রাত নটায় ভুতের গল্প

আমার তিন তিনটে বোন - দীপা সুমনা, শান্তশ্রী প্রায়শঃ আমাকে কথা শোনায়, নানা প্রসঙ্গে গল্পছলে গল্প লিখতে বলে, বিশেষ করে ভুতের গল্প । ওদের খুব প্রিয় বিষয়, আমারও অবশ্যই। আসলে ওরা সরাসরি মুখে বলে, অনুযোগ করে, অনেকে কিছুই করেন না যেমন দেবব্রতদা । অপেক্ষায় থাকেন কখন পোস্ট করি। আমিও সেই মতো চেষ্টা করি তাই কিন্তু কিছুতেই কাগজ আর কলম এক করতে পারিনা।
 আপনারা ভাবছেন আমার লেখাতে বাহাদুরি, ওই জন্যেই ওরা এত করে বলে ? মোটেই না। আসলে ভুত বিষয়টিই এমন । ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি সবারই পছন্দ ভুত । প্রত্যেকেরই মনে কোন একটা জায়গায় ভুত নিয়ে একটা দুর্বলতা লুকিয়ে আছে, বোঝা যায় না । কিছুটা ভয়, আতঙ্ক সাথে কল্পনা আর কৌতুহল। যাদের গলা চড়িয়ে বলতে দেখি, সবটাই বুজরুকি, ভুত, আত্মা বলে কিচ্ছু নেই, তাদেরকেও আমি দেখেছি ভুতের গল্পের আভাস পেতেই দাঁড়িয়ে যেতে স্ট্যাচুর মতো । অনেকটাই আমার বাবার মতো । ভুতের সিনেমা হলেই খাওয়া নাওয়া বাদ দিয়ে টিভির সামনে বসে থাকা। বাড়িতে আমার আর আমার মেয়েরও এক‌-ই বদনাম আছে তবে বাবার মতো নয় । আমার মেয়ে তো ছোটবেলায় লেপের নিচে গুটিসুটি খেয়ে গা ঘেঁষে বসে বসে দেখতো সব সিনেমা । ভয়ে মুখ শুকিয়ে পাংশু অথচ শেষ না হওয়া অবদি ওকে সরানো যাবে না এতটাই ইন্টারেস্ট। এদিকে ভয়ে সেই রাত্রে আমার কাছ ছাড়া হবে না সে কক্ষনো। 
যাক যে কথা বলতে চাইছিলাম, এই যে এত "ভুত" প্রেম বা ভুত নিয়ে চর্চা, বা ভাললাগা, আমাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু এযাবৎ ভুত দেখিনি বা দেখার সৌভাগ্য হয়নি । খুব কম লোকই আছি যারা সরাসরি ভুত দেখেছি বা ওই বিষয়ে সরাসরি অভিজ্ঞতা আছে। ফলে আমরা যা বলি বা বিশ্বাস করি সবটাই শোনা কথা গল্পচ্ছলে, লোকমুখে। আর সেই কারণেই তৃপ্তি সহকারে গল্প শোনার পর কোথায় যেন একটা অবিশ্বাস দানা বাঁধে বারবার। মনে হয়, ধুর এমনটা কি হতে পারে নাকি কখনো ? বা সবশেষে হয়তোবা বলি, " যাঃ, বাজে কথা।" অথচ গলায় তেমন জোর থাকে না। 
 তার মানে কি ? ভুত আছে তো ? আত্মা আছে কি নেই ? আমি বলবো আছে, অবশ্যই আছে । আলো অন্ধকার, ভালো মন্দ, দিন, রাত্রি যেমন আছে তেমনি ভুত বা আত্মাও আছে । সে আপনি স্বীকার করুন আর নাই বা করুন আত্মা কিন্তু আছেই। 
এখন স্বাভাবিক প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই যে সব গাল গল্পের এই অশরীরী আত্মারা, তারা কোথায় থাকেন ? আমরা তো কখনোই দেখতে পাইনা, বুঝতেও পারি না তাহলে বিশ্বাস করি কি করে ! আসলে আমরা সবসময় সচেতন ভাবে লক্ষ্য‌ করি না আমাদের আশেপাশের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো কিংবা নজরে এলেও আমল দিই না বিশেষ । এক হিসেবে অবশ্য‌ই ভালো, ন‌ইলে হয়তো জীবনটাই আতঙ্কময় হয়ে উঠতো আমাদের ।
আমার এক বন্ধুর বৌকে বুঝিয়ে বলেছিলাম বিষয়টা । ও প্রথমে বিশ্বাস করতেই চাইছিল না । তারপর বাধ্য হয়ে বলেছিলাম, একটা এক্সটারনেল থার্মোমিটার‌ এনে দিচ্ছি, পরীক্ষা করে দেখে নাও না কেন ?
আমার কেন যেন মনে হয়েছিল ওখানে কিছু একটা আছে। মাস তিনেক পরেই শুনলাম, ওরা নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে চলে গেছে। আর ঠিক এই কারণেই আমি ওসব নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমার কথা মতোই আনিয়ে ছিল একটা এক্সটারনেল থার্মোমিটার । তারপরেই তো তুলকালাম কান্ড। রান্না ঘর, বাথরুম, ছাদে তিন তিন জায়গাতেই থার্মোমিটারে ইঙ্গিত দিচ্ছিল । ভয়ে সবার ঘুম উধাও । শেষের দিকে এতটাই ভয় পেয়েছিল যে ওর মনে হতো ঘাড়ের পাশেই কেউ দাঁড়িয়ে আছে একজন । আসলে ওরা খুব সেনসেটিভ হয়ে গিয়েছিল । সবসময়ে এক আতঙ্ক, আর ওদের নিয়ে যতো ভাববেন, ততোই ওরা আপনার আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করবে । শেষ মেষ‌ অগত্যা বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল ওদের । এখন শুনছি কাউন্সিলিং চলছে । বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব শেষ । আমি লজ্জায় আর সেই থেকে ওই মুখো হ‌ইনি আজ অবধি।
আমার এই বন্ধুটিকে আপনারাও চেনেন, আমি জানি । দীর্ঘদিন একসাথে কাজ‌ও করেছি । চাইলে ইনবক্সে নম্বর দিতে পারি, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন ।

ওদের কথা ছেড়ে দিন, এই যে আমরা প্রতিদিন ট্রামে বাসে ঘোরাফেরা করছি, কে জানে আমাদের ঠিক গা ঘেঁষেই বসে আছে হয়তো কোন এক কেউ ! কিংবা হয়তো বসতে গিয়ে দেখতে পেলেন জায়গাটা হালকা মতন গরম, মনে একটা খটকা লাগলো, একটু সরে পাশেই বসে পড়লেন কিন্তু কখনো ভেবে দেখলেন না কোনদিন, কারণ ছাড়া জায়গাটা গরম লাগলো কেন ? এমন‌ওতো হয় জানলার পাশে বসে আছেন, হঠাৎই নাকে এলো হালকা পোড়া গন্ধ । আশেপাশে ভালো করে খুঁজে দেখলেন কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না, এমন‌ও তো হয়। রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ব‌ই পড়ছেন কিংবা ফেসবুকে চ্যাট করছেন কারো সাথে, হঠাৎই কোন কারণ ছাড়া জানলার পর্দাটা দোলে উঠলো, চমকে উঠে তাকিয়ে দেখলেন কোথাও কিছু নেই। কারো কারো অভিজ্ঞতা আরো বাজে। এই যেমন আমার বন্ধুবর দেবপ্রিয়, আপনারা সবাই চেনেন, খুব পরিচিত লোক, ছোটবেলায় ওরা থাকতো লাশ ঘরের ঠিক পেছনটায়। এখন ঘরবাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ায় জায়গাটাই পাল্টে গেছে একেবারে । একসময়ে হাসপাতালের এই শেষ সীমানাতেই ছিল শহরের লাশঘর। দেবপ্রিয়রা থাকতো সেই লাশ ঘরের ঠিক পেছনটায় ভাড়া বাড়িতে । জেলায় যত অপঘাতে মৃত্যু হতো, সব লাশ এখানেই এনে হতো পোস্টমর্টেম। কাঁটা ছেঁড়ার শেষে হয়তো বেওয়ারিশ লাশগুলো পড়ে থাকতো দুই দিন তিন দিন কিংবা তারো বেশি, সনাক্তকরণের জন্যে। তারপর সরকার থেকেই সব ব্যবস্থা নিত, কিন্তু নিজের লোকেরা যেভাবে শেষ কাজটা করবে সেভাবে নিশ্চয়ই হতো না। আর তাই অতৃপ্ত আত্মাগুলো ভেগাবন্ডের মতো ঘুরে বেড়াতো আশেপাশেই । লাশ ঘরের পাশ ঘেঁষে একটা রাস্তা ছিল অম্বিকাপট্টিতে যাবার, সন্ধ্যার পর কেটে ফেললেও অনেক ডাকবুকো ছেলেকেও সাহস করতে দেখিনি ওই পথে যেতে। আমরাও যারা হাসপাতালের মাঠে খেলাধুলা করতাম, সন্ধ্যার আগেই ওখান থেকে চম্পট । গল্প শুনতাম একটা বুড়ি সাদা কাপড়ে ঢাকা আপাদমস্তক, হঠাৎ নাকি সামনে এসে বলে, " আমার ভীষণ তেষ্টা, শিগ্গিরি আমাকে জল এনে দে।" কখনো বা পিছু তাড়া করতো । বলতো, " এই কোথায় যাচ্ছিস ? এদিকে আয়, আমার পা'টা টিপে দিয়ে যা ।"
সবটাই শোনা কথা, আমার সাহস হয়নি কোনদিন, প্রয়োজন‌ও পড়েনি কখনো । তা সেই দেবপ্রিয়রা থাকতো সেই লাশ ঘরের পেছনেই ভাড়া বাড়িতে । টিনের চাল, আসাম টাইপ বাড়ি। ওরা তখন খুব ছোট । বাড়িতে প্রায়‌ই নানা উৎপাত, রাত হলেই সব শুরু হতো ক্রমে । রোজ হতো তা নয়, মাঝে মাঝে । মাঝে মাঝেই হঠাৎ রান্নাঘরের বাসনগুলো ঝনঝন করে মাটিতে পড়ে যেত, কিংবা হয়তো কলতলায় মধ্যরাতে কারো বাসন মাজার শব্দ। আবার কখনো মনে হতো কেউ যেন বারান্দায় হাঁটছে । দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলে কাউকেই দেখতে পাওয়া যেত না। সবচেয়ে বেশি হতো মধ্যরাতে টিনের চালে হঠাৎই লাশ ঘরের ওদিক থেকে পাথর ছুটে আসা। মাঝে মাঝে এমন‌ও হয়েছে একটুর জন্য কেউ বেঁচে গেলেন। তবে যত‌ই ভয় দেখাক, ওই বাড়িতে কারো কোন বিশেষ ক্ষতি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। 
থাকতে থাকতে ওদের‌ও অনেকটাই ভয় কেটে গিয়েছিল । শুধু যখন উপদ্রব হতো তখনই বাড়িতে সবাই গুটিসুটি, একদম চুপচাপ, কি জানি কি হয় । তারপর সকাল হতেই সব স্বাভাবিক । কিন্তু সমস্যা হলো বাড়িতে কোন আত্মীয় স্বজন আসতে চাইতো না, বিশেষ করে রাত্রিবাস তো কখনোই না। একবার তো -- । না থাক, যারা বিশ্বাস করেন না, ভাবছেন গালগল্প দিচ্ছি, একবার ফোন করে শুনে নেবেন গল্পটা, হাঁড় হিম হয়ে আসবে বলতে পারি গ্যারেন্টি দিচ্ছি। অনেক পূজা শান্তি করা হয়েছিল, লাভ হয়নি তারপর বাধ্য হয়েই বাধ্য হয়েই বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন কাকু - দেবপ্রিয়দের বাবা । তবে ইদানিং ওখানকার নতুন কোন গল্প শুনি না।
  (ক্রমশঃ)

হ্যাঁ, আত্মা তো আছেই । আমাদের শরীরের ভেতরেও আত্মা আছে আবার শরীর ছাড়াও আত্মা আছে অনেক । আমদের বিষয় ওই সব কায়াহীন অশরীরী আত্মা, আর আমার বিশ্বাস ওরা আছেই। এবং আছে বলেই হয়তো মাঝে মাঝেই এমন সব কান্ড ঘটে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনা। বিশ্বাস হচ্ছে না তো ? আচ্ছা আপনার দরজাটাতো খোলাই ছিল হঠাৎ বন্ধ হলো কি করে ? মনে হয় নি কখনো ? কিংবা মধ্যরাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঘুম ভাঙ্গতেই কোথাও কিছু নেই, এমন হয়েছে কখনো ? হয়নি ? অসম্ভব ! হয় আপনার ঘুম ভীষণ গভীর, কিছুই বলতে পারেন না, নয়তো আপনি খুব ভাগ্যবান । ভালো করে লক্ষ্য করুন আপনার ঠিক ঘাড়ের পাশেই গরম শ্বাস অনুভব করছেন কিনা ? না, ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই আপনার কোন ক্ষতি করবে না। যদি করার হতো তাহলে এতদিনে বুঝতে পারতেন। তবে সাবধানের মার নেই ! অযথা ওদেরকে বিরক্ত করবেন না অবশ্যই ।
আত্মা আছে কি এই নিয়ে বড় বড় শহরে অনেক কর্ম কান্ড চলছে । একদল ভুত পাগল লোক তো পাঁজি পুঁথি ঘেঁটে রাত্রিবেলা বেরিয়ে পড়েন ভুত ভুতনীর খোঁজে। এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে দেখেন কোথায় কারা আছেন । সঙ্গে থাকে রকমারি যন্ত্রপাতি । বিশেষ বিশেষ ক্যামেরাও আছে যাতে আবছা হলেও স্পষ্ট বোঝা যায় কেউ একজন আছেই। ওরা বলেন ঘোস্ট ওয়াক। আর ওদের ভাগ্যটাও তেমনি, কোন না কোন সময় ঠিক দেখা হয় যায়।
তা যাক ওসব বড় বড় মানুষদের কথা । আমার বিষয়টা হচ্ছে অন্য । আমি অতি সাদাসিধে ভুত বিশ্বাসী লোক । কখনোই সেচ্ছায় ওদের ক্ষেপাই না, ওরাও জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্টের মতো আমার কোন ক্ষতি কোনদিন করেনি । আর সত্যি বলতে কি বাপের দেওয়া একটাই প্রাণ বেঘোরে হারানোর একদমই ইচ্ছে আমার নেই । দুই একবার না জেনেই ফাঁদে পা দিয়ে দিয়েছিলাম অবশ্যই কিন্তু বরাত জোরে জোর বেঁচে গেছি। এবার ভাবছি নিজের অল্প বিস্তর অভিজ্ঞতা আর কিছু শোনা গল্প পরিচিত মহলে, সবার সাথে শেয়ার করবো যার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । বিশ্বাস করা না করা আপনাদের, তবে আমি বিশ্বাস করি । গল্পের স্বার্থে নামের দুই একটা অক্ষর একটু এদিক ওদিক হলেও যারা গল্পগুলো জানেন তারা ঠিক নিজেদের চিনে নিতে পারেন, আমার বিশ্বাস । 

 উপালির সাথে আমার মানে আমাদের পরিবারের পরিচয় প্রায় দুই দশক। একটু কম বেশি হতে পারে, তা কিন্তু আমাদের পারিবারিক আত্মিক সম্পর্ক অল্পদিনেই অনেকটাই ঘনিষ্ঠ। ওর সুবাদেই ওর মা বাবার সাথে পরিচয়, তারপর‌ বাড়িতে যাওয়া আসা। আমরা মেসো, মাসীমা ডাকতাম ওরাও আমাদের ঠিক ওভাবেই স্নেহ করতেন । মেসো একটু মেজাজী ছিলেন যদিও, তবে খুব আড্ডাবাজ লোক ছিলেন এই কথাটা সত্যি । কাপড় চোপড় টানটান ইস্ত্রি দেওয়া, আর সাদা । ময়লা কাপড়ে তার প্রচন্ড এলার্জি । সহজেই লোকের সাথে মিশতে পারেন । দেখা হলে নিজে থেকেই খোঁজ খবর নিতেন সবার । খুব বেশি চলা ফেরা করতে পারতেন না, শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন । মাঝে মাঝেই বাড়াবাড়ি হতো। অনেকেই অনেক ভাবে বুঝিয়েছে কিন্তু কিছুতেই সিগারেট ছাড়তে পারতেন না। আমিও অনেক বার বলেছি কিন্তু ওই একটা জায়গাতে একদম অনঢ়। আর একটা বিষয়ে মনের মধ্যে কষ্ট ছিল, মেয়েটাকে মন মতো পাত্রস্থ করতে পারছিলেন না । যখন‌ই দেখা হতো কথা প্রসঙ্গে প্রসঙ্গটি যথারীতি আলোচনায় আসতো। আমরা বুঝতাম তার মনে একটা কষ্ট কাঁটার মতো গেঁথে আছে। 
শিলচর যতদিন ছিলেন, দেখা সাক্ষাৎ হতো, তারপর কলকাতায় চলে যেতেই যোগাযোগ একটু কমে যায় কিন্তু যোগাযোগ ছিল। আমরা ভেবেছিলাম ব্যস্ত শহরে এই বয়সে মানিয়ে নেওয়া ওর পক্ষে হয়তো খুব কষ্ট হবে, কিন্তু দেখা গেল খুব অল্প দিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। কমপেক্সে অনেকগুলো ফ্ল্যাট বাড়ি। গেট পেরিয়েই ভিতরে এক পাশে সাজানো বাগান, অন্য পাশে একটা বড় পুকুর, আসলে ফিশারী । দুই জায়গাতেই বয়স্কদের বসার জন্যে জায়গা তৈরি করে রাখা। কলকাতায় আসার পর মেসো প্রায়‌দিন‌ই এখানে এসে বসতেন, বিশেষ করে ফিশারীর দিকটাতে । ওখানে বসে বসে সিগারেট খেতেন আর জলে মুড়ি ফেলে মাছের সাথে খেলা করতেন । চেনা লোক পাশ দিয়ে গেলে রক্ষা নেই । ডেকে খোঁজ খবর নেওয়া তার নিত্যদিনের কাজ । খেলা থেকে রাজনীতি, বাজার থেকে রান্নাঘর যার যে বিষয় প্রিয় ওই বিষয় নিয়েই আড্ডা চলতো ঘন্টাখানেক। আর অবসরে পরিবারের লোকজন এড়িয়ে চুটিয়ে চলতো সিগারেট। 
সেই মেসো যখন মারা গেলেন তখন ছিল মার্চ মাস। ইচ্ছে থাকলেও তক্ষুণি আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন সব কাজ শেষ, প্রায় বছর ঘুরতে চললো।
কমপ্লেক্সের গেটে এন্ট্রি করতে হয়। নাম ঠিকানা লিখছি, দারোয়ানটা জিজ্ঞেস করল, স্যার কোথা থেকে আসছেন।
বললাম, আসাম।
-- আমাদের কাকাও তো আসামেই থাকতেন, তাই না ?
দারোয়ানটা গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে চাইছে । আজকাল কার কি উদ্দেশ্য বলা যায় না। ভালো করে আপাদমস্তক দেখে বললাম, হ্যাঁ । তোমার বাড়ি কোথায় ?
-- নিলাম বাজার স্যার ।
-- ওঃ তাই বলো । তুমি তাহলে আমাদের ওদিকার‌ই লোক ?
একগাল হেসে বললো, কাকা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনি চলে যাবার পর বাড়িটাই কেমন যেন হয়ে গেছে।
পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ভালোই হলো, তুমি তো আমাদের ওদিককার‌ই লোক। একটু খেয়াল রেখো। আর আমার নম্বর তো এখানে লিখে দিয়েছি যদি প্রয়োজন হয় ফোন করে জানিও কিন্তু । আমি কেন যেন খুব ক্যাজুয়েল মন থেকেই কাজটা করেছিলাম, সত্যি সত্যিই যে প্রয়োজন পড়তে পারে আমার ধারণাতেই ছিল না ।
ওদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম সবাই যেন কেমন একটা বিধ্বস্ত হয়ে আছে। সবাই বলতে উপালি আর মাসীমা। বাড়িতে তো তৃতীয় কোন ব্যাক্তিই নেই । দুজনেই খুব চুপচাপ । মুখে খুব বেশি কথা নেই । আমি যাওয়াতে কতটা খুশি হলো বুঝতে পারলাম না । মেসোর ঘরটাতে টেবিলে সুন্দর করে ফটোটা সাজানো, সামনেই একটা ছোট্ট সুন্দর কৌটা । পাশেই একটা ফুলদানিতে কিছু তাজা ফুল। একটা সাদা সার্ট আর একটা ট্রাউজার হেঙ্গারে ঝুলছে। বিছানা চাদর থেকে টেবিল ক্লথ সব ধবধবে সাদা, টানটান করে পাতা। মেসো সাদা রঙ খুব পছন্দ করতেন। কাপড় চোপড়ের ব্যাপারে খুব সিলেকটিভ ছিলেন । যেদিন থেকে পরিচয় সেদিন থেকেই সব সময়ে ওকে সাদা কাপড়েই দেখেছি। তাও ইস্ত্রি করা কাপড়। হেঙ্গারে টাঙানো কাপড়গুলোও দেখলাম টানটান ইস্ত্রি করা। আসলে মানুষ চলে যায়, যারা থেকে যায় তাদের ভীষণ কষ্ট। প্রিয় মানুষটির এই স্মৃতি গুলো আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চায়। মেসোর ঘরটাতে ঢুকতে যাবো, নাকে এলো কড়া তামাকের গন্ধ । যেন একটু আগেই এখানে কেউ সিগারেট খেয়েছে। পাশেই এস্ট্রেতে আধপোড়া সিগারেট। আমার খুব অবাক লাগলো, এখানে কে সিগারেট খেতে পারে ।
ঘরে ঢুকতে যাবো, উপালি পেছন থেকে আমার হালকা ভাবে আমার হাত টেনে ধরলো। মনে হলো, ও চাইছে না আমি ওই কোঠার ভেতরে যাই। আমি আর ভিতরে যাইনি। দরজাতে দাঁড়িয়েই ফটোতে প্রণাম দিলাম।
 সেদিন অনেকটা সময় থেকেছি, কিন্তু কোথায় যেন ছন্দ পতন ঘটে গেছে, প্রাণ নেই। আমার এতদিন পরে আসাই কি কারণ ? হয়তো আরো আগেই আসা উচিত ছিল, কিন্তু সব চাওয়া তো সব সময়ে সম্ভব হয় না । সবচেয়ে আশ্চর্য লাগলো, এই যে আমি এতদূর থেকে গেলাম, ওরা কিন্তু আমাকে একবার‌ও থেকে যেতে বলেনি বা নিদেনপক্ষে এই ভর দুপুরে খাওয়ার কথাটা পর্যন্ত বললো না। অবাক লাগলো আমার। 
ফেরার পথে দেখলাম সেই দারোয়ানটি তখন‌ও গেটে পাহারা দিচ্ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। বললাম, চলি ।
-- আছেন তো কিছুদিন ?
বললাম, আপাতত এই সপ্তাহ ।
-- তাহলে আবার আসবেন স্যার । কেউ এলে ওদের মনটা ভালো থাকবে ।
বললাম, দেখি ।
সেবার আর সময় করে উঠতে পারিনি। তাছাড়া আজকের এই ঠান্ডা ব্যবহারের পর মনটাও নষ্ট হয়ে গেছে । যাওয়ার তাগিদটাই হারিয়ে ফেলেছি । আমার আর যাওয়া হলো না ওদের ওখানে, তার আগেই আমি ফিরে এসেছি শিলচর।
দিন পনেরো পর হঠাৎ একদিন একটা ফোন। বললাম, কে বলছো ?
-- আমি রিয়াদ স্যার, কলকাতা থেকে বলছি।
-- কে রিয়াদ ? ওই নামে তো আমি কাউকে চিনি না ।
-- আমি সানরাইজ এপার্টমেন্ট থেকে বলছি স্যার, রিয়াদ । সেই যে দাড়োয়ান -- আপনার সাথে পরিচয় হয়েছিল।
সানরাইজ এপার্টমেন্ট বলতেই সব মনে পড়ে গেল। বললাম, হ্যাঁ এবার চিনতে পেরেছি, বল - ।
-- আপনি কি চলে গেছেন স্যার ?
বললাম, হ্যাঁ, কেন বলতো ?
-- তাহলে থাক স্যার ।
বললাম, থাকবে কেন ? বল কোন কাজ ছিল কি ?
-- না, যদি কলকাতা থাকতেন, তাহলে বলতাম একবার আসতে ।
-- কেন ? কিছু হয়েছি নাকি ?
-- হ্যাঁ, কিছু তো একটা হয়েছে স্যার অনেকদিন ধরেই , কয়েকদিনের জন্য ওদেরকে যদি অন্য কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতেন --।
বললাম, আমি তো বলেছিলাম কিন্তু একবছর না হলে ওরা তো কোথাও যাবেন না বলেছেন।
-- এক বছর তো হয়ে গেছে স্যার ।
বুঝলাম, কিছু তো একটা হয়েছে। ন‌ইলে যেচে কেউ এভাবে ফোন করতো না । আমার এক বন্ধু থাকে কলকাতায়, ওদের ওখানে নয়, অনেকটাই দূর তবু তাকেই বললাম, একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানাতে। শিলচরে বসে এর চেয়ে বেশি আমি কি আর করতে পারি।
তারপর কেটে গেছে চার পাঁচ দিন। আমি প্রায় ভুলতেই বসেছি। হঠাৎই বন্ধুর ফোন এলো। যা শুনলাম রীতিমত ভয়াবহ। উপালি নাকি আজকাল স্বাভাবিক ব্যবহার করছে না।‌‌ অধিকাংশ সময়েই ঘরের মধ্যে থাকে । শুধু রোজ একবার উল্টো দিকের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনে। বাড়িতে দুজন মাত্র মহিলা, সিগারেট যে কে খায় ঈশ্বর‌ই জানেন ।‌ আরো একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, মেসো মারা গেছেন একবছরের উপর হতে চললো, কিন্তু এখনো রোজ নিয়ম করে ধোপাবাড়ি থেকে উনার কাপড় ধুইয়ে আনা হয়। প্রায়‌ই ওদের ঘর থেকে অদ্ভুত‌ সব শব্দ শোনা যায়। ফ্ল্যাটের লোকেদের ধারণা কিছু একটা সমস্যা আছে ওখানটায়।
এমন সব কথা শুনলে কার না ভাবনা হয় । বললাম, আমি তো দুমাস পর এমনিতেই আসছি । এই মুহুর্তে আসাটা কি খুব জরুরী ?
 -- হ্যাঁ, এলে ভালো হয় বন্ধু।
এরপর আর কোন কথা চলে না । নেকস্ট এভেইলেবল ডেটেই টিকিট কেটে নিলাম। একবার রিয়াদকে ফোন করা প্রয়োজন। দুবার ফোন করেও সেই রাত্রে যোগাযোগ করা গেল না । পাওয়া গেল পরদিন সকালে । প্রথমে কিছু বলতে চাইছিল না । তারপর যা বললো, সেটা শোনে গায়ে কাটা দেবার অবস্থা। বললে, উপালিদিদি আগেও দু'বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, আপনি যাবার পর এই কদিন আগে আবার । বরাট জোরে বেঁচে গেছেন। আমি তো চোখে চোখে রাখি । সোসাইটিতেও খুব আলোচনা হচ্ছে । ওরা থানায় খবর দিয়েছে। পুলিশ এসেছিল ।
বললাম, সেদিন বললে না কেন ? তখন‌ তখনই কিছু একটা ব্যবস্থা নিতাম ।
 বললে, প্রথম দেখাতেই কি ওভাবে বলা যায় স্যার ? একবার কষ্ট করে আসুন, নিজের চোখে দেখে যা ভালো মনে হবে একটা ব্যবস্থা নিন । 
বললাম, আমি আসছি, কয়েকদিনের মধ্যেই। এই কটা দিন একটু খেয়াল রেখো ।

এবার হোটেলে না গিয়ে সোজা ওদের ফ্ল্যাটেই উঠবো, মনস্থির করেছি । ভাইজাকে আমার কিছু কাজ ছিল, সেখান থেকে সরাসরি কলকাতা পৌঁছেছি তখন রাত্রি সাতটা দশ । সানরাইজ এপার্টমেন্টে যেতে যেতে আরো আধ ঘন্টা সময় লেগে গেল । গেটে যথারীতি রিয়াদ দাঁড়িয়ে । এগিয়ে এসে বললে, দিন স্যার আমি পৌঁছে দিচ্ছি ।
বললাম, তার আগে ব্যাপারখানা কি বলো ?
রিয়াদ কোন উত্তর দিল না, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে র‌ইল চুপচাপ ।
বললাম, তোমার ফোন পেয়ে এতদূর ছুটে এলাম অথচ এখন তোমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোচ্ছে না কেন ?
-- স্যার আমি বললে আপনি তো বিশ্বাস করবেন না, তাই --
-- বিশ্বাস যোগ্য হলে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবো, তুমি নিঃসংকোচে বলো --
রিয়াদ খুব ইতস্তত বোধ করছে বুঝতে পারছি । নিজের মুখে প্রথমেই না বলে বললে, আমি বলি স্যার, আপনি দুই তিন দিন এখানে থাকুন, নিজের চোখে সব কিছু দেখুন, তারপর না হয় বসে কথা বলি ।
-- কিন্তু কি দেখতে হবে মানে লক্ষ্য করতে হবে তার একটা হিন্টসতো দেবে --
-- সব কিছুই দেখবেন স্যার ।একটু চোখ কান খোলা রাখবেন, তবেই হবে। দিন আপনার স্যুটকেশ আমি পৌঁছে দিচ্ছি ।
আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই রিয়াদ আমার লাগেজ তুলে নিল হাতে । হালকা একটা স্যুটকেশ, আমি নিজেই নিয়ে যেতে পারতাম তবু ওর আগ্রহে আপত্তি করলাম না।
গেট ছেড়ে সবে এপার্টমেন্টের দিকে এগুচ্ছি হঠাৎই পিছন থেকে খুব চেনা গলায় কেউ যেন ডেকে উঠলো, দেবপম --
চমকে উঠলাম, কে ডাকলো আমায় । মনে হলো ওপাশের পুকুরের পাড় থেকে কেউ ডেকেছে আমাকে । গলাটা খুব চেনা ! মেসো নয় তো ? কি করে সম্ভব ? মুহুর্তে সারা শরীরে একটা শিহরণ উঠলো । একসাথে অনেক গুলো প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করছে । তবু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফিরে তাকাতে যাচ্ছি, রিয়াদ একঝটকায় আমার হাত চেপে ধরলো । বললে, একদম‌ই পেছনে তাকাবেন না স্যার । সোজা এগিয়ে চলুন ।
আমি প্রচন্ড শক্ড । ওকে যে ফিরিয়ে প্রশ্ন করবো 'কেন' সেই সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছি । বাকিটা পথ একটা ঘোরের মধ্যে কাটলো । মুখে কোন শব্দ নেই দুজনের । যেন বাতাস এসে থমকে গেছে এখানটায় ।
উপালিদের দরজায় স্যুটকেশ নামিয়ে দিয়ে রিয়াদ নিঃশব্দে চলে গেল । মুখে কিছুই বললো না। ওকে দেখে মনে হলো না কিছু হয়েছে । মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন, এইটা কি কোন ষড়যন্ত্র ? কার হতে পারে, কি তার উদ্দেশ্য ? আমার মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছে ।

দরজা খুলে মাসীমা ভীষণ অবাক । কোন প্রকার খবর না জানিয়ে এসেছি । বললাম, কয়েকদিন থাকবো ।
-- বেশ তো বাবা থাক না কিছুদিন, তোমার নিজের‌ই তো বাড়ি ।
উপালি ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে । বললাম, ব্যাগটা কোথায় রাখি বলতো ?
উপালি এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললেন, ওটা তুমি আমার ঘরেই রেখে দাও ।
-- আর তুই ?
উপালি হাসলো । বললে, কেন ? ভাই বোন একঘরে থাকা যায় না ? তারপর নিজে থেকেই বললে, দাও, আমার কাছে, আমি নিয়ে যাচ্ছি ।

হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হতে মিনিট দশেক । ফিরে এসে দেখি চা তৈরি । আড়চোখে দেখলাম এককাপ চা মেসোর ফটোর সামনেও দেওয়া হয়েছে । এই প্রাকটিশটা আমি আমার কলকাতায় মাসতুতো বোনদের বাড়িতেও দেখেছি । ওরা দিনের প্রথম খাবারটা মেসোমশাইএর ফটোর সামনে দিয়ে তারপর খায় । আসলে এইসব ছোটখাটো কাজগুলোর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টা ।
উপালি হাতে একটা থলি নিয়ে বেড়োবে যাচ্ছিল । বললাম, আজ রাতে শুধু ডাল আর ডিম ওমলেট খাবো ।

রাতে খাওয়া শেষ হলে উপালিকে বললাম, চল একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি । 
আসলে রোজকার অভ্যাস, ভাত খাওয়ার পর একটা সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে হয় । ছাদের একটা কোনে দাঁড়িয়ে আছি । সামনেই সদর রাস্তা । একপাশে গোছানো বাগান, অন্য পাশে একটা বড় পুকুর । আসলে ওটা একটা ফিশারী, তবে লোকে ওটাকে পুকুর বলেই জানে । দুপাশেই সুন্দর বসার ব্যবস্থা করা । পুকুর পাড়ের ওদিকটা মেসোর খুব প্রিয় । বিকেলবেলা সময় সুযোগ পেলেই একটা বেঞ্চে গিয়ে বসতেন । উপালিকে দেখলাম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওই পুকুরটার দিকে ।
দুজনেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ কারো সাথে কারো কথা নেই , শ্মশানের নিস্তব্ধতা । নীচে পায়রার খোঁপগুলো থেকে টেলিভিশনের বিচিত্র সব আওয়াজ । দূরে ঝিঝি পোকাদের বিরক্তিকর দল বেধেঁ ডানা নাড়ার শব্দ । ওকে একটু সময় দিলাম নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে । এই অবসরে নিজেকেও খানিকটা গুছিয়ে নিলাম ।
দেখতে দেখতে দুই দুইটা সিগারেট শেষ । কি দিয়ে শুরু করা যায় ভাবছি । উপালিও কেমন যেন চুপ করে গেছে । পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললাম, কি রে কিছু বলবি ?
-- তুমি আজকাল অনেক বেশি সিগারেট খাও ।
-- কেন ? তুই খাস না ?
-- ছিঃ দাদা --
-- তাই ? তাহলে রোজ রোজ কার জন্যে সিগারেট কিনিস ?
উপালি চমকে উঠলো । বললে, তোমাকে কে বললে ?
-- সে দিয়ে তুই কি করবি ? কথাটা মিথ্যে কিনা বল ?
উপালি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে । আমি বুঝতে পারছিলাম এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ওর পক্ষে অস্বস্তিকর । নিজের প্যাকেটটা আলতো করে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, নিবি ?
উপালি প্রচন্ড লজ্জায় আমার পাশ থেকে ছিটকে সরে গেল । বললে, না, না, দাদা, বিশ্বাস করো, আমি খাই না ।
-- লজ্জা করিস না --
এবার একটু বিরক্ত হয়েই বললে, বললাম তো আমি খাই না ।
-- তাহলে রোজ রোজ কার জন্যে সিগারেট কিনিস ?
উপালি আবার চুপ করে যায় । আলতো করে পিঠে হাত রেখে বললাম, আমাকে খুলে বল্ । তোদের জন্যেই আমার এতদূর ছুটে আসা ।
-- তোমাকে নিশ্চয়‌ই সোসাইটি থেকে ফোন করেছে ।
-- না রে, রিয়াদ ফোন করেছিল ।
-- ওহ, রিয়াদা, ছেলেটা সত্যি ভালো । ওর জন্যেই আমি দুই দুই বার প্রাণে বেঁচে গেছি ।
বললাম, শুনেছি । কিন্তু কেন এসব করিস বলতো ? তোর কিসের অভাব ? একবার‌ও মাসীমার কথা মনে আসে না তোর ?
-- আমি তো ইচ্ছে করে করি না দাদা, বাবা আমাকে ডাকে যে !
খুব বিরক্ত লাগলো । বললাম, আজেবাজে কথা বলিস না ।
-- সত্যি দাদা, বিশ্বাস করো । উপালির গলার একটা অদ্ভুত‌ আকুলতা । আমার দিকে ফিরে দাঁড়াতেই দেখি ওর দুচোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল ঝরছে । একটা অসহায় মুখ । খুব মায়া হলো, মুখে কথা সরছিল না ।
একটু সময় নিয়ে বললাম, স্যরি, মনে কিছু নিস না । আসলে তোর কথাগুলো আমি বিশ্বাস করলেও অন্য কেউই বিশ্বাস করবে না ।
-- কেন রিয়াদা নিজের চোখে দেখেছে । এবার আমার চমকে ওঠার পালা । মুহুর্তে মনে পড়ে গেল গেটের সেই ঘটনা । শিঁউড়ে উঠলাম । তাহলে আমি ঠিক‌ই শুনেছি । কাল সকালেই একবার রিয়াদের সাথে কথা বলতে হবে । উপালিকে কি বলি বুঝতে পারছি না । চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি ।
উপালি নিজে থেকেই বললে, চলো নিচে যাই । মা একা ।
-- এক মিনিট, তুই ঠিক ঠিক মেসোকে দেখেছিস ? না মানে ভুল‌ও তো হতে পারে ।
-- দেখেছি, তবে স্পষ্ট নয় ।
বললাম, তাহলে ? কোথাও ভুল‌ও তো হতে পারে , তাই না ? তাছাড়া দোষ তো তোদের‌-ই, যে চলে গেছে, তাকে যেতে দিতে হয় । এভাবে যে সকাল থেকে খাবার দেওয়া, রোজ রোজ কাপড় চোপড় ধুইয়ে দেওয়া -- এসব যত বেশি করবি ততই মনের উপর চাপ সৃষ্টি হবে । এখন থেকে ওসব বন্ধ কর ।
-- বন্ধ করলেই ভীষণ উৎপাত শুরু হয়ে যায় ।
-- বাজে কথা, ওসব মনের দুর্বলতা ।
-- না, দাদা, সত্যি ।
বললাম, যেমন --
-- সে তুমি বুঝবে না । চল, নিচে যাওয়া যাক ।

এই ধরনের সমস্যা কোনদিন নিজে মোকাবিলা করিনি । কাউকে যে বলবো, বিশ্বাস করবে না কেউ । অথচ যা দেখছি, সব কিছুই ধোঁয়াশা । নিচে নেমে এলাম ।
উপালিকে দেখলাম এক প্যাকেট সিগারেট আর একটা দিয়াশলাই মেসোর ফটোর পাশে রেখে দিল । পাশেই রাখা এস্ট্রেটা আরো একবার পরিস্কার করে দিল । তারপর আস্তে করে দরজা টেনে দিল ঘরে ।
আমাকে দেওয়া হয়েছে উপালির ঘরে থাকতে । মাসীমার ঘরে উপালি আর মাসীমা এক‌ই বিছানায় । যে যার ঘরে চলে এসেছি । আমি শুয়ে আছি বিছানায় । কিছুতেই ঘুম আসছে না চোখে । এখানে আসার পর যা কিছু দেখছি, শুনছি তার কোন কিছুর‌ই ব্যাখ্যা পাই না । ভেতরে ভেতরে অযথাই অশান্তি । শুধু শুধু একটা ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে । কিছুতেই ঘুম আসছে না । পাশের ঘরে উপালিদের কোন সাড়া শব্দ নেই । বোধ হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে । হঠাৎই একটা দুর্বুদ্ধি মাথায় এলো । নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম । উপালিদের ঘরের দরজা ভেজানো । কোন সাড়া শব্দ নেই । এখন‌ই সময় । আমি পা টিপে টিপে মেসোর ঘরে দরজা খুলে ভিতরে গেলাম । আমাকে বুঝতে হবে আসল রহস্যটা কি ?
খুব গোছানো ঘর, টিপটপ, ফিটফাট । ঘরে তাজা ফুলের গন্ধ । একটা সাদা পাট ভাঙ্গা সার্ট আর পাজামা হেঙ্গারে ঝুলানো । ফটোটা জ্বলজ্বল করছিল, যেন আমাকেই লক্ষ্য করছে । একবার চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলাম, তাকানো যাচ্ছিল না । ফটোর সামনেই একটা সুন্দর কাঁচের কৌটা, ভেতরে সাদা সাদা কি সব জিনিস । হাতে নিয়ে দেখলাম মুখটা মোম দিয়ে সীল করে রাখা ।একটু যেমন কেমন কেমন লাগলো । খুলতে গিয়েও খুললাম না, জায়গাতেই রেখে দিলাম । আসার সময়ে কি মনে হতেই টেবিলে রাখা সিগারেট প্যাকেট আর দিয়াশলাইটি পকেটে পুরে নিলাম । 
সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই । রাত তখন কটা বলতে পারবো না । হঠাৎই মনে হলো কেউ যেন আমাকে ডাকছে ।
-- আমার সিগারেট, দেবপম আমার সিগারেট -- । চমকে উঠলাম। মনে হলো কেউ যেন আমাকে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে । আমি স্পষ্ট একটা ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করছিলাম । ভয়ে ভয়ে চোখ খুলতেই রক্তে একটা ঠান্ডা বিদ্যুৎ বয়ে গেল । চোখ খুলে তাকাতে পারছিলাম না ভয়ে । আমার ঠিক গা ঘেঁষে উনি কে ?সাদা সার্ট, সাদা ট্রাউজার -- একটা ধোঁয়াশে চেহারা -- মেসো নয় তো ? হাতে পায়ে শক্তি চলে গেছে । বুক শুকিয়ে কাঠ । ঘুম নিমেষে উধাও । এক মুহুর্তে ভেবে নিলাম কি করা উচিত । এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিলাম অনেক দূরে । নিরাপদ দূরত্বে এসে চোখ খুলে দেখি কোথাও কিচ্ছু নেই । সবটাই মনের ভুল । মনে মনে হাসলাম, দুঃস্বপ্ন ।
এক গ্লাস জল খেয়ে আবার বিছানায় শুতে যাবো, ঠিক তখুনি মেসোর ঘর থেকে জোরে একটা আওয়াজ এলো । মনে হলো কিছু একটা পড়ে ভেঙ্গে গেছে। ছুটে বেরিয়ে এলাম বাইরে । মেসোর ঘরের সামনে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই উপালি মাসীমা দুজনেই এসে হাজির । ওরাও শব্দটা শুনতে পেয়েছে । উপালির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে । আমি দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই উপালি হাত টেনে ধরলো । বললাম, ভয় পাস নে, আমাকে একটু দেখতে দে ।
এক ঝটকায় দরজা খুলে দিতেই অবাক কান্ড কোথাও কেউ নেই । শুধু টেবিলের ফুলদানিটা মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে আছে । ঘরের ভেতরটা ভালো করে আরো একবার দেখলাম । হেঙ্গারে ঝুলানো সার্ট কাপড় মাটিতে, বাকি সব ঠিক ঠাক । জানালায় পর্দা সরিয়ে দেখতেই নজরে এলো একটা পাট খোলা । মনে মনে হাসলাম, শুধু শুধু ভয় পেয়েছি । বললাম, দেখলি তো, জানলার পাট খোলা, বিড়াল বা কিছু হয়তো ঢুকে ছিল ঘরে, আর তোরা শুধু শুধু -- ।
বললাম, যা শুয়ে থাক । কাল সকাল বেলা কাঁচের টুকরো গুলো পরিষ্কার করে নিস। ঘর থেকে বেড়িয়ে দরজা টানতে যাবো, হঠাৎই টেবিল থেকে এস্ট্রেটা উড়ে এসে পায়ের কাছে পড়লো । এবার কিন্তু সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম । অল্পের জন্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো । প্রচন্ড প্রচন্ড ভয় লাগলো । পা দুটো যেন পাথর হয়ে গেছে । টেনে সরাতে পারছি না । মাসীমা সঙ্গে সঙ্গেই ঝাড়ু আনতে ছুটলেন । উপালি চিৎকার করে উঠলো, বাবার সিগারেট ।
ভয়ে, লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিলে যাবার অবস্থা । আমার জন্যেই এই এতসব কান্ড । না বলে সিগারেট প্যাকেট পকেটে ঢোকানো তো চুরির পর্যায়ে পরে । উপালির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না । পকেটে থেকে আলতো করে সিগারেট প্যাকেট আর দিয়াশলাইটি বাড়িয়ে দিলাম । উপালি তাড়াতাড়ি আরো একটা ফুলদানি এনে সাজিয়ে দিল টেবিলে । একটা নতুন এস্ট্রেও এনে রাখা হলো, সাথে সিগারেট আর দিয়াশলাই । বুঝলাম এই ধরনের ঘটনা আরো অনেকবার ঘটেছে তাই সব বন্দোবস্ত আগে থেকেই করে রাখা । দরজা টেনে যে যার ঘরে ফিরে গেলাম । সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি সেদিন । ভোর রাতে হয়তো একটু চোখ লেগেছিল । ঘুম ভাঙ্গলো উপালির ডাকে ।চোখ খুলে দেখি ও চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ওকে বসতে বলে, একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম । ফিরে এসে দেখি বিছানা তোলা শেষ । 
আমাকে চা ধরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল উপালি । বললাম, একটু বস ।
-- কিছু বলবে ?
-- হ্যাঁ, কালকের ঘটনাটির জন্যে আমি সত্যি লজ্জিত রে । আমি বুঝতেই পারিনি এমন একটা কিছু --- ।
উপালি হাতের ইশারায় আমাকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে বললে, আমি বুঝতে পারছি দাদা, প্লিজ ।

মনে মনে একটা ছক তৈরি করে নিয়েছি । একবার বাজারে যেতে হবে । রিয়াদের সাথেও একবার বসা দরকার । প্রয়োজনে বন্ধুকেও ডাকতে হতে পারে । আপাতত বাজারে যাবো মনস্থির করে কাপড় জামা পড়ছি এমন সময়ে একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন । 
কথা এগুতেই বোঝা গেল, সোসাইটির সেক্রেটারী । একবার কথা বলতে চান । বললাম, বিকেলে বসি ।
-- এখন কি খুব অসুবিধা হবে ? আমরা বেশ কয়েকজন ছিলাম --
বললাম, বেশ, দশ মিনিট । 
উপালিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম সেক্রেটারীর ফ্ল্যাটটি কোথায় ।
-- তোমাকে ডেকেছে ?
বললাম, হ্যাঁ ।
-- কেন ? উপালির চোখে মুখে উৎকন্ঠা ।
-- জানি না রে । দেখি কি বলে ।

সেক্রেটারী, প্রেসিডেন্ট সবার সাথেই কথা হলো । ভালো কথা কেউই বললেন না । ওদের ধারণা উপালি মানসিক ভাবে অসুস্থ । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই কথা, 'ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিন ।
মিনিট ত্রিশ ধরে এক‌ই কথা বারবার শুনতে শুনতে বললাম, দেখুন আমি রক্তের সম্পর্কে ওদের কেউ ন‌ই কিন্তু নিজের ছেলে বা ভাইএর মতো ওরা আমাকে দেখেন, তাই বুঝতেই পারছেন শেষ কথা বলার আমি কেউ ন‌ই । তবে আমার তরফে যতটুকু দেখার আমি দেখবো ।
সোসাইটি থেকে জানিয়ে দিলেন ওরা কোন দায়িত্ব নিতে পারবেন না । মনে মনে হাসলাম, কতটা দায়িত্ব ওরা পালন করছেন সেতো বোঝাই যাচ্ছে । বেরিয়ে এলাম।

বাজারে যাবো ভেবেই বেরিয়ে ছিলাম, গেটের রিয়াদের সাথে দেখা হয়ে গেল। বললাম, তোমার সাথে আমার কিছু কাজ ছিল যে । কখন ফ্রি থাকো, মানে ডিইটি থাকে না ?
-- এইতো এখন‌ই অবসর আছি স্যার , বিকেলে চাইলে বিকেলে --
বললাম, বেশ তো চল কোথাও বসা যাক । একটু নিরিবিলি হলেই ভালো ।
--- পুকুরের ওদিকটায় বসবেন ? যেখানে কাকু বসতেন ? জায়গাটা খুব সুন্দর, আপনার ভালো লাগবে স্যার ।
বললাম, বেশ চলো ।
দুজনেই এসে বসলাম সেই বেঞ্চটার পাশেই আরো একটা বেঞ্চে । বেশ খানিকটা সময় নীরবেই কাটলো । সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে । বললাম, নাও --
-- না স্যার --
-- আহা লজ্জা পাচ্ছ কেন ? খাও --
রিয়াদ খুব সংকোচে একটা সিগারেট তুলে নিল । আগুন দিতে দিতে বললাম, তোমার কি মনে হয় ?
-- কি স্যার ?
-- এই যে এতসব ঘটছে --
রিয়াদ একটু সময় চুপ করে থাকলো । তারপর নিজে থেকেই বললো, আমার মনে হয় এটা ওই সব স্যার ।
বললাম, ওইসবটা কি খুলে বলবে তো ?
-- কাকুর জিন, আপনারা বলেন আত্মা ।
-- তুমি দেখেছো কখনো ?
-- দেখেছি স্যার ।
-- কি দেখেছো ?
তারপর রিয়াদ যা বললো, আমার সাধারণ বুদ্ধিতে তার কোন ব্যাখ্যা নেই । আমি রীতিমত হতভম্ব । এই সব ঘটনা কেন ঘটে, কি তার মোটিভ সত্যি বোঝা মুশকিল । সাধারণ ভাবে যা বুঝি হয়তো সবটাই ভুল । আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি দেখেছো ? তখন রিয়াদ বলল, তাহলে স্যার শুরু থেকেই বলি ?
বললাম, বলো ।
-- প্রথম প্রথম দিদিকে দেখতাম স্যার বিকেলের দিকে এখানটায় এসে বসতো । ওই যে বেঞ্চটা, যেখানে কাকু বসতেন ঠিক ওখানটায় । একা একা বসে থাকতো, কখনো নিজে নিজেই বিড়বিড় করে কথা বলতো, কখনো গুনগুন করে গান গাইতো, আমি দূর থেকে দেখতাম । সন্ধ্যে অবধি বসে নিজের খেয়ালেই ফিরে যেত ঘরে । বাপ মরা মেয়েটা, বুঝতেই পারছেন স্যার -- এখানে তো কোন আত্মীয় স্বজন নেই যার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারে, তাই হয়তো একা একা এখানে এসে বসতো । আমার হাতে ওই সময়ে কাজ খুব থাকে । সময় পেলে আমিও গিয়ে পাশে বসতাম, তখন খুব সুন্দর গল্প করতো দিদি । একদিন একা গেটে ডিউটি দিচ্ছি, সময়টা সন্ধ্যে হয় বা হয়ে গেছে, আপনি আসার মাস তিনেক আগে, দেখতেই পাচ্ছেন আমার ওখান থেকে এই জায়গাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । দেখলাম দিদি ওই জায়গাটায় বসে আছে ।
রিয়াদ আঙ্গুল তুলে সেই বেঞ্চটা দেখিয়ে দিল । বললাম, বেশ --
-- আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, দিদি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পুকুরের দিকে, আমি দেখছি, দিদি এগিয়ে যাচ্ছে, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা প্রচন্ড শব্দ হলো জলে । আমি ছুটে গিয়ে দেখি দিদি জলে ডুবে যাচ্ছে । সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিলাম। তারপর অনেক কষ্টে তুলে আনলাম দিদিকে । ততক্ষণে লোক জানাজানি হয়ে গেছে, অনেক লোক পাড়ে এসে জড়ো ।সবাই জানতে চায় কি ঘটেছিল । আমি ইচ্ছে করেই চেপে গেলাম সত্যিটা । বললাম, অন্ধকারে পা ফসকে গেছে । লোকেও তাই বিশ্বাস করলো । আমি কিন্তু সাবধান হয়ে গেলাম । আমি জানি এসব মানসিক রোগ, একবার যখন চেষ্টা করেছে তখন আবারো করবে । আবার, আবার যতক্ষণ না সফল হয়। আমি তাই দিদি এদিকটায় এলেই নানা অছিলায় আশেপাশে ঘোরাফেরা করতাম । আসলে কাকু আমাকে খুব স্নেহ করতেন । 
বললাম, তারপর --
-- একদিন কি একটা কাজে একটু অন্য দিকে গেছি আর সেদিনই আবার সেই কান্ড । চারদিকে চিৎকার চেচামেচি শুরু হয়ে গেছে । সবাই তো সাঁতার কাটতে জানে না । ছুটে গেলাম । জলে ঝাঁপিয়ে তুলে নিয়ে এলাম দিদিকে । আর ঠিক যখন ঘাট থেকে দিদিকে তুলে নিয়ে আমি উঠছি, আল্লা কশম, এই দেখুন আমার সব লোম এখন‌ও খাঁড়া হয়ে গেছে, আমি স্পষ্ট দেখলাম কাকু প্রচন্ড রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যেন খুন করে ফেলবেন । স্যার, আপনি বিশ্বাস করবেন না আমি দুই রাত্রি চোখ বন্ধ করতে পারিনি । আমি সত্যি সত্যিই দেখেছি ।
বললাম, তারপর ?
-- তারপর পরদিন দিদির ফ্ল্যাটে গিয়ে আচ্ছা বকাঝকা করলাম । কাকীকে ও বললাম, ওকে বেড়োতে না দিতে । আমি জানতাম দিদি সিগারেট খায় । প্রতিদিন তাই এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে বেড়োতে হয় । বললাম, এখন থেকে তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ । তোমার বাজার থেকে সিগারেট সব আমি এনে দেব । দিতাম‌ও স্যার রোজ নিয়ম করে ।
বললাম, তারপর ?
-- তারপর একদিন বাজার হাট করে দিয়ে মুর্শিদাবাদ গেছি নিজের একটা কাজে । সব মিলিয়ে দুই দিন ছুটি । যেদিন সকাল বেলা ফিরে আসার কথা কাজ শেষ না হওয়ায় আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল । আমি সবে ফিরেছি, গেটে দিদির সাথে দেখা । বুঝে গেছি দিদি সিগারেট আনতে যাচ্ছে । বললাম, দাও আমি এনে দিচ্ছি ।
দিদি বললে, থাক, লাগবে না। আমি তো এসেই গেছি । তুমি বরং কাল থেকে আবার এনে দিও । 
আমি আর গা করলাম না । দিদি যখন ফিরে যাচ্ছে -- ঠিক আপনাকে যে জায়গাতে গতকাল হাত টেনে ধরেছিলাম ঠিক ওখানে আসতেই কে যেন পিছন থেকে ডাকলো, " বুড়ি ---"
আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি । গলাটা খুব চেনা । দিদি চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো । আর তার পর‌ই আচ্ছন্নের মতো হাঁটতে লাগলো ওই পুকুরটার ওদিকে । আমি ওইদিকে ফিরতেই দেখি বেঞ্চের উপর সাদা ধবধবে সার্ট কাপড় পড়ে কাকু বসে আছে । আর ধীরে ধীরে দিদি ওইদিকেই যাচ্ছে । আমারও প্রচন্ড ভয় করছিল । কিন্তু কী একটা শক্তির জোরে আমি ছুটে গেলাম আমি নিজেও জানি না । পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরতেই দিদি দাঁড়িয়ে গেল । সামনে তাকিয়ে দেখি ওখানটাতে কেউ নেই । পরপর এসব ঘটনার পর আমার ধীরে ধীরে সাহস এসে গেছে । এখন আর আমি ভয় পাই না । এইতো গতবার আপনি যাবার পর আরো একবার চেষ্টা করেছিল । তারপর‌ই তো সোসাইটি থেকে তোড়জোড় শুরু হয়েছে, থানা পুলিশ কত কি । তবে ওদের জন্যে সত্যি ভাবনা হয় স্যার । 
আমি কোন উত্তর দিলাম না । রিয়াদ নিজে থেকেই বলতে লাগলো -- এখন আমি প্রায়‌ই দেখতে পাই । আমাকেও ডাকে, উত্তর দিই না । তিন তিনবার ডাকে, সাড়া না দিলে ওইদিন আর বিরক্ত করে না । আমি পরীক্ষা করে দেখেছি । আপনাকেও তো ডেকেছিল , মনে আছে ?
কি জবাব দিই রিয়াদকে । চুপচাপ আরো একপ্রস্থ সিগারেট জ্বালিয়ে বললাম, তুমি এখানে এমন কাউকে জানো যে আমাদের সাহায্য করতে পারে ।
-- না স্যার, তবে আপনি বললে খোঁজ নিতে পারি ।
বললাম, তাই করো ।আর একটু তাড়াতাড়ি । আমার ছুটি বেশি দিন নেই ।
বিকেলে রিয়াদ আমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, সেও জাতিতে মুসলমান । বললে, আজকে হবে না স্যার, আমাকে আগে ফোনে উনার অনুমতি নিতে হবে। যদি উনি অনুমতি দেন তবেই আপনাকে নিয়ে যাওয়া যাবে ।
বললাম, বেশ দেখো একবার চেষ্টা করে । পকেটে পাঁচশত টাকার একটি নোট গুঁজে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিল না । বললে, এসব কাজে পয়সা নেওয়া নিষেধ ।

সেই রাতটা নির্বিঘ্নে কাটলো । রাতেই রিয়াদ ফোন করে আমাকে সকালের প্রোগ্রাম জানিয়ে দিয়েছিল । শুধু যাবার সময় মেসোর ঘর থেকে কিছু একটা জিনিষ নিয়ে যেতে বললে ।
অনেক রাত অবধি ঘুম আসছিল না চোখে । অনেক অনেক ভাবনা, অনেক অনেক সমীকরণ কাজ করছে মাথায় । কিছুতেই কিছু মিলাতে পারছি না । রাত একটু গভীর হতেই তাজা তামাকের গন্ধ । বুঝতে পারছি আশেপাশে কেউ সিগারেট খাচ্ছে । চোখ বন্ধ করে মরার মত পড়ে র‌ইলাম ।কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি ।
ঘুম ভাঙ্গলো খুব সকালেই । সবার অলক্ষ্যে মেসোর ঘর গিয়ে এক টুকরো পোড়া সিগারেট এস্ট্রে থেকে তুলে নিলাম । উপালিকে শুধু বললাম, নিজস্ব একটা কাজে বাইরে যাচ্ছি ফিরতে অনেক দেরিও হতে পারে ।
মে লোকটার সাথে রিয়াদ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার নাম নিজাম । একটা বাইক নিয়ে দেখলাম সে আমার জন্যে গেটে অপেক্ষা করছে । ঘড়িতে তখন সাতটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি । বুঝলাম রিয়াদ যাচ্ছে না সঙ্গে । বাইকে চাপতেই গাড়ি ছুটলো ।
আমি আর নিজাম যাচ্ছি । কোথায় যাচ্ছি জানি না, কতটা কাজ হতে পারে তাও জানি না । এমনকি যার সাথে যাচ্ছি তার সাথে আমার একবার দেখায় মাত্র দশ মিনিটের পরিচয় । মানুষটি কেমন তাও তো জানি না । সে যে আমাকে কোন চক্রে ফাঁসাচ্ছে না তার‌ই বা নিশ্চয়তা কি । একটা দোমনার মধ্যে এগিয়ে চলেছি ।
এদিকে বাইক ছুটছে তো ছুটছেই । শহর ছেড়ে গ্রাম । রাস্তাও খুব একটা ভালো নয় । প্রায় দুই ঘণ্টা হতে চললো পথ আর শেষ হয় না । নিজাম ছেলেটা খুব কম কথা বলে । তিনটে প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দেয় । বললাম, আরো কত ?
-- দশ মিনিট ।
সত্যি সত্যিই মিনিট দশেক পর বাইক এসে দাঁড়ালো গ্রামের একেবারে প্রান্তে । অনেকটা ঝোঁপ ঝাড়ের মধ্য দিয়ে গিয়ে একটা উঁচু টিলা । তার উপর একপাশে একটা কালী মন্দির অন্যপাশে চারচালা মাটির ছোট্ট ঘর । আশেপাশে যতদূর নজরে যায় কোন বাড়ি ঘর নেই । পেছন দিকটায় একটা গ্রামীণ শ্মশান ।
বাইক থেকে নেমে নিজাম একটা কুঁয়ো থেকে জল নিয়ে হাত মুখে দিল । ওর দেখাদেখি আমিও তাই করলাম । তারপর মন্দিরের চাতালে গিয়ে দুজনেই প্রণাম করলাম । সে তার মতো করে করলো, আমি আমার মতো ।
আগে থেকেই বলা ছিল তাই একটা লোক এসে আমাদের বসতে বললে । মিনিট পনেরো পর একজন জটাধারী সাধু ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন । চেহারা দেখে বয়স বোঝা দায়। টানটান শরীর, পেশীগুলো টগবগ করছে। অথচ সাদা দাড়ি, মাথায় অনেকটাই সাদা জট । গায়ে অজস্র রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা জ্বলজ্বল করছে । দেখতেই বুকটা কেঁপে ওঠে । সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চোখ দুটো । রক্ত জবার মতো লাল টকটকে । দেখেই বোঝা যায় চব্বিশ ঘণ্টা মদের মধ্যে আছে । আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে সোজা মন্দিরে চলে গেলেন । আমরা বসে আছি অপেক্ষায় । পূজো শেষ হলে তবেই কথা বলবেন । 
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চললো পূজা । জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ চলছে আর তার ফাঁকে অল্প পরে পরেই ঢকঢক করে মদ খাচ্ছেন । যে লোকটা আমাদের বসতে বলেছিল, তাকে দেখলাম পাত্র খালি হ‌ওয়া মাত্র‌ই কারণসুধায় পূর্ণ করে দিচ্ছে । যত নেশা জমছে গলায় বাজখাঁই আওয়াজ ততই চড়ছে । আমরা ভয়ে ভয়ে দূর থেকে সব দেখছি । ছেড়ে আসার কোন উপায় নেই, আমাদের জন্যেই দিনের বেলায় এই বিশেষ পূজা । 
আশেপাশে জন মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই । একসময়ে খেয়াল হলো এখানে আসা অবধি কোন পাখির আওয়াজ শুনতে পাইনি । একটা সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু উপায় নেই ।
প্রথমে পূজা, তারপর যজ্ঞ সব শেষে ধ্যান । এক সময়ে আমাদের ডাক পড়লো । দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছি, উনি হাতের ইশারায় নিজামকে থামিয়ে দিলেন । আমাকে বললেন, হাত পা ধুয়ে এসেছো ?
বললাম, হ্যাঁ ।
-- বেশ, বসো ।
আমি আসন করে মুখোমুখি বসলাম । উনি কারন পাত্র বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাও গ্রহণ করো ।
সর্বনাশ ! সমুহ বিপদ। মদের সাথে কি কি মেশানো আছে ঈশ্বর জানেন । হাত জোড় করে বললাম, মাপ করবেন, আমার চলে না ।
-- কী ? চলে না ? এত বড় সাহস ? মায়ের প্রসাদের অসম্মান ? সেকি ভীষণ চিৎকার । ভয়ে আমার কাপড় চোপড় নষ্ট হয় প্রায় । কাঁদো কাঁদো স্বরে বিড়বিড় করে আবারও বললাম, বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি । আমার চলে না ।
উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে একদৃষ্টে । আমাকে বললেন, আমার চোখের দিকে তাকাও । আমি ভয়ে ভয়ে চোখের তাকালাম, তাকানো যায় না, ভীষণ কষ্ট হয়, তবু তাকালাম আর মনে মনে রিয়াদকে শাপ শাপান্ত করছি ।
দেখলাম শান্ত হলেন উনি । ঠান্ডা গলায় বললেন, মায়ের প্রসাদ না করতে নেই । কণা মাত্র গ্রহণ করে শরীর শুদ্ধ করো ।
ততক্ষণে আমার শরীরে প্রতিবাদ করার শক্তি চলে গেছে । ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম । উনি একবিন্দু কারণবারি দিয়ে বললেন, নাও খেয়ে নাও ।
তারপর হাত বাড়িয়ে বললেন, ওই বস্তুটা দাও ।
আমি বাধ্য ছেলের মত পকেট থেকে আধ পোড়া সিগারেট বের করে দিলাম । উনি প্রথমে একটি চন্দন পাত্রে পুরো সিগারেটের টুকরোটা ভালো করে ভিজিয়ে নিলেন। তারপর বাঁহাতের তালুতে নিয়ে অনেকটা সিঁদুর দিয়ে পুরোটা ঢেকে দিলেন । এবার ডান হাত বাঁহাতের উপর রেখে অগ্নিকে সাক্ষী মেনে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন ।
মিনিট পাঁচেক পর হাত খুলতেই অবাক হবার পালা । হাতের মধ্যে সিগারেটের পরিবর্তে ছোট্ট একটা কৌটা । বললেন, বাড়িতে এই ধরনের কোন কৌটা আছে ?
-- সেতো অনেক কৌটাই আছে ঘরে ।
-- আহা কাঁচের -- ভেতরে কিছু রাখা, মুখটা সীল করে বন্ধ করা ?
আমার চোখের সামনে অনেকগুলো কৌটা ভাসছে । আমি বুঝতে পারছিলাম না কোন কৌটার কথা উনি বলছেন । ভুল বললে আরো কি থেকে কি হয়ে যাবে । বললাম, আমি ঠিক জানি না ।
উনি আবার আগের মত হাতের উপর হাত রেখে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে বললেন, আছে, ওই কৌটাতেই রাখা আছে মৃতের হাড় বা অস্থি । মনে পড়ছে কিছু ?
অস্থি আমরা কোনকালেই ঘরে রাখি না ।প্রশ্নই ওঠে না । বললাম, না --
-- বেশ, আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি সব । স্নান সেরে এসেছো ?
বললাম, হ্যাঁ ।
-- আমি তোমাকে তোমার বুড়ো আঙ্গুলের নখে দেখিয়ে দিচ্ছি সব । কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, তুমি দেখা মাত্রই তোমার সময় শুরু । ঠিক সাতদিনের মধ্যে ওই কৌটা কোন ভালো জায়গাতে জলে ফেলে দিতে হবে । যদি না দাও তবে তোমাদের ক্ষতি কেউ আটকাতে পারবে না ।
বললাম, রাজী ।
-- মনের মধ্যে সাহস আনো, একদম ভয় পেলে চলবে না । সাপে কাটলেও নড়তে পারবে না কিন্তু। হাত কাঁপলে সব ঝাপসা হয়ে যাবে । দ্বিতীয়বার দেখানোর ক্ষমতা আমার নেই । মনে থাকবে ?
বললাম, থাকবে ।
-- আরো একটা কথা যা দেখতে বসেছো, শুধু ওইটাতেই মন আটকে রাখতে হবে । মনের উপর কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ হারানো চলবে না । যদি হারাও তাহলে চিরদিনের জন্য তোমার মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে । মনে থাকবে ?
মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক আছে ।

একটা শক্ত ভারী টুল জাতীয় কিছু আমার সামনে এনে রাখা হলো । আমাকে বলা হলো ডান হাত মুঠ করে টুলের উপর রাখতে । কনিষ্ঠ আঙ্গুলের দিকটা টুলের উপর রাখা । বুড়ো আঙ্গুল সবচেয়ে উপরে ।
কয়েকটা জবাফুল এনে আমার পুরো বুড়ো আঙ্গুলে ভালো করে ঘষে দেওয়া হলো । এবার তেল, সিঁদুর, চন্দন আর অল্প ছাই মিশিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করা হলো । পুরো বুড়ো আঙ্গুলে সেই পেস্ট লেপে দিয়ে পাশের লোকটাকে ইশারায় আমাকে আমার হাতটা চেপে ধরতে বললেন । তারপর জলন্ত চেলি হাতে তুলে নিয়ে বললেন, একদম ভয় পাবি না চোখ বন্ধ কর ।
একেবারে তুমি থেকে তুই । হাতে জলন্ত চেলি, ভয়ে চোখ বন্ধ করি কি করে ? কিছুতেই চোখ বন্ধ করতে পারছি না ।
এবার একেবারে গর্জন করে উঠলেন । বলেছি চোখ বন্ধ কর । শ্বাস বন্ধ করে থাক, একদম নড়বি না । বন্ধ কর চোখ । সেকি আওয়াজ ! ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে ।
দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যেই বললেন, এবার চোখ খোল । সেকি কান্ড ! তাকিয়ে দেখি জলন্ত চেলি আমার আঙ্গুলের উপর চেপে রাখা । নিমেষে বুকের রক্ত শুকিয়ে কাঠ । কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হলো আমার তো কিছুই অনুভব হচ্ছে না ।
-- এবার তোর বুড়ো আঙ্গুলের নখে দেখ, কিছু দেখতে পাস কিনা ?
এবার সত্যি আবারও অবাক হবার পালা । নখটা যেন আয়না । ছবির মতো আমি সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখানে ।
-- তোদের ওই বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখ -- 'মৃত'-কে কি ডাকিস ?
বললাম, মেসো ।
-- দেখ তোর ওই মেসোর ঘরটাতে দেখ, ভালো করে দেখ --- ।
আমি সিনেমার মতো সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ।
-- খবরদার মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবি না ।অন্য কোন বিষয়ে মন যেতে চাইলেও একদম যেতে দিবি না । ভালো করে দেখ -- ।
আমি সম্মোহিতের মত দেখছি ।
-- টেবিলের উপর ফটোর সামনে ওটা কি দেখতে পাচ্ছিস ?
-- একটা কাঁচের কৌটা ।
-- ওটাই কাল । কথাটা বলেই হাতে জল ঢেলে দিলেন । বললেন, ব্যাস এতটুকুই ।
একটা লাল রঙের তাগা দিয়ে বললেন, এই তাগা দিয়ে ওই কৌটাটকে ভালো করে বাঁধবি । তারপর মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দিবি । একটা তুলসী গাছ লাগিয়ে দিস উপরে । টবের মধ্যে পুঁতে দিলেও চলবে । তবে রাত্রির অন্ধকারে নয় দিনের আলোয় টবটা বাইরে রেখে আসিস । আজকে যদি সম্ভব না হয় আগামী কাল সকাল বেলাতেই বের করে দিবি । ভুলিস না । আর মনে রাখবি সাতদিন। যা, যা এখন এখান থেকে । আরো একটা কথা, জলে ফেলে দেবার সময় তাগাটা খুলে নিস । ওই তাগাটা মেয়েটার হাতে বেঁধে দিবি । সময় হলে দেখবি একদিন এমনিতেই খুলে পড়ে যাবে । মনে থাকবে তো ?
তাড়াতাড়ি উঠে প্রাণাম করে বললাম, আপনার দক্ষিণা ?
-- ভাগ শালা, আমি কি এখানে ব্যবসা করতে বসেছি । তোর কাজ হয়ে গেলে যা ইচ্ছে হয় পাঠিয়ে দিস । যা ভাগ ।

প্রণাম করে ফিরে আসছি, আবার পেছন থেকে ডাকলেন উনি । ফিরে তাকাবো ঠিক তখন‌ই উনি চিৎকার করে উঠলেন, পেছনের দিকে ফিরে দেখবি না কখনো । তারপর নিজে থেকেই এগিয়ে এসে হাতে একটা রুদ্রাক্ষ সুতো দিয়ে বেঁধে দিয়ে বললেন, এই যে তোরা যাচ্ছিস, বিপদ আপদ আসতেই পারে, ভয় পাবি না । নিজামের সব জানা আছে । শুধু দুটো কথাই মনে রাখবি, কোথাও থামবি না, কক্ষনো পিছন ফিরে তাকাবি না তাহলেই আর ভয় নাই, মনে থাকবে ?
বললাম, থাকবে ।
-- বেশ, তাহলে মায়ের নাম করে যাত্রা শুরু কর ।
ওখান থেকে যখন বেড়িয়ে এলাম বেলা ত‌খন ঘড়িতে একটা কুড়ি থেকে পঁচিশ । সূর্য একেবারে মাঝ আকাশে । প্রচন্ড রোদে গা পুড়ে যায় । আসার আগে খানিকটা ডাবের জল অল্প প্রসাদ খাইয়ে দিয়েছিলেন, সারাদিনে আর কোন খাওয়া নেই । উনি বারবার নিষেধ করেছেন, কোথাও থামতে পারবে না । নিজামকে বললাম, আমাদের তাহলে আজকে আর খাওয়া হচ্ছে না ।
-- না সম্ভব নয় স্যার ।
দুধারে ধান ক্ষেত, মাঝ বরাবর সাপের মতো গ্রামীন রাস্তা । কোন এককালে পিচ করা হয়েছিল বোঝা যায়, এখন সেই পিচের স্মৃতি নিয়ে জায়গায় জায়গায় গর্ত । দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি । বাড়ি ঘিরে নানান রকমারী গাছ । মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি উল্টো দিক থেকে আসছে । আশেপাশে কোথাও সাপ্তাহিক হাট হবে হয়তো । দল বেঁধে গ্রামবাসীরা সেই দিকেই যাচ্ছে । নিজাম দেখলাম খুব সাবধানে বাইক চালাচ্ছে । ওর চালানোর হাত ভালো, আসার সময় চালানো দেখে সেই ভরসাটুকু আমার জন্মেছে । ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা নিয়ে ফিরছি । উপালিদের বাড়িতে কাজটা কিভাবে নেবে কিছুই জানি না । কারো মুখেই কথা নেই । মাঝে মাঝে দুই একটা কাজের কথা ছাড়া ।
-- আপনি আমাকে শক্ত করে ধরে রাখুন স্যার ।
বললাম, ভয় নেই, আমার অভ্যেস আছে ।
-- যা বলছি তাই করুন ।
তারপর একটু থেমে আবার বললে, আপনি উনার কথার গুরুত্ব‌ বুঝতে পারছেন না । বোঝার চেষ্টা করুন, ওরা আপনাকে যে কোন ভাবে আটকাতে চেষ্টা করবেই, বাঁধা দেবে, ভয় দেখাবে ।
-- কারা ?
প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম বোকার মতো প্রশ্ন হয়ে গেছে । নিজাম কোন উত্তর‌ই দিল না ।
লজ্জা পেয়ে ওকে শক্ত করে ধরে চুপচাপ বসে আছি । বাইক ছুটছে । রাস্তায় ভীড়ভাট্টা কম । তাই বেশ ভালো গতিতেই চলছি । হঠাৎই একটা বাইক এসে প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে চলে গেল ।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, নিজাম সাবধানে ।
-- জানি, আপনি চোখ বন্ধ করে বসুন ।
অল্প পরে আবার‌ও একটা বাইক ঠিক ওই ভাবে এসে ধাক্কা দিতে দিতে বেড়িয়ে যাচ্ছিল । ব্যপারটা এতটই আকস্মিক ছিল যে বাইকের সাথে সাথেই অজান্তেই মাথাটা অল্প পেছন দিকে ঘুরে যায় । আর যাই কোথায় ? দেখি পেছন থেকে অদ্ভুত‌ কি একটা প্রচন্ড বেগে আমাকে তাড়া করছে । ঠিক আমার ঘাড়ের উপর । জিনিষটা যে কি, আমি বোঝাতে পারবো না, একটা ছাই ছাই রঙের ধোঁয়া, আকারটাও অদ্ভুত‌, বিভৎস। অনেকটা মানুষের মতো কিন্তু পুরোটা নয় । কী ভয়ঙ্কর, কী ভয়ঙ্কর । পৃথিবীতে কিছু জিনিষ থাকে যা ভাষা দিয়ে সঠিক বর্ণনা করা কঠিন । সারা শরীর হিম হয়ে আসে । মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাকে মেরে ফেলবে । এক ঝলক মাত্র দেখেছি, তাতেই আমার হাত পা শিথিল হয়ে আসছিল । আর এই ভয় পাওয়াতেই হয়তো আমি ভীষণ ভাবে নড়ে উঠেছিলাম । নিজাম ঠিক বুঝতে পেরেছে । অনেক কষ্টে ঝাকুনীটা সামলে নিয়ে প্রচন্ড বিরক্তিতে বললে, একশ বার বলেছি পেছনে তাকাবেন না, কথাটা কানে গেল না তো ? এখন বুঝুন ! 
কথাটা শেষ হবার আগেই হঠাৎই বাতাসে হালকা ধূলো উড়তে শুরু হলো । কড়া রোদে মন্দ লাগছিল না । ধীরে ধীরে বাতাসে বেগ বাড়ছে । নিজাম চিৎকার করে বললো, শক্ত করে ধরুন, ন‌ইলে পড়ে যাবেন ।
 দেখতে দেখতে সেই বাতাস ক্রমে ধূলো ঝড়ের আকার নিচ্ছে ।
নিজাম চিৎকার করে উঠলো, এবার শান্তি হয়েছে তো ?
রীতিমতো ভৎসনা, খুব লজ্জার কথা । কোন উত্তর দিলাম না, কোন মুখে দিই । একদিকে এই ধুলোর ঝড় অন্য দিকে সেই ছবিটা, আমি একেবারে বিধ্বস্থ । চোখ থেকে সেই ছবিটা কিছুতেই যেন সরতে চায় না । প্রচন্ড ভয় লাগছিল । 
বাইক একেবারেই চালানো যাচ্ছে না । নিজাম বললো, ভয় পাবেন না । একটু পরে এমনিতেই থেমে যাবে । মনে মনে কালী মায়ের নাম জপছি, আর ভাবছি রাস্তা কেন শেষ হয় না ।
একসময়ে সত্যি সত্যিই থেমে গেল ঝড় । আমরা পিচ রাস্তায় ফিরে এলাম । এবার শুরু হলো নতুন সমস্যা । জায়গায় জায়গায় ট্রাফিক জ্যাম । কিন্তু কোথাও থামা চলবে না । নিজাম বললে, স্যার আপনি মোবাইলে ম্যাপ খুলুন। সামনে ট্রাফিক থাকলে আগে থেকে বলবেন ।
শুরু হলো ম্যাপ দেখে চলা । কোথাও থামা চলবে না তাই যেখানেই মনে হয়েছে ভীড় হতে পারে সেখানেই অন্য রাস্তা । কখনো গলি, তস্য গলি, আবার বড় রাস্তা । দুই ঘন্টার পথ সাড়ে তিন ঘন্টা হয়ে গেছে কিছুতেই শেষ হয় না । সারা শরীরে ব্যথা, বসতে খুব কষ্ট হচ্ছে । নিজামের অবস্থা আরো খারাপ । বারবার এক হাত ছেড়ে এক হাতে চালাচ্ছে । মুখ শুকিয়ে পাংশু । আর বোধ হয় পারা গেল না । সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
হঠাৎই কি মনে হতেই নিজাম বললে, স্যার তাগাটা কোথায় রেখেছেন ?
বললাম, পকেটে ।
-- ওটা হাতে নিতে পারবেন ?
বললাম, পারবো ।
-- তাহলে হাতে নিয়ে মোবাইলে ছুঁইয়ে রাখুন ।
অবাক কান্ড এখন রাস্তা অনেকটাই পরিষ্কার । পথ‌ও যেন অনেকটাই কম । কি করে হলো ?
বললাম, এই কথাটা আগে বলতে পারলে না ।
-- সব সময় সব কথা মাথায় খেলে না স্যার ।

এপার্টমেন্টে যখন পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । নিজাম বললে, স্যার আমি যদি বাইকটা স্লো করি, তাহলে চালু অবস্থায় নাবতে পারবেন ?
বললাম, পারবো ।
-- তাহলে গেটে আপনাকে নামিয়ে দেব । আপনি না থেমে আপনার কাজে চলে যাবেন । রিয়াদকে বলবো আপনাকে সঙ্গ দিতে ।
গেটে বাইক থেকে নেমে আমি সোজা উপালিদের ফ্ল্যাটের দিকে র‌ওয়ানা দিলাম । রিয়াদ আমাকে দেখেই ছুটে এলো । বললাম, আমার সাথে তুমি ফ্ল্যাটের দরজা অবধি চল । তারপর একটা টবে মাটি নিয়ে আসবে । আর একটা তুলসী গাছ এনো ।
-- এখন ? এই রাত্তিবেলা ?
বললাম, হ্যাঁ ।

দরজা খুলে মাসীমা অবাক । দরজায় দাঁড়িয়েই অসংখ্য প্রশ্ন, কোথায় ছিলাম সারাদিন ? কি খেয়েছি ? ফোন কেন করলাম না , নানা প্রশ্ন ।
আমি পাশ কাটিয়ে সোজা মেসোর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম, ওই কৌটাতে কি আছে ?
-- বাবার অস্থি ।
বললাম, এসব জিনিস কখনো ঘরে রাখে ?
-- কোথায় রাখবো ? ফ্ল্যাট বাড়িতে জায়গা কোথায় ?
আমি আর কথা না বাড়িয়ে সোজা মেসোর ঘরে ঢুকে দরজা দিলাম ।
উপালি আমার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ভয়ে বাইরে থেকে চিৎকার করতে লাগলো, কি হচ্ছে দাদা, দরজা খোল, দরজা খোল । বাইরে তখন শুরু হয়ে গেছে মাসীমা, উপালির কান্নাকাটি ।
এদিকে ঘরের ভিতরে অন্য পরিস্থিতি । ভেতরটা থমথম করছে । কেউ যেন রাগে ফোঁসছে ভেতরে ভেতরে । একটার পর একটা কাঁচের জিনিষ মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হচ্ছে । সারা ঘর ময় কাঁচের টুকরো ।কাঁচের জিনিষ শেষ হতেই ব‌ই পত্র ছুড়ে ছুড়ে আসছে । আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম এই রকমই একটা পরিস্থিতির জন্য । আগেও একদিনের অল্প অভিজ্ঞতা আছে । আমার ভেতরে তখন একটা অজানা শক্তি কাজ করছিল , সাবধানে কাঁচের টুকরো গুলো এড়িয়ে সোজা এগিয়ে গেলাম ওই কৌটাটার দিকে । 
ওদিকে ঘরে যত জিনিস পত্র ভাঙ্গার আওয়াজ হচ্ছে বাইরে ততই চিৎকার চেচামেচি বাড়ছে । পারলে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে চলে আসে ।
আমার হাতে সময় খুব কম । আমি বাহাতে ভাবলাম কৌটাটা নিয়ে ডানহাতে তাগাটা বেঁধে দেব । সেকি ? কৌটাটা ছোঁয়া যায় না, ভীষণ গরম । হঠাৎই মনে হলো আগে তাগাটা ছুঁইয়ে তারপর বাঁধলে কেমন হয় । তাগা ছুঁইয়ে দিতেই অবাক কান্ড, ঘরের হাওয়া ঠান্ডা, জিনিস পত্র ছোড়া ছুড়ি বন্ধ, কৌটাটাও ক্রমে ঠান্ডা হয়ে আসছে । আমি তাড়াতাড়ি কৌটাটা তাগা দিয়ে ভালো করে বেঁধে দিলাম ।
বাইরে ততক্ষণে রিয়াদ একটা টবে মাটি নিয়ে হাজির । রিয়াদের কাছ টব নিয়ে তাতেই কৌটাটা পুঁতে দিয়ে মাটি চাপা দিলাম । এবার একটা তুলসী গাছ লাগিয়ে দিলাম টবে । তারপর টবটাকে ফটোর পাশে রেখে বেরিয়ে আসতেই দেখি উপালি মাসীমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । 
রিয়াদকে বললাম, একটু থাকো, আমি স্নান সেরে আসি ।
বলা যায় যদি কৌটাটা টব খুঁড়ে বের করে নেয় । খুব ক্লান্ত লাগছিল নিজেকে ।শরীর চলতে চাইছিল না । উপালিদের ইচ্ছে করেই বিরক্ত করলাম না, কাঁদতে দিলাম । অনেক সময় কাঁদলে মন হালকা হয় ।
স্নান সেরে এসে দেখি তখন‌ও কান্না কাটি চলছে । রিয়াদকে ইশারায় চলে যেতে বলে আলতো করে উপালির মাথায় হাত রেখে বললাম, কাঁদিস না বোন, যে চলে গেছে তাকে যেতে দিতে হয় । তাকে আটকে রাখা মানে শুধু নিজে কষ্ট পাওয়া নয়, তাকেও কষ্ট দেওয়া । তাই যেতে দে উনাকে, যেতে দে ।
কান্না তবুও থামতে চায় না । অগত্যা মাসীমাকে বললাম, আমি কিন্তু সারাদিন কিছু খাইনি মাসীমা ।
একদম টোটকার মতো কাজ করলো কথাটা । কান্না কাটি শেষ, খাওয়া নিয়ে ব্যস্ততা শুরু দুজনার । মনে মনে ভাবলাম, মেয়েদের এই দুর্বলতা যত দিন থাকে ততদিন‌ই মঙ্গল ।
চা খেতে খেতে বললাম সব কিছু খুলে । কোথায় গেছিলাম, কেন গেছিলাম সব বৃত্তান্ত । বুঝিয়ে বললাম এতেই ওদের ভালো হবে। আর বললাম এক সপ্তাহের মধ্যে জলে বিসর্জন দিতে হবে ।
বললাম পরদিন‌ই গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলে কি হয় । দেখলাম মাসীমার তাতে আপত্তি আছে । উনার ইচ্ছে প্রয়াগে অস্থি বিসর্জন হোক । মেসো নাকি তেমনটাই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন । আমি ওই সাতদিনের মধ্যেই আমার বন্ধুর মারফতে ভারত সেবাশ্রমের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়াগে অস্থি বিসর্জন আর গয়া শ্রাদ্ধ দুটোই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করিয়ে দিয়েছিলাম । এরপর আজ তিন বছর, আর কোন অসুবিধা হয়নি । উপালির হাতে শুনেছি এখনো সেই তাগা বাঁধা আছে ।
 

Comments