মুক্তি নাকি নিঃসঙ্গতা

দীর্ঘ দিন থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছি একটা ছক বাঁধা রাস্তায়। চলছি আর চলছি । কোথায় যাচ্ছি, কেন এই পথচলা, কি তার উদ্দেশ্য কোথায় গিয়ে থামবো,  কিছুই জানি না । তবু পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি হেঁটে । পেছনে পরে রয়েছে একটার পর একটার শহর, গ্রাম কিংবা নদী খাল নালা । আমি এগিয়ে চলেছি ক্রমাগত । যেদিন প্রথম হাঁটা শুরু করেছিলাম, তারিখটা মনে আছে যদিও, জানতাম না আমার গন্তব্যটি ঠিক কোথায় ।  কিন্তু চলা আমার সেই প্রথম দিন থেকেই শুরু । আজও যে ঠিকঠাক জানি তেমন দাবি করার মত সাহস অবশ্য আমার নেই, তবু কালের স্রোতের মতো আমি এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে । আসলে এই অদ্ভুত রাস্তাটি আশ্চর্যজনক ভাবে একটি ওয়ান ওয়ে রোড । পিছনে ফিরে যাওয়ার কোন পথ নেই সেখানে, ইচ্ছে করলেই ফিরে যাওয়া যায় না ।
যে রাস্তাটি দিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি, তার চারপাশ একটা অদ্ভুত সুন্দর মনোরম পরিবেশ । কোথাও সবুজ শ্যামল শষ্য ক্ষেতে থোকা থোকা সোনালী ফসল, আবার কোথাও দুপাশ জুড়ে মাইলের পর মাইল রকমারি ফুলের রঙিন গালিচা। চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় আর কেন পথচলা । এখানেই থেমে যাওয়া চলে। কে যেন কানেকানে বলে, "আরো পথ রয়ে গেছে বাকি।" কথাটা সত্যিই সত্যি । আরো কত পথ যে এখনও বাকি আমি নিজেই জানি না ।
আমার পথ সবটাই যে মসৃণ ছিল তা কি কখনো হয় ? কোথাও খাদ খন্দর কিংবা পথ আটকে ছিল কোন নাম না জানা খরস্রোতা নদী, দুর্গম অবশ্যই । কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে  সবসময় হাত বাড়ালেই কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত আমার । সে যতই কঠিন হোক বাঁধা, দুর্গম হোক পথ কিংবা দুস্কর হোক অতিক্রম করা । আমায় যেন কেউ বা কারা আগলে রাখতো সমস্ত বিপদ থেকে কঠিন পাহারায়। তাইতো অক্লেশে চলছে আমার পদযাত্রা ।
এভাবেই চলছিলাম এতটা দিন । গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর হেঁটে চলেছি দুর্বার গতিতে । আজ কিসের একটা ধ্বনি আমাকে হঠাৎই চমকে দিল। তাকিয়ে দেখি আমি কখন নিজের অজান্তেই একটা নতুন দেশে প্রবেশ করে ফেলেছি । পিছনে তাকিয়ে দেখি আমার দেশ,  আমার স্বদেশ, আমার পরিবার যারা এতদিন আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে আত্মার সাথে মিশে ছিল, তারা সারবেঁধে আমার স্বদেশের সীমানাতে দাঁড়িয়ে । চোখগুলো ছলছল করছে । টুপটাপ মুক্তো ঝরছে এদিক ওদিক।  মুখে করুন  হাসি, যেন যেতে দিয়েও মন থেকে মানতে পারছে না এই বিদায়। একটা অদ্ভুত মুহূর্ত । সময়টা যেন বহুদিনের ক্লান্তিতে হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য করুন মুখ । এক একটা মুখ মানেই অসংখ্য গল্প, হাজারো স্মৃতি আর এক সমুদ্র ভাললাগা । পন্ডিতেরা এই ঝাপসা চোখের আলতো হাসিকে কেন যে হাসি ভেবে ভুল করলেন আমি জানি, আমি শুুুধু বুঝতে পারছিলাম একটা ঢুকরে উঠা কান্না সোডার বোতলের মত গলায় এসে আটকে আছে । বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠে । মনে হল কেন এই পথচলা ? কেন ? কেন ?
সামনে তখন নতুন দেশ । নতুন গাছ, নতুন ফুল, নতুন নতুন পাখি। একটা গাছ দুই দেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল। তারই একটা ডাল আলতো করে কানের কাছে নেমে এসে বলল,  মন খারাপ করতে নেই , এটাই কালের নিয়ম । 
আমাকে বিমর্ষ দেখে আমার ফেলে আসা দেশ চিৎকার করে হাত নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল, মন খারাপ করো না বন্ধু, তুমি ভালো থেকো । তোমাকে ছাড়া মন খারাপ লাগবে বৈকি, তবে চিন্তার কারণ নেই,  আমরা সবাই  তোমার নতুন দেশে আসছি একদিন আগে কিংবা পরে । তুমি ভালো থেকো ।

এই কয়েকদিন আগে মৌপী,  মান্না আর রূপা বাড়িতে এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় সম্মাননা দিয়ে গেছে,তারপর শিলচর শাখা, আজ আমার রংপুর শাখায় সহকর্মী ও কিছু গ্রাহক মিলে আবারো আমাকে সম্মান জানালেন। অবসর নিয়েছিলাম আমি সেই একত্রিশে মার্চ দুহাজার কুড়ি। লকডাউনের কারণে তখন সম্ভব হয়নি। কিন্তু একটু শিথিল হতেই তারা আর দেরী করলেন না। একটা আনন্দঘন মুহূর্ত । এতদিনের একসাথে চলার স্বীকৃতি আবার একবুক বিষন্নতাও বটে । এতদিনের কর্মক্ষেত্র, ধ্যান, ধারনা, উৎকণ্ঠা, আবেগ, পরিকল্পনা এখন সবটাই আমার অতীত । সব কিছুই এখন আমার অনধিকার চর্চার বিষয়।
এটা মুক্তি নাকি নিঃসঙ্গতা, আমি জানি না । শুধু বারবার মনে হচ্ছিল, এত ভালবাসা, এত ভালবাসা, সবটাই আমার জন্যে;  আমি কি সেই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো ? হয়তো না, তবু পরম করুনাময়ের কাছে প্রার্থনা করি, হে ঈশ্বর তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো আমি যেন আমৃত্যু এই ভালবাসার সম্মান রাখতে পারি। হে ঈশ্বর করুণাময়, আমাকে এইটুকুই আশীর্বাদ করো প্রভু।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments