যাপনকথা

সময়ের‌ও একটা সীমা থাকা উচিত । যদি ভালো সময় ঘড়ি মেপে এসেই চলে যেতে পারে, তবে বিপরীতে অন্যথা কেন ? সব কিছুতেই বিচার থাকা উচিত। আসলে লোকে যাই বলুক না কেন, সময়টাই এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে । যে ব্যাক্তিটি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন সময়কে নিয়ন্ত্রণে রাখার, তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ হীন বেসামাল । হয়তো বয়সের ভারে কিংবা অভিজ্ঞতার অভাব। সময় এখন ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন হয়ে কাঁধে চেপে বসেছে নিয়ন্ত্রকের । এখন আর অস্ত্র কিনতে হয় না তাঁকে। প্রকৃতির নিজের হাতেই অস্ত্র আছে । ইচ্ছে মতো শায়েস্তা করছে আকছার।

দুটো বছর আগেও ভাবতে পারিনি পৃথিবী এমন পাল্টে যেতে পারে । চেনা জগৎ, দৈনন্দিন ভাবনা, কল্পনা, হুটহাট চলা, কথা বলার বিষয়, কর্ম জীবনের ধারা এমনি আরও কত কি - এত দ্রুত পাল্টে যেতে পারে স্বপ্নেও ভাবানি কোনদিন । চেনা লোকগুলো অচেনা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ । অন্যের কথা থাক, নিজেই অচেনা হয়ে উঠছি পরিজনের কাছে । অসহায় যন্ত্রণায় হাত কামড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়, তবু হাত বাড়াতেই ভয় । লক্ষীন্দরের বাসর সাজাই অর্থহীন যত্নে ।

গতকাল ছোটবেলার বন্ধু অপু, ওয়াটস‌আপে জানিয়েছে, সুদীপ্তের অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল, অক্সিজেন চাই ভীষণ ভাবে। আঁতকে উঠেছিলাম । একসময়ে সুদীপ্ত আমাদের অক্সিজেন ছিল, আজ অক্সিজেনের অভাবে সে নিজেই মরণাপন্ন । মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল সহজেই । অপুকে ফোন করতেই বললে, "কার অবস্থা ক্রিটিক্যাল নয় বল্ । গতকাল ভাইঝির বরটা চলে গেছে আইসিইউ থেকে, আজ ভাইঝিটিও । ছ'বছরের একটা মেয়ে। নিজের কাছে এনে রেখে দিই সেই অবস্থা আমার কোথায় ? না, অর্থ কোন সমস্যা নয়, সমস্যাটা বয়েসের । নিজেকেই ভালো করে সামলাতে পারি না -- ।" কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয় । এই বয়সে এমনিতেই নানা রোগ শোকের বাসা, নতুন করে দায়িত্ব নেবেই বা কি ভরসায়।

অনিন্দ্য ফোন করেছিল আমেরিকা থেকে । বললে, কাকু, কোরোনা রোগী দেখাশোনা করতে পারে এমন কোন নার্সের হদিস জানা আছে কি তোমার ?
বললাম, কার জন্যে চাই রে?
বললে, বাবার জন্যে চাই যে ।
বলি, সেকি , কবে থেকে ?
 -- আজ তিন দিন ।
উৎকন্ঠা নিয়ে বলি, হাসপাতালে দিস নি ?
-- কি করে দেই বলো ? গতকাল টেস্ট হয়েছে, রিপোর্ট আসছে না। রিপোর্ট ছাড়া তোমাদের কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করতে চায় না , কি মুস্কিল বলো তো ?
তাইতো, রিপোর্ট ছাড়া কি করে ভর্তি করবে। এদিকে বৌদি প্যারালাইসিস, বিছানায় ‌‌। এবার দাদা যদি ঘরবন্দি হয়ে যায়, উপায় থাকবে না । 

অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছিলাম গতকাল । ‌‌ক্লাস শেষে কিছু টাস্ক দিয়েছিলাম ছাত্র ছাত্রীদের। বললাম, "আমাকে উত্তরগুলো ওয়াটস‌আপে পাঠিয়ে দিস, রাত্তিরেই চেক করে নেবো ।"সবাই মেনে নিল, শুধু একটা মেয়ে বাদে । বললে, "স্যরি, আমি পারবো না স্যার কিছুতেই ।"
বিরক্ত হলাম, প্রচন্ড বিরক্ত । পড়াশোনা এমনিতেই লাটে উঠতে চলেছে । যাইবা একটু চেপে ধরে চেষ্টা করছি নিজে, তাতেও আপত্তি । একটু রাগ করেই দুটো কথা শুনিয়ে দিলাম । কেঁদে উঠলো মেয়েটি । বললে, "গত পরশুদিন দিদি মারা গেছেন, গতকাল দিদির বর । একমাত্র ছেলেটা আইসিইউতে । বাড়িতে অবস্থাটা ভাবুন স্যার ।" নিজেকেই অপরাধী মনে হলো, স্তব্ধ হয়ে গেলাম মুহূর্তে । গলায় স্বর ফুটেছিল না তখন।

আজকাল চারদিকে ফিরে তাকানো যায় না, কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি । অপু, সুদীপ্ত, অনিন্দ্য বা সেই মেয়েটি এখন ঘরে ঘরে। ওদের খুঁজতে হয় না, চারপাশে একটু তাকাতে হয় শুধু । অমৃতেশ্বর, জয়িতা, দেবাশীষদা, মলয়মামা -- এরা সবাই ছিল আমার খুব কাছের লোক। অনেক সুখ দুঃখ, স্মৃতি জড়িয়ে ছিল ওদের ঘামমাখা শরীরে। এখন সবটাই শুধু স্মৃতি । অগুন্তি সব চেনা মুখেরা এখন চলে গেছে না ফেরার দেশে , শুধুমাত্র এই কদিনের মারণ ব্যাধিতে । বাড়ি থেকে বেরোনো যায় না, ঘরে বসে থাকারও উপায় নেই । শ্বাস নিতে হয় আবার নিতে গেলে ভীষণ কষ্ট, বাতাস ভারী হয়ে আছে মানুষের অসহায়তায় । কোণায় কোণায় চাপা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস মাকড়সার মতো জাল বাঁধছে শুধু । একটা উপায়, একটুখানি সান্ত্বনা নিয়ে কোন এক ফিনিক্স পাখি আসবে, শুধু সেই প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে মানুষ । এমনটাই অবস্থা ।

কিন্তু এমন তো ছিল না কিছুদিন আগেও । একবছর দুঃসময়ের শেষে ধীরে ধীরে ফিরছিল স্বাভাবিক জীবন। আবার ঠোঁটে হাসি, মনে আনন্দ আর জীবনে প্রাণ ফিরছিল । এবার তো উত্তরে আঙ্গুল তুলে বলতে পারি না , "ওরাই সর্বনাশের মূল ।"

তবু এখনও তর্জমা চলে, চলে রাজনীতি নির্দ্বিধায় অক্সিজেন নিয়ে, ভ্যাকসিন নিয়ে আর কিছু গিনিপিগদের ভাগ্য নিয়ে। এখনো সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, বারবার, বারবার । কিন্তু কতদিন ? এভাবে আর কতদিন চলতে পারে ? এত মৃত্যুর দায়ভার কার ? কেন স্বাধীনতার দীর্ঘ সাত দশক পর‌ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এত দুর্বল ? কেন ? কেন ? এবং কেন ? 

সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠান শেষে কাঁটা ছেঁড়া হয় দিন পঞ্জিকায় । এখানেও সমীক্ষা হোক । অবশ্যই হোক সমীক্ষা । নির্ধারিত হোক এযাবৎ সিদ্ধান্তগুলো কতকটা ভুল আর কতকটা সঠিক । কে কতটা নিজের বিবেকের কাছে সৎ একবার বিচার হোক , অন্ততঃ একবার। সবার‌ই জানা উচিত সমস্ত গেম প্লেন, লুক্কায়িত রহস্য, যদি কিছু থেকে থাকে জানা উচিত সবার। অন্ততঃ আগামী প্রজন্মের জন্যে তো অবশ্যই । আমরা সাধারণেরা যে ওদের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে আছি।

Comments