মৃত্যু, হত্যা নাকি মুক্তি


সকালবেলা বাজারে হাজির, ফরমাইস হয়েছে মুরগীর মাংস চাই। সাথে ক্যাপসিকাম, মটরশুটি, কিছু ভালো চাল আর আনুসাঙ্গিক কিছু জিনিস ।শ্যালিকা সুন্দরী আজ দুপুরে দর্শন দেবেন সঙ্গে ওনার কর্তা। খবরটা পেয়ে প্রথমে খুব আনন্দ হয়েছিল । আফটার অল শ্যালিকা হচ্ছে অর্ধেক ঘরওয়ালী। সেই শ্যালিক আসছে আনন্দেরই কথা। তারপর যখন শুনলাম ধর্মের কাঁটাটিও সঙ্গে আসছে তখন আমার উৎসাহে ভাটা দেখা দিলেও আমার ধর্মপত্নীর উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা গেল না, বরং কয়েকগুন বেড়ে গেলো। সাত সকালেই আমাকে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে তিনি সবিক্রমে রান্নাঘরে হাজির । আজ ছোটবোনের বরের জন্য স্পেশাল মেনু হবে তাই আমার সকালের দ্বিতীয় কাপ চা বাতিল, সঙ্গে এক্সট্রা ডিউটি - বাজার । যাইহোক আজকাল বাজারে মাছ কেনা মাংস কেনার চেয়ে অনেক সহজ। আমি তাই বেশি 'গাইগোত' না করে সোজা মুরগির বাজারে এসে হাজির হলাম । সারি সারি দোকান, দোকান গুলোর অধিকাংশ জায়গা জুড়ে খাঁচা বানানো । আর সেই খাঁচাগুলিতে ঠাসাঠাসি করে যতটা সম্ভব মুরগী স্তরে স্তরে রাখা যায় ততটাই রাখা । খাঁচার বাইরে সারিতে একটা প্লেটের মত বানানো, তাতে খাবারের দানা রাখা, কিন্তু যেখানে নড়াচড়াই সম্ভব নয়, সেখানে সেই লোক দেখানো দানা রাখার কি অর্থ জানি না, খাওয়ারতো প্রশ্নই আসে না । একটা লোক ক্রমাগত খাঁচার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তার পছন্দসই একটা মুরগীর ঠাং ধরে ঝুলিয়ে ওজন দিচ্ছে তারপর দাম সমঝে নিয়ে পাশের একটা লোকের হাতে চালান দিচ্ছে । আর ঐ লোকটা একটা দা নিয়ে বসে, হাতে মুরগীটি পাওয়া মাত্রই খদ্দের বুঝে মুরগীটির কখনো গলা থেকে পুরো মাথাটা, কখনোবা অর্ধেকটা কেটে টুটিটা চেপে ধরে রাখছে কিছুক্ষণ ,যাতে যথাসম্ভব কম রক্ত বের হয়। এতে নাকি মুরগীটির স্বাদ বৃদ্ধি হয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে সেই একই প্রক্রিয়া চলছে । আর মুরগীটি, লোকটা তার গায়ে হাত দেওয়া মাত্রই হয়তো বুঝতে পারে লোকটার উদ্দেশ্য কি তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় তার ছাড়া পাবার তাগিদে প্রচন্ড ছটফটানি, ডানার ঝাপটা আর তারস্বরে অসহায় চিৎকার। আর সেই সাথেই একই সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করে ওঠে বাকি অসংখ্য মুরগীগুলি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল ওরা নিজেদের ভাষায় কিছু বলতে চায়। কিছু একটা প্রতিবাদ বা হয়তো সমঝোতাই করতে চায়। কিন্তু মানুষ যে তাদের ভাষা বুঝতে পারে না। তাই ক্রমাগত ঝাাঁকুনিটা ধীরে ধীরে স্থির হয়ে আসার পর, যখন প্রাণবায়ুটি সম্পুর্ণ রূপে বেরিয়ে যায় তখন ঐ মুরগীটির নিথর দেহটি রেখে আরও একটা মুরগী তুলে নেয় লোকটা। জবাই বা বলি দেবার উদ্দেশ্যে । চারপাশে অজস্র গলা কাটা মুরগীর ছড়াছড়ি, থকথকে টাটকা রক্ত, ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ সহ অসংখ্য কাটা মাথা ও পায়ের শেষ অংশ । আর আছে ছাড়িয়ে নেওয়া পালক ও পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি । আজকাল ওসবও নাকি বিক্রি হয় চড়া দামে। ।একটা অদ্ভুত অস্বস্তিকর গা গুলানো গন্ধ। পুরো জায়গাটা ঘিরে খদ্দেরের প্রচন্ড ভীড় আর উৎসাহ । কার আগে কার মুরগী কাটা হবে। সব মিলিয়ে একটা নরকের পরিবেশ । আমি ক্ষাণিকক্ষণ চুুুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম । একটা আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া আমার মধ্যে সৃষ্টি হলো । মনে হলো প্রকৃতির নিয়মগুলো কেমন যেন অদ্ভুত, অমানবিক । নাকি আমাদের বোধ বিচার বুদ্ধি সব নষ্ট হয়ে গেছে । এত অসংখ্য মুরগীর সামনে একটার পর একটা মুরগীর জবাই হচ্ছে , পালক ছাড়ানো হচ্ছে, নাড়িভুঁড়ি বের করা হচ্ছে আর বাকিগুলো অসহায় ভাবে দেখছে, কিন্তু কারো মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না । হয়তোবা ওরা প্রতিবাদ করছে কিংবা প্রাণ ভিক্ষা চাইছে । কিন্তু সে আর্তি আমাদের কানে এসে পৌঁছচ্ছে কোথায় । আশেপাশের মানুষগুলো কেমন যেন দয়া মায়া হীন নির্বিকার । চোখ দুটো লোকগুলোর লোভ আর লালসায় চকচক করছে। যেন কতদিন মাংস খাওয়া হয়নি । আমি কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম । মনে হলো আমি কোন পৃৃথিবীতে বাস করছি । আমার আশেপাশের লোকগুলো কারা? কেন যেন মনে হলো এই লোকগুলোই সেই হিটলারের নাৎসি বাহিনী নয়তো ? আমি ওদের সাথে নাৎসি বাহিনীর কোন তফাত খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওরাও তো এভাবেই চোখের সামনে একের পর এক ইহুদিদের হত্যা করেছে । ওই সময়ে ইহুদি হত্যা আর মুরগী কাটার মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য বোধহয় ছিল না । তবে কি এরাই এযুগের নাৎসি বাহিনী । পুরো প্রক্রিয়াটি আমার কাছে বর্বরতা মনে হচ্ছিল । তবে কি জীবন ধারণের স্বার্থে প্রাণী হত্যা বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রয়োজন । কিন্তু সেটাও তো সম্ভব নয়। তবে ? যা চলছে তাই কি ঠিক ? মুরগীরা কি জন্ম নিচ্ছে এভাবেই মৃত্যুর জন্য ? এটাই কি প্রকৃতির নিয়ম ? মুরগীরা পৃথিবীতে জন্ম নেবে, ফুলে ফেঁপে উঠবে, তারপর একদিন শুভক্ষণে মানুষের হাতেে তাদের মৃৃত্যু হবে। এভাবেই পৃথিবীতে যুগযুগ ধরে চলতে থাকবে মুরগীদের গণমৃত্যু।

আচ্ছা, একে কি গণমৃত্যু বলা উচিত , নাকি গণহত্যা । একদিক থেকে ভাবতে গেলে মুরগীগুলোর মৃত্যু তো নয় হত্যা হচ্ছে । মানুষের জৈবিক চাহিদা মেটাতে গণহারে হত্যা । আবার কেন যেন মনে হয় এক হিসেবে ভালোই হয়েছে । জীবনে যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষমতাটুকুই না থাকে তবে সেই জীবন থাকার কি অর্থ । এই বেঁচে থাকা অর্থহীন । কোন মানে হয় না । অন্তত মৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণে প্রতিবাদ স্বরূপ লোকটার হাতে যদি একটা মরণ কাঁমড় বসানো যেত।

একেতো কোন অবস্থাতেই মৃত্যু বলা উচিত না । গোটা প্রক্রিয়াটি আসলে মুরগীদের পশু জীবন থেকে মুক্তি লাভের পথ । তবে কি এ মৃত্যু নয়ই, হত্যাও নয় , কেবলই মুক্তি ?

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments