রোহিঙ্গা


সংগ্রহীত

আমি রোহিঙ্গা, শরণার্থী একজন
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে
মৃত্যু ভয়ে পালিয়ে আসা
অনাহুত অভাজন।
আপনাদের সুশিক্ষিত
মায়ানমারের সামরিক বাহিনী
যাদের অবর্ণনীয় নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে
ইতিহাসের পাতা আজ রক্তাক্ত
যাদের বিভৎস জুলুম ও হত্যাকাণ্ড
লজ্জিত করে হিটলারের নাৎসি কর্মকান্ড
আমি সেই নির্যাতিত রোহিঙ্গা একজন
দুটো কথা বলার ছিল আমার
যদি দয়া করে শোনেন সুধীজন ।
আপনি বোধকরি জানেন না, মহাশয়
আমি কোন বাঙ্গালী নই
নই কোন বাংলাভাষী
আমি উড়ে এসে জুড়ে বসা
কখনোই নই কোন সন্ত্রাসী।
আমাকে যারা বিদেশী বলে
আসলে, তারা বিদ্বেষের শিকার
পরিকল্পিত ভাবে তারা
মুছে দিতে চায়
রোহিঙ্গা জনজাতির
জন্মগত অধিকার ।

কেউ কি জানেন কারা এই রোহিঙ্গারা
কোথায় তাদের বাস
কেনই বা তার আকাশে বাতাসে
শুধুই দীর্ঘশ্বাস ।
কেন আজ তারা শরণার্থী সেজেছে
কাদের চক্রান্তে
চোখে জল কেন আসে, যদি কেউ জানে
তাদের বৃত্তান্তে ।

এক হাজার চুয়াল্লিশ সনের কথা
তৎকালীন কট্টর বৌদ্ধ রাজা
"আনাওহতা", শুধু ভিন্নধর্মী তাই
তাড়িয়ে দিয়ে ভিটে থেকে, আনলে মগেরে ডেকে ।
রাখাইন হলো দুটো ভাগ, বৌদ্ধ রাজার বলে
দক্ষিণেতে মগের বাস, উত্তরেতে রোহিঙ্গা
ইতিহাস সাক্ষী, আমরা সেদিনও ছিলাম
এই মায়ানমারের বুকে ।
চৌদ্দশ ত্রিশ থেকে সতেরো চুরাশি সাল
খুঁজে দেখুন ইতিহাসের পাতায়
রাখাইন অঞ্চলে বাইশ হাজার বর্গমাইল
রোহিঙ্গা শুধু রোহিঙ্গারই রাজত্বকাল।
সেই রোহিঙ্গা আমি , আজ ভিন্নদেশী
আপনাদের বৌদ্ধ শাসকদের দয়ায়
বৌদ্ধ, যারা নিজেদের অহিংসক জানে
দাবি করে, গর্ব করে , বুক ফুলায়।
কিন্তু হায়, সবটাই রাজনীতি
ধর্মের মোড়কে তারা রোহিঙ্গাদের
পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে চায়।
কেউ কি জানেন কেন ওরা
আমাদের 'কালা' নামে ডাকে
কালা কিন্তু সেই কৃষ্ণ কানাই নয়
কিংবা কালো রঙধারী
অন্য কোন কেউ, তাও নয়
কালা মানে ভারতবাসী
কালা মানে বাংলাদেশি
কালা ডাকে অহরহ জাগে ভয়
কালা যে আসলে হৃদয় নিংড়ানো
সীমাহীন তীব্র ঘৃণা হয় ।

সতেরোশ চুরাশি সাল
মায়ানমারের রাজা বোদাওফায়া ;
প্রচন্ড যুদ্ধে রোহিঙ্গা পরাজিত
স্বাধীনতা অস্তাচলে, দিগন্তে হল হাওয়া।
তারপর, ----
তারপর শুধু ইতিহাস
অত্যাচার নির্যাতন আর কেবলই দীর্ঘশ্বাস ।
ব্রিটিশ এলে, শাসন তাদের হাতে ।
কি জানি কি করে কি যে হয়ে গেল
একশ উনচল্লিশ জাতির মধ্যে
শুধু রোহিঙ্গারাই হারিয়ে গেল
চক্রান্তের বেড়াজালে ।
উনিশশ আটচল্লিশ সালে মায়ানমার,
উড়ে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা
মুক্তির কথা কিতাবেতে লিখা
সত্যটি হলো "গ্যাটো" বন্দি জীবন
কপালে অমোঘ আঁকা ।
উনিশশ বাষট্টি সন
এলেন জেনারেল নে উইন
রোহিঙ্গাদের জীবনে এলো
চরম দুর্যোগ দিন
যখন তখন আক্রমণ আর
ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দাও
গুপ্তচরের তকমা চাপিয়ে
কারাগার ভরিয়ে নাও
বিনা মজুরীতে শ্রমিক চাই
রোহিঙ্গাদের ধরে আনো
যদি নারী দেহের রোমাঞ্চ চাই
বেওনেটে কাছে টানো।
গোলামের জাত, বিধর্মী সব
আজানে আল্লাহকে ডাকে
গুঁড়িয়ে দাও, উড়িয়ে দাও
বারুদের গন্ধে ভরিয়ে দাও
যেন, শুধু বুদ্ধ স্মরণে থাকে ।
শিক্ষার কোন অধিকার নাই
বিবাহেতে বাধা দেবে
চিকিৎসা তাদের কিসের চাই
মৃত্যুতে নির্বাণ পাবে।
সরকারি কাজে অধিকার দিও না
অধিকার নেই ব্যাঙ্কের লেনদেনে
বিদ্যুত, জল বিলাসিতা হয়
গ্যাটো বন্দি জীবনে।
যেথায় সেথায় কেন যেতে দাও
চলাচল হোক বন্ধ
খবরের গলা, টুঁটি চেপে ধরো
পৃথিবীকে রাখো অন্ধ ।

লোকে বলে আউং সান সু চি
উনি নোবেল পদক জয়ী
আমি যে সেই পদক প্রাপ্তিতে
রাজনীতির পদধ্বনি শুনি।
লজ্জা করে না কারো
অতর্কিতে আক্রমণে
ঘর বাড়ি সব জ্বালিয়ে দিয়ে
আকাশ ধোঁয়ার কালো।
মানুষ নাকি অমানুষ ওরা
রক্তাক্ত কোন বাবার সম্মুখে
বিবসনা হয় সাধের আত্মজা
ছিঁড়ে কেটে খুঁড়ে খায় শকুনের দল
বিবেকে বাঁধে না কারো
নারী-- ? তুমি কি সত্যিই নারী হও
তুমিই কি সেই রাষ্ট্রপালিকা
শান্তির দূত যারে কও ।
ধিক তোমার প্রতিদিন সাঁঝে
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালা
প্রদীপ তোমার মিছেই জ্বালাও
হৃদয়ে অন্ধ কালা ।

সেদিন তখন দুপুরবেলা
আমি আর ছোট বোন
খেতের কাজেতে মাঠেতে আছি
বিশ্রামে যাবোখন ।
বোনটি আমার সদ্য যুবতী
রূপে গুনে গুণবতী
ইচ্ছে এবারে ফসল তুলেই
ভালো পাত্রেতে করি গতি।
হঠাৎ শোনা যায় ঠুস ঠাস ধ্বনি
চারিদিকে ক্রন্দন, কোলাহল
বার্মিজ সেনা আবারো এসেছে
তাই বারুদের এত চলাচল ।
বোনটি আমার ভয়েতে কাঠ
এখন কি করা যায় ।
কুঁড়ে ঘর আছে পাহাড় চুড়ায়
কি করে পালাবো হায় ।
আমি বলি বোন, মোর কথা শোন
চল ছুটি,পালাই।
বোন বলে দাদা তুই তো জানিস
আমার সে শক্তি নাই
সব বুঝি আমি, তবু তারে বলি
আয় না চেষ্টা করি
বার্মিজ সেনা যমদুত তারা
মিছে কেন শুধু মারা পড়ি।
যত তারে বলি তত ভয়ে মরি
কি জানি কি এবারে হয়
যদি ধরা পড়ি , আছে কোন হরি
অসময়ে প্রাণ যাবে নিশ্চয়।
বোন বলে দাদা ,শুয়ে পড়
শুয়ে পড় ত্বরা করি
এই মাঠ এই মাটিই মোদের মা
আয় মায়েতে আশ্রয় মাগি।
সবুজ ক্ষেতেতে হলুদ শীষ
ধান পেকে গেছে প্রায়
আর কটা দিন, যদি দেয় দিন
গোলা দুটো ভরে যায়।
দুরু দুরু বুকে, শুয়ে আছি
জল কাদা মাটি মেখে
দুরে শোনা যায় বুটের আওয়াজ
বুকে প্রতিধ্বনি রাখে।
বিশাল প্রান্তর , সবুজের শিরে
সোনালী ধানের খেলা
আহা, কত ঘাম শুষে, আজ অবশেষে
মাঠেতে সোনালী মেলা।

দুরে শোনা যায় গুলির আওয়াজ
বুটে বেওনেটে বিকট উল্লাস
আগুন জ্বলছে গোটা গ্রাম জুড়ে
কেউ মরেপড়ে আছে পথের প্রান্তে
কেউ চিৎকার করে মুক্তি চাইছে
রক্তস্নাত যে , সে ধুঁকছে শ্বাস ।
কেউ হারিয়েছে একাধিক অঙ্গ,
কারো হাতে শৃঙ্খল
কোলের শিশুটি খুঁজে তার মাকে
মা কোথায় ? ভোগের থালায় ---
তাকে ঘিরে মত্ত শকুনিদল।
হঠাৎই কি মতি হয় বার্মিজ সেনার
পেট্রোল ঢালে সোনালী ধানে ,
নিমেষে আগুন পাগলের প্রায়
ছোটাছুটি করে, নেচে ধেয়ে যাই
মাঠের সকল কোনে।
আমি বলি বোন, আজ আর রক্ষা নাই
মৃত্যু এসেছে দুপাশে দাঁড়িয়ে,
কারে ঠেলে দূরে, কারে গলে চাই
আজ এই সন্ধিক্ষণে ।
বোন বলে দাদা যে করেই হোক
তোকে যে বাঁচতে হবে ।
আকাশ বাতাসে শুধুই উল্লাস
আর তাজা রক্তের গন্ধ।
এপাশে আগুন ওপাশে সেনা
পালানোর পথ বন্ধ ।
হঠাৎ চিৎকার ,'ধর ধর ওকে'
চমকে পেছনে ফিরি
দেখি বোনটি আমার ছুটছে দেদার
যেন অচীন অশ্বারোহী ।
অন্তর থেকে চিৎকার জাগে
'একি এ তুই কি করলি বোন ?'
আমাকে বাঁচাতে শুধু আমাকেই বাঁচাতে
নিজেকে করলি খুন।
মনে প্রাণে চাই, উঠে দাঁড়াই
চিৎকার করে বলি ,'এইতো আমি --
আমাকে নিয়ে যাও ধরি,
বোনটি আমার বড় আদরের
দয়া করো , দয়া করে দাও ছাড়ি ।'
নিষ্ফল প্রচেষ্টা, অসাড় দেহকে ঘিরে
বোবা কান্নায় মাটি ভিজে যায়
কে যেন টুঁটি চেপে ধরে ।

সন্ধ্যা নামে প্রায় পশ্চিম আকাশে
স্থানে স্থানে স্তূপীকৃত অভিশাপ
রোহিঙ্গা রক্তে রক্তস্নাত দিনমণি
দিগন্তে রক্তাভ ছাপ।
ধীরে ধীরে আমি নেমে আসি --
জঙ্গল থেকে জনপথে
জনপথ নয় শ্মশান ভুমি এযে
আজ এই সন্ধ্যারাতে।
চারিপাশে খুঁজি , ঐ পথে বুঝি
আমার বোনটি গেছে
হয়তো বা সে -- হয়তো বলি কেন
নিশ্চয়ই, নিশ্চিত বেঁচে আছে ।
এদিকে যাই , ওইদিকে ছুটি
পাগলের মতো হুটোপাটি করি
এতো এতো লাশ মাঝে
কোথায় বোনটি আছে
নাকি ওকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে
বন্দি ওদের কাছে ।
হঠাৎই শুনি বোনটি বলছে,
" দাদা তুই কেন ফিরে এলি ?"
ফিরে দেখি পথের পাশেতে
শুয়ে আছে বোন শতছিন্ন বাসে
যেথায় যেথায় আব্রু যে চাই
উন্মুক্ত রক্তিম আকাশে।
গায়ে অজস্র পোড়া দাগ,
সাথে তাজা রক্ত ছাপ
বোন আমার এখন অন্তিম শ্বাসে।
আমি চিৎকার করে উঠি ,'বোন,
আমার আদরের সোনাধন
এই তুই কি করিলি বোন?
এমন জীবন বল কি প্রয়োজন,
ধিক, ধিক, ধিক আমার এই জীবন।'
" দাদা, তোকে যে বাঁচতে হবে দাদা;
বাঁচতে হবে আমার জন্য
আমাদের মত হাজারো নারীর জন্য
বলতে হবে আমাদের কথা
বলতে হবে বার্মি সেনার অত্যাচার গাঁথা
যত ধর্ষণ আর গুলি বর্ষণ হয়েছে
যত দুগ্ধ শিশু এই রাখাইন ভূমিতে
মাতৃহারা, বিকলাঙ্গ হয়ে রয়েছে
বলতে হবে বিস্তারিত
অত্যাচারের সকল অনুকথা।
দাদা, তুই জেনে রাখ---
কিসের ধর্ম, কিসের আচার
অমানবিক এই ব্যভিচার,
হিন্দু, বৌদ্ধ নাকি মুসলমান
জিজ্ঞাসা করে কোনজন
দুর্বল যে, নাকি দুষ্টের অনুচর
মানুষ হয়ে মানুষের পরে ঘৃণ্য অত্যাচার ।
তোকে যে বলতে হবে দাদা ,
আমরা রোহিঙ্গা, আমরা মায়ানমারবাসী
ইতিহাস সাক্ষী আমরা মায়ানমারেই ছিলাম
মায়ানমারেই আমরা থাকতে চাই
সকলের সাথে কিংবা স্বাধীনভাবে
তবে অবশ্যই সম সম্মান প্রত্যাশী ।
দাদা আমিতো বাঁচবো না
দায়িত্বটা তোকেই নিতে হবে
তোকে যে বলতে হবে সব কয়টি কথা,
দাদা, ভাইটি আমার, বড় কষ্ট রে---
একটু জল দিবি দাদা -----।

হে, মানুষের আকৃতিতে দ্বিপদ প্রাণীরা
যদি পৃথিবীর কোন প্রান্তে আজও
মান হুশ সহ কোন মানুষ বেঁচে আছো
হাত বাড়াও বন্ধু তোমাকে যে আজ
আমার ভীষণ প্রয়োজন ।
এসো হাতে রাখি হাত
যত অন্যায় আর ঘৃণ্য আঘাতে
প্রতিবাদে গড়ি কঠিন প্রাচীর
হানি বজ্র সম কঠোর প্রতিঘাত ।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments

Post a Comment