গাইড


গাইড

হালকা রোদ, শীতের শেষ। কলকাতার অফিস পাড়ায় ব্যস্ত লোকের ভীড়ে অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজছি একজন মনের মতো সঙ্গী, যার সাথে দু'দন্ড বসে গল্প করা যায়। যে কাজ নিয়ে এখানে এসেছিলাম, তা নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ। এখন হাতে অফুরন্ত সময়। ফুটপাতে এক ভাড় চা নিয়ে ভাবছি কি করা উচিত । কোলকাতা শহরে ঘুরে দেখার অনেক কিছু আছে । চাই এমন একজন লোক যে আপনাকে ঠিক মতো গাইড করতে পারে। একটুু এদিক ওদিক খোঁজখবর নিতেই একজন ভদ্রলোক পত্রিকা থেকে মুখ তুলে বললেন, কি দেখতে চান আপনি ?
ফিরে তাকিয়ে দেখি চার্লি চ্যাপলিন মার্কা গোঁফওয়ালা একটা লোক, পড়নে পুরনো দিনের প্যান্টলুন, গলায় টাই আর পায়ে ধুলো মাখা বুট জুতো। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই বাঙ্গালী নাকি অন্য কোন জাতি। তবে বাংলা উচ্চারণ খুব পরিষ্কার। বললাম, তেমন কিছুই নির্দিষ্ট নেই, তবে এমন কিছু দেখতে চাই যাতে বাড়ি গিয়ে গল্প করা যায়। 
ভদ্রলোক অদ্ভুত শব্দ করে হাসলেন । হাসিটা আমার একেবারেই পছন্দ হলো না । কেমন যেন অদ্ভুত বিদখুটে। বললেন, কবরখানায় যাবেন ?
-- কবরখানায় ? পাগল মশাই ? এত জায়গা থাকতে কবরখানায় কি করতে যাবো ?
-- কেন ? ভয় করে ?
বললাম, ওসব ফালতু ভয় টয় আমার নেই ।
-- তবে ? ভাঙ্গাচোরা কবরে আমার একফোঁটাও ইন্টারেস্ট নেই ।
-- যদি সেই কবরটি জব চার্নকের হয় ? দেখবেন ?
বললাম, কলকাতার জনক ?
--- ধুর মশাই কলকাতার কোন জনক আছে বুঝি ? একসময়ে ছিল, এখন নেই ।
--- সেকি ?
ভদ্রলোক এক গাল হেসে বললেন, কিছুই খবর রাখেন না দেখছি আজকাল। 
তারপর একটু থেমে আবার বললেন, দেখতে চান ?
-- কি ?
-- জব চার্নকের সমাধি ?
মূহুর্তে চমকে উঠলাম। বললাম, কোথায় ?
-- এই তো পাশেই । তবে আমার একটা শর্ত আছে ।
বললাম, বলুন।
-- ঘন্টা প্রতি আমাকে এক ডলার ফি দিতে হবে।
আমি অবাক। -- ডলার ? ডলার কোথায় পাবো ?
-- সে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি টাকায় হিসেবে করে দিয়ে দিলেই চলবে। আমার আবার ওতেই বিশেষ সুবিধা।
আচ্ছা পাগল লোক। যেমন পোশাক তেমনি আচরণ। কিন্তু এই সুযোগটা হাতছাড়া করা চলবে না। বললাম, রাজী।

ভদ্রলোক এদিক ওদিক লোকের ভীড়ে লোক টপকে দিব্যি এগিয়ে চলেছেন, আমি চলছি পেছন পেছন। কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের মোড়ে এসে হাতের বাঁদিকে বাঁক নিতেই একখানা বিশাল গেট বা ফটক। ভদ্রলোক সোজা ফটক পেড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কোলকাতার মুষ্টিমেয় প্রাচীন কবরখানার একটিতে আপনাকে সুস্বাগতম।

একটা গাড়ি চলার পাথুরে পথ, এঁকেবেঁকে একটা চার্চের পাশ ঘেষে চলে গেছে দূরে এক খোলা গ্যারেজের দিকে। একটা দুটো করে গাড়ি বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। রাস্তা থেকেই গাড়িগুলো চোখে দেখা যায়। কিছু দূর এগিয়ে গেলে সামনে বিশাল চার্চ। মূল গেট থেকেই নজরে পড়ে। মনে মনে ভাবছি কোন ভুল লোকের পাল্লায় পড়িনি তো ? অদ্ভুত‌ লোকটা, বুঝতে পারছি না এক কথায় রাজি হওয়া ঠিক হলো কিনা। চেনা নেই জানা নেই, কার ভেতরে কি মতলব কে জানে ! আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এগিয়ে যাবো কিনা । 
-- ভয় করছে ?
চমকে উঠলাম। দেখলাম ভদ্রলোক একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ।
বললাম, না, তা নয়। আসলে সন্ধ্যে হয়ে আসছে তো তাই। একদিন দিনের বেলা এলে ভালো করে দেখতে পারতাম।
ভদ্রলোক অদ্ভুত শব্দ করে হেসে উঠলেন। নিঃশব্দ প্রাঙ্গনে হাসিটা ক্রমে প্রতিধ্বনি তুলে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল। সামনেই গীর্জার আনাচে কানাচে থাকা কয়েকটি কবুতর ডানায় শব্দ করে উড়ে গেল তক্ষুনি। আমি দ্বিধাগ্রস্ত। লোকের হাসিও এমন অদ্ভুত হতে পারে !
--- চলুন, হাতে সময় খুব‌ই কম। ভদ্রলোক তাগদা দিলেন।
আমি পিছন পিছন চলেছি। ভদ্রলোক আমাকে শুনিয়ে বললেন, এই জায়গাটা একসময়ে কবরখানা ছিল। এখন অবশ্য আর কবর দেওয়া হয় না। তবে চাইলেই যাদের আমরা অতীত বলে ভাবি, কান পাতলে এখনও তারা এসে কানে কানে গল্প শুনিয়ে যান। 
মনে মনে হাসলাম। ভদ্রলোক বেশ রহস্য করে কথা বলেন।
বললাম, আপনার সাথে ডাইরেক্ট যোগাযোগ আছে বুঝি ?
-- পরীক্ষা চাই ?
বললাম, মন্দ কী ?
ভদ্রলোক খানিকটা সময় সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন । তারপর আস্তে করে বললেন, আপনি ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার নিচেই তো শুয়ে আছেন ওদের কেউ একজন । আপনার পায়ের চাপে হয়তো তার ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে।
আমি চমকে উঠলাম। তক্ষুণি ছিটকে সরে গিয়ে বললাম, স্যরি, বুঝতে পারিনি। 
ভদ্রলোক আবারো শব্দ করে হাসলেন। বললেন, ভয় নেই, না জানলে অপরাধ ধরা হয় না । 
তারপর একটু থেমে নিজে থেকেই বললেন, এই যে গীর্জাটি দেখছেন, এইটি তো এই সেদিন তৈরি হয়েছে। এখন যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং, ঠিক সেখানেই ছিল সেন্ট এ্যানি চার্চ।১৭৫৬ সালে সিরাজদৌল্লা যখন কোলকাতায় এসে ব্রিটিশদের আক্রমণ করলেন,তখন পুরনো ফোর্ট উইলিয়ামের সাথে সেন্ট এ্যানি চার্চ‌ও পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল। তাই লর্ড ক্লাইভ যখন আবার কলকাতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন তখন আর অবশিষ্ট কিছুই বেঁচে নেই। সব পুড়ে ছাই।
আমি শুনেছি । ভদ্রলোক বলেই চলেছেন, এদিকে মাদ্রাজ থেকে নতুন করে অতিরিক্ত সৈন্যরা এসেছে । তখন স্বাভাবিক ভাবেই মাথা গোঁজার জায়গার ভীষণ অভাব । সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকছেন । ধীরে ধীরে ১৭৮২ সাল নাগাদ নতুন করে ফোর্ট উইলিয়াম‌ও তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু চার্চ ? চার্চ কোথায় ? ব্রিটিশরা একটা ব্যাপারে কিন্তু ভীষণ গোড়া । প্রতি রবিবার সপরিবারে চার্চে আসা চাই। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ মহিলা সবার । শুধু ব্রিটিশ কেন প্রায় সব খ্রীষ্টানরাই এই ব্যাপারে ভীষণ শৃঙ্খলা পরায়ণ ।
কথাটা সত্যি । আমি আমার চেনা জানা লোকদের‌ও দেখেছি। রবিবার এলে চার্চে যাবেই। 
 আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি । ভদ্রলোক আপন মনেই বলে চলেছেন । বললেন, যারা ফোর্ট উইলিয়ামে আছেন তারা ফোর্টের মধ্যেই হাজির হতে হচ্ছেন, তাদের জন্যে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু যারা বাইরে থাকেন তাদের কিছু একটা ব্যাবস্থা হ‌ওয়া চাই। তখন ১৭৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস, জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিং এইসব লোকের জন্যে একখানা প্রেসিডেন্সি চার্চ তৈরি করার পরিকল্পনা নেন । 
কথাটা শোনা মাত্র‌ই মনে হলো ব্রিটিশ সরকার কতটাই না সচেতন তার সধর্মীদের নিয়ে, অথচ আমরা --
আমার ভাবনায় ইতি টেনে ভদ্রলোক বললেন, আপনি আবার ভাবতে যাবেন না যে সরকার এই চার্চটি বানিয়ে দিয়েছে।
--- তবে ? আমি অবাক । ভদ্রলোক যেন অন্তর্যামী । বললেন, সবটাই জনসাধারণের টাকায় । লটারী করে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল সেইসময়ে । সব মিলিয়ে মোট সংগ্রহ ১৭০০০০ টাকা, খরচ হয়েছে ১৮৪৮৩৬ টাকা । প্রথম দিনেই সংগ্রহের পরিমাণ ৩০০০০ টাকা । তবে টাকার পরিমান নিয়ে মতভেদ আছে শোনা যায়।
বললাম, আপনি তো অনেক কিছুই জানেন দেখছি ।
ভদ্রলোক ম্লান হেসে বললেন, সবটাই আমার নিজের চোখে দেখা ।
-- তার মানে ?
-- সে আপনি বুঝবেন না ।
আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারলাম না ।
একটু দম নিয়ে ভদ্রলোক আবার বললেন, আগে একসময়ে এখানেই বারুদ জমিয়ে রাখা হতো, বলতে পারেন বারুদের গোদাম । জায়গাটির মালিক ছিলেন সেই সময়কার রাজা - মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর । ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছে প্রকাশ করায় মহারাজা সত্ত্ব ছেড়ে দান‌ করে দেন এই জমিটি । দূর্জনে বলে মহারাজা উপায়ান্তর না পেয়েই নাকি বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন এই জমিটা। ব্রিটিশ সরকার চাইছে, ধরে রাখেন সাধ্যি কার ?
বললাম, আপনার কি মনে হয় ?
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, আমার মনে করাতে কি যায় আসে বলুন ? যা সত্যি, সেটাই ইতিহাস ।
 তারপর একটু থেমে বললেন, এইটাই কিন্তু কলকাতার বুকে প্রথম বারোয়ারী বিল্ডিং । ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তখনকার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস । তারিখ ১৭৮৪ সালের ৬ ই এপ্রিল। লন্ডনের "সেন্ট মার্টিন ইন দ্য ফিল্ডস' এর আদলে তৈরি । বেঙ্গল ইন্জিনিয়ার্স এর লেফটেন্যান্ট জেমস আগ ছিলেন স্থপতিকার । 
তারপর আমাকেই প্রশ্ন করলেন, কলকাতায় সবচেয়ে পুরনো চার্চ কোনটি বলতে পারবেন ?
আমি কি এত শত জানি নাকি, ইতিহাসে আমি চিরকাল‌ই দুর্বল। বললাম, স্যরি দাদা, আমি ঠিক ----।
--- জানেন না তো ? ইটস অল রাইট । আসলে কি জানেন কোলকাতার লোকেরা এখন কোলকাতাকেই ভুলে যেতে বসেছে। ইতিহাস সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নয়।
বললাম, শুধু কোলকাতাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এটা যুগের সমস্যা । পেটের ক্ষুধা যত তীব্র হচ্ছে, মনের ক্ষুধা ততই শুকিয়ে যাচ্ছে যেন ।
কথাটা ভদ্রলোকের খুব মনে ধরেছে মনে হলো। বারবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপর নিজে থেকেই বললেন, কোলকাতায় সবচেয়ে পুরনো চার্চ হচ্ছে আর্মেনিয়ান চার্চ, তারপর ওল্ড মিশন চার্চ আর তিন নম্বরেই এই পাথুরে গির্জা ।
বললাম, তাহলে তো এই চার্চের ঐতিহাসিক ভ্যালু বিশাল।
-- তবে আর কি ? কোলকাতার ইতিহাস জানতে হলে এখানে আপনাকে আসতেই হবে।
কোলকাতা শহরের তৃতীয় প্রাচীনতম চার্চ । কথাটা শোনার পর থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পাল্টে গেল । বারবার মনে হচ্ছিল এখানেই আনাচে কানাচে ইতিহাস জীবন্ত। শুধু দেখার মতো একটু দরদী চোখ চাই। অবাক বিষ্ময়ে দেখছি কোলকাতার প্রাচীনতম বারোয়ারী প্রাসাদ ।
 ভদ্রলোক কিছুটা সময় নিলেন। তারপর বললেন, আপনি তো জানেন, এই সেন্ট জনস চার্চ ১৮১৪সালে একটি ক্যাথিড্রাল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলো, লোকে বলত এঙ্গলিকান ক্যাথিড্রাল অব কোলকাতা । কিন্তু ১৮৪৭ সালে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চালু হয়ে যাবার পর সেন্ট জনস চার্চ তার সেই মর্যাদা হারিয়ে ফেলে ।
বললাম, শুনেছি ।
-- আর ওই যে দেখছেন ওইটিতে চার্চের বিশপ থাকেন। ভদ্রলোক প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন।
দেখলাম, গেটের পাশ ঘেঁষে পাহারাদারের ঘর । তার‌ই পাশ বরাবর একটা পাথুরে রাস্তা দক্ষিন থেকে উত্তরে চলে গেছে। কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের সমান্তরালে এগিয়ে গিয়ে শেষ সীমানায় বিশপের থাকার ব্যবস্থা । দূর থেকেই দেখা যায়। বাঁ'পাশে বেশ কয়েকটি পাশাপাশি জরাজীর্ণ ঘর। অযত্নে খুবই খারাপ অবস্থা । অবাক লাগলো এইরকম একটা পরিপাটি জায়গাতে এই ধরনের ঘর, একেবারেই বেমানান।
ভদ্রলোক মনের কথা পড়তে পারেন। বললেন, এগুলো আবর্জনা নয়, সেই সময়কার পালকি ঘর। তখনকার দিনে গাড়ি, স্কুটার কিছুই ছিল না যে । লোকে পাল্কী আর ঘোড়া গাড়িতেই যাতায়াত করতো। এই সেই পাল্কী ঘর ।
দেখলাম । হাতের ডানপাশটায় অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল একটা গির্জা। ইট ও পাথরের তৈরি নিওক্ল্যাসিকেল স্থাপত্য। উপরে বিশাল একটা পাথরের চূড়া, যেন আকাশ ছুঁতে চায়। একটা ঘড়ি নিঃশব্দে প্রহর গুনে চলেছে। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম।
ভদ্রলোক ছোট্ট করে বললেন, ১৭৪ ফুট।
-- কি ?
-- ওই চূড়াটি ।
আমার কাছে মাপার কোন যন্ত্র নেই, তবু চোখের অনুমানে ভুল মনে হলো না।
ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম চার্চের দিকে । ভদ্রলোক আটকে দিলেন। বললেন, আগে বাকিটা দেখে নিন, তারপর না হয় ওদিকটায় যাবেন। 
বললাম, তথাস্থু, যে ভাবে বলেন ।
হাতের বাম পাশেই স্বেতপাথরে বাধানো এক সুদৃশ্য সমাধি । সমাধির উপরে খোদাই করে নাম লেখা। থমকে দাঁড়ালাম । অবাক হয়ে দেখছি খোলা আকাশের স্বেত পাথরে বাধানো সমাধিটি। একসময়ের দাপুটে ভাইসরয় ও ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল আমার চোখের সামনে শুয়ে আছেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, ইনিই কি সেই ... ?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন একদমই ঠিক। তারপর নিঃশব্দে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সমাধির দিকে। দু একটা শুকনো পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল সমাধির উপরে। হালকা হাতে পাতা গুলো সরিয়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন প্রার্থনা করতে। আমি হতবাক, দাঁড়িয়ে আছি। বুঝতে পারছি না আমাকে কী করতে হবে। ভদ্রলোক ইশারায় আমাকেও বসতে বললেন। আমি আমার মতো করেই প্রার্থনা করলাম।
অল্প পরেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, একটা সত্যি কথা কি জানেন ? মানুষ কখনো মরে না। তার শরীর শেষ হয়ে যায়, সে কিন্তু বেঁচে থাকে অনেকদিন । ঠিক ততদিন যতদিন মানুষ তাকে মনে ধরে রাখে । ততদিন সে সব দেখতে পায়, শুনতে পায় ।
মনে মনে হাসলাম। লোকটা ভালো মক্কেল পেয়েছে আমাকে । যা-ই মনে আসছে তাই বলে যাচ্ছে । আমি কোন উত্তর দিলাম না।
ভদ্রলোক নিজের মনেই বলে চলেছেন। বললেন, পৃথিবীর কি অদ্ভুত নিয়ম দেখুন, সারা জীবন ধরে মানুষ শুধু জমিয়ে যায় কিন্তু যখন চলে যায়, কিছুই নিয়ে যেতে পারে না।, সব কিছু থেকে যায় এই পৃথিবীতে -- টাকা, পয়সা, ধন, দৌলত, সম্পত্তি, বন্ধু বান্ধব এমন কি নিজের শরীরটা পর্যন্ত পড়ে থাকে এই মালিকানাহীন পৃথিবীর বুকে, কিচ্ছু নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ওরা তখন সমস্ত রাগ, দুঃখ, আর অভিমানের উর্ধে ।
তারপর একটু সময় নিয়ে বললেন, এই লোকটার পুরো নাম মাইকেল হার্বার্ট রুডফ নচবুল (Michael Herbert Rudolf Knatchbull)। ১৯৩৩ সালে যখন ওর বাবা মারা গেলেন, তখন তাঁকে প্রথমে পঞ্চম Baron Brabourne ও পরে বোম্বের গভর্ণর হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। বেভোর্ন স্টেডিয়ামের নাম শুনেছেন ?
-- বোম্বাই-এ ক্রিকেট স্টেডিয়াম ?
-- একদমই তাই। এই লোকটাই সেই । ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ার (CCI) সেই সময়কার কর্মকর্তা এন্থনি ডি মেলোর সাথে আলোচনা করে এই লোকটাই ১৯৩৬ সালে ওই ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তারপর ১৯৩৭ সালে নাইট গ্রান্ড কমান্ডার অব দা ওর্ডার অব দা স্টার অব ইন্ডিয়া উপাধি নিয়ে আমৃত্যু ছিলেন বাংলার গভর্ণর। ১৯৩৮ সালের জুন মাসে যখন সেই সময়কার ভাইসরয় Lord Linlithgow ছুটি নিয়ে দেশে গেলেন তখন চার মাসের জন্য তাকে ভাইসরয়-এর দায়িত্বভারও নিতে হয়েছিল। মহম্মদ আলি জিন্নার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন ?
-- হ্যাঁ, অনেকবার। সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের নেতা।
-- শোন যায় ১৬ই অগাস্ট ১৯৩৮ সালে মুসলিম লিগের এই নেতা মাইকেল হাবার্টকে এক সাক্ষাৎকারে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকেই ভারতবর্ষের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য।‌ পরিবর্তে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন করতে প্রস্তুত। কিন্তু বাংলার গভর্ণর রাজি হননি সেদিন। 

আমি নীরব। এত কথা আমার জানা ছিল না। দূরে ঠিক পশ্চিম দিকে তিন তিনটি কবরে শায়িত কলকাতা সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি -- বেঞ্জামিন হীথ, রবার্ট হেনরি ক্লোসেট, ও ক্রীস্টোফার টুলেট । পাশেই শুয়ে জন মেথিয়াস টার্নার, লর্ড বিশপ অব কলকাতা । আলতো হাতে উপরের শুকনো পাতা গুলো সরিয়ে দিলাম। একটা ঠান্ডা হাওয়া ব‌ইছে, হালকা কিন্তু অনুভব করার মতো। 
একটু ফিরে আসতেই একখানা উঁচু স্মারক। দ্বিতীয় রোহিলা যুদ্ধে নিহত ইংরেজ সৈন্যদের স্মৃতিতে তৈরি। ভদ্রলোক বললেন, রোহিলারা আসলে আফগানিস্তান সীমানায় পস্তুন উপজাতির একটি অংশ। তাদের‌ই একটা দল উত্তর ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করতো । সময়টা ১৭৬১ সাল। অযোধ্যার নবাব সুজা- উদ-দৌল্লার সাথে মারাঠাদের যুদ্ধ বাঁধে । রোহিলারা ছিল তখন নবাবের মিত্র বাহিনী । যুদ্ধে মারাঠারা পরাজিত হয়েছিল। দশ বছর পর অবস্থার পরিবর্তন হলে মারাঠারা পাল্টা রোহিলা রাজ্য আক্রমণ করে। এবারে রাজা হাফিজ রহমত খান উপায়ন্তর না পেয়ে তখন অযোধ্যা রাজের সাহায্য প্রার্থনা করেন। চুক্তি হয় চার লক্ষ টাকার বিনিময়ে। রহমত খানের আর্থিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ । কোথায় পাবেন এত টাকা ? ফলে অদেয় থেকে যায় সেই টাকা। আর তাই নিয়েই ১৭৭৪ সালে রোহিলাদের সাথে অযোধ্যা রাজের যুদ্ধ বাঁধে। ১৭৭৪ সালের সেই যুদ্ধে ব্রিটিশরাও সামিল হন নিজেদের স্বার্থে । সরাসরি যুদ্ধ নয়, দিল্লিতে তখন মারাঠাদের প্রতিপত্তি । ওয়ারেন হেস্টিং দেখলেন, মারাঠাদের সাথে যদি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হয় তবে অযোধ্যা নবাবের শক্তি বৃদ্ধি বিশেষ প্রয়োজন । আর ঠিক সেই কারণেই অযোধ্যা নবাবকে সাহায্য করতে গিয়ে ব্রিটিশরা রোহিলাদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন । যুদ্ধে রোহিলারা খুব বাজে ভাবে পরাজিত হয় আর সেই সুবাদে অযোধ্যার নবাব সেনারা ধন দৌলত সহ ঘরে ঘরে গিয়ে রোহিলা নারীদের পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যায়। পরবর্তী কালে ওয়ারেন হেস্টিংকে তার ঠিক এই কাজটির জন্যে অনেক সমালোচনার সম্মুখিন হতে হয়েছিল। সেই যুদ্ধে নিহত ইংরেজ সৈন্যদের স্মৃতিতেই তৈরি এই স্মৃতি সৌধ। 
দেখলাম, বারোটি থামের উপর গোলাকার আকৃতির ডোম। অনেকটাই উঁচু । ফলকে খোদাই করা নিহতদের নাম। সুন্দর, অক্ষত তবে পরিচর্যার অভাব।
ভদ্রলোক বললেন, বুঝতেই পারছেন, কোরোনা পরবর্তী সময়, এখন‌ও সেই ভাবে কাজ শুরু হয়নি, তবে খুব তাড়াতড়ি শুরু হয়ে যাবে, তখন দেখতেও ভালো লাগবে।
উত্তর দিয়ে অযথা কথা দীর্ঘ করে কী লাভ। ততক্ষণে চোখ চলে গেছে পাশেই পশ্চিমের পাঁচিল ঘেঁষেই আরো একটা খুব সুন্দর স্মৃতি সৌধের দিকে । 
ভদ্রলোক আস্তে করে বললেন, এটিই ব্ল্যাক হোল অফ ক্যালকাটা মনুমেন্ট। কলকাতার কলঙ্কিত ইতিহাস ।
ব্ল্যাক হোল অফ ক্যালকাটা মনুমেন্ট সম্পর্কে শুনেছি অনেক, চোখে দেখা হয়নি কখনো ।
 নবাব সিরাজদৌল্লা যখন কোলকাতা আক্রমণ করে নিজের দখলে নিয়ে এলেন, তখন প্রায় একশত পঞ্চাশজন ইংরেজ যুদ্ধ বন্দিকে বন্দি করে একটা কোঠায় আটকে রাখেন। সময়টা সম্ভবত ২০ জুন ১৭৫৬ । গরমে আর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে অনেকেই সেখানেই মারা যান। যারা বেঁচে ছিলেন তাদের‌ই একজন জন হল‌ওয়েল । পরবর্তী কালে তিনিই ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন আর গভর্নর জেনারেল হয়ে জিপিওর কাছে যুদ্ধ বন্দি ওই সব‌ মৃত সৈনিকদের স্মরণে একটা স্মৃতি সৌধ তৈরি করেন তিনি । ১৮২২ সালে সম্ভবত কোন এক কারণে সেই সৌধটি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে ১৯০১ সালে রাইটার্স বিল্ডিং এর দক্ষিণ পশ্চিম কোণে লর্ড কার্জন এইটিকে পুনরায় স্থাপন করেন। আবার ১৯৪০ সালে যখন কোলকাতায় স্বাধীনতা আন্দোলন তুঙ্গে তখন ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে আবার এইটিকে স্থানান্তরিত করা হয়, সরিয়ে আনা হয় সেন্ট জনস চার্চে । এখনো সেই অবস্থাতেই আছে । গল্পটা আমার জানা, তবে শুনেছি শুধু সংখ্যা নয় গল্পের বাস্তবতা নিয়েও বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত আছে। বললাম, এই ইতিহাসটুকুু আমি জানি তবে যতদূর শুনেছি সবটাই মনগরা আজগুবি গল্প । অনেকেই সেই কথা বলে ।
-- লোকে কি বলে তাতে কি যায় আসে ? যা ঘটেছে সেটা অস্বীকার করতে পারেন ? ভদ্রলোক রীতি মত মুখ চোখ খিঁচিয়ে বললেন।
বললাম, রাগ করছেন কেন ? আমি যা জানি তাই বললাম। তাছাড়া পরবর্তী কালে ইতিহাসবিদরাও এই ঘটনাটিকে সিরাজদৌল্লাকে হেয় করার জন্যে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বানানো একটা গল্প বলেই উল্লেখ করেছেন, আপনি কি সেটা জানেন না ?
-- তার মানে ?
আমি হেসে বললাম, মানে মিথ্যে। গল্পটাই মিথ্যে। ঐতিহাসিকরাও এখন স্বীকার করেন যে এই গল্পে সত্যতা নেই ।
ভদ্রলোক একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে র‌ইলেন কিছুক্ষণ । যেন সম্ভব হলে আমাকে এই মূহুর্তেই দুএকটা ঘা বসিয়ে দেবেন । খুব অস্বস্তি করছিল । একটু সময় নিয়ে বললেন, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা গল্পের পিছনেও একটা গল্প থেকে যায়, মানেন কি ?
বললাম, হয়তো ।
-- তাহলে জেনে নিন সত্যিটা । সংখ্যাটি মিথ্যে হতে পারে কিন্তু ঘটনাটি তো সত্যি । একটা ছোট্ট কোঠায় দুটো মাত্র জানালা ।গাদাগাদি করে লোক ঢোকানো হয়েছে কোঠায়। গরমে আর অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল সবার । দূর্গের এদিক ওদিক আগুন জ্বলছে , ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্ত আর লাশ । এভাবে আদৌ বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা ঈশ্বর জানেন ! জলের অভাবে গলা শুকিয়ে কাঠ । বারবার জল চাইছি, কেউ কথা শুনছে না । 
--- চাইছি মানে ?
--- কথার মধ্যে কথা বলবেন না । ভদ্রলোক প্রায় ধমকে উঠলেন ।
আমি চুপ । ভদ্রলোক বলতে থাকলেন, খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এর চেয়ে যুদ্ধ ভালো । একটা সিপাহীকে অনেক টাকা উৎকোচ দিয়ে রাজি করানো গেল নবাবকে আর্জি পৌঁছে দেবার জন্যে, যাতে অন্তত একটা বড় ঘর কপালে জোটে। কিন্তু কোন লাভ হলো না। এরপর আরো একজন সিপাহীকে রাজী করানো হলো দুই হাজার টাকার বিনিময়ে, কিন্তু সেও ফিরে এলো, কারণ নবাব সেই সময়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন । অবশেষে একজন সেপাহী দয়া দেখিয়ে কিছু জল খেতে দিলেন বন্দিদের । কিন্তু দরজা খোলা যে সম্ভব নয়। উপায় না পেয়ে গরাদের ফাঁকে টুপিতে জল নিতেই তুলকালাম কান্ড । নিজেদের মধ্যেই মারামারি ধাক্কাধাক্কির শুরু । সেকি ভয়ঙ্কর অবস্থা। প্রাণের তাগিদে কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। সবার‌ই এক ফোঁটা জল চাই । ফলে যা হয় সব জল এমনিতেই নষ্ট হয়ে গেল। উল্টো মারামারি ধাক্কাধাক্কিতে কিছু লোক শ্বাস বন্ধ হয়ে, কিছু লোক পায়ের চাপে শেষ । সবাই তেষ্টার তাগিদে জানলার কাছে যেতে চায় । একসময়ে ধস্তাধস্তি থামলে দেখা গেল অধিকাংশ লোক ইতিমধ্যেই মরে শেষ হয়ে গেছে। যারা বেঁচে আছে তারাও মৃতপ্রায় ।
ভদ্রলোক এমন ভাবে গল্পটা বললেন যেন উনি সেই সময়ে ওই কোঠাতেই ছিলেন । ওর চোখ ছলছল করছিল ।
সত্যি দুর্ভাগ্যজনক । ভাবতেই শিঁউড়ে ওঠে মন। বললাম, শুনেছি এইরকম‌ই কিছু একটা লিখা আছে হল‌ওয়েলের ব‌ইএ । তবে সিরাজদৌল্লা এমনি একটা কাজ করবেন মন যে মানতে চায় না ।
ভদ্রলোক একটু্ সময় নিলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ নবাব নিজেও জানতেন না বিষয়টি । এই ছোট্ট কুঠুরীতে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন তার অধঃস্তন কর্মীরা । হল‌ওয়েল সাহেব‌ও পরবর্তী কালে এই কথাটি স্বীকার করেছিলেন।
গল্পটা কতটা সত্যি কতটুকু মিথ্যে ঈশ্বর জানেন, আর জানেন ইতিহাসবিদগণ । আমি শুধু ভাবছি সেইসব অভাগাদের কথা যারা যুদ্ধে আত্মসমর্পন করেও প্রাণে বাঁচতে পারলো না । তাদের মধ্যে নিশ্চয়‌ই ভারতীয় সিপাহীও ছিল অনেক । বেচারা !
কথা বলতে বলতে আমরা উত্তর দিকে কিছুটা
 এগিয়ে গেছি । একটা গেট টপকে সামনেই আটকোনা মুরিশ স্টাইলের সমাধি ।ভদ্রলোক না বলে দিলে জানতেই পারতাম না এই সেই সমাধি যা দেখতে আমি এককথাতেই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম । এখানেই শুয়ে আছেন জব চার্নক, একসময়ে যাকে কলকাতার জনক বলা হতো। মৃত্যু তারিখ ১০ জানুয়ারী ১৬৯২ সাল।
জায়গাটি অপরিষ্কার, শুকনো পাতা আর ধুলোর আস্তরন। সমাধি ঘিরে প্রত্যেক দিকে আরো তিনটে করে সমাধি ফলক। ধুলো র আস্তরনে বোঝার উপায় নেই কারা শুয়ে আছেন এখানে। পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতেই তিনটি দিকের প্রবেশ দ্বার দিয়ে দেখা যায় পশ্চিম প্রাচীরের উপরে এপিটাফটি। কালো পাথরের ল্যাটিন ভাষায় খোদাই করে লেখা । ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তিনটি শব্দ -- ডি ও এম ডমিনুস অমনিউম ম্যাজিস্টের অর্থাৎ ঈশ্বর সকলের কর্তা। এই সমাধিটি মাদ্রাজ থেকে আনা পল্লভম শিলা দিয়ে তৈরি। কলকাতায় ওই সময়ে এই পাথরের ব্যবহার ছিল বিরল । পাথরটির নাম দেওয়া হয়েছিল চার্নকাইট। চার্নকের পাশেই শুয়ে আছেন তার দুই কন্যা মেরি ও ক্যাথরিন। সমাধিটি তৈরি করেছেন চার্নকের জামাতা স্যার চার্লিস আইয়ার ১৬৯৫ সালে। শোনা যায় এখানেই নাকি শুয়ে আছেন চার্নকের হিন্দু পত্নী মারিয়া। লোকে বলে চার্নক নাকি সঙ্গীদের সাথে হুগলি নদীর তীরে গিয়েছিলেন কোন এক কারণে। ওখানে তখন এক সদ্য বিধবা মহিলাকে সতী আখ্যা দিয়ে সহমরনের আয়োজন চলছিল। চার্নক সেই মহিলাকে উদ্ধার করে নিজের কাছে আশ্রয় দেন । কেউ বলেন চার্নক এই মহিলা কে বিবাহ করেছিলেন আবার কিছু ইতিহাসবিদ তা মানতে নারাজ । তবে এই মারিয়ার সাথে তিনি দীর্ঘদিন সুখে ঘর করেছেন এবং তাদের যে তিনটি কন্যা ছিল সেই বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।
জব চার্নকের সমাধির পাশেই দেখলাম আরো চারটে স্মৃতি স্তম্ভ। প্রথমেই ব্রিটিশ নৌসেনার অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসন । আছেন উইলিয়াম স্পেইক নামে এক সার্জেন, তারপরেই মিসেস এলিনোর উইন‌উড, এবং সবশেষে মিসেস এলিজাবেথ। তার মৃত্যু হয়েছে ১৬ই সেপ্টেম্বর ১৭৬৭ এবং তার ঠিক একমাস সাতাশ দিন পর ১৭ ই নভেম্বর তার ছেলে মারা যায় । ভদ্রলোক দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, এবারে অঙ্ক কষে দেখুন মিলছে না । মায়ের মৃত্যুর চার পাঁচ দিন পর কি করে বাচ্চার জন্ম হয় ?
দেখলাম সত্যিই তো, কি করে সম্ভব ! দুজনেই দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম ।
ওখান থেকে বেরিয়েই আসতাম কিন্তু ইশারায় আরো একখানা সমাধি দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন ওইটাও দেখে আসুন একবার।
-- ওটা আবার কার সমাধি ? আমি অবাক হয়ে বললাম।
ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, এখানে শুয়ে আছেন কোলকাতার প্রাচীনতম ব্রিটিশ বাসিন্দা, বেগম ফ্রান্সেস জনসন। এই মহিলা ছিলেন বাংলার উপর ব্রিটিশ শাসনের সূচনা অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে উনিশ শতকের গোড়ায় ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার সাক্ষী । তার জন্ম হয়েছিল মাদ্রাজ থেকে ১০০ মাইল দূরে এখন বিলুপ্ত ফোর্ট সেন্ট ডেভিডে।
ভদ্রলোক ভালো গল্প বলতে পারেন। বললেন, বাবা ক্রুক আর মা ছিলেন পর্তুগীজ মহিলা ইসাবেলা বেইজর । তিনিও ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভব। ফ্রান্সেসের জীবনের প্রথম ভাগ কেটেছে মাদ্রাজে এবং বাকীটুকু বাংলায়। এই মহিলা একটাই জীবনে চার চারবার বিবাহ করেছেন ভাবতে পারেন ? আবার ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে। প্রথম স্বামী ছিলেন সেই সময়ে কলকাতার গভর্নর থমাস ব্রডিলের ভাইপো বা ভাগ্নে প্যারী পার্পলার টেম্পলার। তাদের দুটো সন্তান‌ও হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামী সহ দুই সন্তানই মারা যায় । তারপর দ্বিতীয় বিয়ে হয় জেমস অল্থামের সাথে । এই বিয়ের মেয়াদ এক পক্ষের‌ও কম । এবার‌ও বিয়ের পনেরো দিনের মধ্যেই বসন্ত রোগে স্বামীর মৃত্যু। তারপর ১৭৪৯ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়েসে ২৪ মার্চ ফ্রান্সেস তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেন সেই সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ অফিসার উইলিয়াম ওয়াটস-কে । তিনি ছিলেন কাশিমবাজার কুঠির অধিকর্তা ।
বিয়ের প্রথম কয়েক বছর সুখেই কেটেছিল । সিরাজদৌল্লা যখন কাশিমবাজার আক্রমণ করলেন তখন যুদ্ধে স্বামী স্ত্রী দুজনেই সিরাজদৌল্লার হাতে বন্দি। সঙ্গে তিন নাবালক ছেলে মেয়ে। এবার এরা সবাই রাজবন্দি, রাজবন্দিদের ব্যবস্থাই আলাদা। তিন ছেলে মেয়ে সহ ফ্রান্সেসকে রাখা হলো সিরাজের দিদিমা আলীবর্দী খাঁর স্ত্রী নানিবেগমের কাছে আর ওয়াটসকে রাখা হলো অন্যান্য রাজবন্দিদের সাথে। উইলিয়াম ওয়াটস খুব ভালো বাংলা বলতেন। এই বিয়ের পর ফ্রান্সিস‌ও এত দিনে বাংলা ভালো শিখে নিয়েছেন। ফলে নানিবেগমের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে গেল । তিনি চলে গেলেন চন্দননগরে । 
তারপর অনেক ঘটনা । অবশেষে পলাশীর যুদ্ধের সাথে সাথেই তার বন্দী দশা শেষ। ১৭৫৮ সালে উইলিয়ামকে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দিয়ে দেশে ফিরে যেতে চাইলেন। স্বভাবত‌ই ফ্রান্সেস ক্রুক‌ও স্বামীর সাথে চলে যান বিদেশে। ওখানে প্রায় পাঁচ বছর সুখের সংসার। তারপরেই উইলিয়ামের মৃত্যু। স্বামীকে হারিয়ে পাঁচ বছর ফ্রান্সেস ইংলন্ডেই বৈধব্য জীবন কাটিয়েছিলেন । তারপর প্রায় দশ বছর বিদেশে থেকে আবার ফিরে আসেন কোলকাতায়। ছেলে মেয়েদের ছেড়ে মধ্য চল্লিশে কোলকাতায় চলে আসাটা সেই সময়ে তুলনায় অনেকটাই সাহসী পদক্ষেপ ছিল । ওদের সাথে আবার কবে দেখা হবে সেই আশাই ক্ষীণ। আবার ভারতবর্ষে তখন তার বাস্তবিক‌ই কোন কাজ নেই । অথচ তিনি ফিরে এলেন কোলকাতায় সুয়েজ ক্যানেলের মধ্য দিয়ে। তখন সবেমাত্র সুয়েজ ক্যানেল দিয়ে যাতায়াত শুরু হয়েছে । খুব সাহসী অভিযান । কেন তিনি ফিরে এলেন সেই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক কিন্তু তিনি যে ফিরে এসেছিলেন সেই বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই । ১৭৭২ সালে তিনি চতুর্থবার বিয়ের পিড়িতে বসেন উইলিয়াম জনসনের সাথে। এই রেভারেন্ড উইলিয়াম জনসন ও ওয়ারেন হেস্টিংসের আগ্রহেই তৈরি হয়ছিল সেন্ট জনস চার্চ । ১৭৮৮ সালে সেই রেভারেন্ড উইলিয়াম‌ও চার্চের দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে গেলেন । বেগম ফ্রান্সেস আর যেতে চাইলেন না, ফলে আবারো বিবাহ বিচ্ছেদ । জীবনের বাকি বছর তিনি আর বিয়ে করিনি । তবে দাসদাসী পরিবৃতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এক বিলাসবহুল জীবন কাটিয়ে গেছেন বর্ণময় ইতিহাসের স্বাক্ষী বেগম ফ্রান্সেস জনসন। তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি সেই রবার্ট ক্লাইভ থেকে শুরু করে লর্ড মিন্টোর শাসনকাল অবধি দেখেছেন। যেমন দেখেছেন সিরাজদৌল্লাকে আবার নানিবেগমকে। দেখেছেন বর্গীদের ভয়ে মারাঠা খাল কাটতে আবার তিনিই দেখেছেন সেই মারাঠাদের‌ পতন। দেখেছেন নন্দকুমারের ফাঁসি, আবার ফ্রান্সিস - হেস্টিংএর ডুয়েল । দেখেছেন বাবুদের দূর্গোৎসব, নীলকুঠীর পত্তন, ছিয়াত্তরের মনন্তর। দেখেছেন ছাপাখানার ব্যবসা শুরু থেকে ব্যাঙ্ক ইনসিওরেন্স কোম্পানির সুত্রপাত । রাজভবন টাউনহল তৈরি হতেও দেখেছেন তিনি। তাই তার গল্পের ভান্ডার বিশাল। ১৮১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী তার মৃত্যু হয়। ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী লর্ড লিভারপুল ছিলেন এই বেগম জনসনের‌ই নাতি।
বেগম সাহেবার গল্প শুনতেই অনেকটা সময় কেটে গেছে । বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে আর বেশি দেরী নেই।
বললাম, অনেক সময় কেটে গেছে । এখন অন্য কিছু নয় শুধু চার্চ দেখেই ফিরে যাবো।
ভদ্রলোক আমাকে মাঝ পথে থামিয়ে বললেন, বেশ তবে চার্চের ভেতরে তো কথা বলা উচিত নয়, তাই যদি আপত্তি না থাকে তাহলে দুমিনিট আমার কথা শুনে নিন, তারপর ভিতরে গিয়ে মিলিয়ে দেবেন।
বললাম, বেশ, বলুন ।
ভদ্রলোক হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমরা তো আজকের সফরের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে গেছি । এই চার্চটি দেখেই আমাদের আজকের মতো দেখা শেষ ।
আমি উত্তর দিলাম না । ভদ্রলোক একটু দম নিলেন। তারপর নিজেই বললেন, চার্চটি ভালো করে লক্ষ্য করুন, ডোরিক থামের বারান্দা, আর পিরামিডের মতো বেল টাওয়ার। কত ফুট উঁচু মনে আছে তো ?
হেসে বললাম, মনে আছে , ১৭৪ ফুট।
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, লক্ষ্য করুন ঘড়িটা কিন্তু এখনো ঠিক চলছে। এই বেল টাওয়ারে ব্যবহার করা পাথর সেই সময়ে খুব কম পাওয়া যেতে । তাই এই চার্চটিকে পাথুরে চার্চ‌ও বলেন অনেকে ।
একটু সময় কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, আমি তো আগেই বলেছি চার্চের মূল প্রবেশ পথ ছিল পূর্ব দিকে । আমরা পশ্চিম দিক থেকে চার্চে ঢুকবো। আরো একটা পথ আছে, কিন্তু সেটা পরিত্যক্ত।
বারান্দাতেই আছে দুটো ফলক একটা ওয়ারেন হেস্টিংসের ভিক্তিপ্রস্তর অন্যটি মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের জমি দানের বিষয়।
 বারান্দা পেরিয়ে গেলেই দেখবেন হাতের দুপাশে দুটো কোঠা। বাদিকের ঘরটা সেই সময়ে পোশাক বদলানোর জন্যে ব্যবহার করা হতো । দেখবেন এখনো আছে কাঠের তৈরি হ্যাঙ্গার , তাতে পোর্সিলিন আর পিতলের হুক। ডানদিকের ঘরটি ওয়ারেন হেস্টিংসের অফিস ঘর। ওখানেই আছে হেস্টিংসের স‌ই করা পোর্ট্রেট, তার ব্যবহার করা চেয়ার টেবিল, ম্যান্টেল ঘড়ি, অজস্র পুরনো ছবি আর শংসাপত্র । মূল চার্চ ভবনের উত্তর আর পূবদিকে আছে আটটি করে কম্পাসের মাথাওয়ালা জানালা, সমতল ছাদ । ভেতরে দুই সারি কম্পোজিট কলম দিয়ে আইল আর নেভে ভাগ করে বসার জায়গা । শুরুতে অল্টারের দুদিকে সিঁড়ি বেয়ে গ্যালারী ছিল, যেখানে গভর্নর জেনারেল, তার পার্ষদ, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি আর মহিলারা বসার সুযোগ পেতেন । ১৯০১ সালে সেই দুটো গ্যালারীই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে । এখন শুধু দক্ষিণ পশ্চিম কোণে কাঠের সিঁড়ি সহ ছোট্ট অংশ দেখতে পাওয়া যায়। হলের ভেতরে গৌর থেকে আনা নীলাভ মার্বেল। 
ভদ্রলোক কথাগুলো বলছেন যেন কেউ ছবি দেখে কথা বলছে । একসাথে এত তথ্য মনে রাখা কঠিন, তবু শুনে যাচ্ছি যাতে ভেতরে গিয়ে মিলিয়ে নিতে পারি । 
আমাকে বললেন, দেখবেন চার্চের মূল অল্টারটি সংস্কার করা । একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন । অর্ধবৃত্তাকার মুরাল দুটো আয়নিক কলাম দিয়ে সাজানো। লর্ডের টেবিলে রাখা আছে সুন্দর পিতলের ক্রশ । দুপাশে মোমবাতি । এখানেই অল্টারের নীচে কবর দেওয়া হয়েছিল বিশপ মিডলটনকে । এপ্সের ঠিক আগে কালো পাথরে চিহ্নিত সেই জায়গা । লেখা আছে ,টি এফ এম ,ডি ডি একাউণ্ট জুলাই ৮, ১৮২২ । টি এফ এম অর্থাৎ থোমাস ফ্যানশো মিডলটন, কলকাতার প্রথম বিশপ । এমনিতে দেখা যায় না। চার্চ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলে দেখতে পাবেন ।
অল্টারের আরো তিনটে ফলক আছে । প্রথমটি কলকাতার তৃতীয় বিশপ মেথিয়াস টার্নার, মাদ্রাজের বিশপ তথা কলকাতার প্রাক্তন আর্কেডিকন রেভারেন্ড ডানিয়েল ক্যুরী ও তৃতীয়টি বাংলার প্রথম আর্কেডিকন হেনরী লীওড লোরিং । ডান পাশে লেডী চ্যাপেল । আছে ডেমি অল্টার, লর্ডের টেবিলে সাজানো কাঠের ক্রুশ । পেছনে তিন পাটের জানালায় সেইন্ড গ্লাসের কারুকার্যে যীশুর জীবনী ।
অল্টারের বাম পাশে বিশাল পাইপ অর্গান । ভালো করে দেখে নেবেন এই অর্গানটি । এখনো সচল । এই পাইপ অর্গানটি এখানে বসানো হয়েছিল ১৮২৪ সালে। নানা আকারের প্রায় দেড় হাজার পাইপের মধ্যে হাপর দিয়ে হাওয়া দেওয়া হতো । প্রথম দিকে মানুষ‌ই হাপরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে হাপর চালাতেন কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ হয়ে যাবার পর সেই সমস্যা মিটে যায় । অর্গানটি তৈরি করেছিলেন ইংলন্ডের বিখ্যাত কোম্পানি উইলিয়াম হিল এন্ড সন্স ও নরম্যান অ্যান্ড বিয়ার্ড লিমিটেড । বর্তমানে এত বিশাল আর সচল পাইপ অর্গান ভারতবর্ষে আর কোথাও দেখতে পাবেন না ।
একটু দম নিয়ে আবার বললেন, পাইপ অর্গানের বা'পাশেই যে ছবিটি আছে সেইটি লিওনার্দো দা ভিন্সির লাস্ট সাপার অনুকরণে বিখ্যাত জার্মান শিল্পী জোহান জোফানির আঁঁকা লাস্ট সাপার । একদম হুবহু এক কিন্তু নয় । শোনা যায় ছবিতে চরিত্রগুলো সেইসময়কার কলকাতার বিশেষ ব্যক্তিদের অনুকরণে আঁঁকা হয়েছিল । এছাড়াও ছবিতে আরো তিনটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো । প্রথমত, বাম কোনে একটি সাধারণ তলোয়ার, দ্বিতীয়ত মেটেলের জলের পাত্র অনেকটা ভারতীয় পিকদানীর মতো ও তৃতীয়ত উটের চামড়ায় তৈরি ভিস্তিওয়ালাদের ভিস্তি ব্যাগ । ছবির এই অংশগুলো অন্য ছবির সাথে কখনোই মিলে না ।
--- হাতে আঁঁকা আসল ছবি ?
--- একদম‌ই তাই । আর এই কারণেই এই ছবিটির ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বেশি । এছাড়াও এখানে 
আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতি ফলক, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কলকাতা লাইট হর্স ম্যামোরিয়াল । আছে খুব একটা সুন্দর স্মারক ।ডানদিকে একজন উর্দি পড়া সিপাই অন্যদিকে একজন মহিলা শোকাগ্রস্ত , মধ্যখানে একটি কাস্কেলে অস্ত্র আর পদক । আছে সিপাই বিদ্রোহে শহীদ হয়ে যাওয়া সৈনিকের স্মৃতিফলক । আছে লেডি চ্যাপেলের ঠিক আগে দক্ষিণের দেওয়ালে অ্যাংলো নেপাল যুদ্ধে লেঃ পিটার ল্যাটিয়ের স্মৃতি স্তম্ভ। এখানেও দেখার জিনিস -- একজন দেবদূতের খোলা কফিনের দিকে তাকিয়ে আছে এক ভারতীয় সিপাই । আরো আছে চার্চের দক্ষিণ দেওয়ালেই রয়েছে জেমস অ্যাচিলিস কার্কপ্যাট্রিকের স্মৃতি সৌধ‌ । হায়দ্রাবাদের রাজকুমারীর সাথে কার্কপ্যাট্রিকের প্রেমকাহিনী নিয়ে উইলিয়াম ডালরিম্পল লিখেছিলেন ঐতিহাসিক বেস্ট সেলার 'হোয়াইট মুঘল' । নাম শুনেছেন ?
বললাম, শুনেছি তবে পড়িনি ।
-- এই সেই । আবার এই দক্ষিণ দেওয়ালেই আছে উইলিয়াম ডালরিম্পল এর পূর্বপুরুষ জেমস প্যাটিল ও তার স্ত্রীর স্মৃতি সৌধ‌। এখানেও একটা গল্প আছে, শুনতে চান ?
বললাম, গল্প যদি গালগপ্প না হয় শুনতে আপত্তি কি ? বলুন, শুনে নিই ।
ভদ্রলোক বললেন, এই যে জেমস প্যাটিল, তিনি ছিলেন ভীষণ দুষ্ট লোক । লোকে বলে এতটাই খারাপ যে শয়তান‌ও তাকে ভয় পায় । সেই জেমস যখন মারা গেলেন তখন তার শেষ ইচ্ছে ছিল তাকে যেন তার দেশে সমাধিস্থ করা হয় । পয়সাওয়ালা সাহেব বলে কথা। মরার পরেও কিছু সখ পূরণের থেকে যেতেই পারে । তা সেই সখ বা ইচ্ছে অনুযায়ী তার শরীর মদের মধে ডুবিয়ে নাবিকেরা যাত্রা করেছিলেন গার্ডেন রীচের ঘাট থেকে । তখনকার দিনে এটাই ছিল নিয়ম । মদ ভর্তি কফিন রাখা হলো মিসেস প্যাটিলের কেবিনে । শোনা যায়, মাঝ রাতে নাকি কোন না কোন ভাবে প্যাটিলের লাশ কফিন ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ে আর তাই দেখে মিসেস প্যাটিল তখন‌ই সেখানে মারা যান । এবার দুটো লাশ একটা কফিনে রাখলে স্বাভাবিক ভাবেই মদ কমাতে হয় । এবার মদ কমাতে গিয়ে মদ খেয়েই নাবিকেরা পাড় মাতাল । ফলে যা হয় জাহাজ বেসামাল হয়ে হুগলি নদীতে দুটো লাশের‌ই সলিল সমাধি । তাই লক্ষ্য করবেন দক্ষিণের দেওয়ালে স্মৃতি ফলক আছে কিন্তু কোথাও সমাধি নেই ।
তারপর একটু থেমে বললেন, যান দেখে আসুন । আর হ্যাঁ, আরো একটা ফলক না দেখলে আপনার দেখা হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আলেক্সান্ডার কলভিনের স্মৃতিতে রিচার্ড ওয়েস্টমেকটের তৈরি স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে নেবেন । ‌উপরে দুজন মহিলা দুদিকে বসে আছেন, তারা হচ্ছেন শিল্পের প্রতীক আর নীচে একজন ভারতীয় মহিলা শীতল পাটিতে বসা, কাছেই একটা কলস, কুঠির শিল্প। খুব সুন্দর । সবশেষে উত্তর দিকের বারান্দায় সুন্দর স্মৃতি সৌধটি
হচ্ছে ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিংএর স্ত্রী শার্লট ক্যানিং -এর। কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি বিক্রেতা ভীম চন্দ্র নাগ এই লেডি ক্যানিংকেই সম্মান জানিয়ে মিষ্টির নাম রেখেছিলেন 'লেডিকেনি'। ১৮৬১ সালে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর পর ব্যারাকপুরের লাটবাগানে তাকে খবর দেওয়া হয়েছিল। এই স্মৃতি সৌধটি তার ঠিক হুবহু প্রতিরূপ। 
একশ্বাসে এতগুলো কথা ভদ্রলোক একটু থামলেন। বললেন, আমি ওদিকটায় আছি । 
-- সেকি আপনি সাথে যাবেন না ?
ভদ্রলোক হেসে বললেন, আপনি যান, আমি এখানেই আছি । আর যদি আমাকে খুঁজে না পান তবে ওই ব্ল্যাক হোল আশেপাশেই আমাকে পেয়ে যাবেন । কোন চিন্তার কারণ নেই যা বলেছি, মিলিয়ে নেবেন। অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে দেখে নেবেন।
অগত্যা একাই চলে গেলাম ভেতরে । ভদ্রলোক ঠিক যা যা বলেছিলেন, হুবহু তাই দেখলাম ভিতরে । এত কিছু ভেতরে যে ভদ্রলোক না বলে দিলে সম্ভব ছিল না সব খুঁটিয়ে দেখার ।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে । বাইরে প্রায় অন্ধকার, কিন্তু তখনো অন্ধকার হয়নি । অনেকটা সময় ভিতরে কেটে গেছে, বুঝতে পারিনি । কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসে আমি অবাক ভদ্রলোক কোথায় ? এদিকে ওদিকে খুঁজছি, কিন্তু কোথাও নেই । একটা লোক নেই যে কাউকে জিজ্ঞেস করবো । পায়ে পায়ে একটু এদিকে ওদিকে খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু কোথাও নেই । ভদ্রলোককে তার পাওনা টাকাও দেওয়া হয়নি । ভাবলাম অফিসে যোগাযোগ করে ওখানেই জমা রেখে দেবো ।ওমা ! ফিরে এসে দেখি চার্চ বন্ধ হয়ে গেছে । কি করে হলো, এই একটু আগেইতো আমি নিজে বেরিয়ে এলাম । খুব ভয় লাগলো । ভাবছি কি করি, চলেই যাবো কিনা, হঠাৎই মনে পড়লো ভদ্রলোক বলেছিলেন ব্ল্যাক হোলের ওদিকটায় থাকতে পারেন, কিন্তু কোথায় ? কেউ নেই তো সেখানে । আশেপাশে একটা বিশ্রী গন্ধ, গা গুলিয়ে আসছে । হঠাৎই নজরে এলো ভদ্রলোকের টুপিটা ঠিক ব্ল্যাক হোলের সামনে পরে আছে । আমি পকেটে থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে তাড়াতাড়ি টুপিতে রেখে দিলাম । একটা কুকুর দূরে কোথাও বিশ্রী ভাবে কা‍ঁদছে । বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবার অবস্থা ।টাকাটা রেখেই আমি পড়ি কি মরি ছুট । যে করেই হোক আমাকে এখান থেকে বেরোতে হবে । ছুটতে ছুটতে গেটের পাশে এসে আরো ভয় পেয়ে গেলাম ।গেট বন্ধ, কী সাংঘাতিক কান্ড । আমাকে ভেতরে রেখেই গেট বন্ধ হয়ে গেল ? এখান থেকে আমাকে এখন বেরোতেই হবে । ভয়ে হাত পা শিথিল হয়ে আসছে । মনে প্রচন্ড শক্তি এনে লোহার গেট বাইতে শুরু করছি, কোনক্রমে গেটের ওপাশটায় যেতেই নজর পড়লো মাঠের দিকটায় । ওমা ওই তো সেই লোকটা । আমার দিকে ফিরে বারবার টুপি নাড়ছে । তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিল ? হাত শিথিল হয়ে আসছে । আমার শরীর আমার কথা শুনছে না । উপর থেকে টপ করে মাটিতে ছিটকে পড়লাম । তারপর আর কিছুই বলতে পারি না । যখন আমার জান ফিরলো, আমি তখন একটা চায়ের দোকানে ব্রেঞ্চে শোওয়া। অনেক কষ্টে ওঠার চেষ্টা করছি, আশেপাশে সবাই ব্যস্ত হয়ে আমাকে শুয়ে থাকতে বলছেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার চোখ চলে গেছে অল্পদূরে ব্রেঞ্চের‌ই কোনায় বসা এক ভদ্রলোকের দিকে । ভালো করে তাকিয়ে দেখি সেই টুপি ওয়ালা ভদ্রলোক । আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি আর কিছু বলতে পারি না, তক্ষুণি জ্ঞান হারাই ।


Comments