ইচ্ছে

ইচ্ছে

ভীষণ সাধ ছিল মনে, একটু একা থাকি,
একটা নির্জন জায়গায়, যেখানে
অফিসের ব্যস্ততা নেই, নেই বসের টেলিফোন,
সকাল থেকে ছোটাছুটি, ছ'টা পনেরোতে ওয়াশরুম,
বাজার যাও, দুধ আনো, রেশন থাকলে তাও,
ঘড়ি ধরে স্নান, বাসের হ্যান্ডল,
ন'টা পনেরোতে ফেরী, তারপর ট্রাম,
সবশেষে, অবশেষে,
ঠিক ন'টা বেজে পঞ্চান্নতে দরজা ঠেলে ঢোকা,
অফিসতো নয়, যেন স্টক মার্কেট
একটার পর একটা টার্গেট, বিরক্তিকর।
এটাই জীবন।
যেন মহাসড়কে এক একটা মাইলফলক,
শেষ কোথায়, আদৌ আছে কিনা,
কেউ জানে না, হয়তো টার্গেট নিজেই।
তবু ক্রমাগত ইঁদুর দৌড় আর জীবনযুদ্ধ খেলা।
হাঁফিয়ে উঠেছিলাম আমি।
যন্ত্র আর মানুষের মধ্যে যে ফারাক--,
মস্তিষ্কে যে ক্ষুধা হয়, চাই খোরাক,
ভুলে গিয়েছিলাম অনেকদিন।
একটু একা থাকতে চেয়েছিলাম, 
একান্তই একান্তে।
একটা নির্জন বাংলোয়, একা বারান্দায়
চোখের সামনেই সাজানো গোছানো বাগান,
জুই, চামেলি, গন্ধরাজ কিংবা টিউলিপ,
পা বাড়ালেই শাল শিমুলের বন।
কৃষ্ণচূড়া, মহুয়া, নাগলিংগম, অশোক,
কিংবা কাঠগোলাপ বা কনকচাঁপাও চলতে পারে সেখানে।
অলস আমি বসে থাকবো দীর্ঘ বারান্দায়।
যে পাখির ডাক হারিয়ে গিয়েছিল সেই শৈশবে,
কাঠঠোকরা, দোয়েল কোকিলের স্বর  --
আমি শুনবো সব।
একটা বোষ্টোম গেট খুলে রোজ সকালে এসে,
খঞ্জনা বাজিয়ে শুনিয়ে যাবে গান।
কে দিলেন সুর, কিইবা গীতিকারের নাম,
নাই বা জানলাম,বোষ্টোম নিজে জানলে তবেইতো।
সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে 
সার্ফ ডিটার্জেন্টের জলে, 
শুধু অক্ষত থেকে গেছে গান।
আমি শুনবো।
আমি শুনবো তার মুখে দেশ পাড়াগাঁর গল্প।
জেলে যখন মাঝ দরিয়ায় মাছ ধরতে যায়,
মেছুনী তার কপাল জুড়ে কিসের তিলক কাটে,
কার্তিকেতে নিয়মমাসে কিসের ব্রত রাখে।
আমি শুধু শুনবো আর প্রাণভরে দেখবো
মেঘ আর সূর্যের নির্লজ্জ রাসলীলা।
এমনি আরো কত, খুব ইচ্ছে ছিল মনে।

এখন আমি ঘরেই আছি, ঘরবন্দী।
নেই ঘুম থেকে ওঠার তাগিদ,
এলার্মের বিরক্তিকর আওয়াজ,
বাজারে যাবার ত্রাস কিংবা
প্লেনের চেয়ে দ্রুতগতিতে পত্রিকা পাঠের প্রচেষ্টা।
সারাদিন শুয়ে বসেই কাটাই, 
টেলিভিশনে উথলে ওঠা দুধের মতো খবর,
কিংবা জী বাংলা রান্নাঘর, এইসময় বিরক্তিকর।
ফেইসবুক ওয়াটসাপে চোখ থেঁতলে গেছে।
এখন মোবাইলটাই আলুনি লাগে।
এই দিনটি ঠিক আমি চাইনি কখনো।
রাস্তা ঘাট শুনসান, গাড়ি ঘোড়ার প্রশ্ন নেই।
অফিস যেতে হয় না অনেকদিন,
ওই জায়গাটা যে রেড জোনের অধীন।
সারাদিন ঘরে বসে থাকি,
মাছ শাক সব্জিতে ক্যাশ চাই না, কার্ড‌ই চলে।
কারণ ওরা কেউই সেই অর্থে ব্যবসায়ী না।
কারো প্রাইভেট টিউশন, কারো সেলুন ছিল,
কেউ রেস্তোরাঁয় কর্মচারী বা মলে কাটতো বিল,
হাত পেতে ত্রাণ নিতে লজ্জা তাই ফেরি করা।
অনভ্যাস, তবু বেঁচে থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
এখন আমার সকালটা ওদের সাথেই কাটে,
এখন সেই সকালে উঠি,
গেটে দাঁড়িয়ে আমি তীর্থের কাক,
কখন শুনতে পাবো পরিচিত ডাক
আমি অপেক্ষাতে থাকি।
ভীড়ের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া কত আনন্দের
এখন আমি উপলব্ধি করি হাড়েহাড়ে।
আর মনে প্রাণে বলি, এই দিনটি আমি চাইনি।
এত মৃত্যু, এত ক্ষুধা, এত কান্নার বিনিময়ে,
এই সুখ আমি চাইনি কখনো।
ইচ্ছে করে সমস্ত লক্ষ্মণরেখা মুছে দিয়ে
ছুটে যাই সেইসব মানুষের মাঝে,
যারা আমার জন্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়।
খুব ইচ্ছে করে।

আকাশে যখন উড়ছে উড়ান
লক্ষ পাপড়ি আছড়ে পড়ছে পথে মাঠে চত্বরে,
মনে হয় তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীর দেশ,
কেউ কি নেই একজন চিৎকার করে বলি,
চাই না তোমাদের পুষ্পবৃষ্টি, মঙ্গলারতি যত,
যদি পারো আরো কিটস্ দাও,
দাও অক্সিজেন, আধুনিক সরঞ্জাম।
আর উড়ান যদি উড়তে হয় আকাশে,
হোক সে সেই পথিক শ্রমিকটির জন্যে,
পৌঁছে দিতে তাকে সহস্র যোজন দূর
তার ক্ষুধার্ত শিশুটি যেখানে আজ 
এই মুহূর্তে তার‌ই অপেক্ষায় ।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments