ধান ভানতে শিবের গীত (?) --১
বন্ধুরা, কেমন আছেন জানিনা। অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। এই মুহূর্তে কারো বাড়িতে বসে আড্ডডা দিতে দিতে সোফার কোণা বসিয়ে দেব, সেই সৌভাগ্য তো নেই কোরোনা ভাইরাসের সৌজন্যে। যা কিছু যোগাযোগ এখন ফেইসবুকের পাতায়। আপনি একটি পোস্ট দিলেন আমি লাইক দিলাম, আবার আপনি যখনই আমার একটা পোস্ট দেখলেন তখনই আমার সেই ঋণটি শোধ করে দিলেন একটা "লাইক" কিংবা একটু বেশি হলে "ওয়াও" লিখে। আপনিও খুশ আমিও, হিসাব বরাবর। মন্দ কাটছিল না দিনগুলো। ঘরবন্দি জীবন, ভালো মন্দ খাবার সাথে ফেইসবুকে "লাইক" আর "ওয়াও"। ব্যস্ত জীবনে হঠাৎ পাওয়া একটা দীর্ঘমেয়াদী অবসর। মন্দ লাগছিল না মোটেই। মাঝে মাঝে থালা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে বেশ একটা দেশাত্মবোধক ভাবনা প্রচার-- রোমাঞ্চ লাগছিল। তখনও আমাদের তল্লাটে কোরোনার তেমন কোন প্রকোপ নেই। একটা মানসিক শান্তি, নিরাপত্তা বোধ, সরকারে আস্থা আর হাজার টাকার পাঁঠার মাংস খেতে খেতে মেকি আতঙ্ক। আমরা মেতে উঠলাম কবিতা পোস্ট, গান আর ফেইসবুক লাইভে। নিজেকে লাইভ রাখতে, সজীব রাখতে, সে এক দেখার মতো কুস্তি। অন্যের কথা বলছি না, সবটাই নিজের কথা, আমরা তখন ভার্চুয়াল জগতে ব্যস্ত বাসিন্দা। ঠিক ওই সময়ে প্রায় এক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্কে মাইলের পর মাইল হেঁটে, রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরেছিল বাড়ি, যাতে অন্তত মৃত্যুর আগে শয্যার পাশে তার প্রিয় মানুষটিকে দেখতে পায়। বাড়িতে কিন্তু দুবেলা খাদ্যের অনিশ্চিয়তা, তবুও। তাদের খালি পায়ে ফোস্কা পড়ে একাকার। পা ফেটে পিচের ওপর রক্তের আলপনা। আমরা তখন ভীষণ ব্যস্ত প্রতি সন্ধ্যায়। লোকের কথা কতটুকুই জানি, আমি লিখে চলেছি একটার পর একটা কবিতা। আর ঘনঘন মোবাইল খুলে দেখছি কটা লাইক আর কটা কমেন্ট জমলো ইনবক্সে। ভার্চুয়াল জগতের দোহাই দিয়ে আমার আরো একটা নিজস্ব জগৎ। আমি জানতেও পারলাম না আমার চোখের আড়ালে আমার নিজস্ব পৃথিবীতে এক আমূল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল । প্রচারের আলোতে আমার বিচার শক্তিটা খুবই দুর্বল, চোখে একটা রঙিন ভবিষ্যত। পেঁয়াজের দাম পঞ্চাশ টাকা ছুঁইছুঁই , কেনার ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, কিন্তু সোনার দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা সত্বেও বেচাকেনায় ভাটা নেই । অদ্ভুত দুটো সমাজ। কিটস নিয়ে কানাঘুষা, সম্প্রতি আরো একটা বিশাল ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি, একটার পর একটা রাস্ট্রায়ত্ব সংস্থা ব্যক্তি মালিকানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কৃষি থেকে দূরপাল্লার ট্রেন, সবকিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া। প্রশ্নপত্র ফাঁস, পঞ্চায়েত থেকে প্রশাসন, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি আর দুর্নীতির পাহাড়। যদিও সবটাই কানাঘুষা আর প্রচার মাধ্যমে ছোট্ট ছোট্ট বাইট সত্যি মিথ্যে জানি না, আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে প্রথম প্রথম বুুক কাঁপতো ভীষণ, এখন আর আঁতকে উঠি না। যা হলো সে ভালো নাকি মন্দ সে বিচার না হয় পরে হলো, আমাদের দৃষ্টির আড়ালে আরো কত কত অনুচ্চারিত পরিবর্তন হয়ে গেল , কেউ খবরই রাখলাম না। আমরা তখন ব্যস্ত নিজামউদ্দিন, সুশান্ত - রিয়া, আর কোভিডের পরিসংখ্যান নিয়ে।
গতকাল মান্নাদা একটি খুব সুন্দর গল্প বলেছিল আমায়। আমি চাই গল্পটা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে।
একদিন এক অমাবস্যা রাতে একটি লোক গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। গ্রামের রাস্তা তো আপনারা জানেন, একটু বসতি তারপরেই ঘন জঙ্গল, আবার একটু বসতি তারপরেই জঙ্গল । শহরের মতো দুধারে স্ট্রীট লাইটও নেই। তাছাড়া বাঁধানো রাস্তা তো নয় মোটেই, ভাঙ্গা, এবরোখেবরো। একে অমাবস্যা তার ওপর রাস্তায় কোন আলো নেই, তার সঙ্গে আছে নানান সাপ খোপের উপদ্রব, স্বাভাবিকভাবেই গ্রামবাসীরা রাতের বেলা খুব সাবধানে চলাফেরা করেন। তো লোকটা একা একা চলছে অন্ধকারের মধ্যে। হঠাৎ চলতে চলতে সে দুর্ভাগ্য ক্রমে একটা কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল। ঠিক যখন পড়ে যাচ্ছে তখনই তার হুঁশ হলো। সে বুঝতে পারলো ভয়ানক বিপদে ফেঁসে গেছে। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। সে তখন উপায় অন্তর না পেয়ে কুয়োর ভেতর থেকে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগলো। এমনিতেই রাতের বেলা গ্রামের রাস্তায় লোক চলাচল খুব কম থাকে, কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। সে তখন অনন্যোপায় হয়ে আপ্রাণ শক্তি দিয়ে চিৎকার করছে আর ভাবছে খুব শিক্ষা হলো । এখন এই কুয়োর মধ্যেই না অপঘাতে মৃত্যু হয়। অনেকক্ষণ পর আরো একটা লোক এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল। সে তখন লোকটার চিৎকার শুনে গ্রামের মানুষজন ডেকে এনে অনেক কষ্টে কুয়ো থেকে লোকটাকে তুলে আনলো।
কুয়োতে যা হয়, কিছু তো হাত পায়ের চামড়া উঠবেই, দুএক জায়গাতে হাড়ও ভেঙ্গেছে। তো লোকটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কি হে তুমি কি নেশা ভাঙ্গ করেছিলে ?
লোকটা বললো, বিশ্বাস কইরন ডাক্তারবাবু, আমার ইতা বদ অইভ্যাস নাই।
-- তাহলে তুমি কি কিছু দেখতে পেয়ে ভয় পেয়েছিলে ?
-- আইজ্ঞা না ডাক্তারবাবু ।
-- তাহলে তুমি রাস্তা ছেড়ে ওই কুয়োর পাশে গেলে কি করে ? কুয়োটি তো আর রাস্তার উপর আসেনি ? তুমিই গিয়েছো ওটার কাছে । কিন্তু তুমি ওখানে গেলে কি করে ?
তখন লোকটি অনেকটা মাথা চুলকে বললো, "আইজ্ঞা ডাক্তারবাবু আমি তো হাগেদি চাইয়া তেরা দেখাত আছলাম ।"
ডাক্তারবাবু তো অবাক। বললেন, কি আশ্চর্য, তুমি এই অন্ধকারে ভাঙ্গা রাস্তায় আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখতে দেখতে হাঁটছিলে ? তোমার তো ভাই আরো দুটো হাড় ভাঙ্গাই উচিত ছিল।
তো গল্পটা এতটুকুই থাক। মান্নাদাকে আমি সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারি নি।
কারণ তখন আয়নায় দেখছিলাম আমিই সেই লোকটা।
Comments
Post a Comment