সাদা গোলাপ


(বন্ধুরা, যাদের আমি এই গল্পের ট্যাগ করেছি আর যাদের আমি ট্যাগ করতে পারিনি এরকম অনেক বন্ধুর অনুরোধে গল্পটার একট পরিনতি দিলাম ।গল্পটা লিখতে গিয়ে অনেক বড় হয়ে যাচ্ছিল যা ফেসবুক গল্প হিসেবে একেবারেই অচল । তবু আপনাদের দেওয়া সাহসের ভরসায় আমার এই প্রচেষ্টা । যদি কেউ ধৈর্য ধরে পড়ে মন্তব্য রাখেন বুঝবো পরিশ্রম সফল । ধৈর্যচ্যুতি যদি ঘটে, আমাকে মার্জনা করবেন। আমার দুর্ভাগ্য ফেসবুকও গল্পটা একসাথে পোস্ট করতে দিচ্ছে না ।তাই পাশপাশি দুটো পোস্টে দিতে বাধ্য হলাম । অনিচ্ছাকৃত অসুবিধারজন্য দুঃখিত ।)

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, সারাদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে, এখন একটু বেশি । আমি, সুদীপ্ত আর ভুদেব বসে আছি চুপচাপ । এই বৃষ্টিতে যগাদার আসার আশা নেই বললেই চলে । আমরা চারজনই এই বৈকালিক আড্ডায় স্থায়ী সদস্য। কোথাও বাইরে না গেলে আমরা সাধারণত আড্ডায় গরহাজির থাকি না । আড্ডা বলতে নিছকই আড্ডা, নির্মল আড্ডা, সাথে বার কয়েক কাপ চা আর যগাদার ফরমাইস অনুযায়ী তেলেভাজা, পাকোড়া নিদেন পক্ষে মুড়ি মাখা, পেঁয়াজ দিয়ে । শুরু শুরুতে আমরা লুকুদার চাস্টলেতেই বসতাম, লুকুদা মারা যাবার পর এই আড্ডাটি আমার বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছে । আমার পরিচয় নিশ্চয়ই আপনাদের সবার জানা, আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কর্মী, এক মেয়ে বর্তমানে বিদেশে থাকে। আমি আর সবিতা - বুড়ো বুড়ি শহরের বাড়ি ভাড়া দিয়ে গ্রামের বাসিন্দা । সুদীপ্ত ভৌমিক আমাদের এই চা বাগানেরই বড়বাবু । এই বাগানে জন্ম এখানেই কর্ম,এই চাবাগানই ওর পৃথিবী। ভুদেব ভূষণ দেব নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।সুদীপ্ত আর ভুদেব দুজনেরই দারাপুত্র পরিবারে ভরা সংসার, সুখী সংসার । শুধু যগাদা , পুরো নাম যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য আমাদের মধ্যে ছাদনা তলায় পা রাখেননি । সেই পুরনো দিনের মেরামত করা হারকুলিস সাইকেল, স্টেথো ভরা রঙ জ্বলা কালো রঙের ডাক্তারী ব্যাগ আর লাঠি কাম ছাতি এই নিয়ে তার সংসার । এতদিন অসুস্থ মা ছিলেন, তিনিও গত হয়েছেন আজ দুবছর । বর্তমানে দীর্ঘদিনের সাথী লেবুয়াই তার কুক কাম কেয়ার টেকার। আমরা এই চারজন বিকাল বেলা একসাথে বসি, অবসর থাকলে সবিতা আমাদের সঙ্গ দেয় । আজও আমরা আমাদের বৈকালিক আড্ডায় বসা, যগাদা এখনো আসেনি । যেভাবে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে আড্ডা আজ ভেস্তে যাওয়ার পথে বলেই মনে হচ্ছে । লক্ষ্মী এসে একবার খোঁজ নিয়ে গেছে চা লাগবে কিনা । লক্ষ্মী আমাদের বাড়িতে কাজ করে প্রায় পাঁচ বছর, এবাড়িতে কার কখন কি চাই সব তার নখদর্পনে। যখন আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে যগাদার আজ আসা হচ্ছে না সেসময় ভরা বর্ষায় কাক ভেজা হয়ে যগাদা এসে উপস্থিত । এসেই হাঁক দিলেন, "লক্ষ্মী ঠোঙাটি ভেতরে নিয়ে যা ।"

হাতের ভেজা ছাতিটি দেওয়ালে ঠেস দিতে দিতে বললেন, "বুঝলে ভায়া, যতই বেয়ারা বৃষ্টি হোক, ভোলার সৃষ্টি কিছুতেই নষ্ট হতে দেইনি ।"

--- "এই বৃষ্টিতে পকোরা কোথায় পেলেন ?" ভুদেববাবু খুব উত্তেজিত । এতক্ষণে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে ।
--- "এক মিনিট । আগে দাদা ভালো করে শরীর মুছে কাপড় পাল্টে আসুন তারপর চা খেতে খেতে তোমাদের গল্প হবে।" সবিতা যগাদাকে আমাদের মধ্যে থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে গেল ।
যগাদা হেসে যেতে যেতে আমাদের বললেন, --- " বুঝলে ভায়া, ঠিক এই কারণেই আমার বিয়ে থা হলো না । মাথার উপর এমন ননদিনী থাকলে কোন মেয়ে সাহস করে আমার সাথে গাঁটছড়া বাঁধবে।"
--- "ওঃ তাই বুঝি । আজকাল ডাক্তারীর সাথে সাথে মেয়েদের মনেরও খোঁজ রাখা শুরু করেছেন বুঝি ? ভালো , তা সেই মেয়েটি কে?"
--- " মেয়ে হতে যাবে কেন রীতিমত ভদ্রমহিলা । তবে সবুর করো বোন, আমি তোমার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি ।"
কেউ হারতে রাজি নয়। যগাদার জবাবে আমরা সবাই হেসে উঠলাম ।
অল্প সময়ের মধ্যেই যগাদা ফিরে এসে হাঁক দিলেন, " লক্ষ্মী আমার কৌটা ---" কৌটা মানে নস্যির কৌটা । বোধহয় ছেড়ে দেওয়া পাঞ্জাবীর পকেটে থেকে গেছে । লক্ষ্মী ঠিক বুঝে গেছে । নিমেষে কৌটাটি এনে দিয়ে চা আনতে ছুটলো ।
যগাদা নস্যির কৌটা থেকে এক চিমটি নস্যি নিয়ে প্রথমে বাম তারপর ডান নাকের গর্তে চেপে দুটো নাকেই জোরে জোরে নিশ্বাস নিলেন। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যগাদার কাছ থেকে গল্প শোনার আশায় ।
বেতের চেয়ারটিতে আসন করে বসে যগাদা খুব আক্ষেপ করে বললেন, " বুঝলে ভায়া, ভোলার বউটা বোধহয় বাঁচবে না ।"
--- " সেকি? আমাদের ভোলা? ঐ রতনপুর বাগানে বাজার মোড়ের তেলেভাজার দোকানদার?"
--- " হ্যাঁ, সেই । এমনিতে দোকানের যা আয়, ভালো করে সংসার চলে না । তার উপর বৌটার এই অসুখে ভোলাটাও শেষ যাবে ।"--- যগাদাকে খুব অন্যমনস্ক লাগছিল ।
---" আপনি আজকে গেছিলেন ওকে দেখতে ? " সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।
---" ওখান থেকেই আসছি। আসার সময় ভোলাটা আমাকে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিয়ে বললে আর নেই । থাকবে কোথা থেকে । এই বৃষ্টিতে ভুতেরা পর্যন্ত বেরুতে ভয় করে আর মানুষ তো কোন ছাড় । "
---" তারপর ? " ভুদেববাবু উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ।
---" তারপর আর কি ? বললাম টাকাটা তুই রেখে দে । নিতে চাইছিল না‌। তাই বাধ্য হয়ে ঐ টাকায় এগুলো নিয়ে এলাম ।"
--- "ভালোই করেছেন, নইলে এই বৃষ্টিতে তার পকোরা গুলো নষ্ট হতো ।" আমি বললাম ।
যগাদা কোন উত্তর দিলেন না । রতনপুর এখান থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে । এই দুর্যোগের দিনে যগাদা এতদূর রোগী দেখতে গেছিলেন । কিছু সময় সবাই চুপচাপ । চা পকোরা টেবিলে রাখা, কিন্তু আসরের সুরটা কোথায় যেন কেটে গেছে । একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল ।
---" আসলে কি জানো, আজ তিন মাস ধরে চিকিৎসা করছি এখন অবধি রোগটা বুঝতে পারলাম না । একই সিমটমে প্রথমে ওর মেয়েটি মরল, গতমাসে ওর বাবা, আর এবারে বোধহয় ওর বৌটির পালা।"
--- "এমনিতে ওর সমস্যা কি? মানে আপনার ধারণা মতে ওর কি হয়েছে?" ভুদেববাবু নীরবতা ভাঙ্গতে চাইলেন ।
--- " বলার মতো কিছু নেই, শুধু মাথাব্যথা, তাও সবসময় না ।" --- "মানে---"
--- মানে সারাদিন কোন ব্যাথা নেই, একটা নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাথা হয়, তাও ঘন্টা দুয়েক এর জন্য ।"
--- " আশ্চর্য ---" সুদীপ্ত বললে।
--- "আশ্চর্যই বটে, সারাদিন সুস্থ, শুধু ঘড়ি ধরে একটা সময়ে ঘন্টা দুয়েক এর জন্য মাথা ব্যাথা হয়, তারপর আবার সব ঠিক ।"
--- "স্ট্রেঞ্জ ----"
--- " তিনজনেরই কি একই দিন থেকে ব্যাথা শুরু, মানে আমি বলতে চাইছিলাম তাহলে বোঝা যেত কোনো কিছু খাওয়া বা ঐ জাতীয় কিছু থেকে হয়েছে কিনা? ভুদেববাবু রোগের কারণটা বুঝতে চাইছিলেন ।
---" না, প্রথমে ওর মেয়েটি অসুস্থ হল, প্রতি দিন রাত্রি দশটা থেকে বারোটা অবধি মাথা ব্যাথা হত। ঐ সময়ে আমার যতদূর অনুমান আলো সহ্য হয় না, কথা সহ্য হয় না, মনে হয় কেউ যেন হাতুড়ী দিয়ে মাথায় ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে এবং সেই আঘাতের জোর ক্রমশ বাড়তে থাকে, একসময় রক্ত বমি হয় । এরপর কিছু সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে । তারপর সুস্থ ।
--- " শহরে পাঠানো যায় না চিকিৎসার জন্য ?" অসতর্কতায় মুখ ফসকে বলে ফেললাম কথাটা । তাড়াতাড়ি সংশোধন করে বললাম, " অবশ্যই আপনি সেটা ভালো বুঝবেন ।"
যগাদা আমার কথাতে বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হলো না । বললেন, পাঠিয়েছি, ওর মেয়ে আর বাবা দুজনকেই দেখানো হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি ।"
--- "ওরা কি বলছে?"
--- " ওরা কি বলবে, সিটি স্ক্যান হয়েছে, প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল মাইগ্রেন কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তা নয় । আর সবচেয়ে বড় কথা একজন মারা যাওয়ার সাথে সাথে আরো একজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে ।"
--- " মাইগ্রেনের ব্যাথায় বমি হয় শুনেছি, কিন্তু রক্ত বমি হয় আমার জানা নেই ।" আমি বললাম ।
--- " আমারও তাই ধারণা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় একজন থেকে অন্যজনের রোগটা সংক্রমণ হওয়া, সেও একজনের মৃত্যুর পর অন্যজনে, বিষয়টি আমাকে খুব ভাবাচ্ছে ।" বিষয়টা যগাদাকে যে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে সেটা আমরা বুঝতে পারছিলাম ।
--- "আসলে জানো কি ভায়া, চোখের সামনে প্রথমে ওর মেয়েটা তার পর ওর বাপ এখন ওর বৌটা সেই একটা বিচিত্র রঙের কম্বল গায়ে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে, এদৃশ্য চোখে দেখা যায় না ।"
চারদিক অন্ধকার । শুধু ক্রমাগত বৃষ্টির আওয়াজ ।পৃথিবী যেন ভুল করে পাতালে প্রবেশ করেছে । আমরা চুপচাপ বসে আছি, শুধু কতগুলো ব্যাঙ ক্রমাগত বিরক্তিকর চিৎকার করছে । কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করে । মনের ভাবনাগুলো নানা দিশায় ঘুরপাক খাচ্ছিল । মুখ ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না ।

--- " আজকে কি কোন গল্প হবে না দাদু?" লক্ষ্মীর আবদারে আমরাও একটু নড়েচড়ে বসলাম । আসলে এমনিতেই গুমোট আবহাওয়া। বৃষ্টি থামতেই চাইছে না তার উপর ভোলার প্রসঙ্গ আবহাওয়া আরো ভারী করে দিয়েছে । আমরাও যগাদাকে চেপে ধরলাম ।
---" হবে বৈকি, কিসের গল্প শুনতে চাস বল ? "
---" ভুতের ---।" লক্ষ্মী নিমেষে ওর পছন্দ জানিয়ে দিল।
--- " ধ্যাত, আজগুবি সব গল্প---" সুদীপ্তের এসব বিষয়ে প্রচন্ড আপত্তি ।
--- " আহা শোনই নাহয় একদিন, বেচারী যখন শুনতে চেয়েছে ভুতের গল্প ---" ভুদেববাবু সুদীপ্তকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ।
---" আপনি শুনুন, আমি ওসব বিশ্বাস করি না ।"
--- " তুমি কি সত্যিই ভুত বিশ্বাস কর না ?" আমার কেমন আশ্চর্য লাগলো ।
--- " না করি না, ওসব বুজরুকিতে আমার বিশ্বাস নেই ।"
--- " তুমি কি ভগবান বিশ্বাস কর ?" --- আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম ।
--- " করি - - -"
--- " তাহলে ?"
--- " তাহলে কি ?"
--- " ভগবান যদি বিশ্বাস কর তবে ভুত মানতে আপত্তি কিসের ? আলো মানলে অন্ধকার মানতে হবে, সত্য মানলে মিথ্যা, ভগবান মানলে ভূত মানতে হবে । এ নিয়ে মিথ্যা তর্ক করো না । আমিও একসময়ে তোমার মত ছিলাম , এখন সব মানি।" তবে আমার কথায় সুদীপ্ত খুশি হয়েছে বলে মনে হল না । সে তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললে, " সে তোমাদের ব্যাপার, আমি বিশ্বাস করি না এটাই আমার শেষ কথা ।"
--- " কিন্তু কেন ?"
--- " কারণ আমি কখনো নিজের চোখে কখনো ভুত দেখিনি।"
--- " তুমি ভগবান নিজের চোখে দেখেছ?" আমি হয়তো আরো তর্ক করতাম, কিন্তু আমাকে মধ্যখানে থামিয়ে ভুদেব বাবু বললেন, " আমি দেখেছি এবং তাও অনেকবার ।"
--- " আপনি ভুত দেখেছেন?" সুদীপ্ত এর গলায় অবিশ্বাসের সুর।
--- " হ্যাঁ দেখেছি, তবে সরাসরি ভুত নয়, ভুতে পাওয়া লোক ।"
--- "তার মানে আপনি ভুত দেখেননি তাইতো?
---" বোকার মত কথা বলো না সুদীপ্ত ! " ভুদেব বাবু বেশ বিরক্ত হয়েছেন বোঝা গেল ।
পরিবেশ ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে দেখে আমি হালকা করার চেষ্টা নিলাম । বললাম," কোথাকার কথা বলছেন? "
---" কেন আপনার মনে নেই, আমরা দুজনেই তো গেছিলাম একসঙ্গে । বিক্রমপুর বাগানের কালুয়ার নতুন বৌটার কথা মনে নেই ।"

সমস্ত ঘটনাটি এক পলকে মনে পড়ে গেল ।
বললাম, " হ্যাঁ হ্যাঁ সেই লাল গোলাপের কান্ড তো।"
গল্পের আভাস পাওয়া মাত্রই লক্ষ্মীর উৎসাহ ফিরে এল।
বললে, " মেসো আমাদেরকে শোনাও না গল্পটা ।"
--- "আমি এতশত গল্প জানিনা রে, ওসব ভুদেববাবুকে জিজ্ঞেস কর। আমি ওর সাথে গিয়ে যা দেখেছি, সত্যি ভয়াবহ ।"
--- "কোন ঘটনাটি বলছ ? বিক্রমপুর? ওরে বাবা ! সেটা সত্যি সাংঘাতিক কান্ড।" এতক্ষণ যগাদা নিজের ছোট্ট নোটবই এ কিছু একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন । হঠাৎই নোটবই বন্ধ করে আলোচনায় অংশ নিলেন ।

ভুদেববাবু আমাকে ইশারা করায় আমিই বলতে শুরু করলাম, তিনিও সঙ্গ দিলেন । সবাই আরো একবার নড়েচড়ে বসলো ।

সে অনেক বছর আগের কথা । সময়টা শীতকাল । সকালবেলাতেই আমরা খবর পেয়েছিলাম কালুয়ার বৌটাকে ভুতে পেয়েছে । ভুতে পাওয়া কি জিনিস , তার কোন চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা তখন আমাদের ছিল না । পরবর্তীতে অবশ্য আরো দু তিন জায়গাতেই আমাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে । কিন্তু প্রথম দর্শন সত্যি সাংঘাতিক ছিল ।

সকালবেলা প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছি , পথে দেখা ভুদেববাবুর সাথে । জিজ্ঞেস করলেন কোন খবর পেয়েছি কিনা। আমি তখন সবে ঘর থেকে বেরিয়েছি। কাজেই কোন খবর জানার প্রশ্নই উঠে না। তাই তার কাছেই প্রথম জানতে পারলাম কালুয়ার বৌটাকে ভূতে পেয়েছে। আগেরদিন মাঝরাতে প্রাকৃতিক কাজে বাইরে বেরিয়ে ছিল , সেখানেই নাকি ওকে ভুতে পায়। খবরটা আমাদের বিশ্বাস হয়নি। আর না হবারই কথা। ভুদেববাবু জিজ্ঞেস করলেন, " যাবেন নাকি একবার দেখতে?"
কৌতুহল আমার চিরকালই একটু বেশি । বললাম, " আপত্তি নেই ।"

ঠিক হলো সকালের বাজার সেরে যাওয়া যেতে পারে । দিনটি রবিবার ছিল কিনা মনে নেই, তবে কিসের যেন বন্ধ ছিল । কালুয়ার বাড়িটা গ্রামের একবারে শেষ প্রান্তে । বিক্রমপুর বাগানের 10 নম্বর লেবার কলোনি যেখানে শেষ সেখানেই খানিকটা খোলা মাঠের মত জায়গা । তারই পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মতিছড়া নদী। শহরের বাবুদের কাছে নালা মাত্র, গ্রামের মানুষ আদর করে বলে নদী। তবে যে যাই বলুক, মতিছড়াই এই গ্রামের প্রাণ। এই মতিছড়ার পাড়েই গ্রামের শ্মশান ঘাট আবার ভাসান ঘাটও বটে। এই নদীর জলেই গ্রামের সবার স্নান খাওয়া সব। সেই মতিছড়ার পাড়ে গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে কালুয়ার বাড়ি। গ্রামের শেষ প্রান্তে বলেই হয়তো বাড়িতে ঝোপ জঙ্গল একটু বেশি । পেছন দিকের বাড়িতে বট , শিরিষের কোন অভাব নেই। আমরা যখন বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাই তখন আনুমানিক বেলা এগারোটা । দুর থেকে ওর বাড়ির সামনাটা ভীড় আর ভীড় । যত লোক ওদিক থেকে না আসছে তার অনেক বেশি লোক প্রচন্ড কৌতুহলে তার বাড়ির সামনে জড়ো হচ্ছে । ছোট গ্রাম , নিমেষে খবরটা ছড়িয়ে গেছে চারিদিকে ।আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা ধীরে ধীরে এসে হাজির । বাইরে রীতিমত মেলা। সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকটা পান বিড়ি চায়ের দোকান পসরা সাজিয়ে বসে গেছে । তবে মেলার সেই হট্টগোল নেই । কথাবার্তা যা হচ্ছে সবই চাপা স্বরে । সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভূত বলে কথা। তারই ফাঁকে চলছে ব্যবসা । উপস্থিত অনেকেই আমাদের পরিচিত । ভুদেববাবু নিশ্চিত হতে দুই একজনের কাছে খোঁজখবর নিলেন , কিন্তু কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারলে না।কেউ বলছে ভুত আবার কেউ বলছে শাকচুন্নি। কারো বা মতে এসব জিন কিংবা ব্রহ্মদৈত্যের কাজ। মানতেই হবে , কারণ ভুতদের মধ্যেও যে জাতপাতের সমস্যা আছে, এবিষয়তো সবারই জানা। আবার অবিশ্বাসী লোকেও অভাব নেই। তাদের কারো বিশ্বাস বৌটার মাথায় দোষ আগে থেকেই ছিল, লুকিয়ে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এখন পুরনো ব্যামো মাথাচাড়া দিতেই ভুতের দোহাই দেওয়া হচ্ছে । আবার কারো মতে কালুয়াটা ভীষণ লোভী । নতুন বিয়ে করে সোনাদানা যা কিছু হাতিয়ে নেওয়ার সব নিয়ে নিয়েছে । এখন বৌটাকে কিছু খাইয়ে পাগল সাজিয়ে বাপের বাড়ি পাঠানোর ধান্দা । কেউ আবার বলছে বৌটার বিয়ের আগে থেকেই অন্য একটা ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি চলছিল । বাপের বাড়ি জোর করে বিয়ে দিয়েছিল তাই নাটক করে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছে। এমনি নানা মন্তব্য , বিজ্ঞজনের বিবিধ বিশ্লেষণ । মূল জায়গাতে যাওয়ার আগে আমরা নানা জনের মতামতে বিষয় সম্বন্ধে একটা ধারণা নিচ্ছিলাম । এমনি সময় ভেতর বাড়ি থেকে একটা ছোট জনস্রোত নিমেষে বিশাল থেকে বিশালতর আকার নিতে নিতে আমাদের দিকে ছুটে আসতে লাগলো । আর পথে যত রবাহুত ছিলেন সবাই ভয়ে যে যেদিকে দুচোখ যায় ঐদিকেই পালালেন । তারই মধ্যে আমরা শুনতে পারছিলাম কেউ একজন আমাদেরকেও পালাতে বলছেন । আমরা বুঝতে পারছি না কি করব। লোকজনের ছোটাছুটি , সবাই নানাদিকে ছিটকে যাচ্ছে । সে এক বিশ্রী কান্ড । এরই মধ্যে একটা লোক ভীড়ের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেছে । কারো সেদিকে নজর নেই । আমরা হতভম্ব, মুহূর্তে ময়দান ফাঁকা। বাড়ির সামনে থেকে লোকজন নিরাপদ দূরত্বেে পালিয়ে গেছে । দূর থেকে দেখে পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাইছে সবাই। হঠাৎ করে ভয় পাওয়ার মত কি ঘটে গেল বোঝা গেল না । মিনিট ক্ষাণিক পর সব কিছু শান্ত হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ভুত নাকি তাড়া করেছিল । যত দেখছি তত কৌতুহলের পারদ চড়ছে । ভুদেববাবু বললেন, " চলুন কাছে থেকে দেখি ব্যাপারটা কি? "
দুপা এগিয়েছি মাত্র, একটা অদ্ভুত পোষাকের লোক গায়ে বিচিত্র রঙের আলখাল্লা পরে হনহন করে বেরিয়ে আসছে বাড়ির ভিতর থেকে । লোকটার গলায় অজস্র পুতির মালা, কাঁধে একটা কাপড়ের থলি । তাতে অজানা অনেক বস্তু, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। শুধু দুএকটা হাড়ের টুকরো দেখা যাচ্ছে ।হাতে ঝাড়ু জাতীয় কিছু একটা নিয়ে লোকটা আমাদের দিকেই আসছিল।।লোকটাকে দেখে আমার খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছিল না । বেশভূষাই বলে দিচ্ছে লোকটা তুকতাক করে খেয়ে বেঁচে আছে । ভুদেববাবু লোকটাকে আগে থেকেই চিনতেন বোঝা গেলো । কাছে আসতে জিজ্ঞেস করলেন, " কি হে ওঝা, কাজ হয়েছে তো ?"
স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ভুদেববাবুর একটা আলাদা পরিচিতি আছে । গ্রামের সবাই একডাকে চেনে। দেখলাম ওই ওঝাটাও ভুদেববাবুকে চেনে। বেশ বিজ্ঞের মত কাঁধ নাড়িয়ে বললে, " না স্যার, ওকে বড়টিতে. ধরেছে। ও আমার কর্ম নয়।"
বড়টি যে কে বুঝতে পারলাম না । ভুদেববাবুর দিকে তাঁকাতেই উনি আমাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললেন । লোকটা তার পাণ্ডিত্য দেখাতে নিজে থেকেই বললো , " কেসটা জন্ডিস স্যার , ভেবেছিলাম এমনি কোন আত্মা টাত্মা হবে । কিন্তু যা বুঝলাম, তাতে নির্ঘাত বড়টি মানে কোন ব্রহ্মদৈত্য ।"
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম বড়টি কে। কিন্তু লোকটার বক্তব্য আর অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিতে হাসি আটকানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল । আমি আর চুপচাপ থাকতে পারলাম না ।অতিকষ্টে হাসি সামলে জিজ্ঞেস করলাম, " আপনি কি করে বুঝতে পারলেন যে এটা ব্রহ্মদৈত্যের কাজ ?
--- " এ আমার গুরুর আশীর্বাদ স্যার ।" আমার প্রশ্নে লোকটা বেশ গর্বের সাথে গদগদ হয়ে উত্তর দিল ।
বললাম, " বুঝলাম না ।"
--- " আপনাদের আশীর্বাদে এসব আমার কাছে জলভাত স্যার ।"
--- " আমাদের নয় , বলুন আপনার গুরুর আশীর্বাদ ।" আমি ওকে শুধরে দিলাম।
--- "ওই হলো স্যার, আমি ঘরে পা দিয়েই বলে দিতে পারি কার আত্মা কার উপর ভর করেছে, কোনটি শরীরী কোনটি অশরীরী; সব বলে দিতে পারি ।"
--- " আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, "তাই ?"
--- " ঠিকই বলেছে , এই ব্যাপারে ওর খুব নাম ডাক আছে ।" -ভুদেববাবু ওকে শুনিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করলেন।
ভুদেববাবুর সমর্থনে লোকটার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল । বলল, " মাইরি বলছি , স্যার সব জানেন, এসবই আমার বাহাতের কাজ ।"
--- " তাহলে এখানে পারলেন না কেন? "
আমার প্রশ্নে লোকটা বেলুনের মত চুপসে গেল । যতটা সম্ভব জিভ বের করে বলল, " ওটা আমার কর্ম নয় স্যার, ওর জন্য আরো অনেক ক্ষমতা দরকার । পঞ্চমুন্ডির সাধনা ছাড়া ওকে বশে আনা মুশকিল ।"
--- " পঞ্চমুন্ডির সাধনা? এটা আবার কি ?
-ভুদেববাবু পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে ততক্ষণাৎ আমাকে বললেন , "আমি জানি, পরে আপনাকে বুঝিয়ে দেবো ।" উনি চাইছিলেন না আলোচনা দীর্ঘায়িত হোক।
--" এটা এক কঠিন সাধনা স্যার, কুমারী মেয়ের শবের উপর পাঁচটি নরমুন্ডি নিয়ে দিগম্বর সাধনা ।" লোকটাই আলোচনার খেই ধরিয়ে দিলে।
--- "কিন্তু এটাকে আরো কি যেন বলা হয়? "
--- " না স্যার, এটাকেই পঞ্চমুন্ডির সাধনা বলে স্যার
।" এবারে ভুদেববাবু আর কোন ঝুকি নিলেন না। সোজা ইশারায় আমাকে থামিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন , " আচ্ছা হঠাৎ ওকেই কেন ব্রহ্মদৈত্য ধরতে গেল কিছু বুঝতে পারলে কি?"
--- " ধরবে না স্যার ? রাতে কাউকে ফুল তুলতে শুনেছেন ? একে অমাবস্যা রাত তার উপর শিরিষ গাছের নিচে গেছে প্রকৃতির ডাকে । সেও বসবি তো বস একেবারে ব্রহ্মদৈত্যের ছায়ার উপর । ব্যস আর যাই কোথা, সঙ্গে সঙ্গে চেপে বসল ঘাড়ে ।"
--- " বুঝলাম না--"। আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিলাম না ।
--- " কি স্যার ?"
--- " ঐ ব্রহ্মদৈত্যের সাথে ফুলের সম্পর্কটা---"
--- " ওটাই তো আসল স্যার । ব্রহ্মদৈত্যটাই রাতে ওকে দিয়ে সাদা গোলাপ ফুলটি তুলিয়েছে। এখন এই সাদা গোলাপটি ধীরে ধীরে লাল হয়ে যাবে ।আর যখন টকটকে লাল হয়ে যাবে তখনই কালুয়ার বৌটার আয়ু শেষ ।"
জিভের প্রান্তে রাগে ক্ষোভে প্রচন্ড একটা জ্বালা করছিল। ভন্ডামিতেও একটা সীমা থাকা প্রয়োজন । বহু যত্নেও ঠোট দুটো বন্ধ রাখতে পারলাম না । মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, " যত সব বুজরুকি !"
আমার কথাতে লোকটা আহত হয়েছে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না । রাতের অন্ধকারে কত লোকই প্রাকৃতিক কাজে বাইরে যায়, কোথাওতো তাদের কিছু হয়েছে বলে শোনা যায়নি । লোকটা এতটাই ঠগ যে একদিকে বলছে ভুত আবার বলছে তার ছায়া, অদ্ভুত কথাবার্তা । যার কোন কায়া নেই , তার সে ছায়া কল্পনা করছে। সেও অমাবস্যার অন্ধকার রাতে । এই সব অযৌক্তিক কথাবার্তাকে বুজরুকি ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে । প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবো ভাবছি, লোকটা পেছন থেকে আমাকে ডেকে বলল, " স্যার আমার কথাগুলো আপনার বিশ্বাস হলো না, তাই না স্যার । "
বললাম, " না এধরনের গাঁজাখুরি গল্পে আমি কোনদিনই বিশ্বাস করি না ।"
--- " এখানেই আপনাদের সমস্যা স্যার, সব কিছু বিচার না করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান ।"
--- " তাই বুঝি ? আমাকে তাহলে এখন বিচার বিবেচনা শিকেয় তুলে আপনার গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করতে বলছেন।"
আমার কথায় লোকটা ভেতরে ভেতরে ভীষণ রেগে গেছে বুঝতে পারলাম । অনেকক্ষণ আমার চোখে চোখ রেখে বহু কষ্টে রাগ সামলে বললে, " আপনি তন্ত্র মন্ত্র, ভুত প্রেতে বিশ্বাস রাখেন কি ?"
-- " আমি কোন গাঁজাখুরিতেই বিশ্বাস করি না ।" আমারও ক্রমশ স্পষ্ট বলার জেদ চেপে যাচ্ছে ।
--- " তার মানে আপনি ভুত প্রেতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।"
--- " না একদমই না ।" ভুদেববাবু কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, আমি তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলাম ।
--- "তাহলে এখানে এসেছেন কেন? "
--- " তামাশা দেখতে । আপনার আপত্তি আছে? "
--- " " আপনি জানেন না স্যার তন্ত্র মন্ত্রের কি শক্তি তাই তামাশা বলছেন ।"
এতক্ষণ যাবৎ দেখা লোকটা নিমেষে পাল্টে যেতে লাগল । এতক্ষণ যাকে গেঁয়ো ঠগ মনে হচ্ছিল তার গলায় সেকি কঠিন শীতল আওয়াজ , বুকের রক্ত নিমেষে শুষে নিতে চায়। তবু আমি বুকে সাহস এনে বললাম, "তাই বুঝি ? তাহলে আজ আপনার তন্ত্র মন্ত্র ব্যর্থ কেন ?"
-- " যার যতটুকু ক্ষমতা স্যার । আপনাকে আগেই বলেছি, এটা আমার ক্ষমতার বাইরে, নইলে এই বাসুদেব ওঝা বসে থাকার পাত্র নয় জেনে রাখবেন । এসব কাজে জীবনের ঝুঁকি আছে স্যার । কারো ভালো করতে গিয়ে ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে ।"

আমাদের আলোচনা চলাকালীন বেশ কিছু লোক আমাদের ঘিরে জড়ো হয়ে গেছে । আমাদের আলোচনা শুনছিল, আমরা লক্ষ্য করিনি। হঠাৎই ভীড়ের মধ্যে কেউ বলে উঠলো , " ঐ যে সদানন্দ ওঝা, এসে গেছেন। "
নিমেষে সবার দৃষ্টি বড় রাস্তার উপর চলে গেল । একজন মাঝবয়সী সুপুরুষ, টানটান শরীর, সাধারণ পোষাক অথচ দৃষ্টি আকর্ষণ করা ব্যক্তিত্ব , সোজা কালুয়ার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন । পথে সবাই সম্ভ্রমে সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিচ্ছিল । চোখ দু1টো লোকটার আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে । যেন চাইলেই পৃথিবীটা ভস্ম করে দিতে পার।

গল্পটা বেশ জমে এসেছিল, যগাদা হঠাৎই থামিয়ে দিয়ে বললেন, " দাঁড়াও হে , তোমাদের গল্পটা এখানেই শেষ । আর এগুনো যাবে না , আমাকে আর সুদীপ্তকে একটু বেরতে হবে ।"
--- " হঠাৎ ---?" সুদীপ্ত আঁতকে ওঠলো।
--- " একটু কাজ আছে । "
--- " এই বৃষ্টিতে? তাও এই জমজমাট আড্ডা ছেড়ে ?"
--- " তাতে কি , তোমার তো এইসব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাসই নেই। তারচেয়ে চলো এককাপ চা খেয়ে আসি।
সবাই একযোগে হেসে ওঠলো। নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে সুদীপ্ত । ও বুঝতে পারে নি , যগাদা ওকে টার্গেট করবেন। লজ্জা পেয়ে কি উত্তর দেবে ঠিক করতে পারছিল না । পরমুহুর্তেই আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলল, " তা এককাপ চা হলে মন্দ হতো না লক্ষ্মী ।"
আমাদের সবার দৃষ্টি একসাথে লক্ষ্মীর উপর পরলো। বেচারী লক্ষ্মী, এই টানটান গল্প ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না, কিন্তু যগাদা চা খেতে চাইছেন, না গিয়ে উপায় নেই । আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলাম। বললাম, " নিশ্চিন্তে যা , তুই না এলে গল্প শুরু হবে না।"

আমাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে লক্ষ্মী চা তৈরি করতে চলে গেল । পেছনে পেছনে সবিতাও ওঠে গেল ওকে গাইড করত । সবিতা সঙ্গে গেলে চায়ের সাথের 'টা' টা ভালো হয়। ও প্রায়শঃই খাবর দাবার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকে । আর আমরা গিনিপিগেরা এই পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল আস্বাদন করে ধন্য হই। তবে সত্যি বলতে বাধা নেই, আধিকাংশ দিনই সেই খাবারটা প্রশংসনীয় হয়। আজও সেই আশায় আমরা অপেক্ষা করছি, তারই মাঝে দুই একটা টুকটাক কথা বার্তা চলছে। ঘুরে ফিরে আবারো ভোলার বউটার প্রসঙ্গ এলো । যগাদার দুশ্চিন্তা আমাদেরও প্রভাবিত করে দিয়েছে । ভুদেববাবুই নীরবতা ভেঙ্গে যগাদাকে প্রশ্ন করলেন, "ভোলার বিষয়টা একটু আমাদেরও খুলে বলুন না যগাদা , খানিকটা আমরা লোকমুখে শুনছি বটে তবে সবটা জানি না।"
--- " বলার মতো তেমন কিছু তো নেই। "
---" তবু ---" আমি বললাম।
--- " ভোলা বা তার পরিবার আমার অনেক পুরনো রোগী । কিছু একটা হলেই ওরা আমার কাছে ছুটে আসে। আমিও যথাসম্ভব চিকিৎসা করি, চেষ্টা করি সুস্থ রাখতে ।" যগাদা বলতে শুরু করলেন । রান্নাঘর থেকে কিছু একটা ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে । যগাদা বলছেন, আমরা শ্রোতা ।

আজ থেকে প্রায় তিন মাস আগে রাত আনুমানিক বারোটা নাগাদ হঠাৎই একদিন ভোলা আমার বাড়িতে এসে হাজির । আমার যতদূর মনে পড়ে দিনটি ছিল মহালয়ার ঠিক আগের দিন। আমি তখন সবে ঘুমিয়েছি, চোখটা লেগেছে মাত্র, এমনি সময়ে বাইরের হাঁকডাকে দরজা খুলে দেখি ভোলাটা কাঁদোকাঁদো হয়ে হাত জোর করে দরজায় দাঁড়িয়ে । আমি দরজা খুলতেই কেঁদে বললে, " ডাক্তারবাবু আপনাকে এক্ষুনি আমার সাথে একবার যেতে হবে।"
জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, বললে মাথা ব্যাথা ।
--- " কার ?"
--- " আমার মেয়েটার ডাক্তারবাবু । "
মাথা ব্যাথায় এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই । জিজ্ঞেস করলাম," আরো কিছু ?"
-- " না শুধুই মাথা ব্যাথা ---"
--- " কখন থেকে ?"
-- এই ঘন্টা দুয়েক আগে থেকে ---" ভোলাটা উত্তর দিল।
--- "হঠাৎ কেন মাথা ব্যাথা হলো, গ্যাস ট্যাগ হয়নি তো ?"
-- " জানি না ডাক্তারবাবু, সকালে নগরে গিয়েছিলাম মেয়েকে নিয়ে , কিছু টুকটাক জিনিস কিনতে, ফিরে এসেও সুস্থ ছিল । রাতে খাওয়া দাওয়ার পর নতুন একটা কম্বল কিনেছিলাম, সেইটা গায়ে চেপে শুয়ে আছে । হঠাৎই মাথা ব্যাথায় ককিঁয়ে উঠলো ।" নগর হচ্ছে ওদের কাছে নিকটবর্তী বড় শহর । কেউ কেউ আবার সদর বলে থাকে । এক্ষেত্রে ওরা নগর বলতে শহর শিলচর কে বোঝাচ্ছে, আমি সেটা জানতাম । জিজ্ঞেস করলাম, -- " খাওয়া দাওয়া কি করেছিল ?"
--- " তেমন কিছু না । নগরে গিয়ে পরোটা ঘুগনি, রাতে বাড়িতে ভাত আর হাঁসের মাংস । মেয়েটা অনেকদিন থেকে খেতে চাইছিল । "
বুঝলাম গ্যাস হয়েছে। ওষুধ দিয়ে দিলাম, বললাম, " যদি না কমে কাল সকালে একবার আসিস , যাবোখন।"

পরদিন যথারীতি কাজের মধ্যেই দিনটা কেটে গেছে । সকালবেলায় মহালয়ার অনুষ্ঠান ছিল, অন্য কোথাও যাওয়ার উপায়ই ছিল না। মেয়েটির কথা একবার মনে পড়ছিল বটে, কিন্তু নানা কারণে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি । ভোলাও কিছু জানায়নি, তাই ভেবেছিলাম বোধহয় সুস্থ হয়ে গেছে ।
সেদিনও রাতে খাবার খেয়ে সবে শুয়েছি, ভোলা এসে উপস্থিত । কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করায় বলল মাথাব্যথা । খুব রাগ হল, সারাদিন কাটিয়ে এখন ওর মনে পড়ছে । বললাম, " সারাদিন কোথায় ছিলি ?"
--- " কেন, বাজারে ---"
--- " দিনের বেলা আসতে পারলি না? " আমি বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম ।
--- " তখনতো সুস্থ ছিল ডাক্তারবাবু ।"
তার মানে গতকালের আমার ওষুধে কাজ হয়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে । বললাম, " কালকের ওষধটা কয়েকদিন নিয়ম করে খাওয়াতে হবে । চিন্তা করিস না, ঠিক হয়ে যাবে ।"
ভেবেছিলাম কাজ হবে, কিন্তু হলো না । পরদিনও সেই রাতের বেলায় ভোলা এসে হাজির । এবারে আমাকেও কিছুটা ভাবনায় ফেলে দিল। কোথাও ভুল হচ্ছে নাতো। বললাম, " চল , দেখে আসি তোর মেয়েকে ।"

আমরা যখন ভোলার বাড়িতে পৌঁছেছি , ঘড়িতে তখন একটা বাজতে চলছে । ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করা। আমাদের আওয়াজ পেয়ে ভোলার বউটা এসে দরজা খুলে দিল । ঘরের ভেতর লন্ঠনের আলোতে যতটুকু দেখা যায় তাতে দেখলাম ওর মেয়েটি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । মৃদু আলোতেও ওর মেয়ের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম । নিষ্পাপ মুখে কোথাও কোন যন্ত্রণার ছাপ নেই । দিব্যি ঘুমিয়ে আছে । গায়ে একটা কম্বল জড়ানো । শরতের রাত, হাল্কা ঠান্ডা আছে । তবে এখন কম্বল ব্যবহার করার মত ঠান্ডা পড়েনি। চাদরেই চলে যায়। জিজ্ঞেস করলাম, " কিরে ওর কি খুব শীত শীত ভাব হয় ? "

--- " ওসব কিছু নয় ডাক্তারবাবু, কম্বলটা কেনার পর থেকে রোজ ওই কম্বলটা ওর চাই। "
একবার মেয়েটির হাতের তালু পায়ের নিচে হাত দিয়ে দেখে নিলাম ঠান্ডা কিনা। দেখলাম ঠিকই আছে । সবই যখন ঠিক আছে, তখন নতুন করে ডাক্তারী কিছু করার প্রয়োজন হলো না । কম্বলটা সুন্দর। ঝকঝকে রঙ, দামীও বটে । অন্তত ওদের মত আর্থিক সঙ্গতি থাকা পরিবারের পক্ষে অনেকটাই দামী। জিজ্ঞেস করলাম, " কিরে নতুন কিনেছিস বুঝি ?"
--- " হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, এইতো সেদিন নগর থেকে কিনেছি। ফুটপাথে নিয়ে বসেছিল, মেয়ের পছন্দ হয়ে গেল, তাই নিয়ে নিলাম । দামও খুব বেশি নেয়নি । --- "কত নিল ?"
--- " মাত্র একশ পঁচিশ টাকা ।"
--- " মাত্র একশ পঁচিশ ! তাহলে তো অনেক সস্তা, সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস নাতো?"
--- " জানি না. দেখে তো নতুনই লাগলো ।"
যাকগে আমি আর কথা বাড়ালাম না । ভোলাটা ফিস দিতে চাইছিল, আমি নিলাম না । কিছুই তো করিনি , তবে মিছিমিছি ফিস নেওয়া কেন। অবশ্য রাতের ঘুমটা আমার বরবাদ হয়ে গেলো। ওদের সাথে দুচার কথা বলে বিদায় নিলাম । আসার সময়ে আমরা দুজন ছিলাম, ফেরার পথে আমি একা। আমার অবশ্য এভাবে রাতে চলাফেরার অভ্যাস আছে ।

পূজার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি । পরিষ্কার আকাশে একা একফালি চাঁদ । নির্জন রাতে আমার মতই সে একা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে । দূরের ঝোপ ঝাড় থেকে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডানা নাড়ার শব্দ ভেসে আসছে । কান পেতে থাকলে মনে হবে শব্দটা ধীরে ধীরে বিকট থেকে বিকটতর হয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিবে। একা একা সাইকেল চালিয়ে ফিরছি, শরতের রাত, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব আছে । মন্দ লাগছিল না ।শুধু কেন যেন মনে হয়েছিল আমার পেছনে পেছনে কেউ যেন আমাকে এগিয়ে দিতে চাইছে । গা'টা বিনা কারণেই ছমছম করছিল। কয়েকবার পেছন ফিরে দেখেছি, কেউ সত্যি সত্যি আসছে কিনা , কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি । অবশ্য সবটাই আমার মনের ভুল হতে পারে । বাড়িতে যখন ফিরলাম ঘড়িতে তখন আড়াইটা বাজে।

এরপর কিছুদিন ভোলা আর আসেনি। হয়তো একটা আড়ষ্টতা ছিল, এত রাতে নিয়ে যাওয়া সত্বেও আমি কোন ফিস নেই নি, কিংবা অন্য কোন কারণও থাকতে পারে । মধ্যে একদিন দেখা হয়েছিল, জিজ্ঞেস করাতে বলল একই রকম আছে । রোজই রাতে ব্যাথা হয়, ঘন্টা দুয়েক থাকে তারপর আপনা আপনি কমে যায়। ইদানিং নতুন উপসর্গ সুরু হয়েছে । ব্যাথা বাড়তে বাড়তে বমি হতে থাকে । আমি ওকে শহরে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেই। এছাড়া আমার এর বেশি কিছু করারো ছিল না। অবশ্য তারপর আমিও কিছুদিন আর বিশেষ গা লাগাইনি । পূজার ঝামেলা, তারই মধ্যে রোগীদের নানান সমস্যায় দিনগুলি খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যাচ্ছিল । ভোলার মেয়েটির খবর নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে নি । তাছাড়া ওর আমার এখানে আসা কমে যাওয়ায়, আমি ধরে নিয়েছিলাম নিশ্চয়ই সে অন্য কোন ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে । কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে প্রায় কুড়ি পঁচিশ দিন পর আবারো এক রাতে ভোলা এসে হাজির । যথারীতি সেদিনও ঘড়িতে তখন সাথে এগারোটার একটু বেশি । আমাকে দেখে ভোলা দুইপা জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে বললে, " ডাক্তারবাবু আমার মেয়েটাকে বাঁচান ।"
--- " আবার কি হলো ?" আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
--- " মেয়েটা রক্ত বমি করছে, ওকে বাঁচান ডাক্তারবাবু ।"
--- " হঠাৎই রক্ত বমি ?"
--- " ঐ মাথা যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে এখন রক্ত বমি শুরু হয়েছে ।"
তাড়াতাড়ি একটা শার্ট গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভোলার সঙ্গে । রোগের লক্ষণ আমার খুব ভালো লাগল না । পথে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, " এতদিন কি করলি ? শহরের ডাক্তার দেখিয়েছিল তো ?"
আমার প্রশ্নেে ভোলা কোন উত্তর দিল না । চুপ করে থাকল । আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, " কিরে শহরের ডাক্তারবাবু কি বললেন ?"
ভোলা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো । বললো , " ভুল হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু , আর কক্ষনো এমন ভুল হবে না --"
আমি ভাবলাম হয়তো পয়সার অভাবে সবটা ওষুধ খাওয়াতে পারে নি । তবু জিজ্ঞেস করলাম, "কি ভুল করেছিস ?"
---" শহরের ডাক্তার দেখানো হইনি ---"
আমি চমকে উঠলাম । -- "এতদিন ধরে মেয়েটি কষ্ট পাচ্ছে, একজন ভালো ডাক্তার দেখানোর বন্দোবস্ত করতে পারিস নি।"
--- " ভুল হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু--"
আমার প্রচন্ড রাগ উঠছিল। বললাম, " সে নাহয় বোঝা গেল, তাই বলে এতদিন মেয়েটাকে বিনা চিকিৎসায় রেখে দিলি। আমার কাছেও তো আনতে পারতে। "
ভোলা কোন উত্তর দিল না । আমি আবারো প্রশ্ন করায় আস্তে করে বলল, " ঝাড়ফুঁক --সবাই বললে উপরি দোষে পেয়েছে, তাই ----"
মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো । কিন্তু কিছুই করার নেই । গ্রাম দেশে এই এক সমস্যা, চট করে ঝাড়ফুঁকে চলে যায়। বললাম, " এখন আমার কাছে কেন এসেছিস , ওখানেই যা ।"
মুখে বললাম বটে কিন্তু কার্যত আমি সাইকেলে চেপে ওর সাথেই রওয়ানা হলাম । এছাড়া আমার করার কি আছে। এই বিপদে তো ওকে নিরাশ করা যায় না। আমার বাড়ি থেকে ওর বাড়িতে যেতে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগে। যখন গিয়ে পৌঁছেছি ততক্ষণে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । এই মুহূর্তে কোন যন্ত্রণা আছে বলে মনে হল না । ভোলার বউটা আমাকে মেয়ের বমি দেখালো। দেখলাম টাটকা অনেকটা রক্ত । জিজ্ঞেস করলাম, " কতদিন থেকে রক্ত বমি হচ্ছে ?"
-- " আজকে দুই তিনদিন হলো , তবে গত দুই দিন অল্প ছিল, আজকেই প্রথম অনেকটা হয়েছে।"
-- "কতদিন ধরে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে মনে আছে ?"
হিসাব করে বলল উনত্রিশ দিন । আমি আর কোন ঝুকি নিলাম না । পকেটে থেকে পাঁচশো টাকা হাতে গুঁজে বললাম, " কাল সকাল হলেই মেয়েকে নিয়ে সোজা সদরে চলে যাবি। প্রয়োজনে দুই একদিন থেকে ভালো করে চিকিৎসা করাও । টাকা পয়সার দরকার হলে আমাকে বলিস। ভয়ের কিছু নেই, ভালো করে চিকিৎসা হলে সুস্থ হয়ে যাবে ।"
মুখে বললাম বটে ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু মনে মনে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না । রক্ত বমিটা আমার খুব ভাল লক্ষণ মনে হলো না । একবার ভেবেছিলাম মেয়েটিকে ঘুম থেকে তুলে গলার ভেতরটা দেখে নিই , তারপর ভাবলাম প্রয়োজন নেই । শুধু শুধু খুঁচিয়ে কি হবে । তারচেয়ে শহরের বড় ডাক্তাররা যা ভাল বুঝবেন তাই করবেন ।

যাইহোক ভোলাকে যথাযত পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিলাম । রাস্তায় নামতেই গত দিনের কথা মনে পড়ে গেল । সেদিন কিছুই ছিল না তবুও কেমন একটা গা ছমছম ভাব ছিল । মনে পড়তেই শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে গেল। আজও তেমন অভিজ্ঞতা হবে না তো । ঈশ্বরেরে নাম স্মরণ করে সাইকেলের পেডেলে চাপা দিলাম ।

শীতের রাতে গ্রামাঞ্চলে খুব কুয়াশা হয়। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি , কুয়াশার জন্য বেশি দুর অবধি রাস্তা দেখা যায় না । জন মানব শূন্য পথে আমি চলেছি একা , চারপাশে কোন বসতবাড়ি নেই , শুধুই ঘন ঝোপ ঝাড় আর ধুধু মাঠ । রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই । একটা পেঁচা কর্কশ আওয়াজ তুলে এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল । ঝিঁঝি পোকার বিরক্তিকর শব্দ রাতের অন্ধকারে ভয় জাগিয়ে দেয়। অন্য সময় এসব জায়গায় জোনাকি পোকার মেলা বসে । আজ এই শীতের রাতে তারাও কোথাও লুকিয়ে আছে বোঝার উপায় নেই । আমি একমনে সাইকেল চালাচ্ছি, হঠাৎই মনে হলো কেউ যেন আমার পেছন পেছন আমাকে অনুসরণ করে আসছে । পিছন ফিরে তাকাতেই লক্ষ করলাম একটা লোক টর্চ লাইট হাতে আমাকে টপকে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । এসব রাস্তায় সাধারণত পথচারীরা পথ চলতে সব সময়ই কুশল বিনিময় করেন, কিন্তু এই লোকটা কেমন যেন । একটা কথা না বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল । আমি জিজ্ঞেসও করলাম, " কোন গায়েতে বাড়ি ?"
কিন্তু লোকটা কোন উত্তর দিল না । নীরবে এগিয়ে যেতে থাকলো। কিন্তু তার প্রচন্ড গতি। ভাবলাম হয়তো লোকটা কোন কারণে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে, পাশে গিয়ে কথা বললে নিশ্চয়ই কথা বলবে। আমি চেষ্টা নিলাম লোকটার সাথে চলতে। কিন্তু আমি যতই চেষ্টা করছি ওকে ধরতে , লোকটা ঠিক ততটাই গতিতে দুরত্ব বজায় রেখে চলছে। আমার ভেতরে রোখ চেপে গেল। আমি যত গতি বাড়াই লোকটা ততই গতি বাড়াচ্ছে । আমি আরো গতি বাড়াই । এভাবে কতক্ষণ চলছে মনে নেই, একটা সময়ে মনে হলো আমি আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে । লোকটা যেন হঠাৎই শুন্যে মিলিয়ে গেছে। আমি হতবাক । একটা ভয় আবার একটা অবিশ্বাস আমাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল । বারবার মনে হচ্ছিল আমি কি সত্যি দেখেছি লোকটাকে নাকি মনের ভুল । যদি দেখে থাকি তাহলে লোকটা গেল কোথায়। আর সেই পায়ে হাঁটা লোকটাকেই বা কেন আমি সাইকেলে চালিয়ে ধরতে পারলাম না । আবার যদি না দেখে থাকি তবে কার সাথে এতটা পথ ছুটলাম । একটা দ্বন্দ্ব, একটা অবিশ্বাস একটা ভয় । কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ঘরে পৌঁছলাম । সেদিন রাতে প্রচন্ড জ্বর এলো , দুদিন কিছু বলতে পারি না । বিছানায় শুয়ে থেকেই খবর পেয়েছিলাম, ভোলা তার মেয়েকে নিয়ে পরদিনই সদরে গিয়েছিল । কিন্তু ভালো করে চিকিৎসা আরম্ভ হওয়ার আগেই ঐরাতে মেয়েটি মারা যায়। "

যগাদা গল্প বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গেলেন । হয়তো আনমনে ভোলার কথাই ভাবছেন । সবাই চুপচাপ, ওদিকে রান্নাঘর থেকে খাবারের গন্ধ আসছে । আমরা সবিতার অপেক্ষা করছি সবিতার হাতে জাদুকাঠি আছে । যা কিছু রান্না করে সেটাই অমৃত হয়ে যায়। কখনো কখনো মনে হয়, শুধু এই একটা কারণেই সবিতাকে সাত জন্মের জন্য স্ত্রী হিসেবে কামনা করা যায়। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এ আবার কেমনতর মধ্যযুগীয় কথা। কিন্তু আমি লোকটাই এমন, সবিতাও জানে। আমাদের আড্ডাটি আমার বাড়িতে স্থানান্তরিত হওয়ার পেছনেও সবিতার সেই জাদু হাতের কারসাজি আছে । ভুদেববাবু, সুদীপ্ত সবাই সবিতার রান্নার ভক্ত । যগাদার কথাতো বলে লাভ নেই ।
আমাদের আড্ডাটি আজ জমে উঠেছে । সবিতার রান্নাঘর থেকে গরম গরম ঘিয়ে ভাজা সুজি আর চা নিয়ে লক্ষ্মী হাজির , পেছনে পেছনে সবিতাও এসে উপস্থিত । দুর থেকে খাবারের ট্রে দেখেই যগাদা ভোলার প্রসঙ্গ থেকে খাওয়ার প্রসঙ্গে চলে গেলেন । বললেন , " বুঝলে ভায়া, এখন মনে হয় বিয়ে না করে ভালই করেছি। "
--- " হঠাৎ এই উপলব্ধি ?"
--- " আহা , এরকম একটা বোন যার আছে, সেকি বৌ এর রান্নায় ভুলতে পারে?" যগাদা বাঁকা চোখে একবার সবিতাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন ।
---" তাই বুঝি? আর বাহানা দিতে হবে না । গল্পটা শেষ করুন, আমাদের অনেক কাজ আছে ।" সবিতা কপট রাগ দেখিয়ে বললো।
-- "রাগ করছো কেন, তোমার রান্না তো সত্যি খুব ভালো । তবে তোমার স্বামীটা খুব কিপটে ।"
--- "আমি আবার কি করলাম ।"
--- "কেন সেই কবে ইলিশ মাছ দিয়ে বাঁঁশের তরকারি খেয়েছিলাম, ভুলেই গেছি।" যগাদা গম্ভীর হয়ে বললেন ।
সবাই যগাদার কথায় হেসে উঠলো। খাওয়ার কথা উঠলে যগাদা খুব আনন্দ পান। নানা জায়গার নানা ধরনের খাবার, কেমন তাদের স্বাদ, কি করে বানাতে হয় এসব ব্যাপারে যগাদার ভীষণ আগ্রহ । আজও খাবার আসতেই আলোচনার মোড় ঘুরে গেছে । খাওয়া নিয়েই চলছে টুকটাক কথা বার্তা । যগাদাই মুল বক্তা , মধ্যে মধ্যে সবিতাকে রান্নার রেসিপি নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। বাঁশের করইল দিয়ে কি করে মাংস রাঁধতে হয়, কিংবা ঢেড়শের ভিতর সীদলের স্টাফ দিয়ে বড়া। পাশাপাশি চলছে সুজি আর চায়ের স্বাদ আস্বাদন ।

এরই মধ্যে সুদীপ্ত তার সুজির প্লেটটা টেবিলে রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, " যগাদা আপনি কিন্তু লাইন ছেড়ে দিয়েছেন।"
-- " বল কিহে, আমি তো লাইনেই আছি। খাচ্ছি আর গুণ গাইছি।"
-- " আহা সে লাইন নয় ---"
--- " তবে --?"
--- " আপনি কিন্তু ভোলার অসুখ নিয়ে কথা বলছিলেন।" সুদীপ্ত যগাদাকে খেই ধরিয়ে দেয়।
--- " হ্যাঁ বললাম তো , শিলচর মেডিক্যাল কলেজে প্রথমে নিতেই চাইছিল না । কারণ দিনে বেলাতে মেয়েটার কোন মাথাব্যথা থাকে না । এদিকেে কোনো উপসর্গ নেই, কি করে রোগী ভর্তি করবে তারা। তারপর আমার প্রেসক্রিপশন দেখে শেষ অবধি একরাতের জন্য অবজারভেশনে রাখে। কিন্তু সে রাতেই ভোলার মেয়েটি হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।"--- " সেতো বললেন, কিন্তু ওর বাবা ---"
--- " ওর বাবাও সেই একই রোগে মারা গেছে । আমার কাছে এসেছিল । আমি ওর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করি।"
--- " তারপর --- ?"
--- " তারপর আর কি যথারীতি একমাস কষ্ট পেয়ে এই বেটাও মারা যায়।"
--- " এরও কোন চিকিৎসা হয়নি বলতে চাইছেন ?"
--- " চিকিৎসা হয়নি তো আমি বলিনি। চিকিৎসা হয়েছে , তবে শহরে । আমি কিছু করিনি ।" যগাদা সুদীপ্তের প্রশ্নের উত্তর দিলেন ।
--- " আহা একটু বিস্তারিত বলুন না , অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।" সুদীপ্তকে বেশ অধৈর্য লাগছিল ।
--- " না আগে আমাদের গল্পটা শেষ হোক তারপর অন্য গল্প।" আলোচনার বিষয়বস্তু পাল্টে যাচ্ছে দেখে লক্ষ্মী বায়না ধরলো।

--- " যগাদা লক্ষ্মীকে গুরুত্ব না দিয়ে সুদীপ্তকে বললেন, " দ্যাখো, এতে বিস্তারিত বলে কিছু নেই । ওর বাবার চিকিৎসা মুলত বাইরেই হয়েছে। প্রথমে শিলচর পরে গৌহাটিতে । অনেক টাকা খরচ হয়েছে । মাঝে দুবার এসেছিল , টাকা পয়সার ব্যবস্থা করতে। অনেকেই সাহায্য করেছেন, আমিও হাজার দশেক টাকা গুঁজে দিয়েছি । কিন্তু তারপরও বাড়ির একটা অংশ বিক্রী করতে হয়েছে । উপায় ছিল না । অনেক চেষ্টা করেছে , কিন্তু বাঁচাতে পারেনি। সেই ঠিক এক মাসের মাথায় মাথা ব্যাথায় ওর বাপটা মরল। এখন বৌটি অসুস্থ । যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, যে যা বলছে তাই করছে । এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি , কবিরাজি, তুকতাক ঝাড়ফুঁক সব। সব ধরনের পরীক্ষা চলছে ।কিন্তু কি জানো এধরনের চিকিৎসার বিপদের ঝুঁকি বেশি , কারণ কোন চিকিৎসা সঠিক ভাবে হয় না । আমাকেও ডাকে , যাই। যথাসাধ্য চেষ্টাও করি । কিন্তু কোন আশা দেখছি না। "
--- " কিন্তু যগাদা একবার বাসুদেব ওঝাকে দেখালে হতো না? "
--- " দেখিয়েছে , বাসুদেব সদানন্দ দুজনের বাড়িতেই নিয়ে গিয়েছিল। সদানন্দকে পায়নি, আজকাল মাঝে মাঝেই কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, কেউ জানেনা, তাই দেখা হয়নি। তবে বাসুদেব ওঝার সাথে দেখা হয়েছিল। বাসুদেব ভোলার বৌটাকে ওর বাড়ির প্রতিষ্ঠিত কালির সামনে বসিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে । কোন অস্বাভাবিক কিছু নজরে আসে নি। তাসত্বেও ও নাকি কি কি ওষুধ দিয়েছিল কিন্তু কাজ হয়নি ।"

কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন । আসলে ভোলার ব্যাপারে উনি খুব চিন্তিত । কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছেন না । চোখের সামনে একটা একটা করে লোক মারা যাচ্ছে অথচ উনি ডাক্তার হয়েও কিছুই করতে পারছেন না, এটা যে কি কষ্টের একজন সমব্যথী ছাড়া বোঝানো মুশকিল । যগাদা চুপ, বাকিরা ও চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই । এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা প্রহর। সময় বয়ে যাচ্ছে, লক্ষ্মী উসখুস করে উঠলো ।ওর গল্পটা এখন শেষ হয় নি।

-- "মেসো, আমাদের গল্পটা কি আজকে শেষ হবে না ?"
-- "আহা কোথায় যেন গল্পটা শেষ হয়েছিল কেউ একজন বলে না দিলে আমি কি করে শুরু করি বলো তো ?
লক্ষ্মী সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে বললে, " আমি বলবো ?"
--- "হ্যাঁ , বলবি নিশ্চয়ই ।" ভুদেববাবু হেসে বললেন ।
--- " ওই যে গো-- বাসুদেব ওঝার সাথে তোমাদের তক্ক না কি যেন চলছিল, মনে নেই । এমন সময়ে সদানন্দ না কি নামে যেন একটা ওঝা এল ----। " লক্ষ্মী গল্পের খেই ধরিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ।
--- " ঠিক বলেছিস , এখন বুঝে গেছি ।" আমি লক্ষ্মীকে আশ্বস্ত করলাম । আসলে আমাদের গল্পের আসরে লক্ষ্মী খুব মনোযোগী শ্রোতা। এবং গল্প শেষ না হওয়া অবধি ওর কাছ থেকে কারো মুক্তি নেই । তাই অগত্যা আবারও শুরু হলো গল্প । শুধু আমার স্ত্রী সবিতা সময়ের অজুহাতে মৃদু আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু ধোঁপে টিকে নি। একজন বক্তা , বাকিরা শ্রোতা । বাইরে তখনো রীতিমতো বৃষ্টি ঝরছে । এতদিন এত মেঘ কোথায় ছিল ভাবতে ভয় হয়। আমরা বিশাল বারান্দার ভিতর দিকে বসা । সমস্ত উঠান জুড়ে ঘন কালো অন্ধকার । তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুত চমক , যেন শ্মশান কালির তান্ডব । আমরা বৃষ্টির ঝাঝে দেওয়াল ঘেষে নিরুপায় হয়ে জড়সড় বসা। আবারো গল্প শুরু হলো ।

---" সদানন্দ ওঝার নাম তো আপনাদের সবার জানা । খুব বড় তান্ত্রিক , কিন্তু ইদানিং খুব একটা লোকের বাড়ি তিনি যান না । বিশেষ কারণ ছাড়া সাধারণত বাড়িতেই থাকেন। যাদের প্রয়োজন তারা বাড়িতে গিয়ে দেখা করে । উনি সাধ্য মত সাহায্য করেন। লোকে বলে সদানন্দ জিনের মালিক। জিন জানেন তো , এক ধরনের অশরীরী দৈত্য যে ইচ্ছে করলে অনায়াসে কারো ভালো বা ক্ষতি করে দিতে পারে । একসময়ে তার বাড়িতে লোকের ভীড় লেগে থাকতো । কিন্তু একমাত্র মেয়েটা মারা যাবার পর আর খুব একটা কাজ করেন না, বিশেষ করে বাণমারা, বশীকরণ এসবতো নয়ই। আজ তিনি কি করে এলেন বা কাদের অনুুুরোধে এলেন বোঝা গেল না । আসার পথে লোকেরা সম্ভ্রমে সরে সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিচ্ছিল । সদানন্দ কোনদিকে কোন কৌতুহল না দেখিয়ে সোজা বাসুদেব ওঝার কাছে এসে থামলেন । সংক্ষিপ্ত সৌজন্যতার পরই তিনি বাসুদেবের পিঠে আলতো ঠোকা দিয়ে বললেন, " চলুন, আর দেরি করা যাবে না ।"
বাসুদেব সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত টেনে বললেন, " চলুন ---।"
আচমকা এভাবে আমার হাত টেনে ধরায়, আমি চমকে উঠলাম । বুঝতে পারছিলাম না এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত । কৌতুহল যে নেই তা বলব না। কিন্তু তার চেয়েও বড় হচ্ছে ভয়। একটা প্রচন্ড ভয় একদম বিনা নোটিশে আমার উপর চেপে বসেছে । তবু মনে শক্তি এনে বললাম, " চলুন ---।"
--- " না, না ওনাকে নেওয়া উচিত হবে না ।" সদানন্দ বোধকরি আমার প্রতি সদয় হলেন ।
--- " চিন্তা করবেন না আমার কাছে তক্খকাক্ষি কবজ আছে।" বাসুদেবের কথায় সদানন্দ আর বিশেষ আপত্তি করলেন না । শুধু বললেন, " সাবধানে --"
এই "সাবধানে" বলে উনি কি বোঝাতে চেয়েছেন , বোঝা গেল না । প্রথমে দুই ওঝা, পেছন পেছন আমরা ধীরে ধীরে কালুয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম । হঠাৎই ভীড়ের ভিতর থেকে একটা উস্ক খুস্ক চুল , পড়নে হাফপ্যান্ট ও একটি ছেঁড়া শার্ট , খালি পা , কোন চটির বালাই নেই , সোজা সদানন্দের পায়ে ঝাপিয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল । বাসুদেব পরিচয় করিয়ে দিল, " কালুয়া , ওর বৌটিই অসুস্থ ।"
--- "ওঃ---"। সদানন্দ বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। শুধু যে জায়গাতে কালুয়াটা মাটিতে পড়ে কাঁদছিল সেখান থেকে একচিমটি মাটি নাকের খুব কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন। তারপরই কালুয়ার ঘরটাকে ডান পাশে রেখে, ঠিক তার ঘর ঘেষে একটা পায়ে হাঁটা রাস্তায় বাড়ির ঠিক পিছন দিকটায় এসে হাজির হলেন । বাসুদেব , আমি, ভুদেববাবু সঙ্গে গায়ের আরো অনেকেই ওনার পিছনে পিছনে যেতে উদ্যত হতেই, সদানন্দ হাত তুলে সবাইকে ওখানেই থামিয়ে দিলেন । আমি মনে মনে হাসলাম । প্রথমে ছিল একটা ভন্ড, এখন জুটেছে আরো এক। তবে লোকটার পেশাদারি বাহাদুরি আছে মানতে হবে। আসা অবধি একটা টানটান উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে । এই বুঝি কোন অঘটন ঘটবে কিংবা কোন অঘটনের নিষ্পত্তি হতে চলেছে । এবারে তিনি বাসুদেবকে ইশারায় ডাকলেন । বাসুদেব আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, " ভয় পাচ্ছেন নাতো ?"
--- " আপনার কি মনে হয় ?" আমি ফিশফিশ করে পাল্টা প্রশ্ন করলাম ।
--- " তবে চলুন -- ।" দুয়েক পা এগিয়ে কি মনে হতে ফিরে দাঁড়ালেন। কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা লাল কাপড়ের টুকরো আমার বা হাতে বেঁধে দিয়ে বললেন, " এটা তক্খকাক্ষি কবজ। যতক্ষণ আপনার হাতে বাঁধা থাকবে ততক্ষণ কেউ আপনার কিছু করতে পারবে না । শুধু একটা মাত্র সর্ত , কখনো পিছন ফিরে তাকাবেন না। যদিবা তাকাতেই হয় তবে সমস্ত শরীর দিয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়াবেন। তা না হলে ভীষণ বিপদ।
" --- " আমার ওসবের প্রয়োজন নাই ।" আমি প্রতিবাদ করলাম ।
--- " বেশ তো ভালো কথা, থাকলেই বা ক্ষতি কি । থাকুক না কবজটা বাঁধা। " ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে আমরা দুজনেই সদানন্দের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, প্রথমে বাসুদেব পিছনে আমি। হঠাৎই আমাদের সামনে আওয়াজ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। সামনে ঝুঁকে দেখি মাটিতে একটা বাতাবিলেবু । দেখলাম পাশেই একটা বাতাবিলেবু গাছ। বিষয়টা কাকতালীয় বলেই আমার মনে হলো। অথচ এটাকেই ভুতের দাদাগিরি বলে হয়তো কেউ কেউ চালিয়ে দিতে পারেন। মনে মনে হাসলাম । তবে এত ছোট গাছ থেকে এত জোরে কি করে ফলটা মাটিতে পড়লো সেটা অবশ্যই ভাববার বিষয়। নাকি কোন নাটের গুরু আড়ালে থেকে আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে । এমনি সব এলোমেলো ভাবনা নিয়ে আরো দু পা এগিয়েছি, আবারো একটা শব্দে চমকে উঠলাম । আরো একটা বাতাবিলেবু পড়ার শব্দ। আশেপাশে কেউ নেই , তবু কেউ একজন আমাদেরকে লক্ষ্য করে এইসব ছুঁড়ছে, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম । এদিকে ওদিকে সাবধানে লক্ষ্য করছি , ঠিক তখনি আমাদের পিছনে আবারো কেউ বাতাবিলেবু ছুঁড়ে মারলো। চমকে উঠে যেই না পিছনে তাকিয়েছি , অমনি বিরাশি দশ আনার একটি চাটি কেউ আমার গালে সজোরে বসিয়ে দিল। অল্পের জন্য আমার চোখ এড়িয়ে গেছে । আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম বাসুদেবের উপর । কি সাংঘাতিক কান্ড, আশেপাশে কোনো লোক নেই তবে এট কার কীর্তি । রীতিমত ভয় পাবারই পালা। । বাসুদেব চিৎকার করে উঠলো, " একশো বার বলেছি পিছনে তাকাবেন না, কথাগুলো কানে যায় না বুঝি ?"
একে আচমকা এই থাপ্পড় তার উপর বাসুদেবের জ্ঞান, অন্য সময় হলে সমস্ত শরীর মনে বিদ্রোহ ঘোষণা করতো , কিন্তু এইমুহুর্ত আমার সেই অবস্থা নয়। হঠাৎই যুক্তি ছাড়া আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল । আমার মুখের হাসি শুকিয়ে গেছে । অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, " সরি ---"
--- " কবজটার জন্য বেঁচে গেলেন ।" বাসুদেব আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো । আমি কোন উত্তর দিলাম না । আরো বেশি সতর্ক হয়ে গেলাম ।
--- " আপনার পিছনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও পিছন ফিরে কক্ষনো তাকাবেন না । তাহলেই কোন ক্ষতি হবে না ।" সদানন্দ গম্ভীর মুখে উপদেশ দিলেন । আমি নিরুপায় , কথা না শোনে উপায় নেই ।
আমরা সদানন্দকে লক্ষ্য করছিলাম । সদানন্দ বাড়ির পিছনটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন । আমাকে বললেন, " অল্প আবীর পাওয়া যাবে? "
--- "দেখছি ---।" আমি সাবধানে সচেতন ভাবে আবীর আনতে গেলাম । এবারে আর কোন কিছু পড়ার শব্দ পেলাম না । পাশের বাড়িতেই আবীর পাওয়া গেল । কেউ একজন এনে আমার হাতে দিলেন । আমি পৌঁছে দিলাম ।
সদানন্দ বার কয়েক আবীরের প্যাকেট থেকে এক চিমটি আবীরের গন্ধ শুকে ফিসফিস করে কিছু একটা মন্ত্র জপ করতে থাকলেন। তারপর সেই এক চিমটি আবীর মুখের সামনে ধরে ফুঁ দিয়ে শুন্যে উড়িয়ে দিলেন । আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আবীরের দানা গুলো একটা সুক্ষ রেখার সৃষ্টি করেছে যা বাড়ির ভিতর থেকে পিছন দরজা হয়ে সোজা জঙ্গলে চলে গেছে । খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। বাসুদেব আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, " আমাদের হাতে সময় খুব কম । আর বেশি দেরি হলে বৌটাকে বাঁচানো যাবে না ।"
--- " আপনি কি করে বলছেন ?"
--- " দেখছেন না লাইনটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে । সাধারণত রেখাগুলো আরো স্পষ্ট দেখা হয়। "
--- " এ কিসের রেখা ?" আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ওরা কি করতে চাইছেন। --- "এটাই তো সেই পথ। যে পথে আক্রান্ত হয়ে বৌটা ঘরে ফিরেছিল। আপনার মনে সন্দেহ থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন ।"
--- " আপনি বলেছেন, আবার জিজ্ঞেস করা কেন? "
--- " আপনাদের বিশ্বাস খুব কম তো , তাই ।" বাসুদেব বললে ।
বিশ্বাস যে আমার কম , সেটা সত্যি । কিন্তু আশেপাশের লোকজনদের অভিব্যক্তিই বাসুদেবের কথার সত্যতা সমর্থন করছিল । তাই আমি আর কোন উত্তর দিলাম না । আমরা তিনজনই পুনরায় মূল উঠানে ফিরে এলাম । সদানন্দ বাসুদেবকে ডেকে কিছু পরামর্শ করে বললেন, " চলুন একবার বৌটাকে দেখে আসি ।"
আমরা তিনজন কালুয়ার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালাম । ছোট্ট কুটির ঘর। মাটির দেওয়ালে ছনের চাল । ঘরটা অনেক পুরনো। দরজা দিয়ে ভিতরে গেলে , প্রথম ঘরটাতে খুব সাধারণ ভাবে বসার আয়োজন করা, পরের ঘরটা ওদের শোয়ার ঘর। ওখানেই কালুয়ার বৌটা শুয়ে আছে । ঘরের ভেতর ভর দুপুরে আধো আলো আধো অন্ধকার । ভেতর থেকে ক্রমাগত একটা গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে । দূর থেকে মনে হচ্ছে একটা শুকর জাতীয় কোন পশুকে জোর করে বেঁধে রাখা হয়েছে । সদানন্দ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন । আমি আর বাসুদেব পাশের জানালায় দাঁড়ালাম ।
ঘরের এক কোণে একটা চৌকিতে কালুয়ার বৌ শোওয়া । ঠিক শোওয়া বললে ভুল হবে, হাত পা বেঁধে জোর করে শুইয়ে রাখা হয়েছে । শক্ত দড়ি দিয়ে চৌকির পায়ার সাথে বাঁধা। আলুথালু বেশ, কাপড়ের কোন ঠিক ঠিকানা নেই । অনেকটা উপরে উঠে গেছে। বেশিক্ষণ তাঁকাতে লজ্জা লাগে । চুলগুলো উস্ক খুস্ক, তার মধ্যে কয়েকটি সাদা গোলাপ ফুল গোজা। ফুলটির জায়গাতে জায়গাতে লাল লাল ছোপ । বাসুদেব বললো ওটা রক্ত । বৌটার বিধ্বস্ত চেহারাতে শুধু চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে । আমাদের দেখতে পেয়ে ওর আক্রোশ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। আস্রাব্য গালাগালির সাথে আমাদেরকে আক্রমণের বৃথা চেষ্টা বুকের রক্ত হিম করে দেয়। বৌটার হাত পা বাঁধার জায়গা থেকে ক্রমাগত টাটকা রক্ত বেরোচ্ছে । ভয় লাগে, সত্যি ভয় লাগে । সমস্ত ঘরময় একটা আধিভৌতিক পরিবেশ। বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না ।
বাসুদেব আমাকে বললো এখানে দাড়ানো নিরাপদ নয়। চলুন সরে যাই । আমরা আবার উঠানে ফিরে এলাম । সদানন্দকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে । উঠানে একটা পরিষ্কার জায়গাতে বাঁশের শলাকা দিয়ে তিনি একটা সাংকেতিক চিত্র আঁকলেন । তারপর সেই আবিরের প্যাকেট থেকে কিছু আবির নিয়ে ঐ সাংকেতিক চিহ্নের বিভিন্ন কোণা জুরে কিছু একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করলেন । অবশেষে ধীরে ধীরে বললেন, " বাসুদেব, বুঝতেই পারছো , অনেক দেরি হয়ে গেছে । তবে সুখের কথা এখনো কৌশিকী অমাবস্যা ছাড়তে দুই ঘন্টার মত সময় আছে । আমাদের যা করনীয় এই দুই ঘন্টার মধ্যে শেষ করতে হবে নইলে ------"
----" নইলে ---?" আমি আঁতকে উঠি ।
--- "নইলে সব শেষ ।" বাসুদেব সদানন্দের বক্তব্য পূর্ণ করলো।
--- " বাসুদেব তুমি আমাকে আসন সাজাতে সাহায্য করবে । আর আপনি কিছু জবাফুল, এক কৌটা সিঁদুর , অল্প শষ্য দানা , অল্প লাক্ষা, ধুপকাঠি, মোমবাতি, দিয়াশলাই, 500 গ্রাম আটা 500 গ্রাম ঘি ও একটা ছুরি জাতীয় কিছু খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন ।" শেষের কথাগুলো যে আমার উদ্দেশ্যে সেটা বুঝতে আমার কোন অসুবিধা হলো না । আমি চট করে একটা কাগজে নোট করে জিনিসপত্র ব্যবস্থা করতে চলে গেলাম ।
কালুয়াকে ডাকা হলো। সদানন্দ ওকে ডেকে উঠানের পাশে একটা প্রকাণ্ড আম গাছ দেখিয়ে বললেন, " তোমার বউকে এখানে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে রাখো। সাবধান , শক্ত করে ধরে আনবে।"
তারপর কি ভেবে বললেন, " থাক এখন আনতে হবে না । আমি পরে বলবো ।"
উঠানের একপাশে সেই আম গাছটির সামনে, প্রায় মিটার তিনেক দুরে জায়গা পরিষ্কার করা হলো। আমি জিনিসগুলো জোগার করে ফিরে এসে দেখি অনেক কাজ এগিয়ে গেছে । আমাকে কিছুই করতে হয়নি, স্থানীয় বাসিন্দারা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে । আমি শুধু জিনিষগুলো সদানন্দের কাছে পৌঁছে দিয়েছি মাত্র । বাসুদেব খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাঠি দিয়ে একটা ছক এঁকে নিয়েছে। সেই ছকে আবীর ছিটিয়ে একটা যজ্ঞকুন্ড তৈরি করা হয়েছে । কেউ একজন একটা বড় শোল মাছ এনে দিল। এটা কখন আনতে বলা হয়েছে বুঝতে পারিনি ।সদানন্দ মাছটাকে যজ্ঞকুন্ডের পাশে রাখতে বললেন । দেখলাম অনেকগুলো বাঁশের শলাকা তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেকটা শলাকার মাথায় একটা করে জবাফুল গাঁথা হলো। এবারে সেই আম গাছটির দিকে মুখ করে যজ্ঞকুন্ডের পিছনে তিনটি আসন পাতা হলো। সদানন্দ আমাকে বললেন, "আপনার ভয় করছে না তো ?"
আমি কি উত্তর দেবো ভাবছি। আমাকে নিশ্চুপ দেখে বললেন, " এবারে যে কাজটা আপনাকে দেবো সেই কাজটা অনেক কঠিন , অনেক সাহসের প্রয়োজন । আপনি পারবেন তো? ভয় পেলে চলবে না ।"
বললাম, " পারবো---।"
--- " বেশ ----।"
বাসুদেব আমাদের আসন সহ পুরো যজ্ঞকুন্ডটি বাঁশের শলাকাগুলো দিয়ে ঘিরে দিল। সদানন্দ দুরে দাঁড়ানো গ্রামবাসীদের ডেকে বললেন, "আপনাদের মধ্যে যদি কারো তুলা রাশি থাকে তাহলে সামনে এগিয়ে আসুন ।"
ভীড় ঠাসাঠাসি গ্রামবাসীদের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে গেল । মিনিট পাঁচেক পর ছয়জন লোক সাহস করে এগিয়ে এলো । সদানন্দ প্রত্যেককে আলাদা করে রাশি জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলেন ।
এবারে আসল প্রক্রিয়া শুরু হবে। সদানন্দ বাসুদেবকে সঙ্গে নিয়ে পুরো যজ্ঞের স্থান, সামনের আমগাছ সহ কালুয়ার বৌ এর সেই চৌকিটাকে মন্ত্র পরা আবীর দিয়ে গন্ডি কেটে একটা বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত করলেন । তারপর আমাদের ডেকে প্রত্যেকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন । সেই ছয়জন তুলা রাশির গ্রামবাসীদের বললেন, " আপনাদের মধ্যে চার জন আমি বললে ঐ বৌটার হাতে পায়ে বাঁধা চারটা দড়ি ধরে বৌটাকে এনে এই আম গাছটাতে বাঁধবেন । এমনিতে তুলা রাশির কেউ ছুঁলে ও কোন শক্তি বা আপত্তি দেখাবে না । তবু যদি কোন কারণে শক্তি দেখায় তবে প্রয়োজনে দড়ি ছেড়ে দেবেন কিন্তু ভুলেও ওর টানাটানিতে গন্ডির ভেতরে প্রবেশ করবেন না । তাহলেই বিপদ। আর দুইজন দুই দিকে সঙ্গে থাকবেন ।যদি কারো হাত থেকে দড়ি ছুটে যায় তবে আপনারা সাথে সাথে সেই দড়িটা তুলে নেবেন । ভয় পাবেন না, ও যতই চিৎকার চেঁচামেচি করুক , কিছুতেই এই গন্ডির বাইরে আসতে পারবে না । মনে থাকবে তো। "
ওরা ঘার নেড়ে সম্মতি জানালো। বুঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি অনুধাবন করে ওরাও এইমুহুর্তে খুব উত্তেজিত ।
বাসুদেব আমাকে ডেকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বিড়বিড় করে কি সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল । আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি । অল্প পরে একটা বিচিত্র রঙের দড়ি তাতে একটা ছোট্ট হাড় জাতীয় কিছু বাঁধা , আমাকে দিয়ে বলল, " এটা কোমরে বেঁধে নিন।"
--- " এই তেলচিটে দুর্গন্ধময় দড়ি আমাকে কোমরে বাঁধতে হবে ? ভাবতেই কেমন বমি বমি ভাব করছে ।"
--- " এই দড়িতে কি আছে জানেন? শেয়ালের হাড়। পাঁচ পাঁচটা প্রাণীর তাজা রক্ত দিয়ে শোধন করা। তর্ক না করে বেঁধে নিন। আর যদি আপত্তি থাকে তবে চলে যেতে পারেন। আপনাকে ছাড়াও আমরা কাজটা করতে পারবো , কিন্তু আপনার জীবনের ঝুঁকি আমরা নিতে পারবো না ।" বাসুদেব এইমুহুর্তে খুব গম্ভীর । আমি আর তর্ক না করে বেঁধে নিলাম ।
আমরা সদানন্দ আর বাসুদেবের সাথে ধীরে ধীরে কালুয়ার শোবার ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছি । সদানন্দ দুইজন গ্রামবাসীকে দরজার দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে বাকিদের নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন । আমাদের দেখে বৌটার সেকি রাগ। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি আর সেই সঙ্গে হাত পায়ের বাঁধন ছেঁড়ার আপ্রাণ চেষ্টা । দীর্ঘক্ষণ চিৎকারে গলার আওয়াজ কেমন যেন ভাঙা ভাঙা পুরুষালি স্বর। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আস্ফালনে মনে হয় এই বুঝি খাট পালংক ভেঙ্গে বৌটা আমাদেরকে মারতে ছুটে আসছে । একটা ভয় আবার একটা কৌতুহল, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি । আমরা দুরে রইলাম, সদানন্দ আর বাসুদেব ধীরে ধীরে বৌটার দু’দিকে এগিয়ে গেল। সদানন্দ প্রথমে কয়েকটা জবাফুল অল্প ঘিতে চটকে নিয়ে দড়িগুলিতে ভালো করে ঘষে দিলেন । তারপর বৌটার একটা পায়ের দড়ি বিড়বিড় করে অস্পষ্ট উচ্চারণে মন্ত্র শুদ্ধি করে চৌকির পায়া থেকে খুলে দরজায় দাঁড়ানো একটা লোকের হাতে দিলেন । দ্বিতীয়জনকেও একই ভাবে দেওয়া হলো , কোন ঝামেলা হলো। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তির হাতে দড়িটা দেওয়া মাত্রই, একটা বিকট চিৎকারে আমরা চমকে উঠলাম । দেখলাম লোকটা প্রচন্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে দড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে । সদানন্দ সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দেওয়া দড়িটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন, " এটা তামাশার জায়গা নয়। মনে রাখবেন কথাগুলো ।"
বাসুদেব ফিসফিস করে বললো, " লোকটা নিশ্চয়ই তুলা রাশির নয়।"
--- "আপনি কি করে বলছেন? "
--- "দেখছেন না বাকি লোকদের কিছু হয়নি । "
প্রতিবাদ করে লাভ নেই । নিজের চোখেই সব দেখতে পাচ্ছি । তাই চুপ করে গেলাম । সদানন্দ আবারো দড়িটি মন্ত্র শুদ্ধি করে অন্য একজন লোকের হাতে তুলে দিলেন । এভাবে চারটি দড়ি চারটে লোকের হাতে দেওয়া হলে ওরা সাবধানে দড়ি টেনে কালুয়ার বৌটাকে আমগাছটার নীচে নিয়ে এল । সদানন্দ পেছন ধেকে বারবার সাবধানে করে দিচ্ছিলেন যাতে কেউ গন্ডির ভেতরে প্রবেশ না করে । বিনা ঝামেলায় বৌটাকে গাছের নীচে আনা হলে সদানন্দ বাসুদেবের সাহায্য নিয়ে বৌটাকে গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে দিলেন । আমি দূর থেকে দেখছি। লক্ষ্য করলাম যতক্ষণ ঐ চার জন লোক দড়ি ছুয়ে ছিল ততক্ষণ বৌটা একদম পাগলামি করে নি , শান্ত ছিল । কিন্তু যখনই ওরা দড়িটা ছেড়ে দিলে, সাথে সাথে বৌটার কি বিক্রম । মনে হচ্ছিল এই বুঝি দড়ি ছিড়ে ছুটে আসবে মারতে। প্রচন্ড আক্রোশে আস্ফালন আর চিৎকারে বুকের রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা । আমার নিজের উপর বিশ্বাস ছিল যে আমি কোনদিন তন্ত্র মন্ত্র বা এইসব আধিভৌতিক কাজে আস্থা রাখবো না । কিন্তু আজ কেন জানি না আমার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি নিজেই এইসব কার্যকলাপে জড়িয়ে পরছি । বৌটাকে গাছে বেঁধে আমরা তিনজন এসে যজ্ঞকুন্ডের পাশে আমাদের আসনে বসলাম ।আমি মধ্যখানে, একপাশে সদানন্দ অন্য পাশে বাসুদেব । মোমবাতি ও ধুপকাঠি জ্বালানো হলো । বাসুদেব দক্ষ শিল্পীর মত আটা দিয়ে মন্ড তৈরি করে, সেই মন্ড থেকে একটা পুতুল তৈরি করে দিল। এবারে সদানন্দ আমার আর যজ্ঞকুন্ডের মধ্যে জ্যান্ত সেই শোল মাছটাকে সোজা করে মাটিতে শুইয়ে রেখে তার গা ঘেষে চারপাশে সারি সারি লোহা গেঁথে দিল যাতে মাছটা নড়তে না পারে । এবারে শোল মাছটার গায়ে সিঁদুর মেখে মাথায় পুতুলটাকে বসিয়ে দিয়ে আমার হাতে একটা লোহার শলাকা দিয়ে বললেন, " এইটা দিয়ে মাছটাকে চেপে রাখবেন যাতে নড়াচড়ায় পুতুলটা পড়ে না যায় । সাবধান, পারবেন তো ?"
--- " চেষ্টা করে দেখি ।" আমি বললাম ।
--- " চেষ্টা নয় পারতে হবে।"
লোহার শলাকাটা অদ্ভুত রকমের । একটা লোহার শলাকা যার মাথাটা ইংরাজি অক্ষর ভি- মত দুভাগে ভাগ করা । এতে মাছটাকে চেপে রাখতে সুবিধা হবে । তথাপি যদি মাছটা নড়ে গিয়ে পুতুলটাকে ফেলে দেয়। ভয়ে ভয়ে দায়িত্বটা নিলাম । বাসুদেব আমার বা হাতে চিমটা জাতীয় একটা জিনিস দিয়ে বললো , " যদি মনে হয় পুতলটা পড়ে যেতে পারে তাহলে এইটা দিয়ে পুতুলটাকে শক্ত করে ধরে চেপে রাখবেন । সাবধান, হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন না ।"
ধীরে ধীরে কি যাঁতাকল না ফেঁসে গেছি। এখন যদি আমার গাফিলতিতে কোন অঘটন ঘটে তবে সবাই আমাকে দুষবে , নিজে যেচে এই ঝামেলায় জড়ানোর কোন মানে হলো না। অথচ এই মুহূর্তে মাঝপথে সরে যাবো তারও উপায় নাই । নিজের উপর খুব রাগ হলো, আবার ভয়ও করছিল । যাইহোক শুরু হলো তন্ত্র মন্ত্র দিয়ে ঝাড়ফুঁক । হাতে সময় এক ঘন্টার চেয়েও কম । প্রথমে বাসুদেব যজ্ঞকুন্ডে অগ্নি সংযোগের চেষ্টা নিল। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি, কিছুতেই আগুন ধরছে না। ওদিকে কালুয়ার বৌটার কি চিৎকার আর আস্ফালন । কি অদ্ভুত একটা অসুরীয় ক্ষমতা, প্রায় তিন থেকে চার মিটার দুর থেকে ফুঁ দিচ্ছে আর এদিকে আগুন নিভে যাচ্ছে । নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্ট । সদানন্দ বারবার চেষ্টা করছেন, বারবারই একই ফল । সময় বয়ে যাচ্ছে । সদানন্দের চেহারা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে ।সমস্ত মুখটা রাগে লাল। ঐদিকেই কালুয়ার বৌটার সেকি পৈশাচিক অট্টহাসি । গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। প্রায় মিনিট দশেক নানাভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাসুদেবকে কিছু একটা আনতে ইশারা করলেন । বাসুদেব উঠে চলে গেল । আমিও সঙ্গে যাবে ভেবে উঠতে যাচ্ছি, উনি আমাকে হাতের ইশারায় নিষেধ করলেন । একটা থমথমে অবস্থা । সবার মনে সন্দেহ, কালুয়ার বৌটাকে বোধকরি বাঁচানো যাবে না , সদানন্দ ওঝার সব জারিজুরি বুঝি ব্যর্থ হতে চলেছে । ওদিকে বাসুদেব গ্রামবাসীদের কিছু বলায় সবাই নানাদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো । দুর থেকে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, তবে আশেপাশের মাঠেই যে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটা ওদের খোঁজা দেখে বোঝা যাচ্ছে । হঠাৎ মাঠের এক কোণে থেকে চিৎকার শোনা গেল, " পেয়েছি , পেয়েছি----।"
সবাই ছুটে গেল ঐ আওয়াজ লক্ষ্য করে । তারপর সবার মিলিত প্রচেষ্টায় নিয়ে আসা হলো সেই প্রাণীটিকে । সামনে নিয়ে আসার পর বুঝতে পারলাম প্রাণীটি আসলে একটি ব্যাঙ । কাপড় দিয়ে মুড়ে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে । সদানন্দের মুখে হাসি ফুটেছে । ব্যাঙ টার চার পায়ে সূতো বেঁধে যজ্ঞকুন্ডে কাঠের সাথে শক্ত করে বাঁধা হলো, যাতে পালিয়ে যেতে না পারে । ব্যাঙ টার গায়ে সিঁদুর দিয়ে একটা জবাফুলে মন্ত্র পড়ে ওর মাথায় রাখা হলো। লক্ষ্য করলাম ফুলটি মাথায় স্পর্শ করা মাত্র প্রাণীটি কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে । সদানন্দ আবার যজ্ঞে বসলেন । হাতে সময় বেশি নেই ।আর মাত্র আধঘন্টা মত সময় বাকি । ওদিকে কালুয়ার বৌটার গালাগালি আর ক্রমাগত নিষ্ফল ভয় দেখানোতে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে যজ্ঞকুন্ডে ব্যাঙ রাখাটা ওর একদমই পছন্দ হয়নি । একটা থমথমে পরিবেশ । সদানন্দ আবারো যজ্ঞকুন্ডে আগুন দেওয়ার প্রচেষ্টা নিল। কালুয়ার বৌ ঐদিক থেকে পাল্টা ফুঁ দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা নিচ্ছে । প্রচন্ড শক্তি এই ফুঁতে, যেন একটা ঝড়ো হাওয়া বইছে । চারদিকে শুকনো পাতা আর ধুলোর ঝড় । গ্রামবাসীরা ভয়ে দূরে সরে গেল । সবার মনে অজানা আশঙ্কা, কি জানি কি হবে । কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম এত জোড়ে বাতাস যজ্ঞকুন্ডের কোন ক্ষতি করতে পারলো না । ঘি বেশি করে দেওয়ার জন্যই হোক কিংবা তন্ত্র মন্ত্রের ফলেই হোক, নিমেষে যজ্ঞকুন্ডে আগুন জ্বলে উঠলো । আর সেই আগুনে জীবন্ত ব্যাঙ টার বাঁচার জন্যে সেকি আকুতি। একদিকে জলজ্যান্ত ব্যাঙ টা হাত পা বাঁধা অবস্থায় আগুন থেকে বাঁচার জন্য প্রচন্ড ছটফটানি করছে আর অন্য দিকে কালুয়ার বৌটা বিনা আগুনে সেকি পরিত্রাহি চিৎকার । সহ্য করা যায় না। গ্রামবাসীরা দূর থেকে ভয়ে ভয়ে সব কিছু লক্ষ্য করতে থাকলো, কাছে আসার কারো সাহস নেই । এভাবে প্রায় পনের মিনিট চলার পর সদানন্দ এবারে কালুয়ার বৌটার দিকে ঘুরে হাত জোর করে বললেন, " আপনি যেই হোন, এই বৌটা অজান্তে আপনার পথে এসে আপনাকে বিরক্ত করেছে। আমি এই বৌটার হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি, দয়া করে এই বৌটাকে মুক্তি দিন । আপনার উপস্থিতিতে বৌটা প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে। দোহাই আপনার , আপনি দয়া করুন । বৌটাকে মুক্তি দিন ।"
সদানন্দ যত ইনিয়ে বিনিয়ে কাতর হয়ে অনুরোধ করে , কালুয়ার বৌটা বা ওর উপর আশ্রিত অশরীরী আত্মাটি তত দৃঢ়তার সাথে মুক্তি দিতে অস্বীকার করে । এভাবেই কিছুক্ষণ চলতে থাকে অনুরোধ আর প্রত্যাখানের পালা। বাসুদেব তখন আস্তে করে সদানন্দকে মনে করিয়ে দেয় , সূর্যাস্ত আর দশ মিনিট বাকি ।এরপর আর বৌটাকে বাঁচানো যাবে না । চারদিক টানটান উত্তেজনা, সবাই একটা দোদুল্যমান অবস্থায় আছে । কেউ কেউ বলছে সদানন্দ ওঝা যখন দায়িত্ব নিয়েছে, তখন এযাত্রায় বৌটা বেঁচে যাবে । আবার অধিকাংশের ধারণা, হাতে বিশেষ সময় নেই । তাই শেষ পর্যন্ত হয়তো এবারে সদানন্দকে হার মানতে হবে ।
হঠাৎই সদানন্দের গলার স্বর একদম পাল্টে গেল। এতক্ষণ যে লোকটা অনুনয় বিনিময় করছিল, হঠাৎই তার বজ্র নিনাদ । সদানন্দ কালুয়ার বৌটাকে আশ্রয় করা অশরীরী আত্মার উদ্দেশ্য গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, " আমাকে ক্ষমা করবেন, এখন আমি যা করতে যাচ্ছি, তার সমস্ত দায়ভার আপনার । সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে আমি এই প্রক্রিয়া বেছে নিলাম, আমাকে ক্ষমা করবেন ।"
এই মুহূর্তে কি হতে চলছে সে বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না তবুও এইটুকু বুঝতে পারছিলাম যে এখন যা ঘটতে যাচ্ছে তা খুবই সাংঘাতিক কিছু । উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার পারদ এখন অন্তিম পর্যায়ে । সদানন্দ শস্যের প্যাকেটটি থেকে অল্প শস্য নিয়ে মন্ত্র পড়ে শোল মাছটার মাথায় দিলেন । সাথে সাথে সেখানে বড় বড় ফোসকা ফুটে উঠলো । কালুয়ার বৌটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো । কিন্তু লাভ কিছু হলো না । সদানন্দ আবারো কিছু শস্য মন্ত্র পড়ে ছুড়ে দিলেন মাছটার মাথায়। একই ভাবে ফোসকা ফুটে উঠলো। কিন্তু না , উদ্দেশ্য সিদ্ধি হলো না । তারপর আবার এরপর আবার এই করে সমস্ত শস্য শেষ হয়ে গেল কিন্তু কালুয়ার বৌ এর মুক্তি ঘটলো না। সদানন্দ প্রচন্ড গম্ভীর, মুখ চোখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এই কঠিন পরীক্ষায় সদানন্দ রীতিমত কোনঠাসা। বৌটার বাঁচার লক্ষণ খুব ক্ষীণ । সদানন্দ বুঝে উঠতে পারছেন না কি করা উচিত ।এদিকে হাতে সময় সীমিত । যে সমস্ত পদ্ধতি এই মুহূর্তে মাথায় আসছে তা এই অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। অথচ দেরি করা যাবে না । হঠাৎ বাসুদেবকে ইশারায় শুরু করতে বললেন । নিজে একটা করে জবাফুল ঘিতে ভিজিয়ে মন্ত্র পড়ে আহুতি দিতে শুরু করলেন । আর প্রত্যেকটা আহুতি সাথে সাথে বাসুদেব একটা চিমটা দিয়ে লাক্ষা আগুনে গলিয়ে সেই শোল মাছটাকে ছেঁকা দিতে লাগলো । যেখানেই মাছটাকে ছেঁকা দেওয়া হচ্ছে, সেখানেই মাছের শরীরটা পুড়ে গর্ত তৈরি হয়ে যাচ্ছে । যন্ত্রণায় মাছটা ছটফট করছে, আর আমি পাথরের মত টানটান হয়ে মাছটাকে চেপে ধরে আছি যাতে পুতুলটা পরে না যায়। ভিতরে ভিতরে মাছটার জন্য সেকি অমানুষিক কষ্ট, অথচ ছেড়ে দিতে পারি না। তাহলে আমার জন্য কালুয়ার বৌটা মরে যেতে পারে । অন্তত আমাকে তো তাই বোঝানো হয়েছে । অন্যদিকে কালুয়ার বৌটার সেকি অমানবিক চিৎকার । প্রত্যেকটা ছেঁকা যেন তার শরীরের গভীরে গিয়ে প্রবেশ করেছে । অসহ্য জ্বালা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কান্না, চিৎকার আর আকুতি । সহ্য করা মুশকিল । তার অস্বাভাবিক হাত পা ছুঁড়াতে পায়ের নিচের পাথরগুলো ছুটে ছুটে আমাদের দিকে উড়ে আসছিল । মনে হচ্ছিল একটা বড় ধরনের অপরাধ চক্রে জড়িয়ে গেছি। একটা অপরাধ বোধ, একটা প্রচন্ড মানসিক কষ্ট হচ্ছিল । কিন্তু আমি নিরুপায়। কাজ শেষ না হওয়া অবধি আমারও যে মুক্তি নেই । আমি যতটুকু সম্ভব সতর্কতার সাথে মাছটাকে চেপে ধরে রেখেছি। ধীরে ধীরে এই অমানবিক অত্যাচারে শোল মাছটা নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো। আর সেই সাথে সাথে কালুয়ার বৌটাও ক্রমে ক্রমে অসাড়ের মত শরীর ছেড়ে দিল । গাছের সাথে বাঁধা না থাকলে হয়তো মাটিতেই লুটিয়ে পড়তো । হঠাৎ সদানন্দ আসন ছেড়ে উঠে ঐ বৌটার দিকে ছুটে গেল । আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই কালুয়ার বৌটার মাথা থেকে মাটিতে পড়া একটা গোলাপ ফুল তুলে এনে সেই আটার পুতুুুলের মাথায় বসিয়ে খুব তাড়াতাড়ি মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে একটা ছুড়ি দিয়ে ফুল সহ পুতুলটাকেে গেঁথে দিলেন । আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, পুুুুতুলটার শরীরের ভেতর থেকে দগদগে তাজা রক্ত বেরোচ্ছে । সদানন্দ ক্ষিপ্রতার সঙ্গেে তিনবার জবাফুল দিয়ে রক্তটা মুুুুছে মন্ত্র উচ্চারণ করে আগুুুনে আহুতি দিলেন ।
তারপর আবারও সদানন্দ করজোড়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে পুনরায় বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে শুরু করলেন । আমি অবাক হয়ে লোকটাকে দেখছিলাম ।
সব শেষ কিন্তু সদানন্দ মাটিতে হাতজোড় করে বসে আছেন। ক্লান্ত শরীর, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই । দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে একটা অনুশোচনা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ভিতরটা । এতবড় সাফল্যের পরও মুখে একফোটা হাসি নেই । বোঝার উপায় নেই, এই লোকটা একটু আগে কি সাংঘাতিক খেলায় লিপ্ত ছিল ।
সমগ্র গ্রামবাসীদের মধ্যে সেকি উল্লাস ।সদানন্দ সবাইকে ডেকে বললেন কালুয়ার বৌটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে এক গ্লাস দুধ খেতে দিতে । তারপর নিজ হাতে সমস্ত জায়গাটা পরিষ্কার করে সমস্ত আবর্জনা নদীতে বিসর্জন দিয়ে বললেন, "চলি---।"

আশ্চর্য এই লোক। যাবার আগে শুধু আমার পাশে এসে বললেন, " সুযোগ পেলে একবার আমার ডেরাতে আসবেন। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো । নমস্কার ।"
---" একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল, যদিও কিছু মনে না করেন ।"
--- " বলুন--।"
--- " সত্যি করে বলুন তো বৌটার সত্যি সত্যি কি হয়েছিল? "
--- "বৌটাতে একটা প্রেতাত্মা আশ্রয় নিয়েছিল । আত্মা দুরকমের হয় । কিছু আত্মা ক্ষতি করে না, শুধু মানুষের সঙ্গ চায়। আর কিছু আত্মা সুযোগ পেলেই ক্ষতি করতে চায় , ওরা প্রেতাত্মা। কিন্তু চাইলেই ওরা ক্ষতি করতে পারে না । লক্ষ্য করে দেখবেন আধিকাংশ সময়ই মেয়েরা এই সব খারাপ আত্মার শিকার হয়। কারণ অন্য কিছু না, মাসের কয়েকটি দিন মেয়েদের শরীর অশুদ্ধ থাকে । ঐ সময়ে মেয়েদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। তখন যদি কোন খারাপ যোগে কোন মেয়ে খারাপ জায়গাতে চলে যায় আর মন্দ কপাল জোরে কোন প্রেতাত্মা সংস্পর্শে এসে যায় তবেই এধরনের বিপদ হতে পারে । এধরনের ঘটনা হাজার দশ হাজারে একজনের হয়, তবে হয় সেটা সত্যি ।"
---" আরো একটা প্রশ্ন ছিল ।"
--- "বলুন ---"
--- " আপনি তো আত্মা তাড়িয়ে দিলেন, তবে কেন আপনি ঠিক ঠিক খুশি হতে পারলেন না ----।"
---" আমি তো ওকে আত্মা থেকে মুক্তি দিতে পারিনি । কে বলেছে আমি আত্মাকে তাড়িয়েছি --।"
---- " তাহলে ---।"
---- " আমি শুধু প্রেতাত্মাকে শুদ্ধি করে ওর ক্ষতি করার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছি। এখন আর কোন ভয় নেই । ঐ আত্মার থাকা না থাকা সমান ।"
--- "কিন্তু ---।"
---- " কোন কিন্তু নেই । এই মুহূর্তে ঐ খারাপ আত্মা তাড়াতে গেলে বৌটার আত্মা ও একই সঙ্গে দেহ ছাড়া হতো , ফলে বৌটা মরে যেত । তাই আমি কোন ঝুকি নেই নি। চলি, নমস্কার ।"
আমি নিরুত্তর, অবাক হয়ে এই নির্লোভ লোকটার চলে যাওয়া লক্ষ্য করতে লাগলাম।
বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে ।যগাদা সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলেন, " কিছু বুঝতে পারলে সুদীপ্ত ?"
সুদীপ্ত নিরুত্তর, সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারেনি । তাই সরাসরি কোন দিতে চাইছে না । যগাদা তাড়া দিয়ে বললেন, " রাতে একটু ভেবে দেখো ভোলার জন্য কিছু করা যায় কিনা ।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments