একশ ত্রিশ

একশ ত্রিশ


কিছু লিখতে বলছিস আমায় !
কি লিখি বলতো দীপেন্দু ?
শুন্যে, ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি,
ছবির মতো দৃশ্যপটগুলো
ক্রমশ জুম থেকে ফেড হয়ে যাচ্ছে,
আমি নির্বাক, খোলা কলম হাতে,
বিন্দুর সাথে বিন্দু জুড়ে জুড়ে
একটা রেখা টানছি মাত্র ।
রূপরেখা ? দুর পাগল ! 
সে দিল্লি দুর দুরস্ত রে । 
আমার বিদ্যা, বোধশক্তি
আমার জ্ঞান, বিচার, ভাবনা --,
আমার সমস্ত চেতনা,
একটা লক্ষ্মণ রেখায় আবদ্ধ,
তুইতো জানিস --
তবু রেখার পর রেখা টেনে টেনে
ক্লান্ত আমি, এখনো চেষ্টাতে আছি,
ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট মুখচ্ছবি আঁকতে।
যতবার থামতে চেয়েছি, জানিস,
আমার যন্ত্রণা, আমাকে বারবার
টেনে হ্যাঁচড়ে এনেছে অদৃষ্ট লক্ষ্যে।
তুই বলছিস, কিছু একটা লিখো এবার,
লিখে লিখে হালকা হ‌ও,
কি লিখি বলতো দীপেন্দু ?

টিভির সামনে বসতে পারি না
একটা যন্ত্রণা, কষ্ট,
সমস্ত পর্দা জুড়ে মৃত্যু মৃত্যু আর মৃত্যু।
আমেরিকা, স্পেন, ইতালি ফ্রান্স
ইরাক ইরান জাপান জার্মান আরো কত কত---
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যেখানে উন্নত, 
ক্রমাগত যুদ্ধ চলছে সেখানেও ‌।
ভারতবর্ষের কথা, না হয় উহ্য‌ই থাক
অদ্ভুত, আশ্চর্য এই দেশে,
এত প্রচার তবু সম্যক ধারণা নেই
কি ঘটতে চলছে ভবিষ্যতে।
দেশ জুড়ে প্রচার চলছে, ঘরের মধ্যে থাকার,
কি দরকার বাপু দল বেঁধে সব নগরকীর্তনী হবার।
সবটাই তো নিজের জন্য, পরিবারের জন্য
তবে কিসের এত বাধা ?
 আসলে বোঝে না যে বেঁচে থাকার জন্যেও চাই
নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা।
ফলে যা হবার, হচ্ছেও ঠিক তাই
যে হাতগুলো এসেছিল সহানুভূতি নিয়ে,
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে 
এখন সেই গোলাপী হাতগুলাই।
ভাবতে অবাক লাগে না, কি বিচিত্র পরিস্থিতি !
ভেবেছিলাম অন্তত একবার স্বেচ্ছাসেবক হ‌ই
ছুটে যাই কোথাও সংকটের এই সন্ধিক্ষণে,
বিবেকের কাছে একটা জবাবদিহি রাখি --,
ভাবনাটা স্বপ্নেই থাকলো, সময়ের চাহিদা !
নিজেকে বড় ছোট মনে হয় জানিস।
তুই বলছিস কিছু একটা লিখো,
কি লিখি বলতো ?

আচ্ছা দীপেন্দু, তোর কি মনে হয় বলতো ?
এই যখন ঘরবন্দি গোটা দেশ,
ডাইনিং টেবিল থেকে শোবার বালিশ
ফেইসবুক ওয়াটস্আপ টুইটার,
তাবলিগ থেকে ধারাভি,
নয়ডা থেকে মান্নারকর,
ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, পদযাত্রীর মিছিল,
হিউমপাইপ বা বস্তির আবর্জনায় থাকা
লক্ষী শ্যামলাদের পুরো পরিবার যখন,
সবাই, সবার মনেই ভয় ভয় আর ভয়,
একটা অজানা মৃত্যুভয়, কি জানি কি হয় ---,
ঠিক সেই সময়ে কি মনে হয় তোর ,
রাস্ট্রপ্রধানের এই মোমবাতি প্রদর্শন ?
মনে হয় না একটা হাস্যকর প্রহসন ?
আস্ত তামাশা। মনে হয় না তোর ?
আমারও তেমনিই ছিল ভাবনা ।
ভেবেছিলাম কি চায় লোকটা,
খুলে কিছু বলছে না , দোষারোপ করছে না
তাক লাগানো কোন প্যাকেজ বা পে কাট না
ত্রাণ তহবিলে সাহায্য না, পুলিশি জুলুম না
কি হচ্ছে এসব ?
শুধু নটা বাজতেই নমিনিট সময়,
অদ্ভুত অভিনয়।
রীতিমতো নাটক লাগছিল আমার।
ভাবছিলাম, ভালোই হলো এবার,
ভাইরাসটাই বৈতরণী হোক
মন্দার  বাজার  এভাবে ই হোক কভার।
মানসিকভাবে সেই প্রস্তুতিতেই 
গিয়েছিলাম ছাদে।
কিন্তু ঠিক যখন নটা বাজলো,
ঘরে ঘরে নিভে গেল সমস্ত বৈদ্যুতিক বাতি
বিশ্বাস কর, সে এক আশ্চর্য অনুভুতি,
একটা একটা করে চারদিকে
জ্বলে উঠলো দীপের আলো
হিন্দু মুসলমান শিখ ক্রীশ্চান যত
অসমীয়া, বাঙালি বিহারী মারঠী,
উড়িয়া, কিংবা গুজরাটি
রাস্তায় পুলিশ, অন্ধ ভিখারি
ইমাম, পাদ্রী পূজারি
নতুন বৌ, কোলের শিশু, বৃদ্ধা ঠাকুমা
কি উৎসাহে হাতে প্রদীপ,
জলের ট্যাঙ্ক, চিলেকোঠায়, ছাদে,
রেলিং এ ঝুলে বা কার্নিসে পা রেখে
চড়তে যেখানে পা কাঁপে,
ওখান থেকেই টর্চ নাড়ছে 
কি সাংঘাতিক সব ছেলে।
একে তুই কি বলবি বল ?
রাজভক্তি ? উগ্র উচ্ছাস ?  আবেগ ?
নাকি মূর্খের লেজ নাড়া ?
কিন্তু তুই বিশ্বাস কর, কি প্রচন্ড উৎসাহ, 
প্রাণশক্তি ছিল সেই উন্মাদনায়।
তোর ঠোঁটের কোণে কিসের হাসি দেখছি ওটা ;
দায়বদ্ধতা নিয়ে নিশ্চয় প্রশ্ন তুলবি না এবার ?
বিশ্বাস কর, যখন বেজে উঠলে কাঁশি, ঘন্টা করতাল
দিকে দিকে উচ্চারিত হলে প্রার্থণা মন্ত্র
ভেতর থেকে আমিটা সরে গিয়ে আমার,
দেখলাম নতুন অচেনা এক ভারতবর্ষ,
এই অনুভূতি অভুতপূর্ব।
কারগিল যুদ্ধে ভারতকে দেখেছি আমি,
দেখেছি ভারত-পাকিস্থান ক্রিকেট খেলায়
কিন্তু এবারে স্বদেশকে দেখলাম নতুন দৃষ্টিতে।
রবীন্দ্রনাথ গাইলেন আবারো,
বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না জেনো করি ভয়।
কি জানিস, মৃত্যু নয়, আর্তি নয়, নেই আর্তনাদ,
সিংহনাদ করে একশ ত্রিশ কোটি ভারতবাসী,
বলে, "মৃত্যু ভয়ে ভীত ন‌ই হে ঈশ্বর
আমরা সংহত,  সাবধান, সচেতন।
যত দুর্গম হোক পথ,  অন্ধকার হোক রাত্রি,
আমরা অতিক্রম করবোই, 
এ আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
তুমি আমাদের শক্তি দিও প্রভু ।"
ইনশাআল্লাহ, এই বিশাল শক্তি 
যদি চিনতে পেতাম কভু !
শ্রদ্ধায় অবনত হ‌লাম একশ ত্রিশের কাছে।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments