টেলিফোন


ইদানিং অফিসে কাজের চাপ বড্ড বেশী । একগাদা ফাইল, ভীষণ ব্যস্ত । মার্চ মাস বলে কথা । যদিও অফিসের দায়িত্বে আমি তবু আমারও উপরওয়ালা আছেন । প্রতিদিন হেড অফিসে দৈনন্দিন কাজের রিপোর্ট জমা দিতে হয় । তাই নিজের চেম্বারে ফাইনাল এপ্রোভেলের আগে শেষবারের মত ফাইলগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম । বাইরে বসন্তের আকাশ, উদাস করা হাওয়া । রুমে বসে কিছুই বোঝার উপায় নেই । এসি বন্ধ করে জানালার কপাটগুলো খুলে দিতেই দমকা হাওয়ায় মন ভরে গেল । আনমনে সিগারেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম । এই বন্ধ ঘরের খোলা জানালায় পৃথিবীটা বড সুন্দর । নীল আকাশে তুলোর মত টুকরো টুকরো মেঘ স্বাধীন ভাবে এদিকে ওদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে ।পাতাহীন গাছগুলো লাল, নীল, হলুদ, সাদা ফুলে ঢাকা ।প্রকৃতি তার সমস্ত রঙ দিয়ে যেন পৃথিবীর বুকে তুলির টানে ব্যস্ত । দুরে কোথাও কোকিলের ডাক শোনা যায় । যেন সকলকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে । ইচ্ছে করছিল গদ বাঁধা এই জীবন ভেঙে এক বাঁধনহীন জীবন কাটাই, যেখানে থাকবে না রোজকার বিরক্তিকর অফিস, টার্গেটের পারদ, এম. ডি. র ফোন, বাজারের ব্যাগ বা কিংবা প্রেসারের টেবলেট। থাকবে শুধু দিগন্তহীন খোলা আকাশ, তারই নিচে ছোট্ট একটা কুটির, যার আঙ্গীনায় পাতা থাকবে পলাশ শিমুল আর নাম না জানা ফুলের গালিচা আর থাকবে দমকা হাওয়া, যার কোলে পাল তুলে ভেসে যাবে অলস মন স্মৃতির মোহনায়। আর অবশ্যই থাকবেন রবীন্দ্রনাথ, গানে কিংবা কবিতায়।
অজান্তেই কল্পনার জগতে চলে গিয়েছিলাম । বসন্তের অদ্ভুত লীলা, কখন কাকে উদাস করে কাকে যে রাঙিয়ে যায় বোঝা দায় । সিগারেটের ধোঁয়ায় একটু আনমনা হয়ে গেছিলাম, বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো টেবিলে রাখা মোবাইলটি। কতক্ষণ ধরে বাজছে বুঝতে পারেনি । যখন খেয়াল হলো, চট করে মোবাইলটা তুলে নিলাম । হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটি মহিলা সাড়া দিল়েন। অচেনা নম্বর থেকে ফোনটা এসেছে । গলাটা খুব চেনা লাগছিল কিন্তু কে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । তাই পাল্টা প্রশ্ন করলাম , "কে বলেছেন?"
---" ন্যাকামো করো না, এতক্ষণ ধরে রিং করছি, কোথায় ছিলে? "
---" কোথ্তাও না - -। " মহিলাটি যখন তুমি সম্বোধনে কথা বলছেন অবশ্যই পরিচিত কেউ হবেন, কিন্তু কে? এক পলকে মনের ম্যামোরী কার্ডে স্টোর করা যত মহিলাদের ছবি আছে সবার সাথে এই মহিলাটির আওয়াজ মেলানোর এক কঠিন প্রচেষ্টা নিলাম কিন্তু নাঃ, কিছুতেই মনে পরছে না ।
--- " কি হলো?"
--- " কি?"
--- " কথা বলছো না যে?"
--- " কি বলবো?" আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে সম্বোধন করা উচিত । তাই উত্তরগুলো সংক্ষেপে আবার সাবধানে ভাববাচ্যে দিতে লাগলাম ।
--- " কি বলবো মানে? আমাকে কেন ফোন করতে বলেছিলে ।"
--- "আমি ?" এবার আমার অবাক হবার পালা ।
--- "হ্যাঁ" - - ওপাশ থেকে মহিলাটি জোরের সঙ্গেই বললেন।
--- " কি আশ্চর্য? আমি কখন বললাম?"
--- " দ্যাখো, নাটক করো না - -"
--- " শোনো, না মানে শুনুন আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে ।" আমি আমতা আমতা করে বলতে চেষ্টা করলাম ।
--- " এই তোমার পাশে কেউ আছেন নাকি? তুমি কি এখন একা নও?"
--- " একাই তো - -" মহিলাটি কি করে বুঝতে পারলেন যে এই মুহূর্তে আমি একা চেম্বারে বসা। আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । তবে কি কোন কাছের লোক ইচ্ছে করে এসব করছে । আজতো পয়লা এপ্রিল নয।
--- "তাহলে আমাকে আপনি বলছো কেন?" মহিলাটি অনুযোগ করলেন ।
--- " না মানে আমার মোবাইলে নম্বরটা সেভ করা নেই তো, তাই আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কার ফোন ।" আমি সত্যিটা সরাসরি বলে দিলাম ।
--- " ওঃ তাই, এখন তুমি আমাকে চিনতেও পারছো না ।" মহিলাটির গলায় কপট রাগ।
--- " না মানে - - ।" আমি কিছু একটা বলে বোঝাতে চেষ্টা নিতেই ওপাশ থেকে মহিলাটি বিরক্ত হয়ে বললেন, " এখন নিশ্চয়ই বলবে তুমি আমাকে ফোন করতেও বলনি।"
---" সত্যি বিশ্বাস করুন আমি সত্যি সত্যিই আপনাকে ফোন করতে বলিনি।"
--- " দ্যাখো, এবার আমি ফোন কেটে দেব বলে দিচ্ছি । কাল রাতে তোমার দাদাকে লুকিয়ে তুমি আমার কাছে ‌‌‌আসোনি? আমায় ফোন করতে বলো নি?"
--- "আমি, কখন?" আমি চমকে উঠলাম ।
--- " কাল রাতে আমি যখন রান্নাঘরে তোমাদের জন্য ফিসফ্রাই করছিলাম, তুমি আর তোমার দাদা ড্রিংস নিচ্ছিলে , তখন তুমি আইস নেওয়ার বাহানায় রান্না ঘরে এসে আমার হাত ধরে রিকোয়েস্ট করেনি? আমার দিব্যি দিয়ে বল তুমি বলনি।
--- "আমি ? বিশ্বাস করুন - - - আপনি নিশ্চয়ই ফোন নাম্বার ভুল করছেন ।" আমি বললাম ।
--- " তাই? এটা কি ৯৪৩৫১৭৩২৭৩ নয়?" মহিলাটি শুদ্ধ করে আমার নম্বরটা মুখস্থ বলে দিলেন । - - "বলো, এই নম্বরটাও তোমার নয় ।"
আমি নিশ্চুপ । কি উত্তর দিব । নির্ভুল নম্বর । ওপাশে মহিলাটি এবার রীতিমত ক্ষেপে গেছেন । - - - " বেশ তোমাকে কিছু বলতে হবে না। এই আমি ফোন রাখছি, আগামীতে কোনদিন আমাকে ফোন করতে বলবে না। সখ আছে সাহস নেই, ভীতু কোথাকার ।" সত্যি সত্যিই কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মহিলাটি ফোন কেটে দিলেন ।
ফোন রেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এটা কি হলো । আকাশ পাতাল ভেবেও মহিলাটির পরিচয় মনে করতে পারলাম না । এবারে কি করা উচিত? আমি বুঝতে পারছিলাম মহিলাটি খুব রেগে গেছেন । কিন্তু কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই ভূল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে । তা না হলে তিনি কি করে এত নিশ্চয়তার সঙ্গে কথাগুলো বলতে পারলেন ।আমি কি একবার ফোন করব মহিলাকে ।ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা, কাজটা ঠিক হবে কিনা । এমনিতে তো কোন অন্যায় দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু তবু - - । আর এই তবুটাই হচ্ছে আসল। এই তবুটার জন্যই মনটা দোমনা।নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা নিলাম এই বলে যে প্রথম ফোনটা কিন্তু ওপাশ থেকেই এসেছিল । আর সবচেয়ে বড় কথা মহিলাটির গলায় একটা মাদকতা আছে, একটা আকর্ষণ আছে একথা নিজের বিবেকের কাছে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারছিলাম না । মনের মধ্যে একটা দন্দ্ব, একটা দ্বিধা বারবার খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে । কে সেই ভদ্রমহিলা, এত পরিচিতের মত কথাবার্তা, এত আপন করা গলায় স্বর, কে সে। এমনও তো হতে পারে, মহিলাটির কোথাও ভুল হচ্ছে, অন্য কাউকে ফোন করতে গিয়ে আমাকে ভুলে ফোন করে ফেলেছেন । হতেও পারে । কিন্তু তাহলেও আমার দায়িত্ব নয় কি ভুল ভেঙ্গে দেওয়া । মনের সাথে মনের লড়াইয়ে জোরে করে দুর্বল মনটাকে জয়ী করে ফোনটা তুলে নিলাম । আসলে মহিলাটির ফোন আমাকে একটা নিষিদ্ধ আনন্দের হাতছানি দিচ্ছিল যা আমি শত চেষ্টা করেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলাম না । কল লিস্টে শেষ নম্বরটাই ‌ওই মহিলার ।অবশেষে অনেক দ্বিধা নিয়ে আমি কল করলাম মহিলাকে । একটা দুটো রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেল । তাহলে কি ভদ্রমহিলা এখনো রেগে আছেন । একটু অপেক্ষা করে আরো একবার চেষ্টা নিলাম । এবারও কেউ ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিল। নাঃ, আর নয় এবার আমার সত্যি সত্যি ভয় লাগলো । কাজটা ভালো হচ্ছে না । কোন বাজে চক্রে ফেসে যাচ্ছি নাতো। কোথায় যেন শুনেছিলাম মেয়েরা ছেলেদের এভাবে ফোনে ট্রেপ করে । হতেও পারে আবার নাও হতে পারে । একটা সুক্ষ অনুভূতি, কেমন যেন একটা ভয় মেশানো ভাললাগায় মনটা রঙিন হয়ে আছে । বহুদিন আমাকে এত মিষ্টি করে কেউ ভীতু বলেনি। সারাদিনের ছন্দ একটি ফোন উলটপালট করে দিল। কাজে কিছুতেই মন দেওয়া যাচ্ছিল না আর । মনটা পরে রইলো ছোট্ট ওই মোবাইলে। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে তার হিসেব নেই । হঠাৎই আবার ফোনটা বেজে উঠল । সেই অচেনা নম্বর থেকে সেই মহিলার ফোন । শরীরের সমস্ত রক্ত এক নিমেষে বুকে জমাট বাঁধতে লাগলো । বুকের ধুকপুকানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ।একটা ঠান্ডা শিহরণ, অদ্ভুত একটা ভালোলাগা । যেন কত যুগ ধরে আমি এই ফোনের প্রতিক্ষায়।
--- " তোমাকে কতবার বলেছি আমাকে ফোন না করতে , মনে থাকে না বুছি।" সেই মায়াবী কন্ঠ আমাকে ধমকে উঠলেন ।
কি উত্তর দেবে । মহিলাটি তাহলে সত্যি রেগে আছেন । তারপরই সুরে অফুরন্ত মমতা ঢেলে ফিসফিস করে বললেন - - - " রাগ করলে? তুমি তো জানো তোমার দাদা এই সময়ে বাড়িতে থাকেন, যদি জানতে পারে তাহলে আর রক্ষা থাকবে কি? সব শেষ হয়ে যাবে । লক্ষ্মীটি, তুমি আমায় ফোন করতে যেও না প্লিজ । সুযোগ পেলে আমিই তোমাকে ফোন করবো। আর শোনো, আজ বিকেলে এসো কিন্তু ।প্লিজ প্লিজ প্লিজ " একটানা এতগুলো কথা চাপা গলায় বলে মহিলাটি নিজেই ফোনটা কেটে দিলেন । যাঃ বাবা, আমাকে মহিলাটি কিছু বলার সুযোগই দিলেন না । একটা আবেশের বশে সব কথাগুলো শুনে গেলাম । আজ বিকেলে কোথায় যেতে বললেন, কেনইবা যেতে বললেন বুঝতে পারলাম না ।
ঐদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকার পরও আর কোন ফোন এলো না মহিলার। কিরকম নিষ্ঠুর এই মহিলাটি, আমাকে উতলা করে নিজে বেশ নিশ্চুপ হয়ে গেছেন । সন্ধ্যায় বাড়িতে গিয়েও মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না । চেষ্টা করছিলাম সব ভুলে যেতে । কিন্তু এত সহজে কি এই মহিলাকে মন থেকে মুছে ফেলা যায়। বারবার কানে বাজছে মহিলাটির গলা। যদি আরো একটি বার ফোনে কথা বলা যেত।
কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না ।আমার এই আনমনা ভাবে দীপা চা দিতে এসে ক্ষানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলে, "তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ?"
--- "কই নাতো ।"
--- " তবে কি অফিসে কাজের চাপ বড্ড বেশী?"
---" না---"
--- " তবে ---"
--- " কই কিছুই হয়নি তো---" মুখে বললাম বটে, কিন্তু অন্তরে মিথ্যা কথা সইলো না ।
ভাবলাম দীপাকে সব খুলে বলা দরকার । আফটার অল সে আমার জীবন সাথী । ওকে সব বলা দরকার ।কিন্তু কিভাবে বলবো, কতটুকুই বা বলবো । কিছু অনুভূতি আছে যা সম্পূর্ণ একান্ত, শেয়ার করা যায় না । দীপার সাথেও না। কিন্তু সেটাও ঠিক নয় । মন থেকে সেটাও মানতে পারছিলাম না । স্বামী স্ত্রীতে পর্দা থাকা উচিত নয় । সিদ্ধান্ত নিলাম যা বরাতে থাকে থাক সবটাই দীপাকে খুলে বলবো ।
--- " শুনছো---" দীপাকে ডাকলাম সবকিছু বললো বলে ।
--- " কেন, কি হয়েছে ---"
--- " এদিকে এসো, কথা ছিল ।" আমি বললাম ।
--- " এখন আসতে পারবো না, সিরিয়াল চলছে, কিছু বলার থাকলে এখানে এসে বলে যাও প্লিজ ।"
--- " রাখো তোমার সিরিয়াল, তারচেয়েও ইন্টারেস্টিং গল্প আছে শুনে যাও।" আমি ইচ্ছে করেই কৌতুহলের পারদ চড়াতে চেষ্টা নিলাম ।
--- " এক মিনিট প্লিজ, এক্ষুনি ব্রেক হবে ।"
অগত্যা ব্রেক হওয়া অবধি আমাকে অপেক্ষা করতে হলো । প্রায় দশ মিনিট পর ব্রেক হলে দীপা এলো । --- "বলো কি বলবে---"
ততক্ষণে আমার বলার উৎসাহ তলানিতে এসে ঠেকেছে । তবু বললাম, - - - " জানো আজ একটা ফোন এসেছিল।"
--- "ফোন? কার ?"
--- " জানি না, তবে কোন এক মহিলার - -"
--- "তো ?"
--- " তো মানে? ভদ্রমহিলা ফোন করে আমাকে বলছেন আমিই নাকি ওনাকে ফোন করতে অনুরোধ করছি ।"
--- " তাই বুঝি ! তা তুমি কি করে বুঝলে যে উনি একজন ভদ্রমহিলা - -" যা বাবা উল্টো জেরার মুখে পড়ে গেলাম । কোন ভাবে বুদ্ধি করে বললাম, " আসলে গলা শুনেই বুঝতে পেরেছি উনি কোন ভদ্রমহিলা হবেন ।"
--- " বাঃ আজকাল তোমার বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি । আমাদের ফোন পেয়ে তো চিনতে পারো না কোনটা আমার গলা কোনটা তোমার মেয়ের ওদিকে ভদ্রমহিলার গলাতো বেশ চিনতে পারছো।"
গল্পটা দেখছি এখন অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে । বাধ্য হয়ে বললাম, তুমি কি পুরো বিষয়টি শুনবে নাকি - - - "
---" আমাকে থামিয়ে দীপা বললো, " ওসব আমার জানা আছে, আমিও মাঝে মাঝেই এসব কল পাই। বি এস এন এলের জন্য এসব হচ্ছে । ও কিছু না ।" বলেই দীপা উঠে টিভি দেখতে রওয়ানা দিল। তারপর কি মনে হতে ফিরে এসে বলল, " শোন, তুমি আবার ঐ মেয়েটিকে ফোন করতে যেও না, আজকাল টেলিফোন অনেক কিছু হচ্ছে, শেষটায় তোমার জন্য যেন আমার মুখ কাটা না যায় ।"
একদম ঠিক জায়গায় ধরে ফেলেছে । আমি তাড়াতাড়ি শুকনো গলায় বললাম, " মাথা খারাপ, আমাকে বুঝি এই বয়সে এসব মানায় - -"
দীপা আর দাঁড়াল না, ওর সিরিয়াল শুরু হয়ে যাচ্ছে । আমার গল্পটা শেষ হলো না । যাক বাবা বাঁচা গেল । দোষ কেটে গেছে । আমিতো বলতে চেয়েছিলাম, কেউ যদি শুনতে না চায় আমি কি করতে পারি ।
রাতে প্রথমে ঘুম আসছিল না । এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই । স্বপ্নে দেখি আমি একা একা একটা গ্রামীণ পথে হেঁটে যাচ্ছি, ধীরে ধীরে এই পথ একে বেঁকে মিশে যাচ্ছে জঙ্গলে । যত এগিয়ে যাচ্ছি ততই চোখ জুড়িয়ে যায় । চারপাশে নানা ধরনের ফুল ফোটে আছে, পুরো পথ তারই সুভাষে সুভাষিত। আমি হেঁটে যাচ্ছি, দেখি ফুলগুলো সব একটা একটা করে মেয়ের রূপ নিয়ে আমার পিছু পিছু এগিয়ে চলেছে । এক এক করে ক্রমে অনেকজন নারী আমাকে ঘিরে এগিয়ে চলেছে । আমি অবাক হয়ে তাদের প্রশ্ন করি, "কে আপনারা আমার পথের সাথী হয়েছেন ?" ওদের মধ্যে থেকে একজন উত্তর দেন, "আমরা ফুলদেবী, আমরা এসেছি তোমাকে আনন্দ দিতে ।"
---"কিন্তু আমরা কোথায় চলেছি ? " আমি জিজ্ঞেস করলাম।
---" আমরা এখন তোমাকে নিয়ে অমৃতকুন্ডের পারে যাব, যেখানে শুধু আনন্দ আর আনন্দ । একবার ওখানে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না ।
আমি আঁতকে উঠলাম। বললাম, " তাহলে আমার স্ত্রী কন্যার কি হবে? আমি ছাড়া ওদের যে দেখার আর কেউ নেই ।"
আমার কথা শুনে ফুলদেবীরা থমকে দাঁড়াল । বলল, " পথিক তুমি এখনো মায়ায় আবদ্ধ, তুমি মায়া মুক্ত হও। আনন্দ সাগরে ভাসতে হলে কোন বন্ধন থাকতে পারবে না ।"
আমি কাতর হয়ে বললাম, " দেবী আমার সে আনন্দে প্রয়োজন নেই যে আনন্দে আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ ঝুকিপূর্ণ । আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন ।"
যেমনি বলা, সকল ফুলদেবীরা একে একে আবার ফুল হয়ে যেতে লাগলেন । আমার চারপাশ শুন্য, আমি আবার একা একা চলতে শুরু করলাম । হাঁটছি আর হাঁটছি, পথ শেষ হয় না । হঠাৎ এক রামধনু আঁকা মেঘের রথ আমাকে শুন্যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল । চারপাশে নানা রঙের নানা রূপের মেঘ।এদিকে ওদিকে নানান বেশে পরীরা সব উড়ে বেড়াচ্ছে । অপূর্ব এক স্বর্গীয় দৃশ্য । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আমরা কোথায় যাচ্ছি?"
কোন এক মেঘপরী উত্তর দিলেন, "আমরা অমৃত কুন্ডের দিকে যাচ্ছি । সেখানে আমরা আনন্দ সাগরে ভেসে ভেসে স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করবো ।"
--- " দেবী, আমি কি সুখে নেই ?"
--- " সুখের কোন অন্ত নেই পথিক।"
--- " কিন্তু আমার পরিবার? ওদের কি হবে?"
--- " দ্যাখো পথিক, পিছুটান নিয়ে আনন্দ উপভোগ হয় না । তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো তোমার অবর্তমানে তোমার পরিবারের সাময়িক কষ্ট হলেও অচিরেই সুখী হবে।"
--- " কিন্তু দেবী আমার যে ভীষণ ভয় হচ্ছে ।"
--- " সাহস ছাড়া আনন্দ উপভোগ হয় না পথিক।"
আমাদের মেঘউড়ান সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল । আমি আবার সেই পথে একা একা পথ হাঁটছি।
ঘুম ভেঙ্গে গেল । বুঝতে পারলাম না কি দেখলাম, কেনইবা দেখলাম । মোবাইলে সময় দেখতে গিয়েই গতকালের কথা মনে পড়ে গেল । সকাল থেকেই একটা উৎকণ্ঠা, কখন ফোন আসবে। সময়ের আগেই আজ অফিসে পৌঁছে গেলাম । একগাদা কাজ কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছি না । বারবার ফোন খুলে দেখছিলাম কোন ফোন এলো কিনা। কিছু ফোন এলো বটে কিন্তু সেই ফোন আর আসে না। অপেক্ষারও একটা শেষ সীমা থাকে । মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন । আমার আর তর সইছিল না । মনে হচ্ছিল আমার একটা ফোন করা দরকার। কিন্তু একটা ভয়, যদি অন্য কেউ ফোনটা ধরেন তখন । কি জবাব দেব তখন আমি ।সব জেনেও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মহিলাটির সঙ্গে কথা বলার । হয়তো মহিলাটি অভিমান করেছেন কিংবা হয়তো অন্য কিছু ভেবে বসে আছেন । হতেও পারে আমার দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে হয়তো উনি নিজেই আমাকে ফোন করতে ভয় পাচ্ছেন । কত কিছু হতে পারে। এদিকে সময় এগিয়ে যাচ্ছে, দুপুর গড়িয়ে এখন বিকাল । অনেক সাত পাঁচ ভেবে নিজেই ফোনটা করলাম । দু তিনটি রিং হতেই আমার আশংকাকে সত্যি করে ওপাশ থেকে একজন পুরুষ কণ্ঠে কাকে চাই জিজ্ঞেস করলেন ।
আমি রীতিমত অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । একটু ভেবে বললাম, " দেখুন এই ফোন থেকে একজন মহিলা আমাকে ফোন করেছিলেন ।"
--- " হ্যাঁ তো ?"
--- " ওনার সাথে কথা ছিল ।"
--- " আপনি ওনাকে চিনেন?"
--- " না, ফোনে পরিচয় ।" আমি সাবধানে উত্তর দিলাম ।
--- " ওনাকেতো পাওয়া যাবে না, শুয়ে আছেন, খুবই অসুস্থ ।" তারপর একটু থেমে আবার বললেন, " আপনার পরিচয়টা জানা হলো না ।"
কি বলবো, সঠিক পরিচয় দেওয়াটাই উচিত । কিন্তু তাতে বিপদের আশঙ্কাও আছে । আমাকে মৌন দেখে ভদ্রলোক নিজের বললেন, " কলার আইডি থেকে আপনার নাম সুদীপ দেখতে পাচ্ছি, এটাই কি আপনার আসল নাম ।"
ভাগ্যিস ভুল নাম বলিনি, না হলে কি কেলেঙ্কারিই না হতো। বললাম, " হ্যাঁ, আমিই সুদীপ দত্ত, আপনি?
---" আমি ওর স্বামী দেবাশিস রায় । আজ দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে সে ডিমেনশিয়ায় ভুগছে ।"
---" পনেরো বছর ! কিন্তু কালই যে আমার সাথে কথা হলো ।" আমি আঁতকে উঠলাম ।
"---" হ্যাঁ, পনেরো বছর । অধিকাংশ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে, যখন জেগে উঠে তখন সে তার কোন এক কাছের মানুষকে খোঁজে । সময় এগিয়ে যায় কিন্তু ওর জীবন একই জায়গায় আটকে আছে ।"
--- " কাছের মানুষ মানে?"
--- " আমাদের বিবাহিত জীবনে তৃতীয় ব্যক্তি ।"
আমি নিশ্চুপ, কি উত্তর দিব । ভদ্রলোক নিজে থেকেই আবার বললেন, " প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, এখন হয় না । না নিজের জন্য না ওর জন্যে। ঈশ্বরকে বলি হে ঈশ্বর তুমি মঙ্গলময়, নইলে যে ভীরু ছেলেটা আমার স্ত্রীর জীবন নষ্ট করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার সাথে ও কোনদিন সুখী হতে পারত না আর আমিও যতই অসুস্থ হোক ওকে ছাড়া জীবন কল্পনা করতে পারি না ।"
আমি চুপচাপ । দেবাশিস রায় নামটা শোনা শোনা লাগছে । কোথাও পরিচয় হয়েছিল কি, কিংবা কোন বন্ধুর কাছে নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে । হঠাৎ একপলকে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল । জিজ্ঞেস করলাম, " আপনারা কি বান্দোরদোয়ায় থাকেন ?"
--- "হ্যাঁ - - -"
আমি নিশ্চুপ থাকলাম, উত্তর দেবার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments