তর্কে বহুদূর


দিনগুলি আমার বেশ ভালোই কাটছিল । দশটা পাঁচটার অফিস , বাড়ি থেকেই যাতায়াত ।খুব বেশি সময় লাগতো না । সকালবেলা সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে বাস স্ট্যান্ড । ওখান থেকে উদারবন্দ হয়ে ডলু। দশটার আগেই পৌঁছে যেতাম ।অফিসে তেমন কাজের চাপ নেই ।পাঁচটার পর অফিস থেকে ফেরার পথে স্থানীয় বাজার থেকে লাউ কুমড়ো যা মনে চাই কিছু শব্জি আর মাছ কিনে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতাম । এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি । তাই বেশ কয়েক বছর যাবত ইচ্ছে করেই কোন প্রমোশন পরীক্ষাই বসি নি । অবশ্য তার পিছনে অন্য কারণও ছিল । বাবা দীর্ঘদিন ধরে কঠিন অসুখে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী । ডাক্তার বলেছেন থার্ড স্টেজ । যতদিন ঔষধ দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায় । তাই শেষ কয়েকটি দিন বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইছিল না । কিন্তু সে বছর যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল তাতে প্রমোশন না নিলেও বদলি এড়ানো যেত কিনা সন্দেহ ছিল । বাবা কি করে যেন বুঝতে পেরেছিলেন, তাই নিজেই ডেকে বললেন, " কিরে পিন্টু আমাকে কি শেষ পর্যন্ত কেরানির বাবা হয়েই মরতে হবে, নাকি তুই এবারে পরীক্ষায় বসবি? " বাবার এটা অনেক পুরনো কায়দা, সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়া। আমি উনাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি, ওনার এক কথা, "পরীক্ষায় বস। " বাবার ধারণা পরীক্ষায় বললেই আমি পাশ হয়ে যাব। ছেলের উপর উনার অগাধ বিশ্বাস । সব বাবারাই বোধকরি ছেলেদের ঘিরে এমনি স্বপ্ন দেখে থাকেন । যাইহোক আমি পাশ করেছিলাম। আসার সময়ে বাবা বলেছিলেন, " চিন্তা করিস না, বৌমা তো থাকলো, তেমন কিছু হলে ছুটি নিয়ে চলে আসিস ।"
--" কিন্তু তোমার শরীরের যা অবস্থা, তাতে তোমাকে ছেড়ে যেতে বড় ভয় হয়।" উনি হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন , " ভাবিস না , যতদিন না তুই আমাকে ছাড়ছিস , আমিতো তোর সাথেই আছি। " বাবাকে বোঝানো বড় কঠিন । অবশেষে আমায় বাড়ি ছাড়তে হলো। আমি প্রমোশন নিয়ে সেই থেকে ডিগবয়ে পোস্টেড। রোজই বাবার সাথে নিয়ম করে ফোনে কথা হতো। সব সময়ই যে কাজের কথা হতো তা নয়। নানা বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হতো। কখনো যদি প্রশ্ন করতাম, " কেমন আছো ?" বলতেন, " ভালোইতো আছি ।" কিন্তু আমি জানতাম তিনি ভালো নেই । দিন দিন ওনার শরীর খারাপের দিকেই যাচ্ছে । তবু মুখে স্বীকার করতেন না ।

সেদিন তারিখ ছিল 8ই ফেব্রুয়ারি শনিবার। আমার স্পষ্ট মনে আছে এখন যেমন মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শনিবার অফিস বন্ধ থাকে। তখন কিন্তু শনিবার আধা দিন অফিস খোলা থাকতো । কিন্তু কাজ শেষ হতে হতে সেই পাঁচটা । ওইদিনও অনুমানিক পাঁচটা পর অফিস থেকে যখন বাড়ি ফিরছি তখন রাত হয়ে গিয়েছিল । ঘরে ফিরে এসে দরজার তালা খুলতেই একটা ভ্যাঁপসা ঔষধ ঔষধ গন্ধ নাকে এলো। বুঝতে পারলাম না কোথা থেকে এই গন্ধ আসছে । আমি সাধারণত রোজ ঝাড়পোঁছ করে থাকি, তাই এধরনের গন্ধে আমি অবাক। সাহস করে ঘরে ঢুকে সুইস দিলাম, লাইট জ্বললো না । পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি সব জায়গাতেই আলো আছে । তার অর্থ হচ্ছে আমাদের বাড়িতেই কোন সমস্যা হয়েছে । বাড়ির মালিককে ফোন করে জানালাম সব । বললেন , দেখছি । এই দেখাটা কতক্ষণ ধরে চলবে বলা মুশকিল । অগত্যা আলোর আশা ছেড়ে মোমবাতি জ্বালানোই সঠিক হবে মনে হলো । সবে দিয়াশলাই এর কাঠি ঠুকে মোমবাতি জ্বালাতে গেছি , মনে হলো কেউ যেন চট করে পাশ থেকে সরে গেছে । মনেরও ভুল হতে পারে। একবার টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সবগুলো ঘরে ঘুরে দেখে নিলাম । আমার অবর্তমানে অন্য কেউ ঘরে ঢুকলো কিনা । দরজার ফাঁক, খাটের নীচ সর্বত্র, কিন্তু না কেউ নেই । তাহলে কেন এই অনুভূতি বুঝতে পারলাম না । সাবধানের মার নেই, তাই ভালো করে দেখে নেওয়া । মনে একটা সন্দেহ থেকেই গেল । এক বুক দুশ্চিন্তা নিয়ে কাপড় ছাড়তে গেলাম । আশ্চর্য, লুঙ্গিটা যেখানে রাখা ছিল সেখানে নেই । এমন তো হবার নয়। বেশি খোঁজা খুঁজি করতে ইচ্ছে করছিল না । তাই আলনা থেকে অন্য একটা লুঙ্গি তুলে নেবে ভেবেছি মনে হলো কেউ যেন লুঙ্গিটা আমাকে এগিয়ে দিচ্ছে । চমকে উঠলাম । ভালো করে তাকিয়ে দেখি, না লুঙ্গিটা তো জায়গাতেই আছে । তাহলে কেন এই অনুভূতি হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না । তবে যেভাবে লুঙ্গিটা ভাঁজ করে রাখা আছে আমি কখনো ওভাবে রাখি না । কখন ভাঁজ করলাম, কেনই বা ওভাবে ভাঁজ করলাম কিছুতেই মনে পড়লো না ।
এক কাপ চা মনে মনে চাইছিলাম । কিন্তু নিজে বানিয়ে খাব সেই প্রবৃত্তি নেই । সমস্ত শরীরে কেমন একটা অদ্ভুত আলস্য, একটা স্লথ ভাব। টিভি দেখারও কোন উপায় নেই কারণ কারেন্ট নেই । তাই চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম । অনেকক্ষণ এভাবে কেটে গেছে , হঠাৎই মনে হলো কেউ যেন অল্পক্ষণ পরে পরে পর্দাটা সরিয়ে এঘরে ওঘরে যাতায়াত করছে । আশ্চর্য, দরজা জানালা বন্ধ, ঘরে কোন লোক নেই, তাহলে পর্দাটা কি করে কাঁপলো । মিথ্যা বলবো না, মনে মনে ঘাবড়ে গেছি । তবু বুকে সাহস এনে সব কয়টি ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । ঘর বলতে তো মোট আড়াই খানা । আমার শোবার ঘর, একটা তারই পাশে আর স্নানঘর ছাড়া আধখানা রান্নাঘর । বাবার কথা মনে পড়ে গেল ।বাবা বলতেন যেখানে অন্ধকার সেখানেই ভয়। তাই সব কয়টি ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে আবারো শুয়ে পড়লাম । মনকে বোঝালাম হয়ত বিড়ালও হতে পারে তাই ভয়ের কিছু নেই। তবু ঘুম আসছিল না চোখে। একে অসময় তার উপর অস্তিত্বকর পরিবেশ, ঘুম আসছিল না চোখে । অফিসের সমস্যা, বাবার শরীর এমনি আরো কত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এবং সবকয়টি চিন্তাই দুশ্চিন্তা । একা একা নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল। হঠাৎই পাশের ঘর থেকে কার যেন কাশির আওয়াজ ভেসে এলো । চমকে উঠলাম, ভুল শুনিনি তো? ওঘরের মোমবাতিটি কখন যেন নিভে গেছে । মনের সন্দেহ দুর হতে বেশি সময় লাগলো না । অন্ধকার ঘরে আবারো যেন কেউ কেশে উঠলো । গলাটা খুব চেনা চেনা লাগছে। অনেকটা আমার বাবার গলার স্বরের মত। এবারে কিন্তু সত্যি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেলাম । বিছানায় বসেই চিৎকার করে জানতে চাইলাম, " কে কে ওখানে? " যত জোরেই চিৎকার করি না কেন গলা দিয়ে গোঙানি ছাড়া কিছুই বেরল না। আমি আবারো চেষ্টা নিলাম, কিন্তু লাভ হলো না । পাশের ঘর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই । পিনফেলা নিস্তব্ধতা। শুধু চারপাশের জমাট বাঁধা অন্ধকার ছোট্ট মোমবাতির আলোটাকে জোর করে নিভিয়ে দিতে চাইছে । এভাবে বসে থাকা যায় না । বাবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল, উনি জেদ না করলে আজ আমাকে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না । বাবা কিছু কিছু ব্যাপারে বড় একগুঁয়ে, মেনে নেওয়া যায় না । একরাশ বিরক্তি আর ভয় নিয়ে দিয়াশলাই হাতে ধীরে ধীরে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। পর্দা সরিয়ে ভিতরে তাকিয়ে যা দেখতে পেলাম তাতে নিমেষে বুকের সমস্ত রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা । শরীরের নিচের দিকটা ভারি পাথরের মত আটকে আছে এক জায়গাতে । কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না । অন্ধকারে একটা লোক অল্প সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছে, ঠিক যেমনটি আমার বাবা চেয়ারে বসেন, অবিকল সেইভাবে । ওখান থেকে হাত তুলে আমাকে কাছে ডাকছেন । ধীরে ধীরে চেহারাটা পরিষ্কার হচ্ছে, আমি স্পষ্ট আমার বাবাকে দেখতে পাচ্ছি । কিন্তু বাবার যে শারীরিক অবস্থা তাতে বাবা কোন অবস্থাতেই এখানে আসতে পারেন না । তার মানে কেউ আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে । আমি চিৎকার করে উঠলাম,"বেরিয়ে যাও,বেরিয়ে যাও বলছি। আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করো না ।" প্রচন্ড উত্তেজনায় আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে । হাতের টর্চটি নিজের অজান্তেই জ্বালিয়ে চেয়ারের উপর আলো ফেলতেই এক নিমিষেই লোকটা উধাও , শুন্য চেয়ার । শুধু আমার খুঁজে না পাওয়া লুঙ্গিটা এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে চেয়ারে । আমি হতভম্ব, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । সমস্ত শরীরে কেমন একটা অদ্ভূত শীতল স্রোত বয়ে চলেছে । প্রচন্ড ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছিল , গলা থেকে কোন শব্দ বেরচ্ছে না ।
কোন ভাবে দরজা ধরে আমি ধীরে ধীরে ওখানেই বসে পড়লাম । আমার সমস্ত শরীর থেকে জীবনীশক্তি কে যেন জোর করে কেড়ে নিয়ে গেল ।

কতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে জানি না, সম্বিত ফিরতে দরজা খুলে দেখি আমার অফিসের ক্যাশিয়ার দাঁড়িয়ে আছে । বললে, " স্যার আপনার মোবাইল সুইচ অফ করা নাকি ?"
--- "নাঃ , " পর মুহূর্তে মনে হলো হতেও পারে । চার্জ কম ছিল , আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যেতে পারে । নিজেকে শুধরে নিলাম।
--- "আসলে আপনার বাড়ি থেকে খুব চেষ্টা করছেন, পাচ্ছেন না ।"
--- "ঠিক আছে আমি কথা বলে নেব ।" আমি ওনাকে আশ্বস্ত করলাম । কিন্তু ভদ্রলোক তারপরও ইতস্তত করছেন দেখে জিজ্ঞেস করলাম, " কিছু বলবেন ?"
---"হ্যাঁ আপনাকে একবার বাড়ি যেতে হবে স্যার, আপনার বাবা -----"
--- "বাবা কি -----"
--- "আপনার বাবা ------"
বাকিটা বলতে হলো না। বুকের মধ্যে প্রচন্ড একটা যন্ত্রণা মোঁচর দিয়ে উঠলো । কিন্তু একটু আগে যে -------

সুপ্রদীপ দত্তরায়

(মুল কাহিনীটি আমার অফিসের একজন সিনিয়র অফিসারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরা )

Comments