প্রয়োজন

প্রয়োজন

বেশতো কাটছিল দিনগুলো
হাসি ঠাট্টায় , গানে কবিতায়,
মাঝে মধ্যে একটু এদিক ওদিক ঘোরা
একগুচ্ছ সেলফি আর
ফুর্তির ফোয়ারা, 
গোটা শহরটাই ব্যস্ত ছিল ভীষণ।
আমার কথা আলাদা
আমারতো কোনকালেই কিছু নেই।
ঘর বাড়ি নিজস্ব টিভি ,
কোনকালেই ছিল না।
মলের সামনে ওই যে বিশাল টিভিটা
সিনেমা হলের পর্দার মত টাঙানো
ওটা যে পাবলিকের জন্যেই রাখা।
আমিতো পাবলিক ! ভোট আমি নাইবা দিলাম
এন‌আরসিতে নাইবা থাকলো নাম
আমি তো বাপু বাবুগিন্নি ন‌ই --
আমার আবার তেমন ভাগ্যি কই ?
আমার জন্যে খোলা বারান্দা,
টিভির পর্দা, আর এই উন্মুক্ত আকাশ,
আছি বেশ আনন্দেই।

খুব কাটছিল জানো দিনগুলো
সারাদিন কিছু না কিছু জুটে যেত খাবার,
বিড়ি, পিৎজা বা পাউরুটি, হোক না উচ্ছিষ্ট,
আমিতো সর্বভুক। আমার সব চলে।
গরমের দিনে যে বরফ‌ওয়ালা বসে,
দুর্মুখ হলেও মনটা ভীষণ নরম।
খুব গরমে, যখন সবকিছু সুনশান
একটা গরুও হেঁটে যায় না রাস্তায়,
আমাকে তখন সে বরফ দিত খেতে,
বিনে পয়সায়। হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ।
বলতো, খা, খেয়ে নে,
আর পারিস তো দোয়া করিস
আমার জন্যে।
বড় শান্তি পেতাম গো।
মাঝে মধ্যেই, একদল ছেলেমেয়ে
পুজোর ঠিক আগে কিংবা
বসন্তের শেষ বিকেলে
আমাদের কাপড় দিত তারা।
হ্যাঁ, এখানে আসার পর প্রতিবার‌ই পাই ।
শীতে জুটতো কম্বল,  হোক সস্তা,
গরীবের সম্বল‌ইতো ওইটা।

ভালোই কাটছিল দিনগুলো,
হঠাৎই কি এলো, অনাহুতের মতো,
জীবনের সব ছন্দ লন্ডভন্ড করে
এক অদ্ভুত পরিবেশ,
রাস্তা ঘাট সুনশান, লোকজন নেই,
হকারের ডাক নেই, ফুলের পসরা নেই,
দুপুরে বরফ, বিকেলে ফুচকাওয়ালা,
মুখে লাল রঙ মেখে ওই তিনটে মেয়ে,
যারা সকাল থেকে রাত্রি গভীর
বারবার ফিরে আসতো এই রাস্তায়,
তারা কেউ এখন আর আসে না এখানে।
একটা মাইক একা একা চিৎকার করে বেড়ায়,
একটা এ্যাম্বুলেন্স আর একটা পুলিশের গাড়ি,
হঠাৎই কোথাও থেমে,
কিছু লোককে নিয়ে যায় তুলে
অজানা ঠিকানায়।
ভয়ে সিঁটিয়ে আছে পাড়া পড়শি সব।

এখন আর রোজ খাবার জোটে না জানো,
পাউরুটি, বিস্কুট, আধ খাওয়া পিৎজা
পুড়ে যাওয়া বিরিয়ানি বা আধসেদ্ধ কষা মাংস
এখন আর ডাস্টবিন নেই, শুধু ব্লিচিং পাউডার।
গুমোট বাতাসটাতে একটা ভয়ের শিহরণ,
হঠাৎ যেন পাল্টে গেছে দিনটা।
গতকাল যে পুলিশটা ঠিক উল্টো দিকে
ডিউটি দিচ্ছিল,
অনেকক্ষণ বসে ছিল খাবার প্যাকেট হাতে।
আমাকে সামনে রেখে খেতে পারছিল না সে।
তারপর একসময় পুরো প্যাকেটটাই
তুলে দিয়ে দেয় আমার হাতে,
আমি লুফে নিয়েছিলাম সেই খাবার।
দুদিনের না খেতে পাওয়া নাড়ী
অসহ্য ছিল, পারছিলাম না নিজেকে থামাতে।
আজ‌ আবারও তাই করেছিল সে।
হঠাৎই মাথাটা বিগড়ে গেল আমার
অসভ্যের মত গালিগালাজ করলাম খুব,
ওকে, ওর বাবা, মা চোদ্দগুষ্টিকে
আচমকাই মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার।
লোকটা বুঝতে পারেনি আমাকে,
ক্ষেপে গিয়ে দিলে কষে দুই ঘা
লাল হয়ে গেছে পিঠ, তবু আওয়াজ তুলিনি মুখে,
রাগে গটগট করে ফিরে, আমার‌ই সামনে
খেয়ে নিল পুরো প্যাকেটটা ।

বোকা পুলিশ,
জানতো না খাবারটা আমার চেয়ে
তার বেশি ছিল প্রয়োজন।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

কবিতাটি গত ৩.৪.২০২০ গতি পত্রিকাতে বেড়িয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ মনমোহনদা সহ গতি পত্রিকার সবার কাছে। আজকের পোষ্টে খানিকটা সংশোধন করা, কবিতার স্বার্থে।

Comments