পাগলী

এই শহরে এসেছি বছর দুই প্রায়, এপাড়ায় তার‌ও কম । অফিসের কাছাকাছি তাই এখানে ঘর ভাড়া নেওয়া। শহরের মধ্যেও একটা নির্জনতা আছে, ঘিঞ্জি না । খুব একটা কোলাহল নেই, শান্তি আছে । আমার অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না । অধিকাংশ দিন‌ই ট্যুরে কেটে যায় । মাসে দশদিন স্টেশনে থাকতে হয়, তাই এই ঘর ভাড়া নেওয়া । একাই থাকি, পরিবার দেশ বাড়িতে থাকে । ওখানেই মা বাবাকে নিয়ে ছয়জনের সংসার । বাচ্চারা ওখানেই স্কুলে পড়ে । মাসে একবার যাওয়া হয়, তবে বেশি দিন থাকার উপায় নেই । প্রাইভেট চাকরি, চাপ অনেক বেশী । স্বপাকে রান্না খাবার খাওয়া অনেকটাই সীমিত । সারাদিনের ঝক্কি নেবার পর কড়াইএ তেল চাপানোর মতো আর তেল থাকে না শরীরে । তাছাড়া আজকাল অনেক সুবিধে আছে, অর্ডার দিলেই বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়ে যায় । হ্যাপা কম । তবু টুকটাক জিনিষ তো কিনতেই হয় ।আর সেই কারণেই পাড়ার মুদির দোকানে গিয়েছিলাম । আমি দোকানে কিছু জিনিষ কিনছি হঠাৎই নাকে এলো বিশ্রী একটা ভোঁটকা গন্ধ । চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি একটা পাগলী আমার ঠিক পিছনে পথ আগলে দাঁড়িয়ে । বুঝতে অসুবিধা হলো না, পাগলী মেয়েটার শরীর থেকেই গন্ধটা আসছিল । আমি তক্ষুণি ছিটকে সরে গিয়ে বললাম, এই দূর হ, দূর হ এখান থেকে ।,,
পাগলীটার বয়স কত হবে ? তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ । সারা গায়ে নোংরা, গায়ের কাপড়টাও তেমনি । নতুন অবস্থায় কি রঙের ছিল, এখন আর বোঝার উপায় নেই । কেনার পর থেকে সাবান লাগেনি বোধহয় । বুকের উপর একটা ব্লাউজ জড়ানো, তবে এই পর্যন্ত‌ই ।বোতাম না থাকলে যা হয় । আমার দিকে তাকিয়ে পাগলীটা হাত পেতে ভিক্ষে চাইছে । 
আমার ওসব ভিখারীতে ভীষণ এলার্জি । শরীর খাটিয়ে রোজগার করতে চায় না ওরা, বিনা পরিশ্রমে হাত পাতে খেতে চায় । আমার একদম‌ই সহ্য হয় না ।
দোকানীর সাথে হিসাব শেষ করে চলে যাবো, পাগলীটা আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে । আমি যত বলি, সর্, পথ ছেড়ে দাঁড়া, ততই যেন পাগলীটা চেপে বসতে চায় । ওর একটাই আবদার,  একটা পাউরুটি চাই । দাম বেশি না, কিন্তু ভিক্ষা জিনিষটাই আমার না-পসন্দ । আমি যত‌ই ওকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই, ততই পাগলীটা আমার পথ আগলে দাঁড়ায় । আমাকে কিছুতেই যেতে দেবে না । আশে পাশে লোকেরা দাঁড়িয়ে মজা লুটছে । আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল । দোকানি তখন অন্য পাশটায় দাঁড়িয়ে খদ্দের সামলাচ্ছে । তারমধ্যেও সে দুই একবার পাগলীটাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু পাগলীটার কোন কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই । আমার থলেতে একটা পাউরুটি কিছু বিস্কিট আর চিপস নিয়ে ছিলাম, সেই থেকে তার একটাই বায়না, একটা পাউরুটি চাই । দাম খুব বেশি না, মাত্র কুড়ি টাকা কিন্তু আমিও মনস্থির করে ফেলেছি কিছুতেই দেব না । ওর থেকে দূরে সরে থাকতে গিয়ে আমি পেছনে যেতে যেতে একেবারে কোণায় চলে গেছি প্রায় । আর পেছনে যাবার উপায় নেই । আমি যত পিছনে যাই, ততই সে এগিয়ে আসে । সম্ভব হলে পা চেপে ধরতে চায় । নেহাতই আমি ছিটকে সরে যাচ্ছিলাম তাই, ন‌ইলে ওর নোংরা হাতটা দিয়ে কখন আমার পা'টা চেপে ধরতো । আমার ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে । হঠাৎই হাতের নাগালে একটা লাঠি পেয়ে যাই । আমি তক্ষুণি লাঠিটা হাতে তুলে নিই । ভাবখান একটু ভয় দেখালে যদি পথ ছেড়ে দেয় । মারধোরের কোন উদ্দেশ্য‌ই আমার মনের মধ্যে ছিল না । কিন্তু পাগলীটা কী বুঝলো জানি না, হয়তো বিপদের আশংকা করে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক ঝটকায় আমার খাবারের থলেটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে চাইলে । আমার‌ও তখন কী যে হয়ে গেল,  আচমকা হাত থেকে জিনিষ ছিনিয়ে নিলে যা হয়, ধৈর্য্যের বাঁধটাই ভেঙ্গে গেছে । হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম । ছেলে মেয়ে বোধ নেই, প্রচন্ড রাগে হাতের লাঠিটা দিয়েই একটা ঘা বসিয়ে দিই । পাগলীটা একটা চিৎকার করে ছুটে পালায় । আমার রাগ তখন সপ্তমে । আমিও ছুটি ওর পেছনে পিছনে ।বেগতিক দেখে দোকানি ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরে । বলে, মারবেন না দাদা, প্লিজ । আমি আপনাকে আরো একপ্রস্ত জিনিষ দিয়ে দিচ্ছি, পয়সা লাগবে না, তবু ওকে ছেড়ে দিন ।
দাম খুব বেশি না, সব মিলিয়ে এক'শ পয়ত্রিশ টাকার মতো ।তবু রোজগার করা পয়সা, ফোকটে পাওয়া নয় । দোকানদার আরেক প্রস্থ জিনিষ বিনে পয়সায় দিয়ে দেওয়ায় ঝামেলা আপাতত এখানেই শেষ । তবে ভেতরে ভেতরে একটা রাগ থেকেই গেল । মনে মনে স্থির করলাম, যদি আরো একবার দেখা হয় তবে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো । 
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে, বেশ কয়েকবার‌ই পাগলীটাকে দেখেছি । আমাকে দেখতে পেলেই প্রতিবার পালিয়ে যেত পাগলীটা । ধারে কাছেই ঘেঁষতো না । আমিও কাজের চাপে ধীরে ধীরে ভুলেই গেছিলাম সেদিনের ঘটনা ।
গতকাল ট্যুরে যাচ্ছি, সকাল সকাল বাস স্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি বাসের অপেক্ষায় । হঠাৎই মেয়েলি গলায় শুনতে পেলাম, কেউ যেন বলছে, খা, বাবা খা । শব্দ ক'টা শুনেই অভ্যাসবশে পিছন ফিরে দেখি শেডের এক কোণায় সেই পাগলীটা বসে । হাতে একটা থালায় কিছু একটা খাবার নিয়ে কাউকে খাইয়ে দিচ্ছে । আমার মাথায় এবার ভুত চাপলো । এই সুযোগ, এবার দেখি কি করে পালায় ।
আমাকে সে প্রথমটায় দেখতে পায়নি । যখন দেখতে পেল তখন সে নিরুপায় । হাতের থালা হাতেই র‌ইলো । দেখলাম, সামনে শুয়ে বছর পাঁচেক এক জড় মানব । তাকানো যায় না । আমি থমকে গেলাম, স্থির নির্বাক । আমার‌ও এইরকমের‌ই একটা ভাই ছিল । আমি জানি এই নিয়ে মায়েদের মনের অবস্থা । ছোটবেলায় মাকে দেখেছি সেই ভাইকে নিয়ে দিনের পর দিন কত কষ্ট করতে । কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিল একটা দিনের জন্যেও কাছ ছাড়া করেন নি ওকে । কতরাত দেখেছি মাকে লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে, কিন্তু কোন অভিযোগ ছিল না । শুধু বাড়িতে কেউ এলে বলতেন আমার এই ছেলেটার জন্যে একটু দোয়া করো বাবারা, যেন আমি বেঁচে থাকতে থাকতে ওর মৃত্যু হয়, একটু দোয়া করো । কথাগুলো  বলতেন আর ঝরঝর করে কাঁদতেন । আজ আবার সেই পাগলীর মধ্যেই আমার মাকে দেখতে পেলাম অনেক দিন পর ।
অনেকটা সময় নিয়ে পাগলীটা ওকে যত্ন করে থালার শেষ খাবারটুকু খাইয়ে দিচ্ছিল ।  । আমি দেখছিলাম । মাটিতে পা গেঁথে গেছে, কিছুতেই সরে আসতে পারছিলাম না । আমাকে দেখে পাগলীটা এবারে আর পালানোর চেষ্টা করলে না । একটু একটু করে থালার সবটুকু খাবার খাইয়ে দিয়ে যখন সে আমার দিকে ফিরে তাকালো, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর দুচোখ জুড়ে জল ছলছল করছে । ওর মধ্যে কোথাও পাগলের লক্ষণ নেই, চোখে অসহায় দৃষ্ট । যেন আমার মা বলছেন, ওর জন্যে একটু দোয়া করো, দয়া করে একটু দোয়া করো আমার বাচ্চাটার জন্যে ।
চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি নেমে এলো । আমি স্থম্ভিত । চমকে ওঠে দেখলাম, পাগলীটা অন্তসত্ত্বা । বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো, এই নোংরা সমাজে তাহলে  পাগলীটারও রেহাই নেই !

Comments