থার্টি এইট বাই টু .....এলগিন রোড


সময়টা ১৯৪১ সালের ১৬ই জানুয়ারী মধ্য রাত্রি, ইংরেজি তারিখ মতে ১৭ই জানুয়ারী শুরু হয় হয়। শীতের রাত, গোটা কলিকাতা শহর গভীর ঘুমে। শুধু জেগে আছে কিছু টহলদারি পুলিশ, রাস্তার নেড়ি কুকুর আর কড়া নজরদারির দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ গোয়েন্দা দল। আর জেগে আছেন নিঃশব্দে ভবানীপুর অঞ্চলে ৩৮/২, এলগিন রোডের জনা কয়েক বাসিন্দা।
সদর রাস্তা থেকে দেখা যায় দোতলায় ঘরটি। মূল ফটকের সোজাসুজি বারান্দার উপরে ঘর। এখানেই ১৯৪০ সনের ডিসেম্বর মাস থেকে অসুস্থ সুভাষচন্দ্র বসু গৃহবন্দী আছেন। বাইরে কড়া পাহারা। প্রত্যেকটি লোকের আসা যাওয়ার উপর কড়া নজরদারি চলছে। বন্দীটি যে, যে সে ব্যাক্তিত্ব নন।
পরিকল্পনা অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে অসুস্থ সুভাষচন্দ্র বিছানায় শুয়ে শুয়েই চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাইপো শিশির কুমার বসুকে ডেকে বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি তার রাঙ্গাকাকার একটি কাজ করে দিতে পারবেন। এলগিন রোডের বসুদের এই যৌথ পরিবারে সুভাষকে তার ভাইপো, ভাইজিরা রাঙ্গাকাকা বলেই ডাকতেন।
শুরু হয়ে গেল নীরবে, প্রচন্ড গোপনীয়তায় ঐতিহাসিক যাত্রার পরিকল্পনা। প্রায় দেড় মাস জুড়ে ধীরে ধীরে আটঘাট বেঁধে তৈরি হচ্ছিলেন সুভাষ। কোথাও কোন তাড়াহুড়ো নেই। ভুলেও যাতে কারো মনে সন্দেহ না জাগে।
সুভাষচন্দ্রের পরিচর্যা দায়িত্বে তখন ভাইজি ইলা বসু, সুভাষের সেজদাদা সুরেশচন্দ্র বসুর দ্বিতীয়া কন্যা। ডঃ অশোক নাথ বসু তার My Uncle Netaji ব‌ইতে লিখেছেন, "From that time onwards till his departure from Calcutta in January 1941, Ila filled the dual role of uncle's principal private secretary and nurse and served him with untiring zeal and single- minded devotion."
১৬ই জানুয়ারী সেই ঐতিহাসিক রাতে নীরবে তৈরি হচ্ছিলেন মহানায়ক। সহকারী ভুমিকায় ইলা বসু। নেতাজি ভবন তথা নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো তথ্যমতে যা মুলতঃ শিশির বসু তার ব‌ইতেও উল্লেখ‌ করেছেন, সেই মতে ১৯৪১ সনের ১৬ই জানুয়ারী মধ্য রাতে / ১৭ই জানুয়ারী সুভাষচন্দ্র একজন পাঠানের ছদ্মবেশে ভবানীপুর ৩৮/২ এলগিন রোডের পৈতৃক বাড়ি থেকে শেষবারের মতো পেশোয়ারের উদ্দেশ্যে র‌ওয়ানা দেন। প্রথমে স্থির ছিল শরৎচন্দ্র বসুর গাড়িতে যাওয়া হবে কিন্তু গাড়িটি যেহেতু যথেষ্ট পরিচিত তাই শেষ পর্যন্ত শিশির বসুর গাড়িটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওয়েন্ডারা  গাড়ির নম্বর বি এল এ হবে ৭১৬৯ ।কেউ যাতে সন্দেহ না করেন তাই প্রতিরাতের মতো নেতাজির জন্যে ফ্লাস্কে কফি তৈরি করে রাখা হলো, দায়িত্বে ইলা বসু। বাড়িতে কুকুর "সানিবয়"কে তিনতালার কোঠায় বেঁধে রাখতে বললেন সুভাষচন্দ্র। মধ্যরাতে বাড়িতে লোক চলা চলে যদি সে আওয়াজ করে উঠে, হয়তো তাই। ভাই বোন মিলে রাঙ্গাকাকু যেসব কাপড় সঙ্গে নিয়ে যাবেন সেই সমস্ত কাপড়ে ৬ নম্বর লিখে চিহ্নিত করে দিলেন । ৬ একটি সাংকেতিক সংখ্যা। সুভাষ ছিলেন তার মা-বাবার ষষ্ঠ সন্তান ।
 
নেতাজির গৃহত্যাগ প্রসঙ্গে সুরেশচন্দ্র বসুর বড়ছেলে রণজিৎ বসুর লেখা "নেতার নেতা সুভাষচন্দ্র" তেও বেশ কিছু তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুভাষচন্দ্রের ভারতবর্ষে থাকার শেষ চার বছরের সঙ্গী ছিলেন রণজিৎ বসু। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এই ইঞ্জিনিয়ার ভাইপোটি ছিলেন তার গাড়ির চালক, সর্বক্ষনের সাথী। গৃহবন্দী থাকাকালীন যাতে কোর্টে হাজিরা দিতে না হয় সেইজন্য ডাঃ মণি দে মহাশয়ের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট এনে দিয়েছিলেন এই রণজিৎ বসুই। সুভাষচন্দ্রের নির্দেশেই রণজিৎ বসু সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক লালাশঙ্কর লালকে তৎকালিন শিয়ালদহের অনারারী কোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট হেমচন্দ্র নস্কর মহাশয়ের কাছে পাঠান। ওখান থেকে শঙ্করলাল "হীরালাল গুপ্তা" ছদ্মনামে পাসপোর্ট পেয়ে যান। সেই পাসপোর্ট সহযোগে নানা দেশ ঘুরে তিনি সমস্ত যোগাযোগ তৈরি করেন, এবং দেশত্যাগের পরিকল্পনা তৈরি হয়। সুভাষচন্দ্র তখনও প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি। রণজিৎ বসু রেডিও মেকানিক সেজে সেখানে গিয়ে রাঙ্গাকাকুর সাথে দেখা করেন। ছোট ক্যাপসুল মোড়কে নিজের শরীরের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যান শঙ্করলালের প্ল্যান। দিল্লিতে দরিয়াগঞ্জ নিবাসী ট্রপিক্যাল ইনসিওরেন্স কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টার এই শঙ্করলাল ছিলেন সুভাষচন্দ্রের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ও দেশপ্রেমিক। 
১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র জেলেতেই কালী পূজা করেন ও ২৯ শে নভেম্বর থেকে অনশন শুরু করে স্বাস্থের অবনতি ঘটান। ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়ে ৫ই ডিসেম্বর তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেন ও এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখেন। এই গৃহবন্দি থাকাকালীন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তার বিরুদ্ধে চলা মামলায় যাতে হাজিরা দিতে না হয় তারজন্যেই ডাঃ মণি দে র কাছ থেকে আগাম মেডিকেল সার্টিফিকেট আনানো হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তারপর‌ই কৃচ্ছ্রসাধন ও ব্রতপালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। চলে গেলেন গৃহকক্ষের আরো অভ্যন্তরে। পর্দার আড়াল থেকে নিয়মিত তাঁকে নিরামিষ আহার দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। এর‌ই মধ্যে একদিন ইলাকে দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মন্দিরে পাঠালেন প্রসাদী ফুল ও সিঁদুর আনতে। মায়ের আদেশ ছাড়া কি কোন শুভ কাজ শুরু করা যায় । শোনা যায় একসময়ে সুভাষচন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর কাছে প্রায়শ‌ই যেতেন, তবে অতি গোপনে।
আবারো ফিরে আসি রণজিৎ বসুর স্মৃতিকথায়। গৃহের অভ্যন্তরে বন্দি সুভাষচন্দ্র তার ভাইপোকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না এই অভিমানে বেশ কিছুদিন দূরে ছিলেন রণজিৎ। তারপর একদিন রাতে "..... মনের অপরিসীম মর্মবেদনা যথা সম্ভব গোপন করে সেদিন রাতে পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করেছিলাম রাঙা কাকাবাবুর অন্তরীণ কক্ষে। দেখেছিলাম তার অপূর্ব সৌম মূর্তি। পরণে গেরুয়া রঙের গরদের ধুতি চাদর, কপালে সিঁদুরের লাল তিলক। তিনি হাসিমুখে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, " তোমার কারখানা কেমন চলছে" ।একটা সাধারণ উত্তর দিয়েছিলাম, কি উত্তর দিয়েছিলাম তা আজ আর স্মরণে নেই। তারপর রাঙা কাকাবাবু বলেছিলেন, " তুমি কোনদিন রাজনীতি কোর না। সেজদার সংসারের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি।" এইরকম কিছু বাক্যলাপের পর আমাকে ওঁর বাহুবন্ধনে জড়িয়ে মাথার ওপর মুখটা রাখলেন। সেইসময়ে কী যে অনুভূতি হচ্ছিল আমার বলার নয়। শরীরের ভেতরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। নিজের মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে বাহুমুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে একছুটে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, বেশ মনে আছে। আমার ধারণা এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর‌ই রাঙা কাকাবাবু সন্তর্পনে ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে গৃহত্যাগ করেন। ( নেতার নেতা নেতাজি ,- রণজিৎ বসু, পৃষ্ঠা ৫৮-৫৯)।
যাবার আগে ভাইজির কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, " গড ব্লেস ইউ"।
ঘড়িতে সময় রাত ১:৩৫ মিনিট। শিশির বসুর ওয়ান্ডারা গাড়িতে নিঃশব্দে বেড়িয়ে গেলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পৈতৃক বাড়ি থেকে। গাড়ি চালাচ্ছিলেন শিশির বসু নিজে। সারা রাত গাড়ি চালিয়ে ধানবাদের কাছে বারারি বলে একটি জায়গায় সুভাষচন্দ্রকে সারাদিন লুকিয়ে রাখা হয়, পাছে লোক জানাজানি হয়ে যায়। পরদিন রাতে আবার‌ও গাড়ি চালিয়ে বিহারের গোমো স্টেশন অবধি তাঁকে পৌঁছে দিলে তিনি মহম্মদ জিয়াউদ্দিন ছদ্মনামে দিল্লি কালকা মেলে পেশোয়ারের উদ্দেশ্যে র‌ওয়ানা হন। পেশোয়ারে অপেক্ষা করছিলেন সহকর্মী মিঁয়া আকবর শা। সেখান থেকে কাবুল, তারপর ইউরোপ, বাকিটা ইতিহাস। বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর সে ঘরের আলো নিবিয়ে দেবার দায়িত্বভার নিয়েছিলেন ইলা বসু। কেউ যাতে সন্দেহ না করে তাই দীর্ঘসময় শুয়ে র‌ইলেন সুভাষের নির্দিষ্ট শয্যায় যতক্ষণ না ভোরের আলো ফোটে। শুধু তাই নয় তার‌ও পরে দশদিন যাবৎ সুভাষচন্দ্র কে দেওয়া খাবার খাওয়ার বা সরিয়ে দেবার ভান করতে হয়েছিল গোপনীয়তার স্বার্থে।

উবেরে চড়তেই ড্রাইভার কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করাতে বললাম, নেতাজি ভবন।
-- মেট্রো স্টেশন তো ?
বললাম, না, নেতাজি ভবন।
লোকটা কতটা বুঝতে পারলো বুঝতে পারলাম না। তাই আবার‌ও বললাম, নেতাজির বাড়ি।
-- ওঃ তাই বলুন।
গাড়ি এসে থামলো ৩৮/২ এলগিন রোডের সেই বিখ্যাত বাড়ির গেটে।পুরণো দিনের ত্রিতল বাড়ি। জানা না থাকলে চোখ ফসকে পেরিয়ে যাবার সম্ভবনা খুব বেশি। ফটকের ডান পাশে নেতাজির আবক্ষ মূর্তি। বাম পাশে স্বেত পাথরের ফলকে নেতাজির মহানিষ্কমণের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ। মূল সড়ক থেকে দেখা যায় পরিষ্কার ঝকঝকে করে সাজানো। ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বুকস্টল সহ টিকিট কাউন্টার। দাম খুব বেশি নয়, মাথা পিছু দশ টাকা। বাচ্চাদের জন্যে ছাড় দেওয়া আছে। সামনেই কাচের গ্লাস দিয়ে ঘেরা সেই বিখ্যাত গাড়ি। যে গাড়িতে বসে নেতাজি শেষবারের মতো পৈতৃক ভিটে ত্যাগ করেছিলেন। দর্শনার্থীরা ভিতরে এগিয়ে যাওয়া মাত্র‌ই 
 দারোয়ানেরা এগিয়ে এসে নিয়মাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়। নিচে, বা বাইরে খোলা জায়গায় ফটো তুলতে কোন বাধা নেই, শুধু মাত্র জাদুঘরে প্রবেশ করা মাত্র‌ই সমস্ত নিষেধাজ্ঞা লাগু। সমস্ত বাড়ি জুড়ে হিম শীতল নীরবতা। ইতিহাস যেন এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে একতালা চড়তেই একজন দারোয়ান এগিয়ে এসে পথ দেখিয়ে দিল। কোন গাইডের প্রয়োজন নেই। জায়গায় জায়গাতে ছোট্ট করে লিখা। বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। তথাপি অল্প দূরে দূরে লোক দাঁড়িয়ে যথা সম্ভব কৌতূহল মিটানোর জন্যে। বারান্দাতে পা দেওয়া মাত্র‌ই চোখে পড়ে লাল লাল পায়ের ছাপ। যেন সামনের ঘর থেকে কেউ একটু আগেই বেরিয়ে গেলেন। কোন কিছুই লেখা নেই তবু বুঝতে বাকি 
থাকে না এই সেই মহামানবের পায়ের ছাপ যা দীর্ঘ আশি বছর ধরে এখানে সংরক্ষিত। নিজের অজান্তেই নুইয়ে একবার স্পর্শ করলাম, মনে হলো সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং নেতাজি। একটা অদ্ভূত শিহরণ হলো সমস্ত শরীর জুড়ে। খুব সাবধানে পায়ের ছাপগুলো এড়িয়ে এগিয়ে যেতেই প্রথম ঘরটি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের শোবার ঘর। পাশাপাশি দুটো শয্যা পাতা।‌ বড় পালঙ্কটি বাবা জানকিনাথ বসুর। পাশেই সুভাষচন্দ্রের শয্যা। এই শয্যাটিই সুভাষচন্দ্র ব্যবহার করতেন। মনের মধ্যে আঁঁকা সেই বিশাল ব্যাক্তিটিকে এই ছোট খাটে ভাবতে আবাক লাগে। কাঁচের গ্লাস দিয়ে সংরক্ষিত। আছে বাঘের ছালের আসন, কিছু পুঁথি একখানা চেয়ার। পাশের ঘরটি দাদা শরৎচন্দ্র বসুর। দেওয়ালে টাঙানো কিছু পারিবারিক ছবি। ওপর পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই আবার খোলা বারান্দা। শেষ প্রান্তে সুভাষচন্দ্রের বৈঠকখানা। কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র এখানেই অফিস করতেন। বিশাল টেবিল, আছে কিছু ব‌ইপত্তর। আবার তার সামনেই সোফা পেতে আলাদা করে বসার ব্যবস্থা। অফিস ঘরের দেওয়াল ছিল তিরঙ্গা । এখনো সেইমতোই রঙ করা রয়েছে।
দ্বিতল জুড়ে সেন্ট্রাল হলে বিভিন্ন মুহূর্ত ধরে রাখা। আছে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বের সাথে ছবি, আছেন আবিদ হাসান, আছেন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, মহাত্মাগান্ধী, জহরলাল নেহেরু সহ পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্বের ছবি, আছেন ১৯৪৩ সনে জার্মানিতে U-boat U-180 এ সুভাষচন্দ্র। আছে কাচের বাক্সে সাজিয়ে রাখা তার ব্যবহার করা কাপড় জামা আর বিভিন্ন সময়ে পাওয়া উপহার। তিনতালায় একদিকে এশিয়া অন্যদিকে ইউরোপ। ওখানেই রাখা দাদার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি, লিখেছেন তিনি বিবাহিত। আছে তাঁর ব্যবহার করা সামরিক পোশাক, টুপি আর ব্যাল্ট। আছে ভারতীয় ভুখন্ডে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলার ছবির। নেতাজি বেড়িয়ে আসছেন সেলুলার জেল থেকে, ওপরে জাপানের সাথে ভারতীয় পতাকা, এক অদ্ভুত অনুভূতি।

সবশেষে সেই ঐতিহাসিক মালাটির কথা উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সন ১৯৪৪, ২৬শে জানুয়ারী রেঙ্গুনে মিউনিসিপাল বিল্ডিংএর সামনে নেতাজি প্রথমবারের মতো বার্মায় বক্তৃতা দিবেন। সাধারণ থেকে গণ্যমান্য - লোকে লোকারণ্য। শুরুতেই বার্মাবাসীর পক্ষ থেকে নেতাজিকে একখানা মালা পড়িয়ে দেওয়া হলো। নেতাজি টানা দুঘন্টা ভাষণ শেষে নিজের গলার মালাটি দেখিয়ে বললেন, এই মালাটি সমস্ত বার্মাবাসীর শুভেচ্ছার প্রতীক, এই মালা অমূল্য। আজাদ হিন্দ ফোর্সের সাহায্যে এই মালাটি তিনি নিলাম করতে আগ্রহী। জন সমুদ্রের মধ্য থেকে এক শিখ যুবক হরগোবিন্দ সিং প্রথমেই চিৎকার করে বুলি হাঁকান," এক লক্ষ ডলার" । সভায় উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ব্রিজলাল। তিনি হেঁকে ওঠেন, " দুই লক্ষ ডলার" । আরো একজন , " দুই লক্ষ দশ হাজার ডলার" ।‌ দাম ক্রমেই বাড়ছে। রাস্ট্রনায়কের গলার মালা বলে কথা ! তিন লক্ষ ডলার। দাম বাড়ছেই। শেষ অবধি নিলামের দুই প্রতিদ্বন্দী হরগোবিন্দ আর ব্রিজলাল। ব্রিজলালের অর্থের জোর হরগোবিন্দের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। দাম ওঠে সাত লক্ষ ডলার, হরগোবিন্দের সামর্থের বাইরে। হতাশ হরগোবিন্দ নিরুপায় হয়ে পাগলের মত ছুটে যান নেতাজির কাছে। দুচোখে জল টসটস করছে। বললেন, তার রেঙ্গুনে কয়েকখানা বাড়ি, গ্যারেজ, আটখানা ট্রাক ব্যাঙ্কে জমানো টাকা, সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য সাত লক্ষ ডলার হয়ে যেতে পারে। এর বেশি তার আর দেবার মতো কিছুই নেই। জীবনের সমস্ত সঞ্চয়ের পরিবর্তে এই মালাটি তার চাই। হরগোবিন্দের এই কাতর প্রার্থনায় সাড়া দিলেন নেতাজি। নিলামে সর্বোচ্চ দাম হাঁকিয়েও নেতাজির অনুরোধে ব্রিজলাল তার দাবি ছেড়ে দিলেন। হরগোবিন্দ তখন আক্ষরিক অর্থে কপদর্ক শূন্য। নেতাজি তার এই দেশপ্রেমিক ভক্তকে আশ্রয় দিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজে। ঐতিহাসিক ওই মালাটি সযত্নে সংরক্ষিত আছে এখানেই।
দেখতে দেখতে ঘন্টা তিন কী করে পেরিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে ধীরে পায়ে বেরিয়ে এলাম নেতাজি ভবন থেকে। মন আর মস্তিষ্ক জুড়ে দেশপ্রমের ছোঁয়া।
গেটের বাইরে বেরিয়ে এসেছি, তখনও ঘোর কাটেনি। চারপাশে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। কোন এক রাজনৈতিক দল তাদের পোস্টারে নেতাজি ভবন থেকে পদযাত্রার আহ্বান জানিয়েছেন । ভালো করে পড়তেই‌ হঠাৎই কেন যেন মনে হলো, নেতাজি ভবন কি তবে এখন বিস্মৃতি কোলে ? তাই কি ভবনটি চিনিয়ে দিতে পোস্টারে লেখা "ফোরাম মলের উল্টোদিকে" !

Comments