হরিকাকু


"হরিকাকু বাবা ডাকছেন" - ছোটবাবুর ডাক শুনেই হরি তাড়াতাড়ি দোতলা ঘরের দিকে ছুটলো। এই অসময়ে বড়বাবু সাধারণত ডাকাডাকি করেন না । সকাল বেলার এই সময়ে বড়বাবু পেছনের বারান্দায় বসে দুতিনটে খবরের কাগজের সঙ্গে সকালের চা সারেন ।পাশে বসে বড়মা এই সময়েই সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেন, কারণ এরপর সারাদিন বড়বাবু কে পাওয়া খুবই কঠিন । মাঝে মাঝে ফুলন মালীকে গাছের পরিচর্যা নিয়ে এক দুটো উপদেশ দেন । ফুলগাছ বড়মার প্রাণ। কিন্তু আজকের কথা আলাদা । আজ বাড়িতে সরস্বতী পুজো, তার চেয়েও বড় কথা আজ ছোটবাবুর মেয়ের হাতেখড়ি । বড়মা, ছোটমা, হরি সবাই আজ পূজোতে ব্যস্ত ।
--"এই হরিদা কোথায় যাচ্ছ, কর্পূরের কৌটাটা দিয়ে যাও।"
--"যাই বড়মা ।"
--"হরিকাকু আমাকে একটু নৈবেদ্য জন্যে নাড়িকেল খুঁড়ে দিও।"
--"দেই ছোটমা, আগে বড়বাবু কেনে ডাকে শুনি আই।" এই মালতী ছোটমারে একটু নাইরকেল কুড়াইয়া দে।" মালতী এই বাড়ির ঠিকে ঝি, তবে পূজা পার্বনে সারাদিন থাকে। হরি ছুটলো দোতলায় ।
--"হরিদা প্যাকেটটা নিয়ে যাও, দিদিভাই এর হাতেখড়িতে এই কাপড়টি পড়ে এসো‌।"
হরি একটু ইতস্তত করে চুপচাপ প্যাকেটটা নিয়ে নীচে চলে গেল । বড়বাবু র মেজাজটাই আলাদা । বেশি কিছু বলেন না, যা বলেন সেটাই শেষ কথা ।

--"হরিদা তুমি এখানে বস।"
ঠাকুর ঘরের সামনে বড়বাবু ছোটবাবু বড়মা ছোটমা সবাই সবাই বসা। পূজা প্রায় শেষ পর্যায়ে ।
--"হরিদা তুমি এখানে বস।" পাশেই একটা আসনে হরিকে বসতে বললেন ।
হরি বুঝতে পারছে না কি করা উচিত । একবার বড়বাবু একবার বডমার দিকে তাকিয়ে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলো । বড়মা চোখের ইশারায় ওখানেই বসতে বললেন হরিকে । হরি খানিকটা ইতস্তত করে উপায়ান্তর না পেয়ে ঐ আসনটি গুটিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো।
--"আহাঃ, কি করছ, এই আসনেই বস।" বড়বাবুর আদেশ ।
হরি এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে তার সমর্থনে পেল না । অগত্যা অসহায়ভাবে বড়বাবু র পাশেই গুটিসুটি হয়ে বসল ।
হরি এবাড়িতে আছে প্রায় চল্লিশ বছরের বেশি । ছোটবাবুর জন্ম বেড়ে ওঠা সবই তার কোলেপিঠে । কিন্তু কোন দিন এভাবে বড়বাবু র পাশে বসতে হয়নি। চক্রবর্তীমশাই এবারে হাতেখড়ি দেবেন ।
--"ঠাকুরমশাই হরিদা আমাদের দিদিভাই এর হাতেখড়ি দেবে।"
কথাটা কানে যাওয়া মাত্র পুরোহিত মশাই যতটা না আঁতকে উঠলেন তার চেয়ে অনেক বেশি ঘাবড়ে গেল হরি। সে বুঝে উঠতে পারছিল না কি ভুলে বড়বাবু তাকে এত বড় শাস্তি দিচ্ছেন । এতদিনের সেবার আজ এই পরিনাম। ঘর ভর্তি লোকের সামনে এভাবে অপমান । হরি ঠিক বুঝতে পাারে, কোথাও  ঠিক একটা ভুল হয়ে গেছে , কিন্তু নিজে সে বুঝতে পারছে না । হরি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আর  কাল বিলম্ব নয়।  কাঁদোকাঁদো স্বরে বড়বাবু র পায়ে লুটিয়ে বললো, " আমারে খেমা করি দেইন বড়বাবু।"
--"ছিঃ হরিদা এরকম করো না, ঠিক হয়ে বস।"-- পাশ থেকে বড়মা বললেন ।
---"আমার ভুল হই গেছে বড়মা, ইবারের মত আমারে খেমা করি দেইন । " অজানা ভয়ে হরির বুক কাঁপছেে ।
--" তুমি তো কোন অন্যায় করিনি হরিদা ।"
--"তাইলে - - "
--" তাহলে কি? "
--" আমি তো টিপ দেই, আমি কেমনে---"
--"ঠিকই তো, ও নামই সই করতে পারে না, কি করে হাতেখড়ি দিবে। তাছাড়া এটা বাড়ির কর্তাকেই মানায় ।"
--"না পুরোহিত মশাই বাড়ির কর্তা নয় বাড়ির বয়ঃজেষ্ঠ -
--"ওই একই হলো।"
--"না এককথা নয়।"
--"কিন্তু আমি যে লেকতে পারি না বড়বাবু ।"
--"তাতে কি? ছবি আঁকতে পারো তো।"
হরি ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। পারে ।
--"তবেই হবে - - "
--" কিন্তু - -? " পুরোহিত মশাই একবার শেষ চেষ্টা নিলেন।
--" দেখুন ঠাকুরমশাই, হাতেখড়ি তো শুধু অক্ষরের হাতেখড়ি হয় না , আজ আমার দাদুভাই এর শিক্ষার হাতেখড়ি । আর শিক্ষার প্রথম পাঠ হচ্ছে গুরুজনের সর্বদা সম্মান করা। হরিদা আমার থেকে বয়সে বড় ।"
---"আমরা সবাই চাই তোমার হাতেই ওর হাতেখড়ি হোক হরিকাকু ।"--পাশ থেকে ছোটবাবু ও ছোটমা বলে ওঠলো।
---"তুমি বরং এককাজ করো হরিদা, তুমি আমাদের দিদিভাই এর হাত ধরে একটা ছবি আঁক, যাতে একটা পাহাড় থাকবে, একটা গাছ থাকবে আর থাকবে একটি নদী।" - - বড়মা পাশ থেকে বললেন ।
হরি শুধু পাথরের মত স্থির হয়ে বসে রইল । আর তার কাঁপা কাঁপা হাতে পাহাড়ের ছবি আঁকার আগেই দুচোখ দিয়ে নদীর স্রোত ব‌ইতে লাগলো।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments