লক্ষ্মী সেন

লক্ষ্মী সেন

বাবারা, তোরা যা ---'
তোরা যা ফিরে যা ঘরে
আমি আর যাচ্ছি না রে বাড়ি ।
ওখানে আর লক্ষ্মী কোথায় ?
লক্ষ্মী মানে ঠাকুর নয়, লক্ষ্মী সেন
আমার নিজের কথাই বলতে চাই 
তোদের জন্মদাত্রী অলক্ষ্মী মা
তাঁকে রাখার জায়গা কোথায় ঘরে ?
আমি আর যাচ্ছি না ফিরে ।
আমার এখন মন ভালো না,
দেখলে তোদের কষ্ট পাই
তোরা দয়া করে যা ফিরে যা ঘরে ।

মনে আছে তোদের বাবা -- যেদিন গত হলেন
সবাই বললি আমরাতো মা আছি তোমার সাথে ।
বলিস নি বল ? আমি ভাবলাম সত্যি তো
পাঁচ পাঁচটি সন্তান আছে, পঞ্চ রত্ন
আমার আবার ভাবনা কিসের
আমি কি আর জানতুম রে
ভাবনা আমার সেদিন থেকেই শুরু ,
দিনের পর দিন কেটেছে
লাঞ্ছনা -- গঞ্জনা -- আর অপমান
আমায় দেখলে বৌমা ওদের
কুঁচকে উঠতো ভ্রু । দেখিস নি?
আমি সব ভুলতে পারি বল ?
যে ঘরটিতে থাকতে দিলি, ওটা তো ঘর নয়,
গুদাম একটা,  তোদের ভাষায় স্টোর রুম
আবর্জনায় ঠাসা, কোণে আমার খাট
একটা কোথাও জানালা নেই, নেই রৌদ্র পাট
আলো জ্বালানো নিষেধ ছিল
বিদ্যুতের বিল বাড়তে পারে
তুই কি তার কিছুই জানিস না ।
তাঁকিয়ে দেখ, এখন আমি ভালোই আছি বল ?
দশ ফুট বাই দশ ফুটে ছোট্ট একটা খাট
আমার জন্য অনেক জায়গা
জানলাগুলো খুলে দিলে আকাশ দেখা যায়
টিভি নেই তাও ভালো, কথা বলার লোক আছে যে
না রে বাবা , আমাকে আর ওবাড়িতে
যেতে বলিস না।

তোর মনে আছে জানি,  যেদিন আমি বেরিয়ে এলাম,
বাড়ি থেকে --, নিজের বাড়ি, নিজের হাতে গড়া, 
ফুলের টব---, ব্যালকনিতে দোলনা চেয়ার ---,
মনে পড়ে , তোর বৌ এর কি সুতীব্র চিৎকার,
বেরিয়ে যান , অশিক্ষিত বুড়ি কোথাকার  ---।
আমার এত বিদ্যে নেইকো, বেরিয়ে এলাম,
বেরিয়ে এলাম শুধু তোর মুখটি চেয়ে
অপরাধ ? বলেছিলাম পেনশনের টাকাটা
আমার হাতে দিতে । মনে পড়ে তোর?
তুই তো তখন ড্রইংরুমে বসা ।
একটা শব্দ বললি নাতো বাবা,
একটিবারও ভাবলি না
তোর বুড়ো মাটা, এখন কোথায় যাবে ।
এখন তোদের প্রয়োজনে নিয়ে যাবি বাড়ি
সেও আবার বোধন থেকে লক্ষ্মী পুজা
তারপরেতেই ফেরৎ । কেন রে,
কেন এত ঘটা করে নিয়ে যাবার বহর ?
আমি কি সব বুঝি না বল ? এতই বোকা ?
না রে বাবা, ওবাড়িতে যাচ্ছি না আর আমি ।

তোরই বা দোষ কিসের ? তুইতো আর একা নস,
চার চারটে বাচ্চা কাচ্চা আরো ছিল আমার ।
আত্মজ আর বললাম না, শব্দটাতে ব্যাপ্তি বিশাল
তোরা আমার সন্তান নয়,  অভ্যাসেরই ফসল
তাইতো এমন । কোথাও আমার মাথা গোঁজার
জায়গা হয়নিকো, এমনটাই কপাল ছিল আমার ।

বাড়িটাতো তোদেরও নয়, আমার নামে
তোদের বাবার টাকায় কেনা
সখ করে কিনেছিলেন,
দলিলটাতে আমার নামটি লেখা,
তা থাক, খাট পালং আলমারি, 
দেওয়াল জুড়ে টাঙানো ওই ঢাউস ফটো,
ওসব বাবা তোদের জন্যই থাক,
আমি আর যাব নারে ফিরে ।
আমার কিছুই চাই না আর,
এখন আমার বিদায় নেবার পালা ,
আমায় কি আর ওসব ঘরে মানায়?
তোদের ঐ ছোট্ট ঘরে দম বন্ধ হয় ।
শুধু একটা কথা বলে দিই , শুনে রাখ
বাড়িটা আর দিচ্ছি নাকো তোদের  ।
যতদিন বেঁচে আছি, ভোগ কর,
মরে গেলে ছেড়ে দিস, তাতেই ভালো
নইলে তাড়িয়ে দেবে , জেনে রাখো
ওখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম যে হবে
অনেকটা ওই বারইগ্রামের মতো ।
আমার মতো হতভাগিনী যারা, থাকবে ওরা, আর ---
আর ? তোদের কথাও বলেছি রে,
তোরা যে আমার পেটে ধরা সন্তান
আমার রক্ত চুষার দল,
তোদের কথাও বলে রেখেছি
যেদিন তোদের তাড়িয়ে দেবে, তোদের ছেলেমেয়েরা
আমার যে আজ শুধু ওইটাই ভয়
তোদেরকেও থাকতে দেবে, বলা আছে
জানি তো সেদিনটি যে অনেক দুরে নয় ।
আমার কথা ভাবিস না আর ,
মরে গেলে বেঁচে যাবো, ভালো থাকিস তোরা ।
তবু দোহাই তোদের ও বাড়িতে যেতে বলিস না ।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments