আমিনা


বন্ধু,  জানি না কি নামে ডাকবো তোমায়

আমিনা, ফতেমা, নাসরিন কিংবা নার্গিস 

তুমি ফিরোজাও হতে পারো ।

আমি যে ঠিক তোমায় চিনি না ।

তোমার আমার দেখা হয়েছিল

কোনদিন কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে  

তেমন কোন ভাবনাও মনের মধ‍্যে নেই ।

তবু, তুমি আমার বন্ধু । তুমি আর আমি, 

আর আমাদের মত আরো যারা --

গুরমীত, মালালা কিংবা সীতারা,

আমরা কেউ কাউকে চিনি না, তবু,

আমরা খুব কাছের মানুষ । 

সুদূর দেশে থাকি বটে,

ভূগোলের কাটাকুটিতে যার 

অনেক সমীকরণ, অনেক বিচ্ছেদ , 

তবু আমাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, উদ্বেগ 

অনেকটাই এক।

এই বিশাল ভুখন্ডের দুই প্রান্তিক শহরে থেকেও, 

অনাত্মীয় --তবু আত্মীয় আমরা

মনের দিক থেকে খুব কাছের লোক ।

স্বজনও ভাবতে পারো, যদি দ্বিধা না থাকে ।

যদি থাকে অন্তরে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ,

তবে ভাবতে পারো, আমরা বন্ধু বটে ।

জানো বন্ধু, এই তোমাকে আমিনাই বলছি, 

এই নামটাই আমার খুব পছন্দের ।

নামে কি যায় আসে বলো ?

নামটাতো ফাঁকি, ভেতরের টানটাই সার।

তোমাকে জানো, কেন জানি এই মুহূর্তে  

খুব মনে পড়ছে আমার ।

কি জানো, আসলে কিছু ক্ষণ আসে, 

যখন ইতিহাস নতুন করে জন্ম লয়, 

হয়তো সাধারণ সেই মুহূর্ত কোন ব্যক্তি বিশেষে,

কালের যাত্রা পথে তার অনন্ত বিস্তৃতি রয় ।

কি হারিয়ে কি পেয়েছো সে প্রসঙ্গ থাক, 

সময় তার সঠিক বিচারক ।

তুমি আমি দর্শক শুধু,  নীতি নির্ধারক নই, 

কি লাভ সেই বিতর্কেতে গিয়ে ।

মনে মনে শুধু শঙ্কা , 

তাই খুব জানতে ইচ্ছে করে, 

আজ সাতই আগস্ট দু’হাজার উনিশ--

কালান্তরের এই দুর্বিষহ মুহূর্তে 

বন্ধু, তুমি কেমন আছো ? 

শুধু বলো, ভালো আছো তো ?

কাশ্মীরের সাথে আমার মুখোমুখি 

নেই পরিচয় । যাকে বলে চাক্ষুষ ।

যা কিছু চেনা সেই ভূগোলের ম্যাপে ,

বাকিটাই আফসোস ।

কাঁপা হাতে যখন আমি ম্যাপ আঁকতাম, 

কষ্ট হতো খুব । তবু স্বপ্নে দেখতাম,  আমি

ভুস্বর্গের দেশে । ওখানে ডাল লেক, আর

নৌকা বিহার । ফুল, ফুল আর ফুলে ভরা 

অসংখ্য শিকারা । স্বপ্নে যেতাম ।

পেহেলগামের তাবুতে শুয়ে

লিডার নদীর সাথে কানেকানে কথা , 

সবটাই স্বপ্ন ছিল আমার ।

তারপর ঝিলমের স্রোতের মত

কত জল বয়ে গেছে জীবনে ।

আমি বেড়ে উঠেছি, তাল আর নারিকেলের বনে,

তোমার ওখানে চিনার গাছের সার ।

যাওয়া আর হয়নি জানো, 

কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে মাঝরাত্তিরে

ঝিলমের ডাক শুনি, ক্লান্ত ক্ষীণ স্বরে ,

ঘুম ভেঙে যায় । ভাবি কি শুনতে পেলাম? 

ওকি বুলেটের শব্দ, নাকি ডাকছে আমায় ।

যদি বলি বন্ধু, তোমার জন্যে আমি খুবই চিন্তিত, 

তুমি সশব্দে উঠবে হেসে,  খানিকটা ঘৃণায় ।

কিন্তু বিশ্বাস করো , তুমি যেমনটি ঘৃণা করো, 

ভারতবাসীকে,  হয়তো বা, আমি জানি না; 

আমার রাষ্ট্র ও আমাকে নিয়ে তেমনি শঙ্কিত ।

আমার নাগরিকত্বের সতীত্ব নিয়ে বহু পরীক্ষা ।

তোমার ধর্ম, আমার ভাষা, কেউ সন্দেহের উর্ধে নই।

বন্ধু, তোমার কষ্টের সাথে আমার যন্ত্রণা, 

কোন তুলনা চলে না, 

যদিও শুধু প্রসঙ্গেতে বলা, 

কিন্তু বিশ্বাস করো আমরা কেউ ভালো নেই ।

কেউ স্বজন হারা বুলেটের ঘায়ে, 

কেউ ভিটে ছাড়া অনন্যোপায়ে ।

তাই,  যখন সংবাদটি আমি প্রথম শুনি

তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল বন্ধু ।

কি হলে কি হতো, কি হলে ভালো ছিলো --

সে অনেক কথা । আমি শুধু বুঝি একটি কথা

বড় বিপর্যস্ত ছিলে তুমি সেইদিন । 

কি করছিলে তখন বন্ধু ? 

রুটি হয়েছিল তোমার ? দুপুরের খাবার ?

শুনেছি কাশ্মীরী ওয়াজবান ভুবন বিখ্যাত,

কত রকমের পদ, কত তরিবত ।

শুনেছি ওয়াজবানে নাকি ভেদাভেদ নেই ।

এখনো কি পাওয়া যায়, ওখানে ওসব? 

এখনো কি সমস্ত নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ভাসে

ভজন সপোরি । কি রাগ ভাসে তাতে,

কৌশিক রঞ্জিনী নাকি শুধুই মালকোষ ?

বন্ধু, খুব জানতে ইচ্ছে করে যে।

তোমার কথা,  তোমার মেয়ের কথা 

সত‍্যি বলি, খুব জানতে ইচ্ছে করে ।

আমিনা,  আমি জানি না, 

তোমরা কেমন আছো? 

পত্র পত্রিকায় যা দেখি, সেতো অন্য কথা বলে ;

কেউ জমি কিনতে চায় কাশ্মীরে 

কারো ইচ্ছে গুলমার্গ যাবে ঘুরে, 

সবটাই ওদের কথা।

তোমাদের মনে কি ভাবনা বইছে, 

কেউ বলে না । বলতে চায় না ।

তোমাদের ঘরে সেদিন খাবার ছিল কিনা ---

নাকি আগে থেকেই সবকিছু কেনাকাটা ছিল? 

তোমরা কি কিছু আঁচ করেছিলে ? 

ভয় করে নি তোমাদের?

বাবার ঔষধটা কেনা ছিল তাহলে? 

ছেলের সাথে শেষ কবে কথা হয়েছিল? 

আরো কত সহস্র প্রশ্ন আমার ---

হয়তো অবান্তর সব,মিথ‍্যে কালক্ষেপ --

তবু জানতে ইচ্ছে করে, 

খুব জানতে ইচ্ছে করে বন্ধু।

এর বেশি আর কিছু নেই তো জানার ।

বড় ভয় লাগে জানো, তোমার মেয়েটির জন্য, 

আমার মেয়ের মত তার অনিশ্চিত জীবন ।

এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ‍্যত, 

হয়তোবা রাষ্ট্রীয় সংকট,

বড় ভয় লাগে বন্ধু ।

তবু বলি শোন, যদি কোনদিন, 

যদি কোনদিন বুলেটের শব্দ থামে 

কলকল ধ্বনিতে গর্জে ওঠে লিডার, 

যদি কোন শান্ত পরিবেশে আমায় 

আবার  মনে পরে, 

তবে জানতে দিও বন্ধু কে বেশি সুন্দর --

তোমার কন্যা নাকি ডাল সুন্দরী ।

জানতে দিও তোমার প্রিয় নদীর নাম, 

বরফ ঢাকা  কারাকোরামের গল্প, 

তোমার টিউলিপ , তোমার লোটাক গাছের ফুল,

জানতে দিও সুফিয়া কালামের কথা, 

তোমার মেয়ের প্রিয় গান । জানতে দিও ।

আর ততদিন,  যতদিন না উপত্যকাতে 

শান্তি ফিরে আসে, বারুদেরা গন্ধ হারায়, 

ততদিন লক্ষ্মীটি বন্ধু আমার --

বেঁচে থেকো অন্তত আমাদের জন্যে 

এই রক্তাত্ব ভূগোলে।

Comments