সন্তাপ


বিজয় বাবা আমার কেমন আছিস
ভাবছিস, আবার কি হলো আমার
দেশে ফেরার টিকিট দিয়েছিস
বৃদ্ধাশ্রমে ঠিকানা দিয়েছিস
মাসান্তের মাসোহারা,
তাও রেখেছিস জমা
আবার কিসের প্রয়োজন
নারে তেমন কোন সমস্যা নয়
আসলে তোর মধ্যে যে বাবা
আমাদের দুজনার রক্ত আহা
তোর শিক্ষায় আমাদের সন্তোষ
তোর সাফল্য আমাদের স্বপ্ন বাবা
তোর চিন্তায় আমাদের ভয়
তোর হাসিতে আমাদের তৃপ্তি যে হয় ।

বিশ্বাস কর, বড় চিন্তা হয়
প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ভয় হয়
এতদূরে থাকিস, কখন কি হয়
শরীর ঠিক আছে কিনা
ঠিক মত বিশ্রাম নিস কিনা
এগুলোই, এইসব আর কি
এজন্যই তোকে ফোন করা
আর কিছু নয়
ভালো থাকিস বাবা
আমাদের আর কি, ভালোই আছি
তেমন কোন অসুবিধা নেই
তোর বাবার প্রেশার একটু বেশি
ডাক্তার বলেছে, "সাবধানে থাকবেন"
তোর বাবা বলেন, ও কিছু নয়
প্রাণ থাকলে প্রেশার থাকবে
ও নিয়ে এত কিসের ভয় ।
আমিও বলি ঠিকই তো
আমাদের আছে কি
আজ আছি, কাল নেই
শুধু প্রার্থনা একটাই
আমি যেন ওর মৃত্যু দেখে যাই
বিশ্বাস কর বাবা
সত্যি ওর মৃত্যু দেখে যেতে চাই
আমার অবর্তমানে কে দেখবে তাকে
কে আছে তার, এই অভাগার
কে এগিয়ে দেবে ঔষধ
জলের গ্লাস , বাথরুমে গামছাটা
কিংবা যখন যা চাই
এই আরকি, আর কিছু নয় ।

আচ্ছা বাবা, তুই কি রাগ করেছিস
আমাদের বৌমা, বড় অভিমানী সে
তোরা কি কিছু মনে নিয়েছিস
আসলে..... না থাক ওসব কথা আজ
তোদের ছোট্ট পরী, আমাদের তাজ
ওকি আনমনে আমাদের খোঁজে
ওর খাবার সময়, দুপুর বেলা
কিংবা, কিংবা যখন সে করে খেলা
নাঃ থাক ওসব বিষয়
ও নিয়ে ভাবলে মন খারাপ হয় ।

আচ্ছা, তোর সুদীপকে মনে আছে?
সেই যে তোদের স্কুলে পড়তো
তোর থেকে দু তিন ক্লাস ছোট হবে
মনে আছে নিশ্চয়ই, ওর বাবা
ওপাড়ার ঘোষালদা , শ্যামসুন্দর ধাবা
দুরারোগ্য কর্কট রোগের থাবায়
ধন প্রাণ দুইই হারায় ।
ওনারই বড় ছেলে সুদীপ
বুলু নামে সবাই ডাকে
তোর বাবাই মানুষ করেছেন তাঁকে
না না ভুল বললাম বাবা
মানুষ করেন নি উনি
মানুষ গড়ার কারিগর যে তিনি নন
দেখাশোনা করছেন নিশ্চয় ।
সেই সুদীপের সাথে হঠাৎ দেখা
আমরা পিটার্সবার্গ থেকে ফিরছি
টিকিটটা তোরই হাতে কাটা
সেও ফিরছিল ওই প্লেনে
আমাদের কথা, স্বাভাবিক বাংলায়
ও বসা ঠিক পিছনের কেদারায়
কথা হচ্ছিল বেশই নীচু স্বরে
তবু জানি না সে কি করে
আমাদের ঠিক চিনে নেয়
বলে, "আমাকে চিনেছেন নিশ্চয়,
আমি আপনাদের সুদীপ, ওপাড়ার
আপনাদের বাড়ি গেছি, বহুবার
মনে আছে, মনে আছে সেইসব দিন
কত নাড়িকেল নাড়ু, পুলি, পাটিসাপ্টা
কত নিয়ে গেছি বাগানের মালভোগটা
আমি সেই সুদীপ, কেমন আছেন?"
বললাম ভালো আছি বাবা, তোমরা কেমন?
বললো ভালো আছি মাসীমা ।
কিন্তু আমার মন বললো ও ভালো নেই ।
ভালো আমরা কেউই নেই রে
তুই, আমরা, সুদীপ, সবাই
আমরা কেউ সুখে নেই
তবু জেনেশুনে মিথ্যার আশ্রয় নিই।
ওর বিয়ে হয়েছিল মঞ্জুর সাথে
টিকে ছিল কিছুদিন, ছিল একসাথে
তারপর কি জানি কি হয়
মঞ্জু ফিরে আসে দেশে
ডিভোর্স, না এখনও হয়নি বোধহয়
যোগাযোগ আছে কিনা তাও জানি না
শুধু জানি ছেলে মেয়ে হয়নি তাদের ।

আমাকে জিজ্ঞেস করে সে কেমন আছি
কি বলি বল, কিকরে বলি কেন ফিরছি দেশে
উত্তর কি দেই, কি বলি তখন
কি করে বলি, কি আশায় দিয়েছিলাম পাড়ি
কি উদ্দেশ্যে তিন পুরুষের ভিটেটা
আমাদের দুধেল গাভীটা
সেইসঙ্গে পাঁচ হাল ক্ষেতি জমিটাও
চণ্ডীমন্ডপ , উঠোনের তুলসিতলা
সব সবকিছু ছাড়ি, কালাপানি পাড়ি
দিয়েছিলাম দুইজন স্বপ্নভরা চোখে
একমাত্র ছেলের একমাত্র নাতনি বুকে
জীবনের শেষটা কাটবো সুখে।
হায় সুখ... আসলে জানিস বাবা
সুখ বড় কঠিন জিনিস
একের সুখ, অন্যের বিষ।

মনে আছে বাবা, সেইদিন তোরা দুইজন
কত কথা বলেছিলি, দিষ়েছিলি নাতনির প্রলোভন
আসলে তোদের তখন বেবিসিটার ছিল প্রয়োজন
তাই তোদের এতকথা, ভ্রমণের রূপকথা
প্রলোভনের প্রলেপেতে ছলনার মিথ্যা আচ্ছাদন ।
আমরা বুঝিনি রে, কোনদিন ভাবিনি যে
আমাদের জীবনে এরও ছিল প্রয়োজন
সেইদিন জানলাম যেই দিন শুনলাম
তোর এই ছোট ঘরে
তারচেয়েও ছোট মনে
আমাদের শেষ প্রয়োজন ।

সুদীপ ছেলেটা ভালো, জানিস কত কথা শুধালে
কটা দেশ ঘুরেছি, কি কি দেখেছি
কত দিন দেশে থেকে ফিরে যাবো পিটারে
কি বলি তাকে, কি করে বোঝাই
যে তোর ঘরে আমাদের আর ঠাই নাই ।
এ লজ্জা তোর নয় বাবা
এই লজ্জা আমাদের, আমাদের শিক্ষার
তোকে ঘিরে আমাদের সেইসব স্বপ্নের
উচ্চাকাঙ্খার ইমারতে নির্বোধ অহংকার ।

আর হ্যাঁ, শোন বাবা, তোর বাবা
বৃদ্ধাশ্রমে যে টাকা করেছিলি জমা
সুদ সহ সেই টাকা ফিরিয়েছে তোকে
পেয়ে যাবি, মিলিয়ে নিস হিসাবটা ।
বাড়ি নেই তাতে কি ভাড়া ঘর আছে
চাকরি নেই ঠিকই, পেনশন আছে
সুদীপের দৌলতে ভালোই আছি
এক ছেলে হারিয়েছি ঠিকই, একমাত্র নয়
হাজার ছেলের মা আমি হয়েছি এখানে
এটাই আমার এখন একমাত্র পরিচয় ।

ঠিকানাটা চাইবি না বাপ, কিসের প্রয়োজন
যা ছিল মোদের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়েছি
আর কিসে আছে বল তোর প্রলোভন
ভুলে যা, তোকে ভুলে যেতে চাই বাবা
ভুলে যেতে চাই তোর পরিবার
তোর বিদেশের বাড়ি, গাড়ি
ছোটখাটো বিষয়ে তোর ব্যবহার
সব ভুলে যেতে চাই তুইও ভুলে যা,
ভুলে যা তোর এক বাবা ছিল কিংবা মা
ভুলে যা দোহাই তোরা ভুলে যা
ভালো থাকিস লক্ষ্মীটি আমার ।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments