খোলা চিঠি

খোলাচিঠি 
প্রিয় 
বন্ধুবর চাসেন লোয়়াং 

আজ সকালে তুমি যখন রাজপথে দুপাশে সেপাই নিয়ে হেঁটে হেঁটে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলে, আমি তখন আমার ছোট্ট ঘরের ততধিক ছোট্ট জানালার পাশে বসে ছিলাম । শীতের সকাল, সারাটা পৃথিবী কুয়াশায় ঢাকা, অন্তত আমিতো তাই দেখতে পাচ্ছি । আমার আকাশেও ছেয়ে আছে কালো মেঘ, ঘন কালো মেঘ । তোমাদের খোলা আকাশের কুয়াশার  চেয়েও ঘন কালো ।
তোমাকে টিভিতে দেখাচ্ছিল।  ফিটফাট পরিচ্ছন্ন পোষাক, হয়তো ওরা দীর্ঘ সময় নিয়ে যত্ন করে তোমাকে সাজিয়েছেন। কিন্তু তারা কি কেউ  জানে, তখন তোমার বুকের ভেতর আছড়ে পড়ছে লক্ষ সুনামীর ঢেউ। হয়ত জানে না । তুমি যেন একটু প্রয়োজনের চেয়ে বেশী গতিতে হাঁটছিলে। কেউ বুঝুক না বুঝুক আমি বুঝতে পারছিলাম তোমাকে, আমরা যে একই নৌকার যাত্রী । তুমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছো, লক্ষ জোড়া চোখ তখন তোমাতে স্থির। কিন্তু কি অপূর্ব কৌশলে তুমি তোমার চোখ দুটোকে সবার আড়ালে লুকিয়ে রাখলে। আমি দেখছিলাম, হ্যাঁ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার সেই চোখে প্রশান্ত মহাসাগর । আমার বুকেও যে বোন তখন আটলান্টিকের ঢেউ । আরো একজন হয়ত দেখেছিলেন, তিনি তোমাদের রাষ্ট্রপতি মহাশয় । হয়ত বললাম, আমার ভুল হতে পারে, তাই এনিয়ে যেন কোন বিতর্ক না হয় । আবার সত্যিও হতে পারে, দেখতেও পারেন তিনি । হয়তো সেইজন্যেই উনি তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না । তিনি তো জানেন কার ছোড়া তিরে কার তীর ভাঙছে । নেপথ্যে মাইকে তখন ঘোষনা চলছিল তোমার স্বামীর বীরগাঁথা। তোমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে । রাষ্ট্রপতির হাত থেকে অশোকচক্র সম্মান নেবে তুমি । চারপাশে শ্মশানের নিস্তব্ধতা । শুধু  টপ টপ শব্দে ঝরে পরছিল শ্বেতমুক্তা তোমার দুচোখ থেকে । শত চেষ্টা করেও বাঁধ বাঁধতে পারলে নাতো।
কেঁদো না চাসেন কেঁদো না, তবু তুমি ভাগ্যবতী । তোমার একটা সান্ত্বনা আছে। তুমি বীরসেনানীর সহধর্মিণী । গ্রামে তোমার একটা আলাদা সম্মান । আজ রাষ্ট্রপতি কাল রাজ্যপাল কেউ বা কেউ তোমাকে মানপত্র দিচ্ছেন । হয়তো তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে নানা সংস্থায় তোমাকে যেতে হয় । সেখানে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে হয়তো মন্ত্রীবর এসে তোমার হাতে মানপত্র তুলে দেন ।মানপত্রের  পাহাড়ে হয়ত তোমার ঘরের একমাত্র টেবিলটি ভরে গেছে । কিন্তু সত্যি করে বলত, সাথে দেওয়া চেকটি ভাঙাতে তোমাকে কতটা না কষ্ট পেতে হয়েছে । আসলে এসব কিছুই না,  তোমাকে সামনে রেখে নিজেদের মহান বানানো। আমি হলফ করে বলতে পারি তোমাদের দেশের খুব কম লোকই আছেন যারা পাঁচ জন অশোকচক্র প্রাপকের নাম বলতে পারবেন । এটাই বাস্তব । তাই তুমি ওসবে ভুল বোঝা না। পাথর হও। আমিও পাথর হয়ে গেছি। 

জানো চাসেন, তোমার মত আমিও স্বামীহারা । হ্যাঁ, তোমরাতো স্বামীই বল, তাই না । তোমার স্বামীর বয়স ৩৬, আমার মরদের বয়স ৩৪। আমরা দুজনেই হয়তো একই বয়সের হব। তুমি হয়তো ভাবছ আমি কে? আমাকে তুমি চিনবে না । আমাদের কোনদিনই দেখা হয়নি । আমার নাম বললে তোমার চেনার কথা নয় । কিন্তু আমার পরিচয় পাওয়া মাত্র আমি জানি চাসেন তোমার মন ঘৃণা ভরে উঠবে । তাই আমার পরিচয় দেওয়ার আগে তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তোমার ছয় বছরের ছেলে সেনওয়াং এর দিব্যি, আমার চিঠিটা ছিড়ে ফেল না। আমিও তোমার মতই হতভাগী।
আমি বেনজির, ইমরান এর বিবি। সেই ‌‌ ইমরান, চিনতে পারছ,  সেই যে চারজনের সাথে তোমার স্বামীর শেষ মুখোমুখি লড়াই হয়েছিল । ঠিকই চিনেছো, আমার মরদেরই গুলিতে তোমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে । কিন্তু এটাও সত্যি যে তোমার স্বামীর গুলিতেই  আমার মরদের মৃত্যু । কই আমি তো তোমাদের ঘৃণা করি না ।

জানো চাসেন, সেদিন যদি তোমার হাংপানের জায়গায় অন্য কেউ থাকতেন, তাহলে আমার ইমরানকে হয়তো আজ হারাতে হত না। আমিও হয়তো কোন দিন তোমাকে এই চিঠি লিখতাম না । বড় ক্ষুরধার বুদ্ধি ছিল তোমার হাংপানের । যেমনি তার ক্ষিপ্রতা তেমনি তার অসীম সাহস। তোমার হাবিলদার হাংপান দাদা সত্যি সত্যিই দাদা। সেদিন তারিখ ছিল ২৬শে মে ২০১৬ ইংরেজী । উত্তর কাশ্মীরের সামসাবারি রেঞ্জে গভীর অন্ধকার । নৌগাম সেক্টরের ৫ নম্বর ক্যাম্পে ইমরান, আলতাফ, রশিদ আর ওমর তিনদিন থেকে ক্যাম্পে অপেক্ষায় আছে । ইন্ডিয়া থেকে সংকেত না পেলে আর এগুনো যাচ্ছিল না । গত দুদিন ধরে তোমাদের আর্মির শিফটিং ছিল তাই প্ল্যান অনুযায়ী ঐদিন রাত দুটোয় আমাদের মার্চ করার কথা । সেই মত ইমরান ওরা তৈরি ।কিন্তু কি করে যে ইন্ডিয়ান আর্মি খবর পেয়ে গেল, জানতেও পারলো না কেউ । রাত একটায় মনে হচ্ছিল জঙ্গলটা যেন একটু একটু নড়ছে। ইমরান ই প্রথম লক্ষ্য করে । দুরবিনে চোখ মেলে বুঝতে অসুবিধা হল না লড়াই আসন্ন । আমাদের ক্যাম্প পাহাড়ের উপরে, ইন্ডিয়ান আর্মি নিচ থেকে উপরে উঠছিল । পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে । ইমরান ওরা পজিশন নিয়ে তৈরি । ইন্ডিয়ান আর্মি  খুব ধীরে ধীরে উঠেছে । বন্দুকের রেঞ্জে না এলে আক্রমণ করা যায় না । আমাদের ছেলেরা ওদের অপেক্ষায় । হঠাৎ যমদুতের মত হাবিলদার হাংপান দাদা হাজির । শুরু হয়ে গেল সামনে পিছনে দুদিক থেকে গোলাগুলি । আমাদের ছেলেরা খুব লড়াই করল।এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না । কিন্তু তোমার স্বামী ভীষণ সাহসী । একা সামনাসামনি লড়াইয়ে আলতাফ, রশিদ আর ওমর কে হত্যা করেছে । প্রথমে রশিদ তারপর আলতাফ সবশেষে ওমরকে । ওমরটা ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য খুব কান্নাকাটি করছিল, কিন্তু তোমার স্বামী কোন দয়া দেখায় নি । বেওনটের আঘাতে ওমরের রক্তাক্ত কলিজাটা শরীর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছিল। কিন্তু এক জায়গায় তোমরা ভুল করে ফেলেছিলে । ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে খবর ছিল তিনজনের,  আসলে ওরা ছিল চার জন । তাই হেংপান যখন ওমরকে শেষ আতঙ্কী ভেবে বেপরোয়া ভাবে হত্যা করছিল, তখন পাশের রেঞ্জ থেকে ইমরান তোমার স্বামীকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি ছুড়ে । আমার ইমরান কখন লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়নি । অন্য হলে ওখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা । ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিল দাদার শরীর থেকে । বহু কষ্টে পিছনে ফিরে সে ইমরানকে লক্ষ্য করে গুলি চালালো বটে, কিন্তু লক্ষ্য ভেদ হল না । একটা দুটো গুলি নয় পুরো এক রাউন্ড গুলি,  শরীরটা কিছুতেই সোজা রাখা সম্ভব ছিল না । তোমার স্বামী মাটিতে লুটিয়ে পরেছিল। ইমরান আরো দুটো গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করল । কোন সাড়া শব্দ নেই । সমস্ত প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেছে । রাগে দুঃখে ইমরান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। রেঞ্জ থেকে বাইরে এসে সে হেংপান এর মুখে কষে একটা লাথি হাকায় । তখনও সে বুঝতে পারে নি যে তোমার স্বামী জীবিত । তারপর সব ইতিহাস । কি করে যে মৃতপ্রায় লোকটির শরীরে শক্তি ফিরে এলো, আল্লাহ জানেন । হাতের মুঠোয় শত্রু পেলে যা হয় ।তোমার স্বামীর আগেই আমার ইমরান আল্লাহ র পেয়ারা হয়ে গেল । দুটি অচেনা লোক কার আঙুলী হেলানে একে অন্যের জীবন নিল একবার ভাব চাসেন ।

জানো চাসেন,  তোমার মেয়ে রৌকিন এর মত আমারও একটা মেয়ে আছে, শবনম। ফুলের মত মেয়ে । নিজের মেয়ে বলে বলছি না আমার মেয়েকে তুমি কোলে না নিয়ে থাকতে পারবে না । ওতো জন্নতের হুর। তোমার মেয়ের আগামী ৩০ জুন ১০ বছর হবে,  আমার মেয়ের গত ১৮ তারিখ তিন। আমি জানি না তুমি তোমার সন্তানদের কি বলে বোঝাও, আমি পারি না । আমার মেয়ে তো শিশু, জেহাদ কি সে তো জানে না । খুব বায়না করে, ওর আব্বু কেন আসে না । ওকে কি করে বোঝাই বল তো, ওর আব্বা আর কোনদিন ফিরে আসবে না ।

আমাদের এখানে এক ধরনের ফুল ফোটে, ইংরেজিতে ওটাকে কেটস্ টেল বলে ।সাদার সঙ্গে গোলাপি মেশানো একগুচ্ছ ফুল। অপূর্ব সুন্দর দেখতে । তোমরা বোধ হয় ওটাকে দ্রৌপদী ফুল ‌‌‌ বল। আমার খুব প্রিয় । ইমরান সেটা জানতো। শেষ যে রাত্রিতে আমারা একসাথে ছিলাম, ঐদিন পুরো বিকেলে আমরা তিনজন আঙিনার ঐ ব্রুন গাছের ছায়ায় বসেছিলাম একাএকা । হ্যাঁ একাএকাই তো,  আমি ইমরান আর আমাদের আদরের শবনম। পাশাপাশি বসা তিন ভুবনে তিনটি মানুষ ।জানো,  আমি জানতাম ইমরান কি কাজ করে,  কোথায় যায়, সব। কিন্তু আমারা নিরুপায় ছিলাম । যেদিন মোল্লা আমাকে বলেছিল, "ভয় পেয়ে না বেনজির, ওর কিছু হলে আমরা তো আছি ।"  বিশ্বাস কর চাসেন,  তুমি তো নারী, তুমি বুঝবে একথা গূঢ় অর্থ । ঘেন্নায় সমস্ত শরীরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল ।  কিন্তু আমরা বড় নিরুপায় ।ব্রুন গাছের ছায়ায় একগুচ্ছ দ্রৌপদী ফুল আমার খোপায় গুজতে গুজতে সে আমায় বলে ছিল এই বর্ষার আগেই চাল সারাই করবে। এবারের অপারেশন ঠিকঠাক হলে সে নাকি অনেক টাকা পাবে। সেই টাকায় আমাদের ঘরের চাল, শবনমের জন্যে একটা সোয়েটার, - - আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না । হায় আল্লাহ! 

চাসেন বোন  আমার, একবার ভেবে দেখোতো , তোমার বাড়ি তিরাপ জেলার খুনশা শহরের পাশে বড়দুরিয়া গ্রামে, আমি থাকি পাকিস্তানের মুজাফ্ফর শহরের পাশে দধিয়াল। তুমিও যে হিমালয়ের পাদদেশে থাক,  আমিও থাকি সেই হিমালয়ের স্নিগ্ধ ছায়ায় । তোমার বনে শাল , সেগুন আর পিয়ালের সারি,  আমাদের বনে আছে পিপল, চন্দন, অশোক আর কদম্ব । তোমার ওখানে ফোটে টোকো, টোকউ, নিশি আর পুরবং, আমাদের ফোটে মাসওয়াল , ডাস্টার পুশ আর জাফ্ফর। তাহলে কোথায় আমাদের বিবাদ। আমরা তো ব্যাক্তি  হিসেবে কেউ কারো শত্রু ছিলাম না তবে কেন আমাদের এই পরিনতি । আমাদের কাঁধে বন্দুক রেখে কারা সেই শিকারী। আমি ইমরানকে কত বুঝিয়েছি, এর নাম জেহাদ নয় । ধর্মের নামে রাষ্ট্রের নামে তোমরা যা করছো, ইসলাম তা বলে না। ইসলামের মূল মন্ত্র তা নয় । কিন্তু আমরা যে  বড় নিরুপায় চাসেন,  ফেরার কোন পথ নেই । একবার ভাবতো চাসেন, এত যুদ্ধ শেষে তোমারা কি পেয়েছে, আমরাও কি বা পেলাম। আমরা তো কেউ জিততে পারলাম না। অথচ এই যুদ্ধকে জিইয়ে রেখে আমাদের রক্তে সাধনা করছে একদল তান্ত্রিক । ঘর তো আমাদের ভাঙছে, ওদের নয় । আমাদের ঘর অন্ধকার । আমাদের সুখ,  আমাদের স্বপ্ন, ভালবাসা সব শুন্য ওদের জন্যে ।  এখানেইু তুমি আমি আমরা এক । এখানে কোন দেশ নেই, ধর্ম নেই, আমরা সবাই হতভাগার দল। ওদের হাতে কাঠপুতুলি । 

তাই অনেক হয়েছে চাসেন, আর কান্না নয়, এখন পাথর হবার সময় । এস আজ সময় এসেছে তুমি আমি আমাদের মত হতভাগার এক হই,  আর আমাদের সবার চোখের জলকে  বাষ্প বানিয়ে এমন একটা বজ্র তৈরী করি যার আঘাতে সেইসব তান্ত্রিকদের সমস্ত তন্ত্রজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে । যাতে আগামীতে আর কখনো কেউ তোমার আমার মত হতভাগী হবে না ।আর কারো স্বপ্ন ভাঙবে না, আর কোন শবনম হারাবে না তার বাবাকে ।

ভালো থেকো,  
তোমার সহমর্মী
বেনজির

                      ********(কাল্পনিক)

Comments