নোটা


প্রযুক্তি আর ইনটারনেটের যুগে, পৃথিবী এখন ছোট হতে হতে হাতের মুঠোয় । বিশাল বিশাল দেশগুলো মনে হয় ছোট্ট একটি শহর । আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ মোবাইলে হুকুম দিলেই মন-পসন্দ জিনিষ হাজির । আজকের পৃথিবী অনেক কিছু শিখে গেছে, ভালো এবং অবশ্য‌ই খারাপটাও । এমনি এক প্রক্ষাপটে আমাদের পাড়াটি দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে ।

আমাদের পাড়াটি শহরের মধ্যে হলেও অনেকটাই রেসাডেন্সিয়াল । নদীর পাড় ঘেঁষে নাক বরাবর রাস্তা । তার একপাশে নদী অন্য পাশে সারি সারি গলি । কোনটি অন্ধগলি, কোনটি আবার পেট কেটে সোজা অন্য রাস্তায় গিয়ে মিশেছে । গলির দুপাশে শহরের আদি বাসিন্দারা । সবটাই ঘরবাড়ি, দোকান পাট যা কিছু, সব বড় রাস্তায় । মাঝে মাঝেই বনেদি বাড়ি,আর তার‌ই ফাঁকে ফাঁকে 'নতুন' বাবুদের ঘর । সময়ের সাথে সাথে জমির মতোই সবার‌ই ধীরে ধীরে দাম বাড়ছে । আর এই বাড়তি দামের আদিখ্যেতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত আর দশ ঘরের । বনেদি বাড়িগুলো এখন নামের জোরে ওজন ন‌ইলে যশ হারিয়ে স্মৃতির পাহাড় । এমনিতেই গলিগুলো ফাঁকাই থাকে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতেই আরো নির্লজ্জ হয়ে ওঠে পাড়াগুলো ।বাবুরা ঘরের ভেতর দরজায় খিল দিয়ে বসা, সন্ধ্যে হতেই মশার উপদ্রব আর সেই সুযোগে গেটেই কালবার্টে বেপাড়ার কিছু ছেলে ছোকরার আড্ডা জমজমাট । আড্ডা বলতে নিছক আড্ডা নয়, বিড়ি সিগারেট থেকে পাউডার, কোন কিছুতেই খামতি নেই । রসে থেকে পাড়াটাকে বশে রাখা যা যা দরকার । পাড়ার সাব্যস্তবাবুরা দেখেও না দেখার ভান করে চলেন, পাছে বাড়ির গেটেই মান সম্মান পকেট কাটা যায় ।আর এই ভয়েই ভদ্রলোকেরা ভীষণ সাবধান । সচেতন ভাবে গলার ভেতর থেকে আলজিহ্বাটি খুলে রেখে দিয়েছেন । পাছে বলা তো যায় না, ভুল করে প্রতিবাদ করে ফেলতে পারেন । এভাবেই একটার পর একটা দিন, মাসের পর বছর কাটছে ।
অবস্থা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তখন দিনের আলোয় সভা আয়োজন হলো । বাবুরা বক্তৃতা কাড়িকাড়ি দিলেন, অনেক অনেক অভিযোগ । পাতার পর পাতা প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ হলো, কিন্তু আসল দোষীকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কারণে চিহ্নিত করা গেল না । মিটিং চললো দীর্ঘক্ষণ । নতুন করে আবারো কমিটি হলো । কিছু দুর্বল মুখ বাদ পড়লেন, কিছু নতুন মুখ সংযোজিত হলো । শুধু সভাপতি আর সম্পাদক এক‌ই থাকলেন । সবশেষে আবারও সহাবস্থান ।
এখন আর সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে মেয়েরা বের হয় না। সকাল বেলা রাস্তার যেখানে সেখানে শিশি বোতল ছড়ানো থাকে । সাফাই করার লোক আলাদা করে ঠিক করা । তারা ঠিক সময়ে এসে সব প্রমাণ লোপাট করে দিয়ে যায় । অনেকেই দেখেও দেখেন না । সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে বাড়িতে অতিথি অভ্যাগত আসা বন্ধ । যারা না জেনে ভুল করে চলে আসেন তাদেরকে খেসারত দিতে হয় বৈকি । 
এই পর্যন্ত সব‌ই ঠিক ছিল। কিন্তু রসময়বাবুর বড় মেয়ে লতিকা যে রাত্রে কান্নাকাটি শুরু করলে সেদিনই পাড়াটা আবারো একটা ঝাঁকুনি খেল ।
দীনদয়ালবাবু একটু বেশি প্রতিবাদী, লোকে বলে অন্য ঘেঁষা লোক প্রস্তাব দিলেন, অনেক হয়েছে, এবার নিজেদেরকেই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে ।
নিজের সজ্জন ভাবখানা অক্ষুণ্ন রাখতে আমি নিরুপায় । নিজের ইমেজ বলে কথা । বললাম, আছি । অনেকেই ঘার কাত করলেন, কিন্তু সময়ে দেখা গেল আমরা মাত্র তিনজন । বললাম, তাহলে বাতিল হোক পরিকল্পনা ।
দীনদয়ালবাবু গর্জে উঠলেন, অসম্ভব । "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে ।"
বললাম, বেশ তবে যাওয়া যাক । হাতে ভারী পাওয়ার ফুল টর্চ, "কদম কদম বড়াহে যা" ।
কিছুটা যেতেই ভক্তিমাধববাবুর গেটেই পুরো রাস্তা জুড়ে কয়েকটি নতুন প্রজন্ম । লাইট পোষ্টের আলোয় দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি মদের বোতল আর গ্লাস । দূর থেকে ওদের খেউর খিস্তি শোনা যাচ্ছে ।
দীনদয়ালবাবু দূর থেকেই আওয়াজ দিলেন, ওখানে কে ?
-- তোর বাপ --
-- কী ??
-- বুঝতে পারলি না, তোর বাপ !
-- অসভ্যের মতো কথা বলবে না । কথা বলতে বলতে দীনদয়ালবাবু ছেলেগুলোর মুখের উপর টর্চ ফেলতেই একটা ছেলে খিস্তি দিয়ে বললে আলো বন্ধ কর্ ।
আমি তক্ষুণি দীনদয়ালবাবুর কাছ থেকে টর্চটা কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দিলাম । শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ ।
ততক্ষণে দুটো ছেলে ওঠে এসেছে । কাছে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ । একজন সভাপতির ছেলে আরেক জন সম্পাদকের ভাইপো । গত মিটিংএ তারাই অনেক বড় বড় কথা বলেছিল , অনেক বিপ্লবী কথা ।
দীনদয়ালবাবু তক্ষুণি সুর পাল্টে বললেন, আরে তোমরা ? বলবে তো ?
-- তার আগে বলুন, আপনারা এখানে কেন ?
-- ওই একটু ইভিনিং ওয়াক ।
-- বুড়ো বয়সে ঘোড়া রোগ হয়েছে ?
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললে, এই যে কাকু, তাহলে আপনিও বিপ্লবী !
আমি কোন উত্তর দিলাম না ।
-- শিউলি এখন কোথায় ?
শিউলি আমার একমাত্র মেয়ের নাম । আমি এবারো কোন উত্তর দিলাম না । ওদের আস্পর্ধা লক্ষ্য করছিলাম ।
-- আহা বলেন না, কোথায় ?
-- বাড়িতে ।
--- আর আপনি এখানে ? ওর যদি কিছু হয়ে যায় পাড়ায় মুখ দেখাতে পারবেন ? আপনার বলিহারি সাহস মাইরি । যান, বাড়ি গিয়ে মেয়েকে পাহারা দিন, আর যদি কোন সমস্যা হয় আমাকে বলবেন ।
দেখলাম, আমার সঙ্গী দুজনেরই অবস্থা খারাপ । পালাতে পারলে বাঁচেন । আমাকে চলে যাবার জন্যে পেছন থেকে হাত ধরে টানছেন ।
আমি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একটু সময় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম । ভীষণ অসহায় লাগছিল নিজেকে ।এই মুহূর্তে আমার পাশে দা‍ঁড়ানোর মতো কেউ নেই । চেয়ে চেয়ে ওদের সদর্পে চলে যাওয়া দেখলাম আর ঠিক সেখানে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামী নির্বাচনে আমি আমার ভোটটা অন্তত "নোটা"তেই দেবো ।

Comments