গড় গোবিন্দপুরের বিলে

গড় গোবিন্দপুরের বিলে

উবের চড়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আমি আর আমার ভাইজি, নাতাশা। ব্যস্ত কলকাতায় ওই আমার একমাত্র ভ্রমণসঙ্গী। নিজে যেমন ঘুরতে ভালবাসে তেমনি তার ঘুরতে যাবার আগে সেই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা। কোথাও যাবার আগে ওর হোম‌ওয়ার্ক খুব ঈর্ষণীয়, আর ঠিক ওই কারণেই ওকে নিয়ে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। কলকাতায় এলে আমি তাই ওর সাথে কয়েকটা দিন আমার নিজের মতো করে কাটাই। যেমনটি সেদিন‌ বেরিয়েছিলাম দুজনে । গন্তব্য জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, আর হাতে সময় থাকলে কাছেই মার্বেল পেলেস বাড়িটিও একঝলক দেখে নেবার ইচ্ছে। গাড়ি ছুটছে বিবাদী বাগ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। নেতাজি সুভাষ রোড ধরে কলকাতা জিপিও- র পাশে আসতেই নাতাশা হঠাৎই বললে, ওই দেখো, তোমার ডান পাশটায়, স্বামীজীর বাড়ি।
চমকে উঠেছলাম। কি বলছে নাতাশা ! এখানে কি করে স্বামীজীর বাড়ি হবে ? তবু চারপাশে ভালো করে দেখে হতাশ হয়ে বললাম, কোথায় ?
-- কেন ওই তো, ওই যে ।
-- ওটা তো কলকাতা জিপিও রে !
-- সে তো এখন ।
বললাম, ধ্যাত, কি সব আজেবাজে কথা বলছিস । ওটা প্রথমে পুরনো ফোর্ট উইলিয়ামের অংশ ছিল, এখন পশ্চিমবঙ্গের জেনারেল পোস্ট অফিস, সমস্ত পোস্ট অফিসগুলোর কন্ট্রোলিং অফিস এইটা। তারপর একটু ভেবে বললাম, সম্ভবত, না সম্ভবত নয় ১৮৬৮ সালেই পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের এই অংশে আজকের ডাকঘরটি তৈরি হয়েছিল। ওয়ালটার বি গ্রেনভিলের নকশা অনুসারে ম্যাকিনটশ বার্নের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে এই বাড়িটি। এখনো ডাকঘরের জাদুঘরে গেলে দেখতে পাবি পুরনো দুর্গের একমাত্র স্মারক একটি পিতলের পাত সযত্নে ওখানে রাখা।
--- মানছি । নাতাশা মুচকি মুচকি হাসছে ।
--- তাহলে ? আমার অবাক প্রশ্ন। তারপর ওকে নিঃসন্দেহ হবার জন্য বললাম, আর তার ঠিক পাশেই তো ১৭৫৬ সালের সেই কুখ্যাত অন্ধকার কূপ, ব্ল্যাক হোল অফ ক্যালকাটা - গল্পটা জানিস তো ?
-- জানি ।
-- তবে ‌? আমি অবাক ।
-- তাহলে এবার আমার কাছ থেকে পুরো গল্পটা শুনে নাও।
আমি আর আপত্তি করলাম না। নাতাশা গল্প বলতে শুরু করলো। 
-- স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আমলাহাড়া নামক কোন এক স্থানের জমিদার। আমলাহাড়া নাম শুনেছো কোনদিন ?
-- আমলাহাড়া ?
-- প্লিজ আমলাহাড়া কোথায়, এই প্রশ্নটা এখন আমাকে করতে যেও না তুমি। নাতাশা প্রশ্নের শুরুতেই আমাকে থামিয়ে দিল । আমি হেসে বললাম, বেশ, তুই বলতে থাক । নাতাশা আবার গল্পে ফিরে যায়। 
-- স্বামীজীর ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন, তাদের পরিবারে একটা প্রচলিত কথা আছে, "কে জানে আমার তত্ত্ব / আমলাহাড়ার দত্ত" । সেই আমলাহাড়া থেকে স্বামীজীর পূর্বপুরুষেরা ডেরিয়াটোনা গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। ডেরিয়াটোনা বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমায় একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। যেহেতু গ্রামটি দত্তদের জমিদারির অংশ ছিল তাই লোকে বলতো, " দত্ত ডেরিয়াটোনা" । মোঘল সম্রাটদের আমলে তারা দীর্ঘদিন সেই গ্রামে বেশ সুখেই বাস করছিলেন। তারপর সম্ভবত ইংরেজ আমলের প্রথমদিকেই স্বামীজীর পূর্বপুরুষ রামনিধি দত্ত, তার ছেলে রামজীবন দত্ত ও নাতি রামসুন্দর দত্তকে সাথে নিয়ে গড়-গোবিন্দপুরে চলে এলেন।
গড়-গোবিন্দপুর নামটা খুব শোনা শোনা লাগছিল, কিন্তু মনে আসছে না। বললাম,গড়-গোবিন্দপুর ঠিক কোন জায়গাটা একটু খুলে বল্ তো !
-- কেন, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সুতানটি, ডিহি কলিকাতার সাথে আরো একটা গ্রাম নিয়ে যে কলকাতা শহরের গোড়া পত্তন হয়েছিল, সেই গ্রামটির নাম‌ইতো গোবিন্দপুর।
নিমেষেই মনে পড়ে গেল সব কিছু। বললাম, বুঝে গেছি, এবার বলে যা।
নাতাশা আমার কথায় হেসে উঠলো। বললো, বুঝতে পারছি তোমার বয়েস হয়ে গেছে, এখন তোমাকে চোখ বুজে বুড়ো বলাই যেতে পারে। 
বললাম বেশ তো, বলিস। এবার গল্পটা শেষ কর্।
গাড়ি তার নিয়মেই এগিয়ে যাচ্ছে । ড্রাইভার ভদ্রলোকের স্টিয়ারিংএর সাথে গল্পেতেও মন মজেছে পরিষ্কার। নাতাশা বললে, ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদৌল্লা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্গ ধ্বংস করে দিয়েছিল মনে আছে তো, তখন‌ই ইংরেজরা অনন্যোপায় হয়ে নতুন দুর্গ তৈরি করার জন্যে দত্তদের জায়গাটা ছেড়ে দিতে বলে । এই জায়গাটাই ছিল সেই ছেড়ে দেওয়া গড়-গোবিন্দপুরের আদিবাড়ি । 
একটুখানি থেমে আমার মনের ভাবটুকু মাপার চেষ্টা করলো নাতাশা। তারপর নিজে থেকেই বললে, পরিবর্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদেরকে কোথায় পুণর্বাসন করেছিল জানো তো ?
-- কোথায় ?
-- সুতানটিতে মধু রায় লেনে । এমন একটা জঙ্গল যেখানে, জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্যে কোম্পানি সেই সময়ে সাথে অতিরিক্ত ১৪ টাকা অনুদান দিয়েছিল।
আমার ঠিক বিশ্বাস হলো না। বললাম, বিশ্বাস হচ্ছে না, তথ্য সুত্র বল্ ।
-- কেন রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, তারাই বলে দেবেন।
 বললাম, বেশ মানছি। তবে তোর সোর্সটা বল্।
--- স্বামী একরূপানন্দ।
এবার আর অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। কথায় কথায় আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। ড্রাইভার ব্রেক কষতেই গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, বাকিটা ওয়ান ওয়ে। আপনারা এখানেই নেমে যেতে পারেন।
--- মানে ?
--- ওই তো ডান পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে যান, আপনাদের ডেস্টিনেশন পেয়ে যাবেন।
--- আমরা এখানে নয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নামবো । ওখানেই আমাদের ডেস্টিনেশন দেওয়া। পাশ থেকে নাতাশা স্মরণ করিয়ে দিল ড্রাইভারকে।
--- ওসব জোড়াসাকো টাকো বুঝি না ম্যাডাম, ম্যাপ অনুযায়ী ঠিক জায়গাতে আমি পৌঁছে গেছি।
মহা ঝামেলা, লোকটাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছেনা। অগত্যা গাড়ি ছেড়ে একটা দোকানে খোঁজ নিতেই দোকানদার ইশারায় আরো একটু সামনের দিকে যেতে বললেন। মিনিট দুই এক এগিয়ে গেছি হাতের ডান দিকে একটু ভিতরে একটা বিশাল গেট । তাতে স্পষ্ট লেখা " জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি" । এবারে বুঝলাম ম্যাপ ভুল নয়, ড্রাইভারটাই ভুল করেছে। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল, গেট বন্ধ। কোরোনার জন্যে বন্ধ রাখা হয়েছে। বুঝলাম, কলকাতায় তৃতীয় হাতের ভীষণ ক্ষমতা। রাজ্য জুড়ে নির্বাচনের হাওয়া, হল থেকে মল, মিটিং, মিছিল কিছুতেই কোন খামতি নেই। সব কোরোনা ঝাঁটা দিয়ে এইসব জায়গাতে জড়ো করে রাখা। বিরক্তিকর, কিন্তু উপায় নেই। বললাম, এবার ?
-- চলো, মার্বেল পেলেস।
বললাম, না চল স্বামীজীর বাড়ি যাই।
আবারো উবের বুক করা হলো। বললাম, ওখানে যাবার আগে সংক্ষেপে তোর গল্পটা শেষ করে নে।
উবেরে বসতে বসতেই নাতাশা ছোট্ট করে বললে, গল্প বলতে তেমন কিছুই আমার জানা নেই। তবে এইটুকু জানি যে পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে রামসুন্দরের বড় ছেলে রামমোহন শিমুলিয়ার মধু রায় লেনের বাড়ি ছেড়ে ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জির বর্তমান এই বাড়িটিতে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। মহেন্দ্রলাল দত্তের লেখা পড়ে যতটুকু জানা যায়, সেই মতে বাড়ির জমির পরিমাণ ছিল মোট চার বিঘা। দেড় বিঘা নিয়ে মূল বসতবাড়ি, বাকি আড়াই বিঘা জুড়ে পুকুর, আস্তাবল, ফুল ফলের বাগান আর কাজের লোকদের থাকার ঘর। বিধান সরণি আর বিবেকানন্দ রোডের ঠিক ক্রসিং-এই ছিল সেদিন কার সেই পুকুর আর ২নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে চার কাঠা জমির উপর রামমোহন দত্তের বিশাল আস্তাবল । এখন সেখানেই রামকৃষ্ণ মিশন স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাস, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মূল অফিস সাথে স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজেস ।

স্বামীজীর বাড়ি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয় । বাড়ি চিনে নিতে কোন অসুবিধা হলো না। মূল রাস্তার পাশেই। বর্তমান ঠিকানা, রামকৃষ্ণ মিশন স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ১০৫ বিবেকানন্দ রোড, কলকাতা ৭০০০০৬ । জায়গাটি বিধান সরণি, বিবেকানন্দ রোড, সিমলা স্ট্রিট আর গৌরমোহন মুখার্জী রোডের মাঝখানে। বিধান সরণির ট্রাম রাস্তা বা বিবেকানন্দ রোড ধরে এগিয়ে এসে দুটো রাস্তার ঠিক ক্রসিংএ নেমে যেতে হয়। এখন এখানে মোট ছয়টি বাড়ি তৈরি হয়েছে। স্বামীজীর মূল বাড়ি, যেখানে আছে স্বামীজীর জন্মস্থান ও সংগ্রহশালা, দ্বিতীয় অংশে অফিস, টেক্সট বুক লাইব্রেরী সাথে ভাষা শিক্ষার স্কুল । তাছাড়া বিবেকানন্দ গবেষণাগার, সাধু ও কর্মী নিবাস, নিবেদিতা ভবন, যেখানে ফ্রি কোচিং সেন্টার সাথে দাতব্য চিকিৎসালয় আর সবশেষে সভাগৃহ। বিবেকানন্দ সংগ্রহশালার পাশেই বিশাল ব্রোঞ্জ মূর্তি । পয়লা জানুয়ারী ২০০৮ সালে মূর্তিটি উন্মোচক সেই সময়কার মঠ ও মিশনের সঙ্ঘাধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী আত্মস্থানন্দজী মহারাজ।
সংগ্রহশালার সামনে এসে দাঁড়াতেই একজন স্বেচ্ছাসেবক জুতোঘর দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওখানে জুতো রেখে আসুন আর মোবাইলটা প্লিজ সাইলেন্ট করে দিন।
দরজায় একজন স্বেচ্ছাসেবক থার্মেল স্কেনিং করে হাতে কিছুটা সেনিটাইজির ঢেলে দিলেন। ভেতরে বা'পাশে টিকিট কাউন্টার, ডান পাশে বুক স্টল । একজন মহারাজ বুক স্টলে বসা। আমরা টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম। সিঁড়িতে উঠতেই প্রথমে চোখে পড়ে পুরনো কলকাতার বিশাল আকৃতির চারখানা ছবি। একখানা নাখোদা মসজিদ, একটা ধর্মতলা, একটা ঘোড়ায় টানা করলাম আর একখানা জগন্নাথ ঘাটের । আসলে শুরুতেই দর্শনার্থীদের উনিশ শতকের সেই সময় সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া। এখানে লাইট এন্ড সাউন্ড শো-র মাধ্যমে স্বামীজীর জন্মভিটায় ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে। আছে খুব সংক্ষেপে স্বামীজী সম্পর্কে রামকৃষ্ণের ভাবনা, নিজের মাকে নিয়ে স্বামীজীর মনভাব আরো অন্য অনেক কিছু । সাথে আছে স্বামীজীর সময়কার কিছু ব্যাক্তিত্বের ছবি। বিশাল কোন ঘর নয়,একটু হাটতেই শেষ। একপাশে একটা পর্দা দিয়ে পথ আটকে রাখা। একটু অবাক লাগলো। শুধু এইটুকু দেখার জন্যে এত দূরে ছুটে আসা ! সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাবো ভাবছি, তখন‌ই একজন স্বেচ্ছাসেবক এসে উপস্থিত। বললেন, এদিকটায় আসুন। 
উনি না এলে পর্দা সরিয়ে ভিতরে যে যেতে হবে বোঝার কোন উপায় ছিল না। আমরা ভদ্রলোকের পিছনে পিছনে এগিয়ে গেলাম। পর্দা সরাতেই সামনে পাশাপাশি দুটো ঘর। ভদ্রলোক বললেন, স্বামীজী বাড়িটিতে সেই সময়ে দুটো ভাগ ছিল। একটা বাহিরমহল, অন্যটি অন্দরমহল। আমরা প্রবেশ করেছি বাহির মহল দিয়ে। ঠিক এখান থেকেই শুরু অন্দরমহল। প্রথম দুটো ঘরে কারা থাকতেন বা কি কারণে ব্যবহার করা হতো তার সঠিক কোন তথ্য নেই, তাই প্রথম ঘরটিকে বৈঠকখানার মতো করে সাজিয়ে রাখা। এখানে আছে এই বাড়ি থেকেই সংগৃহিত চেয়ার, টেবিল, কিছু আইনের বই, একটা টাইপ রাইটার, একটি গড়গড়ি আর কিছু অন্যান্য সামগ্রী। দ্বিতীয় ঘরে স্বামীজীর বংশতালিকা আর পুরনো বাড়ির ছবি।
তৃতীয় ঘরটি স্বামীজীর পিতামহী শ্যামাসুন্দরীর । এখানেই রাখা আছে শ্যামাসুন্দরী দেবীর লেখা অপ্রকাশিত ব‌ই "গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিনী" একটি প্রতিরূপ। মূল ব‌ইটির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর‌ই ছোট্ট একটা বারান্দা পেরিয়ে স্বামীজীর জন্মস্থান। তিন দিকে ঘরে ঘেরা খোলা আকাশের নীচে এই দোতালাতেই একফালি জায়গা। এখানেই দত্ত পরিবারের আঁতুড় ঘর। বাড়ির মহিলাদের প্রসূতিকালে ছনের ছাউনি দিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। এখানেই ১৮৬৩ সালে ১২ই জানুয়ারী মকর সংক্রান্তির দিন পৌষ কৃষ্ণা সপ্তমী তিথি সোমবারে স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে এখানে স্বামীজীর সুসজ্জিত পট বসিয়ে রাখা।‌ কাঠের তৈরি সিংহাসনটি যেন বাঁশের কুঠির উপর ছন দিয়ে ছাউনি। সব কিছুই সেই সময়টাকে ধরে থাকার প্রচেষ্টা ।
স্বামীজীর জন্মস্থানের সঠিক বর্ণনা কিরণচন্দ্র দত্তের ডাইরি থেকে পাওয়া যায়। ২ জুলাই ১৯২২ সালে তিনি ডাইরিতে লিখেছেন, " সেদিন বর্তমান বাড়ির মালিক উপেন্দ্রনাথ দত্তের অনুমতি নিয়ে স্বামীজীর পৈতৃক বাসস্থান দর্শন করতে যাই।‌স্বামী শুদ্ধানন্দের ইচ্ছা অনুযায়ী আমি তাঁকে ও আরেক ব্রহ্মচারী মহারাজকে সাথে নিয়ে গিয়েছি। স্বামীজী মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁদের বাড়ির উঠানে গঙ্গাজল ও ফুল দিয়ে আমাদের অভ্যর্ধনা জানালেন। উপেনবাবুর উপস্থিতিতে আমরা বাড়ির ছাদে উঠে সেই স্থান দর্শন করি -- যেখানে বংশের কেউ সন্তানসম্ভবা হলে অস্থায়ী আঁতুরঘর তৈরি করা হতো ও পরে তা ভেঙ্গে ফেলা হতো। বর্তমানে ছাদের ওপর একটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। আমরা ঐ পবিত্র স্থান গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে পূজা করে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি। পরে সন্ধ্যায় ফিরে আসি।"
আমরা দুজনেই ধ্যানমগ্ন সেই মহাঋষিকে আরো একবার প্রণাম করি । ওখান থেকেই পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবার রাস্তা। ডান পাশে একটা অত্যাধুনিক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলে স্বামীজীর শিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার‌ই একটা অংশবিশেষ থ্রিডি মুভিতে দেখানো হয়। এনিমেটেড মুভি, তবু দেখতে ভালো লাগে। বিশ্বের দরবারে স্বামীজী ভারতবর্ষকে কোথায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তার একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
মুভি দেখে বেরিয়ে এসে হাতের বা'পাশে এগিয়ে গেলে প্রথমেই শিবমন্দির । তথ্য মতে মা ভুবনেশ্বরী দেবীর প্রথমে একটি ছেলে হয়ে মারা গিয়েছিল, তারপরের কয়েকজন‌ই কন্যা সন্তান। তাই পুত্র সন্তান কামনায় মা ভুবনেশ্বরী দেবী নিজের বাড়িতেই নিত্য শিবপূজা করতে শুরু করেন। পাশাপাশি এক নিকট আত্মীয়াকেও প্রতি সোমবার বারাণসীতে "বীরেশ্বর" শিবের পূজা করতে অনুরোধ করেছিলেন। বর্তমানে এই ঘরটিতে বীরেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত, নিত্য শিবপূজা হয়। লোকে বলে এই শিব খুব জাগ্রত, মন থেকে কিছু চাইলে, শিব তার মনবাঞ্ছনা পূর্ণ করেন। পাশেই স্বামীজীর দিদি স্বর্ণময়ী দেবীর ঘর । হীরাময়ী ও যোগেন্দ্রবালা ২২ বছরে ও কিরণবালা মাত্র ১৬ বছর বয়সে মারা যান। একমাত্র স্বর্ণময়ী দেবী জীবিত ছিলেন ৭২ বছর। তার কোন সন্তান ছিল না। পরের ঘরটি ব্যবহার করতেন মা ভুবনেশ্বরী দেবী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি এই ঘরটিতেই থাকতেন। এই সারিতে সবশেষ কোঠায় দুই সারিতে স্বামীজীর ৪০ খানা ছবি বাঁধিয়ে রাখা। সময়কাল ১৮৮৬ থেকে ১৯০১ । সর্বশেষ ফটো দূটো শিলংয়ে তোলা।
ওখান থেকে বেরিয়ে গেলে সামনেই ঠাকুরদালান। অনেক অনেক ঘটনা, অনেক অনেক স্মৃতি বুকে নিয়ে এখনো এক‌ই ভাবে দাঁড়িয়ে। বড় থামের আড়ালে এখানেই খেলা করতেন শিশু বীরেশ্বর। একবার খেলতে খেলতে তিনি সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক রক্ত ঝরে। বহু চেষ্টায় তাঁকে সুস্থ করা হয়। সেই পড়ে যাওয়াতে ডান চোখের ওপরে ক্ষত দাগ আজীবন থেকে গিয়েছিল। ঠাকুর বলেছিলেন, " যদি সেদিন ঐরকম ওর শক্তি না কমে যেত, তাহলে ও যে পৃথিবীটা একেবারে ওলট-পালট করে ফেলত ।" এই ঠাকুরদালানেই স্বামীজী একসময়ে নাটকের দল করেছিলেন। নাটকের দৃশ্যপট তার নিজের হাতে আঁকা। এখানেই তিনি বন্ধুদের সাথে কবাডি, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলতেন। বাড়ির মুরব্বীরা রোয়াকে বসে আনন্দ নিতেন প্রতিদিন।
ঠাকুরদালান ঘিরে চারপাশে ঘর। হাতের বা'পাশে প্রথম ঘরটি ধ্যানঘর। স্বামীজীর ধ্যানের কোঠা ছিল দোতলায় চিলে কোঠায়। ওখানেই ধ্যান ধ্যান খেলার সময়ে একবার ওই কোঠায় বিষধর গোখরা ঢুকেছিল। এই কোঠায় সেই ঘটনাটি পুতুল দিয়ে দেখানো। 
পরের কোঠায় শরীর চর্চার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা। এই সবকিছুই স্বামীজী নিজে ব্যবহার করতেন। আছে ঘোড়ার পিঠে বসার আসন, মুগুড় আরো কত কী। এখানেই রাখা পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দের সব সময়ের সাথী দুখানা যষ্টি। আছে আলমারিতে স্বামীজীর ব্যবহার করা ধুতি, জামা আর জপের আসন। পাশের ঘরটি সঙ্গীত চর্চার ঘর। কথামৃতকার মাস্টারমশাই এই ঘরটিতে বসেই স্বামীজীর গান শুনতেন।
ঠাকুরদালানের বারান্দা ধরে বাঁক নিতেই প্রথম ঘরটি ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের। উচ্চ শিক্ষিত, বিলেতে পড়াশুনা, অনেকের কাছে তিনি "মহিমবাবু", "মহিনদা" বা বুড়োশিব নামে পরিচিত। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলছেন, " মহিম আমাদের সন্ন্যাসীর অধিক ।" এই ঘরেতেই আছে সেই সময়কার লন্ঠন, জুতা সহ অন্যান্য পূজার সামগ্রী। দেওয়ালে টাঙানো নন্দলাল বসুর পোস্ট কার্ডে ছোট্ট চিঠিতে সাথে স্কেচের প্রতিলিপি বড় করে বাঁধিয়ে রাখা।
পাশের ঘরটি ছোট ভাই ভুপেন্দ্রনাথ দত্তের। দুটো কোঠার মধ্যে সরু একফালি পথ। এইটাই একসময়ে দত্তবাড়ির মূল প্রবেশ পথ ছিল। অর্থাৎ ৩ নং গৌরমোহন স্ট্রিটের দত্তবাড়িতে ঢোকার মূল প্রবেশপথ। 
ভুপেন্দ্রনাথও মহেন্দ্রনাথের মতোই উচ্চ শিক্ষিত এবং তিনি ছিলেন সেই সময়কার বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃ স্থানীয় লোক। ১৯০৬ সালে তিনি "সাধনা প্রেস" প্রতিষ্ঠা করেন ও তার সম্পাদনাতেই "যুগান্তর" পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।

পাশের ঘরটি স্বামীজীর পড়ার ঘর। এখানেই তাঁর বুদ্ধ দর্শন হয়েছিল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছাত্রাবস্থায় স্বামীজীর বাড়িতে এলে এই ঘরটিতেই বসে পড়াশুনা করতেন। পাশেই বাবা বিশ্বনাথ দত্তের বৈঠকখানা। নানা আকারের হুঁকো সাজিয়ে রাখা। এই ঘরটিতেই স্বামীজী হুঁকো খেয়ে জাত যায় কিনা পরীক্ষা করেছিলেন।
বারান্দায় বাঁক নিতেই বাবা বিশ্বনাথ দত্তের চেম্বার। সাজিয়ে রাখা বাবার ব্যবহার করা চেয়ার টেবিল। আছে কোর্টে ব্যবহার করা কোট। আছে কিছু আইনী ব‌ই।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে বাবা- মায়ের শোবার ঘর। দুপুর বেলা বিশ্বনাথ দত্ত এই ঘরটিতে বিশ্রাম নিতেন। মা ভুবনেশ্বরী দেবী তখন দোতলায় বিপরীত দিকের ঘরটিতে থাকতেন ।
নিচে বিশ্বনাথ দত্তের ঘরের পাশে সিঁড়ি কোঠা ঘেষে পূজো পার্বনের জায়গা। ওখানেই স্বামীজীর তত্ত্বাবধানে মা ভুবনেশ্বরী দেবী ১৯০১ সালে জগদ্ধাত্রী পূজো করেছিলেন। বেলুড়ের অনেক সাধু নিমন্ত্রিত হয়ে প্রসাদ পেয়েছিলেন সেদিন।
পাশ ঘেষে বেরিয়ে যেতেই সবশেষ কোঠা, বোধন ঘর। সম্ভবত এই ঘরেই জগদ্ধাত্রী মায়ের বোধন করা হতো। স্বামীজীর ঠাকুর্দা দুর্গাপ্রসাদ দত্ত সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করার বারো বছর পর একবার বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। এই ঘরটিতেই তিনি সেইবার তিন রাত্রি বাস করেছিলেন।

বোধনঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই খোলা আকাশ। আমরা সংগ্রহশালার বাইরে চলে এসেছি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কি করে যে তিন ঘন্টা কেটে গেল ,নিজেরাই বুঝতে পারিনি। একটা পরম তৃপ্তি নিয়ে আমরা দুজনেই বেরিয়ে এলাম। নাতাশা জিজ্ঞেস করলো, এবার কোথায় যাবে ?
বললাম, আজ আর কোথাও না। যা দেখলাম, যা অনুভব করলাম আজ শুধু সেইটুকুই রোমান্থন করতে চাই।

সুপ্রদীপ দত্তরায়
(দৈনিক গতি পত্রিকার ২৮শে মার্চ বিশেষ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত)

Comments