ধান বানতে শিবের গীত

ধান বানতে শিবের গীত - ২

বয়েসের সাথে সাথে মানুষের মন‌ও কেমন যেন বুড়িয়ে যায়। একটা অলস ভাব সব সময়েই মনের মধ্যে কাজ করে। চলা ফেরা খাওয়া ঘুম সব কিছুতেই শ্লথ গতি। বন্ধু বান্ধবীদের সংখ্যাও ক্রমেই কমে আসতে থাকে। কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে। হয়তো তাই অধিকাংশ সময়ই কাটে অতীত নিয়ে জাবর কাটায়। আমারও এখন এক‌ই অবস্থা। চাকরিতে অবসর নেবার পর এমনিতেই ব্যস্ততা কমে গেছে তার উপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া কোরোনা আতংক। এখন তো প্রায় সবারই ঘরবন্দি জীবন। কাজের মধ্যে দুটোই, টিভি দেখা আর অতীতের স্মৃতিতে ডুবে থাকা। আপনি বলবেন, "ধুর মশাই কি সব আবোল তাবোল বলছেন, আপনাকে দেখে তো মনেই হয় না, শুধু শুধু আপনি বললেই মেনে নিতে হবে নাকি ?" আমি তখন মুচকি হেসে বলি, আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, যা বলছি তার সবটাই সত্যি।
এই যাঃ, ধান ভাঙ্গতে গিয়ে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে যে। এই মুহূর্তে যে প্রসঙ্গ নিয়ে আজ কথা বলবো ভেবেছিলাম, সরাসরি সেখানেই চলে যাওয়া বাঞ্ছনীয়, নয় কি।

আজ কয়েকদিন থেকেই আমার ছোট্ট বেলার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছিল। আমার তখন বয়েস কত হবে, আট থেকে দশ । বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অল্প কিছুদিন আগের কথা। সীমান্তের খুব কাছেই থাকতাম আমরা । ওই সময়ে সব সময়ই সেনাবাহিনীর ঘনঘন আসা যাওয়া চলছিল শহরের পথে ঘাটে, যখন তখন। যুদ্ধ যদিও বাঁধেনি তবু পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে। 
আমাদের বাড়ির সামনে কিছুটা খালি জায়গা ছিল। খুব বিশাল নয়, তবে অনেকটাই। আমরা পাড়ার সমবয়সী বেশ কিছু ছেলেরা মিলে ওখানেই ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম।। ওই সময়ে ফুটবল দেখতে অন্যরকমের ছিল এখনকার মতো নয়। ভেতরে ব্লাডার, বাইরে অল্প জায়গা জুড়ে লেইস ফিতা বাঁধা। সাইকেলের পাম্পার দিয়ে ফোলাতে হতো।। চামড়ার টুকরো গুলোও এখনকার মতো ছয়কোনা নয়, টি- সেইপ। মাঝে মাঝেই ব্লাডার লিক হয়ে যেত। আমরা তখন সাইকেলের দোকানে নিয়ে লিক বন্ধ করতাম। অল্পস্বল্প চামড়া ছিঁড়ে বা ফেটে গেলে সেলাইও চলতো বটে।

তা সেদিন আমরা বন্ধুরা মিলে চুটিয়ে ফুটবল খেলছি আর তখনই আমাদের-‌ই কারো পায়ে লেগে বলটি রাস্তায় চলে যায়, আর দুর্ভাগ্য কাকে বলে ! ঠিক তখনই একটা মিলিটারি ট্রাকের চাকার চাপে বলটি বিশ্রী ভাবে ফেটে যায়। আমাদের চাঁদা তোলা পয়সায় গরিবানা মতে কেনা ফুটবল, আরো একটা যে কিনতে পরবো তেমন আর্থিক সামর্থ‌ও নেই। স্বাভাবিক‌ কারণেই মনটা সবার‌ই খারাপ। মুখ শুকিয়ে গেছে। খেলা তো লাটে উঠলো। আমরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। আমাদের চিৎকারে ট্রাকের মিছিল গেল থেমে। গাড়ি থেকে নেমে এলো কিছু মিলিটারি। ওই বয়সে পুলিশ, মিলিটারি নিয়ে এমনিতেই মনে একটা ভয় কাজ করতো। তার ওপর একসঙ্গে বেশ কয়েকজন মিলিটারি এগিয়ে আসতেই সবাই ভয় পেয়ে গুটিসুটি। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। সাহস করে এক জায়গাতেই গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিলিটারিগুলো প্রথমে আমাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করলো, তারপর উপায়ান্তর না দেখে নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে লাগলো। তাদের বক্তব্য ছিল গাড়িতো রাস্তায় ছুটবেই, বল কেন রাস্তায় আসবে। চলতি গাড়ির নিচে বল এলে সেই বলতো ফাটবেই। তাতে গাড়ির কি দোষ। আমরা বললাম, যদি বলের পরিবর্তে মানুষ একজন চাকার নিচে চাপা পড়তো, তাহলেও কি গাড়ির কোন দোষ ধরা হতো না। যখন জমিয়ে ঝগড়া চলছে তখনই একজন কমান্ডার বা ওই জাতীয় কেউ -- মনে হলো উনিই টিম লিডার গাড়ি থেকে নেমে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন কি সমস্যা হয়েছে । আমরা সবটাই খুলে বললাম। উনি মধ্যস্থতা করে বলটি সেলাই করার জন্যে সামান্য পয়সা দিতে সম্মত হয়ে গেলেন, তবে খুবই কম। অবশ্য এছাড়া উনার আর কোন উপায় ছিল না তখন। পাড়ার দাদারা ততক্ষনে জমতে শুরু হয়ে গেছে। আমরা দাবি করলাম বলের পরিবর্তে নতুন বল‌ই চাই। কেউই জায়গা ছাড়তে রাজি ন‌ই। না আমরা, না মিলিটারিরা। তখন হঠাতই ওদের মধ্যে থেকে একটা সিপাহি এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিয়ে বললো যে সে পরেরদিন ফেরার পথে নতুন বল দিয়ে যাবে। আমরা খুব খুশি। ফাটা ফুটবলটা নিয়ে ট্রাকগুলো চলে গেল গন্তব্যে, আমরা বিজয়ীরা ফিরে এলাম যে যার ঘরে। সেদিনের জন্য আমরা তখন হিরো। পাড়ায় আমাদের সাহসিকতা নিয়ে খুুব আলোচনা চলছে। বেশ খানিকটা প্রশংসাও পেলাম, খুব খুশি।
পরদিন সকাল থেকেই আমরা পালা করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, কখন গাড়িগুলো ফিরবে আর আমরা ফিরে পাবো আমাদের বল। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে যারা দেশ রক্ষায় জীবন বাজি রেখেছে তারা কোন অবস্থাতেই দেশের লোকেদের সাথে কথার খেলাপ করতে পারে না। আমরা জানতাম তারা ফিরে আসবেই।
কিন্তু, দিন যায়, মাস যায় বছর ঘুরে আসে। দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পেরিয়ে গেল কিন্তু সেই সেপাই আর তাদের গাড়ি আর ফিরে আসে না। দিনের পর দিন দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিতি বিরক্ত হয়ে একদিন আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা আবারও মাঠে ফিরে গেলাম। সেই ফুটবল আর ফেরত পেলাম না।

আজ সকালেই খবরের কাগজে হেড লাইন "সুপ্রিমে আটকে গেল কৃষি আইন .... ।" আমি তখন মনকে বোঝাতে চেষ্টা করছি, কিন্তু বাস্তবিক‌ই আমি যে তখন বাকরুদ্ধ !

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments