ভোলা


আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে, থামার কোন লক্ষণ নেই । বিরক্তি এসে যায় । ভোলা তার জীবনে অনেক ধরনের বৃষ্টি দেখেছে, টিপ টিপ বৃষ্টি, পশলা বৃষ্টি, ঝরো হাওয়া সহ বৃষ্টি, তুফানী বৃষ্টি আবার ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি । বৃষ্টিরও কত রকম আছে ভোলা তার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছে । ছোট বেলা থেকেই বছরের এই কটা মাস ভোলার খুব কষ্ট হয় । পাপী পেট কা সওয়াল, উপায় নেই । নিজের পেটের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে এবং এতদিন ধরে সে ঠিক তাই করে এসেছে । সত্যি বলতে কি কোনদিনই সে পুরোপুরি অভুক্ত থাকে নি। কিন্তু আজকের ব্যাপার সম্পুর্ণ আলাদা । ভোর থেকেই অবিরাম ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, কখনো হালকা আবার কখনো ভারী। কখন থামবে তা অনুমান করা দুষ্কর । সকাল বেলা অনেক কষ্টে একটা টুকরো পাউরুটি জোগাড় করে ছিল, তাই আজ সারাদিনের খাবার । উপায় নেই, আগের মতো সে আর বৃষ্টিতে ভিজতে পারে না । শরীর খারাপ করে । এই সংসারে তো তাঁকে ঔষধ এনে দেওয়ারও মত কেউ নেই, তাই সাধু সাবধান । ভোলা খুব সাবধানে থাকে। আজ বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব । নিজের আস্তানায় এককোনে চুপচাপ বসে আনমনে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল ভোলা । ইদানিং দিন বড় কঠিন হয়ে গেছে । ছোটবেলায় এবাড়ি ওবাড়িতে প্রায়শই কিছু না কিছু উৎসব লেগে থাকতো। খাবার নিয়ে তখন এত হিসেব হতো না । বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে দিনগুলো ভালোই কাটতো তখন । বেশ একটা স্বাধীনতা ছিল । ভোলা যখন কারনে অকারণে এপাড়া ওপাড়ায় ঘুরে বেড়াত তখন অনেক মেয়েরাই তার থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারত না । ভোলা উপভোগ করতো সেটা । তারপর এল ভবন কালচার, হিসেব করা খাবার । কে কাকে ঠকায় আবার কে কাকে টেক্কা দেয়। প্রাণ খুলে খাওয়া বা খাওয়ানোর সেই আনন্দ আর নেই । সবকিছুই টাকার পারদে বাঁধা । তবুও চলে যাচ্ছিল ভোলার । কোন না কোন ভাবে সে ব্যাবস্থা করে নিত। কিন্তু আজকাল দিন বড় কঠিন । নতুন এক প্রধানমন্ত্রী এসে ফরমান জারি করেছেন সারা দেশের জঞ্জাল সাফাই করতে হবে ।উত্তম প্রস্তাব বটে, কিন্তু জঞ্জালকে ঘিরেই যাদের জীবন তাদের কি হবে? যারা স্বপ্নে জঞ্জালের পাহাড় দেখতে ভালবাসে, জঞ্জালের বিষ নিঙরে অমৃত আস্বাদন যাদের দৈনন্দিন অভ্যাস তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা কি সে নিয়ে তো কেউ মুখ খুলছেন না ।
ভোলা কোনদিনই এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না । এসব নিয়ে ভাবার জন্য আলাদা প্রজাতি আছে । আজ বাইরে এত বৃষ্টি, তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ভোলা অলস ভাবে বসে দার্শনিকের মত ভাবছিল। শুধুই ভাবছিল আর কপালে ভাঁজ বৃদ্ধি করার একটা অপপ্রচেষ্টা নিচ্ছিল।
বাইরে তখনও অবিরাম ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে । রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে । বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ এই বৃষ্টিতে ঘরের বাইরে যেতে চাইবেই বা কেন । ভোলার কোন উপায় নেই । তার প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও বেড়োতে পারবে না। বছর দুয়েক আগে এক বিয়ে বাড়িতে অসতর্কতায় গরম জল পড়ে গিয়েছিল গায়ে । সেই ঘা এখনো শুকায়নি। বৃষ্টিতে ভিজলে সেই গা আবার মাথা চারা দিতে পারে । একা ভোলা তাই অলস চোখে দেখছিল বৃষ্টির সৃষ্টিছাড়া খেলা।
হঠাৎই একটা মেয়ে বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে ভোলার আস্তানায় এসে হাজির । অন্য সময় হলে ভোলা মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিত কিন্তু আজকের এই দুর্যোগের দিনে মেয়েটির প্রতি মায়া লাগলো ভোলার । আহারে বেচারা, এই বৃষ্টিতে কি বিপদে না পড়েছে মেয়েটি । ভোলা কোনপ্রকার উচ্চবাচ্য না করে চুপচাপ বসে থাকলো । মেয়েটি বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে । মাথার উপর ছাদ পেয়ে মনে হলো মেয়েটি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছে । হাতের পোটলাটি নিচে নামিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ করে ভোলাকে দেখতে পেয়ে ভয় পেল মেয়েটি । ভোলা নির্বিকার, সে নীরব থাকলো যেন অভয় দিচ্ছে । ভোলাকে নীরব দেখে ধীরে ধীরে মেয়েটির মনে সাহস সৃষ্টি হল । পোটলাটি বৃষ্টি থেকে নিরাপদ দূরত্বে মাটিতে রেখে, তার থেকে একটা শুকনো কাপড় বেছে নিল সে । তারপর ভোলার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মেয়েটি একটু ভেতরের দিকে অন্ধকারে চলে গেল । ভোলা পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটি নিঃসংকোচে একটানে ভেজা কাপড় খুলে ফেলেছে । হোক আবছা অন্ধকার তবু কোন মেয়েকে ভোলা এভাবে দেখেনি। ওর অস্বস্তিবোধ হলো । হাজার হোক সে একজন পুরুষ । ভোলা আবার মুখ ফিরিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে । মেয়েটি ভেজা কাপড়ের যথাসম্ভব জল ছাড়িয়ে সেই কাপড়েই নিজের নগ্ন শরীর মুছে ফেললে। তারপর হাতের শুকনো কাপড়টি গায়ে চাপিয়ে সেই পোটলাটির পাশে গুটিসুটি হয়ে বসলো । বৃষ্টি তখনও অঝোরে ঝরে যাচ্ছে । রাস্তা জনমানব শুন্য। মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি তীব্র গতিতে নিরুদ্দেশের পথে ছুটে যাচ্ছিল । দুজন পাশাপাশি চুপচাপ বসা। কারো সাথে কারো কথা নেই । একটা মারুতি ভ্যান এই রাস্তায় যাচ্ছিল । হঠাৎ কি মনে করে কিছু দুরে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আবার পিছনে আসতে লাগলো । ভ্যানটি একেবারে রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই, ভিতর থেকে একটা ছেলে গাড়ির গ্লাসটা অল্প নামিয়ে মেয়েটিকে ইশারায় ডাকতে থাকল । মেয়েটি চুপচাপ, কিন্তু ভোলা বুঝতে পারছিল এই মুহূর্তে মেয়েটির মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে । ছেলেটি এবারে গাড়ি থেকে নেমে সোজা মেয়েটির পাশে গিয়ে ওকে চাপা গলায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা নিতেই মেয়েটি আরো গুটিসুটি হয়ে চুপচাপ বসে রইল । ভোলাও নিশ্চুপ । ভোলাকে নীরব দেখে ছেলেটির সাহস যেন বেড়ে গেল । পকেটে থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট মেয়েটির দিকে ছুড়ে ফেলে চাপা গলায় কি যেন বোঝাতে চাইছে। অল্প পরে আরও একটি ছেলে গাড়ি থেকে নেমে হঠাৎই মেয়েটির গলায় কিছু একটা চেপে ধরতেই মেয়েটি ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল।প্রথম ছেলেটা নিমেষে মেয়েটিকে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে তুললে । গাড়িটি মুহূর্তে আবার ছুটতে শুরু করলো । এত তাড়াতাড়ি এত কিছু ঘটে গেল যে ভোলা প্রতিবাদ করার সুযোগ পেল না ।নিজের মূর্খতায় নিজেরই উপর খুব রাগ হল ভোলার।
. সবকিছু আবার নিশ্চুপ, শুধুই বৃষ্টির আওয়াজ । শুধু মেয়েটির সাথে আনা পোটলাটি নীরবে ওর উপস্থিতি ঘোষণা করে যাচ্ছিল । কতক্ষণ এভাবে কেটে গেছে বলা মুশকিল । হয়তো একঘন্টা কিংবা তার চেয়েও বেশি । আবারো সেই মারুতি ভ্যানটি ফিরে এলো। দরজা খুলে এক ধাক্কায় মেয়েটিকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে গাড়িটি চলে গেল নিরুদ্দেশের পথে । ভোলা অবাক হল, এ কেমন তর পৃথিবী । দিনের বেলা যাদের পূজা হয় রাত্রির অন্ধকারে তাদের এই পরিনতি । এবারে আর মেয়েটি ছুটাছুটি করলে না । মনে হলো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে নিজের দেহটাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে ফেললো নিজের পোটলাটির পাশে । তারপর দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে শুন্যে মুখ তুলে তাকিয়ে অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে বুক ভরা অভিমান উগলে দিল। বাইরে তখনও বৃষ্টি ঝরছে আর তারও বেশি জোরে তুফান বইছে মেয়েটির অন্তরে । দুচোখে ভরা জোয়ার এর এর কল্লোল । ভোলা ধীরে ধীরে মেয়েটির পাশে গিয়ে বসল । মেয়েটি আলতো হাতে ভোলার মাথায় আদর করে দিতেই বহুদিন পর ভোলার চোখে আবার জল এলো । চুপচাপ নিজের লেজটি গুটিয়ে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল ভোলা । দুটো প্রাণীকে অভুক্ত রেখে নিজেদের ক্ষিদে মিটিয়ে নিয়ে গেছে একদল ক্ষুধার্ত পিচাশের দল। তারপর....... তারপর আবারও নতুন শিকারের লক্ষ্যে বেড়িয়ে পড়েছে তারা।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments