যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন


যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে 

চুকিয়ে দেব বেচা কেনা 

মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা, 

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে---

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে, 

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমার ডাকলে।

যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়

কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা 

ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বসবাসের 

শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে 

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে ।

পঁচিশে জুলাই উনিশশো একচল্লিশ সাল, শুক্রবার বেলা তিনটা পনেরো মিনিটে গুরুদেব এলেন আবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। খবরটা জনসাধারণের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল, তাই স্টেশনে বা বাড়িতে ভিড় হয়নি মোটেও । সারাদিন ট্রেনের গরমে তিনি কষ্ট পেয়েছেন, খুব ক্লান্ত । যে স্ট্রেচারে করে তাঁকে আনা হল তাইতে তিনি সেইভাবেই শুয়ে রইলেন । খাটে আর তোলা গেল না তখন । বললেন, " এখন আর আমাকে নাড়াচাড়া করো না, এইভাবেই থাকতে দাও।"

বিকেলে দুয়েকজন যারা গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, কারো সঙ্গেই তিনি তেমন কথাবার্তা বলতে পারলেন না । সন্ধ্যার দিকে বেশ খানিকটা ঘুমালেন ঐ স্ট্রেচারে শুয়ে শুয়েই। রাত সাতটায় একবার বলে উঠলেন, " কি জানি -- ভালো লাগছে না যেন আমার ।"

পাশের ঘরে ডাক্তাররা কেউ না কেউ সবসময়ই থাকতেন । গুরুদেবের আড়ালে সদাজাগ্রত হয়ে থাকতেন তাঁরা । গুরুদেবের নাড়ি দেখলেন, ঔষধ খাওয়ালেন । বললেন, " ভয়ের কিছু নাই, তবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন ।" রাতে গুরুদেবকে স্ট্রেচার থেকে তুলে খাটে শোওয়ানো হল। সেই রাত্রে বেশ ভালো ভাবেই ঘুমালেন তিনি ।


গানঃ আমারে করো জীবন দান 


২৬ শে জুলাই । সকালবেলা গুরুদেব খুবই প্রফুল্ল । ক্লান্তিটাও অনেকটা কেটে গেছে । রাতে ভালো ঘুম হওয়াতে বেশ বিশ্রামও হয়েছিল । সবার সাথে অনেক কথা বললেন । দুপুরেও ভালো । বিকেলে সাড়ে চারটার সময় পঞ্চাশ সি সি গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়া হল ডান হাতের শিরায় । গুরুদেবের বেশ একটু লেগেছিল । হঠাৎই তার সারা শরীরে কাঁপুনি উঠলো, কম্বল চাপা দিয়ে তিন চারজন চেপে রাখা সত্ত্বেও আধঘন্টার উপর ঠকঠক করে কাঁপলেন গুরুদেব, খুব কষ্ট পেলেন আজ ।জ্বর ১০২.৪ ডিগ্রি । সারারাত গুরুদেবের একটানা ঘুমের মধ্যেই কেটে গেল ।


আজ ২৭শে জুলাই ।সকালে গুরুদেব মুখে মুখে একটা কবিতা বললেন। 

প্রথম দিনের সূর্য 

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে ---

কে তুমি ।

মেলেনি উত্তর ।


বৎসর বৎসর চলে গেল, 

দিবসের শেষ সূর্য 

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল 

পশ্চিম সাগর তীরে, 

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় ---

কে তুমি ।

পেল না উত্তর ।

গুরুদেব বললেন, " সকালবেলার অরুণ আলোর মতো মনে পড়ে কয়েক লাইন ---- লিখে রাখ্  নয়তো হাড়িয়ে ফেলব। প্রত্যেকবারই  ভাবি ঝুলি খালি হয়ে গেল --- এবারে চুপচাপ থাকি; পারিনে। এ পাগলামী নয়তো কি?

কবিতার কয়েকটি জায়গা মুখে মুখে ঠিক করে দিলেন । তারপর অনেকক্ষণ একইভাবে স্থির হয়ে শুয়ে রইলেন । বললেন, " ঐ কবিতা বল্ তো একবার , শুনি, ঐ যে 'বিপদে মোরে রক্ষা করে এ.....


গান :- বিপদে মোরে রক্ষা করো 


বারবার ভুল হচ্ছিল । গুরুদেব কান পেতে আছেন, দুঃখে শ্বাস রোধ হয়ে আসছে । একে একে অনেকেই চেষ্টা করলেন, সবটা মনে আনতে পারলেন না, বড় অসহায় অবস্থা । গুরুদেব তেমনি স্থির হয়ে আছেন । কিছুক্ষণ কাটলো । গুরুদেব চোখ মেললেন, বললেন, " এই কবিতাগুলি মুখস্থ করে রেখে দিস --- এগুলো মন্ত্রের মত। "


২৯ শে জুলাই সকাল । এই দুদিন গুরুদেব অপারেশন নিয়ে খুব বিমর্ষ হয়ে আছেন । বলছেন, " যখন অপারেশন করতেই হবে, তখন তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা চুকে গেলেই ভালো । বিকেলে একটি কবিতা বললেন, লিখা হলো । লিখা শেষ হয়ে গেলে আপনমনে বললেন, " ভয়কে ভয় করলেই ভয় --- ।"


গানঃ-   ভয় হতে তব অভয় মাঝে ....


গত একবছর ধরে অসুস্থতার জন্য গুরুদেবের আধশোয়া অবস্থায় ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । অপারেশনেরপর সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে হবে কিছুদিন অবধি, তাই ডাক্তাররা কিছু বালিশ কমিয়ে নেওয়ার পরামর্শদিলেন । বিকেলে যখন পায়ের নিচে বালিশটা ঠিক করে দিতে যাওয়া হল, গুরুদেব বললেন, " আর কেন ? পা তুলে থাকা আমার চলবে না গো , উঁচু ঘাড়ও আমার আর সাজবে না। যে ঘাড় কোনদিন নামাইনি আজ ডাক্তাররা বলছে, ঘাড় নামাও -- পা সোজা করো। কি অধঃপতন হল আমার বল দেখি ?"


৩০ শে জুলাই । আজ গুরুদেবের অপারেশন হবে । সকাল থেকে তারই তোড়জোড় চলছে । পাথরের ঘরের বারান্দায় অপারেশন টেবিল সাজানো । ঘরে বারান্দা ধোওয়া - মোছা হচ্ছে, সব কিছুই নিঃশব্দে । সবার প্রাণ উদ্বেগে শঙ্কাতুর। গুরুদেব অনেকক্ষণ হল চুপ করে আছেন । কি যেন ভাবছেন । ইশারাতে বললেন, " লেখো --।"


তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি 

বিচিত্র ছলনাজালে

হে ছলনাময়ী ।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে 

সরল জীবনে।

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বেরে করেছ চিহ্নিত; 

তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি ।

তোমার জ্যোতিষ্ক তারে

যে পথ দেখায় 

সে যে তার অন্তরের পথ,

সে যে চিরস্বচ্ছ,

সহজ বিশ্বাসে সে যে

করে তারে চিরসমুজ্বল।

বাহিরে কূটিল হোক অন্তরে সে ঋজু, 

এই নিয়ে তাহার গৌরব।

লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।

সত্যেরে সে পায় 

আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে 

কিছু পারে না তারে প্রবঞ্চিতে 

শেষ পুরষ্কার নিয়ে যায় সে যে

আপন ভান্ডারে ।


কবিতাটি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন গুরুদেব । আজকাল কিছু ভাবতে গেলে অল্পেতেই তাঁর ক্লান্তি আসে;  এ কথা তিনি নিজেও স্বীকার করেন ।

গুরুদেব আবার বুকে হাত দুহাত জড়ো করে চুপচাপ চোখ বুজে রইলেন । অনেকক্ষণ এইভাবে কাটলো। সাড়ে নয়টায় বললেন, " লিখে নে ---"


অনায়াসে যে পেয়েছে ছলনা সহিতে

সে পায়  তোমার হাতে 

শান্তির অক্ষর অধিকার ।


বললেন, "সকালবেলার কবিতাটির সঙ্গে জুড়ে দিস।"

গুরুদেব তখন জানেন না আজই তার অপারেশন হবে । জানতে পেরে গুরুদেব একটু হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, " আজই ? তা ভালো, এরকম হঠাত হয়ে যাওয়াই ভালো ।" 

কিছুক্ষণ পর আজকের লেখা  কবিতাটা আবার শুনতে চাইলেন । বললেন, " কিছু গোলমাল আছে  --- তা থাক, ডাক্তাররা তো বলেছে অপারেশনের পর মাথাটা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে । ভালো হয়ে পরে ঠিক করব'খন ।"


গান গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে 


বেলা এগারোটা নাগাদ বাইরের বারান্দায় স্ট্রেচারে করে গুরুদেবকে অপারেশন টেবিলে আনা হয়। মুখের সামনে বুকের উপরে ছোট স্কিন দিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে গুরুদেব তার ওদিকে কিছু দেখতে না পান। ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা হয়নি গুরুদেবকে, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে অপারেশন করা হচ্ছে । নিঝুম বাড়ি , কোথাও একটা ছুচ পড়লে যেন সে আওয়াজ কানে লাগবে , এমনি ভাব সবার ।

এগারোটা কুড়ি মিনিটে অপারেশন শেষ হয়। সেলাই ব্যান্ডেজ ইত্যাদি শেষ হতে আধঘন্টা সময় লাগে । গুরুদেবকে ঘরে আনা হয় ।গুরুদেব ভারী হাওয়াটা উড়িয়ে দেবার জন্য সবার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন , " কিরে ভাবছো?  খুব মজা -- না ?"

দিনের বেলা খুব ঘুমালেন গুরুদেব । বিকেলের দিকে বার কয়েকই বললেন, " ব্যাথা করছে ---- জ্বালা করছে।"

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ললিতবাবু আবার এলেন। গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করলেন, " অপারেশনের সময়ে কি খুবই  লেগেছিল আপনার? "

গুরুদেব বললেন, " কেন মিছে মিথ্যে কথাটা বলাবে আমাকে দিয়ে ।"

রাতে গুরুদেব ভালোই ঘুমালেন ।


গান :- আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে 


তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে ।।


একতারাটি একটি তারে  গানের বেদন বইতে নারে


তোমার সাথে বারে বারে  হার মেনেছি এই খেলাতে 


তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে ।।


এ তার বাঁধা কাছের সুরে, 


ঐ বাঁশি যে বাজে দুরে।


গানের লীলার সেই কিনারে যোগ দিতে কি সবাই পারে 


বিশ্বহৃদয় পারাবারে রাগরাগিণী জাল ফেলাতে--


তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে? ।


৩১শে জুলাই । আজ সকালে গুরুদেব একটা দুটো কথা বললেন মাত্র । ---" ব্যাথা করছে, জ্বালা করছে ।"

দুপুর থেকে কেমন নিঃসাড় হয়ে আছেন ।গায়ের তাপ বেড়েছে আজ। দিনের বেলা বেশ ঘুমিয়েছেন , রাতে ভালো ঘুম হলো না গুরুদেবের ।


১লা অগস্ট । আজ সকাল থেকেই গুরুদেব কোন কথা বলছেন না । অসাঢ় হয়ে আছেন । কেবল যন্ত্রণা সূচক শব্দ করছেন থেকে থেকে । দুপুরের দিকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে মাথা নাড়ছেন ।মাঝে মাঝে তাকান কিন্তু কিছু বলেন না ।অল্প অল্প জল আর ফলের রস খাওয়ানো হচ্ছে গুরুদেবকে ।ডাক্তাররা চিন্তিত, অন্য কোন উপসর্গ আছে কিনা বুঝতে পারছেন না ।সারাদিন ডাক্তারদের আনাগোনা, পরামর্শ ফিসফিস চলছে।


২রা অগস্ট । কাল রাতটুকু নানারকম ভয় ভাবনাতে কেটেছে। গুরুদেব কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন সারারাত । আজ সকালে দুই চারটি কথা বলছেন --- পরিষ্কার ।কিছু খাওয়াতে গেলে বিরক্তি প্রকাশ করে বলছেন, " আঃ , আমাকে আর জ্বালাস নে তোরা। "

একজন ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, " কি রকম কষ্ট হচ্ছে আপনার ?"

গুরুদেব স্নিগ্ধ হাসি হেসে বললেন, "এর কি কোন বর্ণনা আছে  ?"

দুপুর থেকে গুরুদেব আবার আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন । সারারাত এভাবেই কাটলো । বিধানবাবু এসেছিলেন । গুরুদেবের খুব হিক্কা উঠছে, মাঝে মাঝে কাশিও আসছে ।


গান :- আমার যাবার বেলা 


৩রা অগস্ট । কাল রাতে গুরুদেবের অবস্থা সংকটজনক ছিল । আজ যেন একটু ভালো,  মানে ঔষধ বা কিছু খাওয়াতে গেলে যে বিরক্ত হচ্ছেন সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন । রাতটা গুরুদেবের ভালো কাটলো না মোটেই ।


৪ঠা অগস্ট । ভোরবেলা গুরুদেব অল্পক্ষণের জন্য একটু আধটু কথা বললেন ।ডাকলে বা কিছু খেতে বললে সাড়া দিলেন ।কিন্তু এর বেশি কিছু নয়।

ডাক্তাররা দুবেলাই আসছেন । রাত্রি সাড়ে দশটায় গুরুদেব শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ । নিয়মিত ঔষধপত্র দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু রোগ উপশমের কোন লক্ষণ নেই ।রোজই কিছু না কিছু নতুন উপসর্গ জুটছে ।জ্বর বেড়েই চলেছে, ক্রমশ গুরুদেব দুর্বল হয়ে পড়েছেন ।রাত এগারোটার সময় একবার ডান হাতখানি তুলে আঙুল ঘুরিয়ে আবছা স্বরে বললেন, " কি হবে কিছু বুঝতে পারছি নে ----।"

তারপর সারারাত আর কোন কথা নেই ।


গান :- তবু মনে রেখো 


৫ই অগস্ট । সারাদিন গুরুদেব একই অবস্থায় আছেন । সন্ধ্যায় স্যার নীলরতনকে নিয়ে বিধানবাবু এলেন । আজ আর ডাকলেও গুরুদেব সাড়া দিচ্ছেন না। স্যার নীলরতন গুরুদেবের পাশে বসে তাঁকে দেখলেন, তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা শুনলেন অন্য ডাক্তারদের কাছ থেকে । কিছু বললেন না । যতক্ষণ বসেছিলেন পাশে, সারাক্ষণ গুরুদেবের হাতখানি হাতের উপর রেখে আলতো বুলিয়ে দিচ্ছিলেন । তারপর নীরবে চলে গেলেন । রাতে স্যালাইন দেওয়া হল গুরুদেবকে। অক্সিজেন আনিয়ে রাখা হয়েছে । গুরুদেবের নাকটি কেমন যেন বাঁদিকে একটু হেলে পড়েছে । গাল দুটো ফুলে গেছে, বাঁ চোখ ছোট আর লাল ।পা হাতের আঙুলগুলোতে অল্প অল্প ঘাম।


আজ ৬ই অগস্ট ।সকাল থেকেই লোকে লোকারণ্য ।গতকাল কয়েকদিন ধরেই লোকজনের ভীড় ছিল, আজ আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না । আজ আবার পূর্ণিমা, ভালোয় ভালোয় কেটে গেলেই হয়। কিন্তু সে ভরসা খুব কম।

গুরুদেব এক একবার খুব জোরে কেসে উঠছেন, থেকে থেকে হিক্কা ও চলছে। আজ আর কোন সাড়াশব্দ নেই । মুখে জল আর ফলের রস একটু একটু করে দেওয়া হচ্ছে, বেশি দিতে ভয়,  কখন হিক্কা উঠবে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল, গুরুদেবের একই অবস্থা ।সন্ধ্যা হতে অনেকেই গুরুদেবের ঘরে এসে তাঁকে  দেখে যেতে লাগলেন । রাত বারোটা, গুরুদেবের অবস্থা অবনতির দিকে।


গান :- জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে 


৭ই অগস্ট ১৯৪১ সাল ২২শে শ্রাবণ । ভোর চারটে থেকে মোটরের আনাগোনা জোড়াসাঁকোর সরু গলিতে । নিকট আত্মীয় -- বন্ধু -- পরিজন, প্রিয়জন, সব আসছেন দলে দলে । পূবের আকাশ ফরসা হল । শ্রীমতী অমিয়া ঠাকুর অঞ্জলি ভরে চাঁপা ফুল এনে দিলেন । সাদা শাল দিয়ে ঢাকা গুরুদেবের পা দুখানার উপর তাই ছড়িয়ে দেওয়া হল ।

বেলা সাতটায় রামানন্দবাবু গুরুদেবের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে উপাসনা করলেন । শাস্ত্রীমশাই পায়ের কাছে বসে উচ্চারণ করলেন গুরুদেবের কন্ঠে শতবার শোনা মন্ত্র ---


ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নবোধি 

নমন্তেহন্তু মা মা হিংসীঃ।

বিশ্বানি দেব সবিতরং দুরিতানি পরাসুব 

 যদ্ ভদ্রং তন্ন আসুব ।

নমঃ শংভবায় চ ময়োভবায় চ, 

নমঃ শংকরায় চ ময়স্করায় চ, 

নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ ।


গান :- মরণ রে তুঁহু মম


বাইরে বারান্দায় কে যেন গাইছে ----  কে যায় অমৃত যাত্রী ------


বেলা নয়টায় অক্সিজেন দেওয়া শুরু হলো । নিশ্বাস সেই একই ভাবে পড়ছে । ক্ষীণ শব্দ নিশ্বাসে। সেই ক্ষীণ শ্বাস ক্ষীণতর হলো। পায়ের উষ্ণতা ধীরে ধীরে কমে আসছে । বেলা দ্বিপ্রহরে বারোটা দশ মিনিটে  গুরুদেব শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন ।


গান :- দীপ নিভে গেছে মম


বাইরে জনতার কোলাহল, সবাই শেষবারের মত একবার দেখতে চায় ।গুরুদেবকে সাদা বেনারসী - জোড় পরিয়ে সাজানো হল ।কোঁচানো ধুতি , গরদের পাঞ্জাবী, পাট করা চাদর গলার নীচে থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো । কপালে চন্দন, গলায় গোড়ের মালা, দুপাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা ।  বুকের উপর রাখা হাতে একটা পদ্মকোরক ধরিয়ে দেওয়া হল। যেন রাজবেশে রাজা ঘুমাচ্ছেন রাজশয্যার উপর ।

একে একে এসে প্রণাম করে যেতে লাগল নারীপুরুষ । একপাশে কারা যেন গাইছে শান্ত কন্ঠে ব্রহ্মসঙ্গীত ।


গান :- আছে দুঃখ আছে মৃত্যু 

Comments