপাত্তা, এই কথাটি সত্যি । থানায় মামুলি একটা মিসিং ডাইরী হয়েছে মাত্র । তবে সবকিছুর পর, যে যাই বলুক, এই বাগানবাড়িটির একটা আলাদা আকর্ষণ আছে । ছিমছাম সাজানো, সারিসারি ফুলের গাছ, ফল বাগানে এক এক সময়ে এক এক ধরণের ফল -- যেমন সুস্বাদু তেমনি চোখ জুড়ানো । বাগানের মালি খুবই বিশ্বস্ত, সারাদিন বাগানেই কাজ করে, খুব যত্ন নেয় । লোকে বলে, ভজহরি জাদু জানে !

তা, যে প্রসঙ্গে এই গল্পের অবতারণ, আজ তেত্রিশ দিন রামগোবিন্দ বাবু রাজসূয় যজ্ঞে বসেছেন, আজ অন্তিম দিন । লোকজন অতিথি, অভ্যাগতের ভীড় । বিশেষদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা, চাই মদ থেকে নারী ।
অতিথি নারায়ণ হোন ! ফটকে টেবিল লাগিয়ে কাঙাল ভোজন চলছে সেই সকাল-সন্ধ্যা । আজ তার তেত্রিশ দিন । সবটাই এই বাগানের ফসল । এবছর আমের ফলন খুব ভালো হয়েছে। প্রত্যেককে এক এক টুকরো করে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে ।আমতো নয় যেন অমৃত । সবার মুখে একবাক্যে রামগোবিন্দ বাবুর জয় জয়াকার । যারা ভাগ পেয়েছেন, তারাতো অবশ্যই, যারা পাননি তারাও শেষবেলায় ভাগের আশায় জয়গানে ব্যস্ত । রামগোবিন্দ বাবু যজ্ঞের আসনে বসেও সমস্ত খোঁজ খবর রাখছেন, সবদিকেই নজর । ঠোঁটের কোণে আত্মতৃপ্তির এক চিলতে হাসি আঠার মতো জুড়ে আছে, ভালো লাগছে দেখতে । বছর পাঁচেক পর পরই এই ধরণের উৎসব হয় শহরে । শহরটাও এই সুযোগে মাঝে মাঝেই ঝিমুনি কাটিয়ে নড়ে চড়ে বসে । রামগোবিন্দ বাবুর মনে মনে খুব ইচ্ছে, এবারের যজ্ঞটি ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে আগামী বছর বিশাল আকারে আরো একটা যজ্ঞের আয়োজন করবেন । সাধ‌ও বলতে পারেন ।

আজ যজ্ঞের শেষ দিন। অনেকেই মনে মনে চাইছিলেন ত্রিপুরা থেকে পুরু শাঁস যুক্ত নারিকেল আনিয়ে পূর্ণাহুতি হোক কিন্তু রামগোবিন্দ বাবুর ভাবনাটাই আলাদা । শেষমেষ রামগোবিন্দ বাবুর ইচ্ছাতেই মালভোগ কলা দিয়ে পূর্ণাহুতি হলো । লোকে লোকারণ্য । আমলা থেকে 'কামলা' মানে দিনমজুর সবাই হাজির। রাজসূয় যজ্ঞ বলে কথা ! যারা 'কম নিষ্ঠা' রাখেন সহায়বাবুর প্রতি, তাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পেয়াদা পাঠিয়ে পৌঁছে দেওয়া হলো এই বাগানের পেয়ারা । একটু শক্ত, অনেকেরই দাঁত ভেঙ্গে গেল । তবু রামগোবিন্দবাবুর আগ্রহের অভাব নেই ।

যথা সময়ে যজ্ঞের সমাপ্ত হলে ক্লান্ত রামগোবিন্দ বাবু বিশ্রামে যাবেন । তার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা, সেটাই স্বাভাবিক । রাজসূয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করা চারটি খানি কথা ! তবে বিশ্রাম চাইলেই তো বিশ্রাম হয় না । একে একে অতিথিরা এলেন সম্বর্ধনা জানাতে । সবার মন রাখতে হয় ! রামগোবিন্দ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে । এবারে অতিথিরা যে তার বাড়ি ফিরে গেলেন, এখন অনেকটাই ফাঁকা । মালী ভজহরি দাসের ডাক এলো মালিকের খাস কামরা থেকে । ওখানে রামগোবিন্দ বাবু বিশ্রামে ব্যস্ত । ভজহরিকে দেখা দেখা মাত্রই অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কতটা খরচ হলো ভজহরি ?
ভজহরি গদগদ হয়ে বললে, আজ্ঞে খুবই কম ।
-- কম মানে কতটা বলবি তো হারামজাদা ?
-- আজ্ঞে বড়জোর মেরে কেটে পাঁচ শতাংশ ।
মালিক খুশি হয়ে বললেন, কী করে করলিরে হতভাগা ?
-- আজ্ঞে আপনি বলেছিলেন, প্রত্যেককে একটা করে আম দিতে, আমি তাদের টুকরো করে আধখানা দিয়েছি, তাতেই খুশি ।
মালিক প্রসন্ন হলেন । বললেন, এবারে লোক লাগিয়ে সবকটা গাছের ফসল নেট দিয়ে ঢেকে দাও । কাকপক্ষীতেও যেন খেতে না পারে । আমি সময় মতো ঘরে তুলে নেব ।
ভজহরি নীরবে ঘাড় নাড়লো ।
রামগোবিন্দ বাবু বললেন, এবার তোমার পাঁচ বছরের ছুটি ভজহরি, যাও আনন্দ করো । আর যাবার সময় মনে করে আস্ত একটা আম তুমি নিয়ে যেও কিন্তু, ওখানে আবার ভাগ করতে যেও না । তোমার নিজের হাতে ফলানো ফসল বলে কথা !
ভজহরি চলেই যাচ্ছিল, আবার ডেকে বললেন, তোমার অনেক খাটাখাটনি হয়েছে, তুমি বরং দুটোই নিয়ে যাও । ন‌ইলে আমার খুব খারাপ লাগবে । আর হ্যাঁ, সামনের বার শুধু আম দিয়ে হবে না, কিছু ডালিম রাখতে হবে । এক জিনিষ বারবার চলে না ।
ভজহরি অনেকটাই সাহস সঞ্চয় করে বললে, মালিক আগামী বছর লোকসভায় ভোট ---।
রামগোবিন্দ বাবু ভীষণ ব্যস্ত লোক, এত কথা বলার বা শোনার সময় কোথায় ? ক্রমাগত ফোনে কথা বলতে হয় । কতটা শুনলেন, ঈশ্বর জানেন ! তবে মুহুর্ত কাল থেমে কী ভেবে যেন ফোনটা কানে লাগিয়েই ইশারায় বললেন, এখন যাও, পরে কথা হবে ।
ভজহরি তরিঘড়ি ঘর গোছাতে গেল ।

Comments