দেশ ভাগের বলি ঢাকার ঢাকেশ্বরী


সকাল বেলা, তখন‌ও ঘুম কাটেনি চোখ থেকে। একটা বালিশে মাথা রেখে আরো একটা বালিশ মাথার ওপর চেপে শুয়ে আছি। ঘুম যদিবা কেটেছে রেশ কাটেনি তখন‌ও। মাথার পাশেই মোবাইলটা বেজে উঠলো হঠাৎই । হাতের অনুমানে শুয়ে শুয়েই ফোনটা তুলে দেখি নাতাশা, আমার ভাইঝি । এই সাতসকালে‌ কী‌ ব্যাপার ? অসময়ে ফোন এলে আমার ভীষণ ভয় হয়, কী জানি কেউ আবার টপকে গেলেন কিনা । মোবাইলটা কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে নাতাশার গলা । 
--- তুমি কি কিছু জানো ?
কী আশ্চর্য ! আমি তো অনেক কিছুই জানি আবার সেই হিসেবে কিছুই জানি না । বললাম, এইটা কী ধরনের প্রশ্ন হলো ।
অন্য সময় হলো নাতাশা অনেক কিছুই বলতো । এখন ভীষণ সিরিয়াস । বললো, ঠাট্টা নয় একেবারেই, খবর পেয়েছি ঢাকার ঢাকাশ্বরী এখন আর ঢাকায় থাকেন না ।
এবার আমার‌ও চমকে ওঠার পালা । বললাম, সেকি রে, কবে চুরি হলো ?
চোখে ঘুমের রেশ চলে গেছে পলকে । একলাফে উঠে বসলাম বিছানায়। 
--- চুরি হয়নি তো ।
--- তবে ?
--- তবে আবার কি ? সরিয়ে আনা হয়েছে ।
--- কোথায় রে ?
--- এই কোলকাতা ।
এই কথার পর আর বিছানায় থাকা যায় না। বললাম, এই খবরটা এতদিন দিতে পারলি না ? পরদিন‌ই ফিরে যাচ্ছি শিলচর । বললাম, ঠিকানা দে, আজকেই বেরোচ্ছি।

ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশের অতি প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম । বাংলাদেশ সরকার এই মন্দিরটিকে জাতীয় মন্দিরের মর্যাদা দিয়েছেন । এখানেই মন্দিরে স্থাপিতা ঢাকার মঙ্গলময়ী মা ঢাকেশ্বরী । 
পলাশী ব্যারাক এলাকায় ঢাকেশ্বরী সড়কের উত্তর দিকে প্রাচীর ঘেরা মন্দির। সিংহদ্বারের মধ্য দিয়ে ভেতরে যাবার রাস্তা । লোকে বলে নহবত তোরণ। ভেতরে মন্দিরটি বেশ কয়েকখানা মন্দির আর সৌধের সমাহার । বলতে গেলে দুটো ভাগ, পূব দিকে অন্তর্বাটি বা ভেতর বাড়ি আর পশ্চিম দিকে বহির্বাটি । বহির্বাটিতে আছে কয়েকটি মন্দির, একটা পান্থশালা আর কিছু ঘর । এছাড়াও আছে পশ্চিম দিকে একটা প্রাচীন দিঘীর আর সেই দিঘীর দক্ষিণ পূব কোনে এক প্রাচীন বটগাছ, উত্তর পুব কোণায় এক‌ই সারিতে এক‌ই মাপের চারটি শিব মন্দির। এই চারটি শিব মন্দির‌ই মানসিংহ তার চার চারবার ঢাকায় আসার নিদর্শন হিসেবে তৈরি করেছিলেন । বহির্বাটি থেকে পূব দিকে আরো একটা তোরণ পেড়িয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় । সাথেই আছে নাট মন্দির আর কিছু ইমারত । লোকে বলে দেবীর এই মন্দিরটি সতী একান্ন পীঠের অঙ্গ, একটি উপপীঠ । দক্ষযজ্ঞে সতী যখন পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করলেন, দেবাদিদেব মহাদেব সেই খবর পেয়ে রাগে দুঃখে উন্মাদ । দক্ষের যজ্ঞস্থল থেকে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে মহাদেব পাগলের মতো নাচতে শুরু করেছেন। তার এই প্রলয় নাচে স্বর্গ মর্ত পাতাল কেঁপে উঠলো । দেবতারা প্রমাদ গুনলেন, এই বুঝি সৃষ্টি ধ্বংসের পথে । সব দেবতারা তখন বিষ্ণুর শরনাপন্ন হলেন কিছু একটা উপায় বের করার জন্য। শিব দেখলেন যতক্ষণ সতীর দেহ শিবের কাঁধে থাকবে ততক্ষণ শিবকে শান্ত করা যাচ্ছে না। তখন অন্য কোন উপায় না পেয়ে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে দিলেন । সেদিন যেখানেই সতীর অঙ্গ পড়েছিল সেখানেই পরবর্তী সময়ে এক একটা সতী পীঠ সৃষ্টি হয়েছে বলে হিন্দুদের বিশ্বাস । যেহেতু সতীর অঙ্গ নয় অঙ্গের ভুষণ, দেবীর 'কিরিটের ডাক' মানে উজ্জ্বল গহনার একটি অংশ এখানে পতিত হয়েছিল তাই ঢাকার ঢাকেশ্বরী সতী পীঠ নয় একটি উপপীঠ । কিরিটের ডাক থেকে ঢাকেশ্বরী নাম । লোকগাঁথাটি আসলে এক পৌরানিক কাহিনী, শাস্ত্রে আছে ।
যতীন্দ্রমোহন রায় তার ঢাকা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে দাবী করেছেন, ভবিষ্য ব্রহ্মখন্ডে নাকি বলা হয়েছে,
বৃদ্ধ গঙ্গাতটে বেদ বর্ষ সাহস্র ব্যত্যয়ে
স্থাপিতব্যঞ্চ যবনৈ জাঙ্গিরং পতনং মহৎ ।
তত্র দেবী মহাকালী ঢক্কা বিদ্যপ্রিয়া সদাঃ
গাস্যন্তি পত্তনং ঢক্কা সজ্ঞকং দেশবাসিনঃ ।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস নিয়েও নানা কাহিনী প্রচলিত । অনেকের ধারণা সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । কিন্তু এই নিয়েও বিতর্ক আছে । ১২শ শতাব্দীর সমকালিন স্থাপত্যকলার সাথে এই মন্দিরের বিস্তর ফারাক । ভারতবর্ষে মুসলমানদের আসার আগে অবধি স্থাপত্যে চূন বালির ব্যবহার ছিল না । কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি আগাগোড়া চুণ বালিতে তৈরি। যদিও বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে । এমনকি মানসিংহ নিজেও মন্দিরের ভগ্নদশা লক্ষ্য করে নিজের তহবিল থেকে মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন।
মনে করা হয় এইটিই ঢাকার আদি ও প্রথম হিন্দু মন্দির । হিনদুদের ধারণা ঢাকেশ্বরী শব্দ থেকেই ঢাকা শহরের নাম। ঢাকেশ্বরী দেবীই হচ্ছেন ঢাকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী । কিংবদন্তি আছে রাজা আদিসুর তার এক রাণীকে কোন এক কারণে বুড়িগঙ্গার জঙ্গলে নির্বাসন দিয়েছিলেন । জঙ্গলেই রাণীর একটি ছেলে হয়, নাম রাখা হয় বল্লাল । বল্লাল জঙ্গলেই বড় হচ্ছিলেন । একদিন জঙ্গলে থাকা অবস্থাতেই একটি দেবী মূর্তি খুঁজে পান । অনেকে আবার বলেন রাজা হবার পর তার জন্মস্থানে কোন কারণে গেলে সেখানে একটি দেবী মূর্তি পেয়েছিলেন । তার বিশ্বাস এই দেবী দূর্গাই তাকে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেন । রাজা তখন ওই স্থানেই দেবীর একটি মন্দির তৈরি করেন । মূর্তিটি যখন পাওয়া গিয়েছিল তখন কিছু দিয়ে মূর্তিটি ঢাকা ছিল । ঢাকা ঈশ্বরী তাই নাম ঢাকেশ্বরী ।
আরো গল্প আছে । অন্য এক কিংবদন্তি মতে রাজা বিজয় সেনের স্ত্রী স্নান করতে লাঙ্গলবন্দ নামে একটি জায়গাতে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় তার একটি ছেলে হয়, নাম দেওয়া হয় বল্লাল সেন। সেই বল্লাল সেন রাজা হবার পর স্বপ্নে দেখেন তার জন্মস্থানে জঙ্গলে একটি দেবী মূর্তি ঢাকা অবস্থাায় আছে । রাজা সেই মূূর্তি আবিস্কার করে সেখানে একটি মন্দির তৈরি করেন । দেবী ঢাকা অবস্থায় ছিলেন তাই নাম ঢাকেশ্বরী।
মানসিংহ বাংলার সুবেদার থাকাকালিন ১৫৯৪‌ থেকে ১৬০৬ সালের মধ্যে তিন তিনবার মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন । শোনা যায় ওই সময়ে তিনি চারটি শিব মন্দির গড়ে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন । কিন্তু এই নিয়েও বিতর্ক অনেক । এফ বি ব্রাডলী বার্ট ১৯০৬ সালে তার "রোমান্স অব এ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটেল" ব‌ইএ এই মন্দিরটিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক হিন্দু এজেন্টের ২০০ বছরের পুরনো মন্দির বলে বর্নণা করেছেন।

ঢাকেশ্বরী মন্দির নিয়ে এইটুকু তথ্য আমার জানা ছিল । শুধু আমি ন‌ই যারা নেট দুনিয়ায় ঘোরাফিরা করেন তাদের অনেকের‌ই জানা । কিন্তু সেই ঐতিহাসিক মন্দিরের ৮০০ বছরের পুরনো মূর্তিটি যে এখন আর তার আসল মন্দিরে নেই এই খবরটি আমাকে খুব চমকে দিল । নাতাশার মারফৎ খোঁজখবর নিয়ে বর্তমান ঠিকানা নিতে সময় লাগলো না । আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। মেট্রোতে শোভাবাজার স্টপেজে নেমে পায়ে হাঁটা পথ । কুমারটুলীতে দূর্গাচরণ স্ট্রিট । কাঁধে ক্যামেরা ফেলে র‌ওয়ানা দিলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে । কুমারটুলীতে খোঁজে নিতেই বেশি বেগ পেতে হলো না । একটু জিজ্ঞেস করাতে দেখিয়ে দিলেন এক ভদ্রলোক । ঢাকার ঢাকেশ্বরী বলে কথা, স্বপ্নে পাওয়া দেবী । আমি যাচ্ছি সেই দেবী দর্শনে । কত ঘটনা, ঘাত প্রতিঘাতের সাক্ষী এই দেবী প্রতিমা ।আধ্বাত্মিক কথা ছেড়ে দিলাম, ঐতিহাসিক মূল্য‌ও অনেকখানি । মনে মনে একটা উত্তেজনা, সাথে দেবী কি করে ঢাকা ছেড়ে এখানে চলে এলেন সেই গল্প নিয়ে বিশাল কৌতুহল -- মনের অবস্থা সত্যি চমৎকার ।
একটু খোঁজাখুজি করে ঠিক যে জায়গাতে এসে উপস্থিত হলাম সেখান থেকে মন্দির চার পাঁচ পা দূরত্বে । মনের মধ্যে যে বিশাল ঐশ্বর্যময়ী দেবীকে কল্পনা করে আসা, দরজায় এসে আমি প্রচন্ড হতাশ ।এই সেই মা ! বাড়ি ঘরে মন্দির যেমনটি থাকে অনেকটা ঠিক তেমনি, জৌলসহীন। সাথে লাগোয়া নাটমন্দির । দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে মন্দির কমিটি অতি কষ্টে মন্দির পরিচালনা করে চলেছেন । স্বভাবত‌ই প্রচন্ড অব্যবস্থা, কিছুটা হলেও যত্নের অভাব । মায়ের এই দুর্দশা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল । পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম বিগ্রহের দিকে ।
অষ্টধাতুর তৈরি দেড় ফুট উচ্চতার কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী দূর্গা, দেবীর দশ হাত। দশ হাতে দশ অস্ত্র । সাধারণতঃ আর দশটি দশভূজা দূর্গা মূর্তির সাথে এই মূর্তির কোন ফারাক নেই । দেবীর বেদীর নিচে লিখা -
ঢাকেশ্বরি জগন্মাতঃ ত্বং খলু ভারত বৎসলা ।
স্বস্থানাৎ স্বাগতা চাত্র স্বলীলয়া স্থিরা ভাব ।।

তার অর্থ হচ্ছে, হে দেবী জগন্মাতা ঢাকেশ্বরী, তুমি পরম ভক্তবৎসলা । আজ থেকে এই তোমার স্বস্থান । এইখানেই স্বমহিমায় বাস করে তুমি লীলা বিস্তার কতো ।
পূজাবিধি বৃহৎনন্দীকেশর মতে তবে উত্তর ভারতের মতো নবরাত্রি বিধিতে । যেহেতু দেবী এখানে প্রতিষ্ঠিতা তাই এখানে কল্পারম্ভ, কলাবৌ ইত্যাদির প্রয়োজন হয় না । আশ্মিনের শুক্লা প্রতিপদে তিনখানি ঘট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পূজা শুরু হয়। একখানা ঘট গনেশের, একখানা দেবীর ও অন্যটি শান্তির। প্রতিটি ঘটের উপর পঞ্চপল্লবের শাখা রেখে তার উপরে একখানা প্রদীপ বসানো । প্রদীপের চারদিকে চারটি শিখা। প্রতিপদ থেকে নবমী অবধি জ্বলবে। ঘটের গায়ে অল্প মাটি মেখে তাতে যব ছড়িয়ে দেওয়া হয় । নয়দিনে সেই যব অঙ্কুরিত হয়ে গাছ বেরিয়ে আসে। পাশে লক্ষী, সরস্বতী ও নিচে কার্তিক গনেশ । পশুরাজ সিংহের উপর দাঁড়িয়ে দেবী মহিষাসুর বধ করছেন। মানসিংহ আজমগড় থেকে এক তেওয়ারী পরিবারকে এনে পূজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন । সেই থেকে এই তেওয়ারী পরিবার মায়ের পূজারী। দেবীকে যে ভাবে অলংকার হীন বিবস্ত্র অবস্থায় কোলকাতায় আনা হয়েছিল তার একখানি ফটো দেখলাম মন্দিরে রাখা আছে ।
প্রণাম শেষে পরিচয় হলো বর্তমান পূজারী শক্তি প্রসাদ ঘোষালের সাথে । বর্তমানে তিনিই তেওয়ারি পরিবার পক্ষ থেকে নিযুক্ত পূজারী । তখন‌ও মনে সন্দেহ। এখানে যদি ৮০০ বছরের পুরনো দেবী মূর্তি অধিষ্ঠান করছেন তবে বাংলাদেশে মূল মন্দিরে উনি কে ? মন থেকে সন্দেহ যেতে চায় না । খালি চোখে মূর্তি দেখে বোঝার‌ও উপায় নেই । তাই সরাসরি ঘোষালবাবুর কাছেই প্রশ্নটা রাখলাম। কথা প্রসঙ্গে আলোচনা হলো দেবীর কোলকাতা আগমনের বিষয়ে । ঘোষালবাবু বললেন, রাজনৈতিক স্বার্থে যখন দেশভাগ হলো তখন এপার বাংলা ওপার বাংলা, দুপাশেই অবস্থা শোচনীয় । দাঙ্গা, লুট আর ধর্মের নামে রক্তারক্তি কান্ড । পূর্ব পাকিস্তানে তখন বেছে বেছে মন্দির আক্রমণ হচ্ছে । এই অবস্থায় মন্দির পরিচালকরা দেখলেন, বিগ্রহ অক্ষত রাখা কঠিন । তাই ১৯৪৮ সালে খুব দ্রুত অথচ গোপনীয়তার সাথে রাজেন্দ্রকিশোর তিওয়ারি ও হরিহর চক্রবর্তী মূল বিগ্রহটি বিশেষ বিমানে ঢাকা থেকে কোলকাতায় নিয়ে আসেন । অনেকের মতে রাজেন্দ্রকিশোর নয় , হরিহর চক্রবর্তীর সাথে ছিলেন প্রহ্লাদ কিশোর তেওয়ারি। তবে ঘোষালবাবুর মানতে নারাজ কারণ ওই সময়ে প্রহ্লাদ কিশোর তেওয়ারি জীবিত ছিলেন না। মূল মন্দিরে রাখা হলো গোপনে আসল মূর্তির এক হুবহু প্রতিরূপ। হরিহর চক্রবর্তী থেকে গেলেন ঢাকায়, মূল মন্দিরের পূজারী হিসেবে । এখনো তার বংশধরেরা ওখানে পূজো চালিয়ে যাচ্ছেন।
 যাই হোক কোলকাতায় নিয়ে এসে প্রথম দু'বছর হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে দেবন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাড়িতে দেবীর পূজা হয় । তারপর দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী ১৯৫০ সালে এই মন্দিরটি তৈরি করে দিলে দেবী সেই থেকে এখানেই পূজিত হয়ে আসছেন ।
তারপর ঘোষাল বাবু একটু থেমে বললেন, তবে ঢাকার মূল মন্দিরে সেই মূর্তিটি এখন আর নেই। দূর্বৃত্তেরা মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলে । বর্তমানে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখানকার মূর্তির আদলেই আরো একবার মূর্তি তৈরি করে পাঠানো হয়। সেই নতুন বানানো মূর্ততিটিই এখন ওখানে অর্থাৎ ঢাকায় পূজিতা হচ্ছেন।
ঘোষাল বাবুর কথা শুনলাম, কিন্তু মন থেকে সন্দেহ যায় না। বললাম আপনার কথাগুলো মেনে নেবার মতো কোন দলিল বা কিছু আছে ? আমি না হয় বিশ্বাস করলাম, লোকে কেন বিশ্বাস করবে ?
-- আছে তো ! কথাটা বলেই বাড়ির ভেতর থেকে একখানা পুরনো পত্রিকা নিয়ে এলেন ।
বললেন, এই দেখুন ওই সময়কালের পত্রিকা ।
দেখলাম, পুরনো যুগান্তর পত্রিকা । তারিখ ২৩ শে জুন ১৯৫০ সাল, বাংলায় ১২ই আষাঢ় ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার। হাতে নিয়ে অবাক। সত্যি সত্যিই দেশভাগের বলি হয়েছিলেন ঢাকার ঢাকেশ্বরী দেবী ।
স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা । কিন্তু আমার জন্যে ছিল আরো কিছু অবাক করা তথ্য ছিল তখন‌ও । ভালো করে খবরটি পড়ে জানতে পারলাম, মূল মূর্তিটি ছিল সোনার । মহারাজা মানসিংহ যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন বাংলায়। প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে ফিরে যাবার পথে তিনি যশোরের বিখ্যাত যশোরেশ্বরী কালী মূর্তিটি রাজস্থানের জয়পুরে নিয়ে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান কিছু বাঙ্গালী পুরোহিত, দেবীর পূজা অর্চনার জন্যে।। ঢাকাতেও ঢাকেশ্বরী মন্দির সংস্কারের অছিলায় মূল মূর্তিটি একখানি দিঘী খনন করে সেখানে লুকিয়ে রেখে ছিলেন । আর সেই মূর্তির জায়গাতে অষ্টধাতুর বর্তমান মূর্তিটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করানো হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে যেহেতু অষ্টধাতুর মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে তাই এই মূ্রতিটিই থেকে যায়, সোনার মূর্তিটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না । তার মানে এই দাঁড়ায় যে বর্তমান মূর্তির বয়স অনুমানিক ৫২৫ বছর , ৮০০ বছর নয়।
তাই হোক বর্তমান মূর্তির‌ও ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। 
ভাবছি আসল ঢাকেশ্বরী মূর্তিটি না থাকা সত্বেও ঢাকার মন্দিরটি এখন জাতীয় মন্দিরের মর্যাদায় ভুষিত, অথচ মূল বিগ্রহ নিয়ে এখানকার মন্দিরের কী করুন অবস্থা । ভাবা যায় ?
কথাটা ঘোষাল বাবুকে বলতেই ভদ্রলোক হেসে বললেন, সবটাই মায়ের ইচ্ছা । তিনি চাননি তাই দীর্ঘদিন শুয়ে ছিলেন জঙ্গলে আবার যখন ইচ্ছে হলো তখন তিনি মন্দির তৈরি করে রাজপূজিতা । এবার ইচ্ছে হয়েছে সব ছেড়ে চলে এলেন কোলকাতা । অভাব আর কষ্টের সংসারে, সবটাই মায়ের ইচ্ছা । আবার কখন কার উপর দয়া করবেন মা নিজেই জানেন । তখন হয়তো আবার দেখবেন, হয়ে যাবে নতুন করে মন্দির, বাজবে নহবত, মা সেজে উঠবেন নব সাজে।
ঘোষাল বাবুর কথা শুনলাম, কতটা ভরসা পেলাম জানি না, তবে মনে মনে খুব তাড়াতাড়ি সরকারি উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরী অনুভব করছিলাম ।

Comments