কাঠের চেয়ার

কাঠের চেয়ার

দরজায় কলিংবেল বাজতেই চমকে উঠলাম। যদিও ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে আটটা, তবু ইদানিংকালে বাড়িতে মানুষজনের আসা খুবই কমে গেছে। আমার বলে নয়, সবার‌ই। পরিস্থিতিই এমনটা করিয়েছে। কারো বাড়িতে গেলে অনেক ঝামেলা। মাস্ক ব্যবহার করো, সেনিটাইজার দিয়ে হাত ধোও, এমনি কত কি। কেউ বাড়িতে এলে তাকে কিছু খেতে দেওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই সৌজন্যতা প্রকাশ, কিন্তু যদি তুমি ভুল করে কিছু খেয়েছো, ব্যাস, সে-ই এঁটো প্লেট তোমার সামনেই পরে থাকবে যতক্ষণ না তুমি চলে যাচ্ছো। তুমি চলে গেলে একজোড়া গ্লাভ্স লাগিয়ে ট্রে শুদ্ধ বাসন চলে যাবে বেসিনে। এখনতো এসব‌ই চলছে। তার উপর যদি শ্বশুরবাড়ি থেকে জেষ্ঠ শ্যালিকা বা কোন ননদ ননাস ফোন করে বলে দিয়ে থাকে সাথে দুটো নিমপাতা চুবিয়ে রাখিস, তবে তো সোনায় সোহাগা।
যাক, ধান ভাঙতে শিবের গীত গেয়ে লাভ নেই।যে কথাটি বলছিলাম, কলিংবেল বাজতেই চমকে উঠেছি। এখন আবার কে এলো বাড়িতে। দরজা খুলে দিয়ে দেখি অদুরে সুকান্ত দাঁড়িয়ে।
সুকান্ত আমার অনেক পুরোনো কাঠমিস্ত্রি। আমার বাড়িতে অনেক কাজ তার নিজের হাতে করা । ইদানিং শুনেছি রংপুরে একটা নিজে দোকান খুলে বসেছে। হাতের কাজ খুব পরিস্কার। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে আমার দরজায় দেখে আমি অবাক। বললাম, তুই হঠাৎ , তোর বৌদি ফোন করেছিল বুঝি ?
--- না আমি নিজে থেকেই এসেছি ।
--- তা বেশ তো বল, কি দরকার ?
সুকান্তের চোখে মুখে একটা অস্বস্তি । বললাম সংকোচ করিস না, খুলে বল ।
-- কিভাবে বলি বলুন স্যার, বুঝতেই পারছেন, এই বাজারে একটাকাও রোজগার নেই, অথচ ---।
--- অথচ ঘরে খরচ আছে, তাইতো ?  ওকে মাঝপথে থামিয়ে বললাম। - এত ইতস্তত করছিস কেন ? কিছু টাকা নিয়ে যা যেদিন সুবিধা হবে ফেরৎ দিস। আমি কোনদিন তোর কাছে টাকা চাইতে যাবো না। বিশ্বাস রাখ। ফেরৎ দেয়ার কথাটা ইচ্ছে করেই জুড়ে দিলাম, যাতে সে নিতে সাচ্ছন্দ বোধ করে। 
বললাম, বল, কত চাই তোর ?
---  স্যার, কুড়ি হাজার টাকা ।
--- কত ? কুড়ি হাজার ? এতো টাকা কিসের জন্যে প্রয়োজন ? আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। 
--- না স্যার, আমি এমনি এমনি নেব না। একটা জিনিসের বদলে টাকাটা নিতে চাই।
--- জিনিস ? দ্যাখ, আমি সোনাদানা বন্ধক রাখি না বাপু। ওসব রাখার টাকার অনুরোধ করিস না প্লিজ। তুই অন্য জায়গাতে দেখ্।
-- না না সোনাদানা নয় স্যার, একটা চেয়ার --।
--- একটা চেয়ারের দাম কুড়ি হাজার টাকা।
--- কুড়ি হাজার নয় স্যার, ওটার দাম ঠিক হয়েছিল পঁচাত্তর হাজার টাকা।
--- সেকি ?
--- হ্যাঁ স্যার, এই চেয়ারটি অর্ডার দিয়েছিলেন কুয়েতে থাকেন আমাদের ওখানকার এক প্রবাসী বাঙ্গালী। নাম আজমল হোসেন বড়লস্কর।  কোন এক হেডমাস্টারকে উপহার দেবেন বলে গড়িয়েছেন।
বললাম, এত দামী চেয়ার, সেও গিফট !
--- হ্যাঁ স্যার, উনার জন্যেই নাকি আজমল সাহেব মানুষ হয়েছেন।
বললাম, চল, দেখি তো তোর চেয়ারটা । কি এমন আছে চেয়ারটাতে যে এত দাম ।
কথা বলতে বলতে আমরা ফ্ল্যেটের বেসমেন্টে চলে এসেছিলাম। দুর থেকে দেখতে পেলাম ঝকঝকে একটা কপার বার্নিশ করা চেয়ার। একটু কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম, জিনিসটা সত্যি সত্যিই দামী। আমার শৈশব কেটেছে জঙ্গলের সংস্পর্শে, কাঠ আমি। খুব ভালো চিনি। শিশু কাঠের তৈরি, খুব সুক্ষ কাজ। বসার জায়গাটা একটা পদ্ম ফুল বানানো। পা চারটি বাঁকানো, অনেকটা ঠাকুরের আসনের মতো কাজ করা। আসলে হাঁসের পায়ের আকৃতি। পেছনে ঠেস দেবার জায়গাটি যেন খোলা ব‌ই। ব‌ইটাতে যে অনেক পাতা, সেটাও সুক্ষ কাজে স্পষ্ট। দুটো হাতল যেন রাজহাঁসের গলা। পিছনে হেলান দেবার জায়গাটি মাথা সমান উঁচু। আর তার ঠিক উপরে তিনটে পাখের কলমের মতো খোদাই করা তিনটি কলম।  মধ্যের কলমটিতে স্বামীজী, আর এক দিকে সুভাষ অন্যটিতে রবিঠাকুর।
অবাক হলাম চেয়ারটি দেখে। অদ্ভুত তার পরিকল্পনা। যে দেখবে তার‌ই পছন্দ হতে বাধ্য। আমি হলে এটাকে ঠাকুরের আসন হিসেবে ব্যবহার করতাম। বললাম,  সত্যি করে বলতো আইডিয়াটি কার ?
-- কেন স্যার ? আজমল সাহেবের ।
-- তোর আজমল সাহেব তো মুসলমান নিশ্চয়ই।
-- হ্যাঁ স্যার।
-- আশ্চর্য ! 
সুকান্ত বলল, স্যার চেয়ারটাতে একটাও পেরেক গাঁথিনি। যদি সময়ে সময়ে পালিশ করিয়ে নেন, তবে খোলা জায়গাতে ফেলে রেখে দিতে পারেন। রোদ বৃষ্টি বর্ষায় একশ বছরেও কিছুই হবে না এই গ্যারেন্টি দিতেই পারি।
--- কিন্তু এত টাকা দেবার সামর্থ আমার নেই রে বাপ। একটা চেয়ারের জন্য পঁচাত্তর হাজার খরচ করা আমার কাছে বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। তাছাড়া আজমল সাহেব অর্ডার দিয়েছিলেন তাকে জানিয়ে দে জিনিস তৈরি। টাকা দিয়ে নিয়ে যাক। এটাতো উনার জন্যেই তৈরি, তাইনা ?
--- উনি আর বেঁচে নেই স্যার। গত সপ্তাহে মারা গেছেন কুয়েতেই। করোনা হয়েছিল। পত্রিকাতে ছেপেছিল খবরটা। দেখেন নি আপনি ?
মনে পড়ে গেল, কিছু দিন আগে এরকমই একটি খবর পড়েছিলাম বটে। বললাম, তাহলে তার পরিবারের যারা এখানে আছেন তাদের বল ।
--- তারা নেবে না জানিয়ে দিয়েছে স্যার।
--- কিন্তু এত টাকা --- ।
--- আপনি শুধু আমার খরচটুকু দেবেন স্যার। কাঠ বার্নিশ মিলিয়ে আমার মোটামুটি আঠারো হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দু হাজার টাকা লাগবে গ্যাস, রেশনের জন্য। প্লিজ স্যার।
চেয়ারটি দেখা মাত্রই আমার পছন্দ হয়েছিল। শিশু কাঠ পুরো উত্তর পূর্বাঞ্চলে দুর্লভ। তাছাড়া এই দামে উত্তপ্রদেশেও এত নিখুঁত কাজ পাওয়া অসম্ভব। বললাম, নিতে পারি তবে একটা শর্তে ।
--- স্যার ---। খুশিতে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বললাম, এতো সুন্দর চেয়ারে তোর মতো গুণী লোককেই মানায় জানিস, কিন্তু আমরা বড় অভাগা রে। যার গুণ আছে তার সামর্থ নেই আর যার সামর্থ আছে তার বিদ্যা নেই। 
সুকান্তের চোখে বিষন্ন হাসি। বললে, স্যার, সত্যি বলছি আমরা কিন্তু ভালো আছি স্যার।
বললাম, আমি জানি তোরা ভালো আছিস কারণ তোদের চাহিদাটা বড় সীমিত। মুস্কিল যে আমাদের। আমাদের কোন কিছুরই কোনো সীমা নেই রে।
বললাম, যাক, তুই ওই চেয়ারটাতে বস। তোর একটা ফটো রাখতে চাই আমি।
সুকান্ত শোনা মাত্রই কেমন যেন গুটিয়ে গেল। বললে, এটা আবার কি কথা স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন, আমার দ্বারা হবে না স্যার -- ।
বললাম, বেশ, তবে নিয়ে যা তোর জিনিস, আমিও তাহলে রাখছি না।
--- এমন করবেন না স্যার, প্লিজ।
বললাম, যা বলেছি, চটপট কর, ন‌ইলে আমি চললাম। কেমন যেন ভেতরে একটা জিদ চেপে গেছে আমার।
অগত্যা সুকান্ত চেয়ারে বসলো।
আমি মোবাইলে ফটো তুলতে গিয়ে দেখলাম বসাটা যেন সঠিক হচ্ছে না। কেমন যেন একটা আড়ষ্ট ভাব। বললাম, ঠিক করে বস।
কিন্তু কিছুতেই সহজ হতে পারছে না। এতদিনের সংস্কার। একটু একটু করে দেখিয়ে দিলাম হাত কোথায় রাখতে হয়, পিঠ কতটুকু সোজা হবে, মাথা কিভাবে রাখলে ভালো দেখায়, ঠোঁটের কোণে হাসি, চোখের দৃষ্টি -- । আমায় যেন একটা নেশা পেয়ে বসেছে। সুকান্ত প্রথম অবস্থায় খুব অস্বস্তি বোধ করছিল। ধীরে ধীরে সেও সহজ হয়ে এসেছে। ঠিক যখনই ফাইনাল শট নিতে যাচ্ছি, তখনই একটা ফোন এলো।
স্ক্রীনে দেখি বিদ্যুৎ চক্রবর্তী । আমার খুব প্রিয় মানুষ। আমাকে খুব ভালবাসে। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে বললে, দাদা চিনতে পারছেন ?
বললাম, অবশ্যই, বল --- হঠাৎ ?
--- আপনার কিছু লেখা নিয়ে আমাদের মুক্তমঞ্চে লাইভে আসতে হবে।
--- কে ??? আমি !!! 
চমকে উঠলাম। কারণ এধরনের অনুষ্ঠান থেকে সচরাচর আমি অনেক দুরে থাকি। ভাবনাতেই আনি না। তাই অবাক হবারই কথা।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি সুকান্ত রাজার মত বসা, তার আড়ষ্টতা অনেকটাই কেটে গেছে, আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে সে।

সুপ্রদীপ দত্তরায় গল্প

Comments