আইজলের পথে


ফটো নিজস্ব

আইজল থেকে শিলচর ফিরছিলাম ।গাড়িতে আমি জীবন আর আমার বস ।জীবন আমাদের ওয়াগনারটি চালায়, খুবই দক্ষ ।সামনে ওর পাশে আমার বস বসা, ওটাই ওনার প্রিয় সিট, আমি পেছনের সিটে ।টুকটাক কথা চলছে, সেই সাথে আমার বসের বাছাই করা কিছু ক্লাসিক গান ।উনি খুব রসিক লোক, গান কবিতা খুব ভালোবাসেন ।আমরা একটা মিটিং সেরে ফিরছিলাম ।আজই সকালে আইজল এসেছি, মিটিং শেষ হতে অনেক দেরি হয়ে গেলো ।তবু ফিরে যাওয়াই শ্রেয় ভাবলাম । কাল যেহেতু ক্রিসমাস তাই এখন আর কয়েকদিন আইজলে থেকে কোনও কাজ হবে না । আমরা অনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আইজল থেকে রওয়ানা হলাম । জীবন জিজ্ঞেস করলো, "কোন রাস্তায় যাবো?" আমরাই বললাম ছোট রাস্তায় যেতে । এই সময়ে নতুন রাস্তায় খুব ট্রাফিক সমস্যা হয় । তা ছাড়া বড় রাস্তায় নানা জায়গায় মেরামতির কাজ চলছে ।ছোট রাস্তা মানে দুতলাং হয়ে পুরনো রাস্তা, ঘুরপাক খেতে খেতে নেমে গেছে সমতলে । এমনিতে খুব সুন্দর, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, শুধু রাস্তাটি সরু, দুটো গাড়ি খুব কষ্টে পার হয়, আর প্রচন্ড খাড়া । তবে সন্ধ্যার পর প্রাকৃতিক শোভা উপভোগের কোন প্রশ্ন নেই, ঘোর জঙ্গলের অন্ধকার আর সাপের চলার মতো ঘন ঘন বাক নেওয়া রাস্তা । আমাদের জীবন-এর এতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় । রাস্তার প্রতিটি পাথর তার পরিচিত । তাই আমরা নিশ্চিত । গাড়ির গ্লাস অল্প খোলা, সেই ফাঁকে পাহাড়ের কনকনে ঠান্ডা বাতাস শীতের উপস্থিতি ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল । গ্লাস বন্ধ করার কোন উপায় নেই, ভেতরটা ঘেমে যায় । এমনিতেই অল্প দূরে দূরে জমাট বাঁধা কুয়াশা, তার উপর গ্লাস ঘেমে সাদা হয়ে গেলে চালাতে খুব অসুবিধা হয় । তাই এইটুকু অসুবিধা মেনে নিতেই হবে । একটু ঠান্ডা লাগছিল ঠিকই তবে আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছিল না । প্রাকৃতিক কারণে একবার গাড়ি থামিয়ে বাইরের খোলা আকাশের নিচে নেমে দাঁড়ালাম । না ভুল বললাম, খোলা আকাশ কোথায়, আকাশের নাম গন্ধ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।একপাশে বিশাল খাদ, অন্যদিকে ঘন জঙ্গল । দুপাশে বড় বড় গাছগুলো এই ঠান্ডায় একে অপরকে জড়িয়ে আছে। চারপাশ নিঃঝুম, একটানা বিরক্তিকর ঝিঝি পোকার ডাক । একটানা মন দিয়ে শুনলে কানে জ্বালা ধরে । আমার বস একটা সিগারেট জ্বালালেন ।খস করে একটা শব্দ হলো । দিয়াশলাই কাঠির এই আওয়াজটি যেন খুব ভারী। চমকে দেওয়া আওয়াজটি আমাদেরকে ঘুরপাক দিয়ে দুর থেকে দুরান্তে কারো উদ্দেশ্যে পারি দিল। আমার আবার সিগারেট চলে না। জীবন - এর কাছ থেকে একটা তাম্বুল চেয়ে নিলাম, এতে গা গরম থাকে । গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে । বেশ একটা গা ছমছম ভাব। গাড়ির আলোক বৃত্তের বাইরে অন্ধকার, অন্ধকার আর অন্ধকার আর সাদা ঘন কুয়াশা । বেশি দুরে রাস্তা দেখা যায় না ।আজ কোন তিথি বোঝার উপায় নেই । গাড়িতে আমরা চারটি প্রানী, আমরা তিন জন আর গীতা দত্ত । পুরনো গানের মজাটাই আলাদা, কেমন একটা নস্টালজিক হয়ে গিয়েছিলাম । হঠাৎ দুর থেকে ক্যারোলের আওয়াজ ভেসে এলো । এই উৎসবের প্রাক্কালে খ্রীস্টধর্মীরা ক্যারোল গানে মেতে ওঠেন । বেশ মিষ্টি লাগছিল শুনতে । কথা বোঝার উপায় নেই, মিজো ভাষায় তবে সুর খুব চেনা, চার্চ রোড মিশনে অনেক শুনেছি । বড় মিষ্টি । কেমন যেন ঘোর লেগে যায় । গাড়ি যত এগিয়ে যাচ্ছে সুর তত স্পষ্ট হতে থাকলো ।ক্রমশ মনে হচ্ছিল যেন আমারা চার্চের খুব পাশে চলে এসেছি ।অথচ আশ্চর্য চারপাশে জনবসতির কোনো চিহ্ন নেই । হঠাৎ গাড়ি বাক নিতেই গাড়ির আলোয় দেখি সমস্ত রাস্তা জুড়ে বেশ কিছু যুবক যুবতী ড্রাম গীটার হাতে নেচে নেচে ক্যারোল গাইছে । মনটা একটা স্বর্গীয় আনন্দে ভরে গেল । নিঃঝুম এ প্রাকৃতিক পরিবেশে মিজোদের এই ক্যারোল যেন একটা মায়াবী দৃশ্য । অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম । গাড়ি যত এগিয়ে যাচ্ছে চেহারাগুলি ততই ছবির মতো ফুটে উঠেছে । যেন স্বর্গের পরী আর দেবদুতের মেলা। আমাদের গাড়ির প্রতি ওদের কোন ভ্রূক্ষেপই নেই । আপন মনে গান গাইছে তারা । গাড়ি ক্রমশ ওদের খুব কাছে চলে এসেছে । "একী"... আমি চিৎকার করে ওঠলাম, -" জীবন গাড়ি থামা।" পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি গীটার হাতে ২৫-২৬ বছরের মেয়েটি গাড়িতে ধাক্কা লেগে পেছনের রাস্তায় ছটফট করছে । আর তার শরীর থেকে ছিটকে পড়া রক্তে পেছনের গ্লাসটি পুরো রক্তাক্ত হয়ে গেছে । বাকিরা সবাই এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । নিমিষেই ক্যারোল যেন কান্না আর চিৎকারে ভরে গেল । এক ঝটকা হতভম্ব মত গাড়ি থামিয়ে জীবন জানতে চাইলো, "কি হয়েছে স্যার?" আমার সমস্ত হাত পা থর থর করে কাঁপছে । মুখে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না । বহু কষ্টে পেছনের গ্লাসে রক্তের দাগগুলি দেখালাম । সঙ্গে সঙ্গে আমার বস আর জীবন গাড়ির পিছনে ছুটে গেল । "কোথায় রক্ত?" - বস কিছুই বুঝতে পারছিলেন না । আমার তখন চলার শক্তি নেই । আমি গাড়িতে বসেই পিছনের গ্লাসে রক্তের দাগ দেখিয়ে দিলাম ।আমার চারপাশে আর্তনাদ আর তাজা রক্তের ছড়াছড়ি।ওরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না ।জীবন আমাকে মুখের তাম্বুলটি ফেলে একটু জল খেতে বলে গাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে গেল । তার ধারণা এটা তাম্বুল খেয়ে ভ্রম সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু বেশি দুর তখনও যেতে পারে নি, দুই চার পা এগিয়েছে মাত্র, ওর কথার রেশ কাটেনি, তাকিয়ে দেখি জীবন কেমন একটা অস্বাভাবিক আচরণ করতে করতে মাটিতে বসে পড়েছে । মুখ দিয়ে কেমন যেন অদ্ভুত আওয়াজ বের হচ্ছে, অনেকটা সেই কুকুরের গোঙানোর মত। বস সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে ছুটে গেলেন । আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না খুব বড় একটা বিপদে আমরা ফেঁসে গেছি। বুকের ভেতর কেউ যেন ব্লেড দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়েছে ।হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যেন অনাদি কাল থেকে স্তব্ধ । বহু কষ্টে শরীরে শক্তি এনে প্রায় টলতে টলতে আমিও ছুটে যাই ওদের পাশে । কারো মুখে কোন কথা নেই । তাকিয়ে দেখি রাস্তার প্রায় অর্ধেক অংশ ধ্বসে নীচে চলে গেছে । আর একটু হলেই আমরা নির্ঘাত অতল খাদে তলিয়ে যেতাম । আমার শরীর খুব খারাপ লাগছিল । কেমন যেন বমি বমি ভাব, প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট..মাথাটা ঘুরছে কি, আমি পৃথিবীতে থেকেও যেন পৃথিবীতে নেই,.. আমাকে কে যেন দুর বহু দুরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে আমাকে কেউ শুনতে পাচ্ছে না..... . তারপর কিছুই মনে নেই ।

যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন আমি মিজো একটি গ্রামে শুয়ে আছি, প্রচন্ড জ্বর । বসের কাছ থেকে জানতে পারলাম জীবনও খুব অসুস্থ । স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে উনিই আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন। ওদের ধারণা হঠাৎ করে সামনে এরকম একটা ধ্বস দেখে ভয় পেয়ে গেছি । আমার বসও বিশেষ কিছু খুলে বলেন নি।

শুধু গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারটি আমাকে ফিসফিস করে বললো, - "মাই বয়, ইউ আর লাকী এনাফ, ইউ পিপুল হ্যাব স্টপড্ দি কার এট রাইট টাইম । ইটস্ এন একসিড্যান্ট প্রুন এরিয়া । লটস্ ওব পিপুল ডাইড হেয়ার ইন একসিড্যান্ট। লাস্ট ইয়ার অলসো এ ক্যারোল টিম অব টুয়েল্ব গাইস ডাইড দেয়ার ।ভেরি আনফরচুনেট, ভেরি আনফরচুনেট প্লেস ইট ইজ।সি, সী ইজ মাই ওনলি গ্রান্ড ডটার, ভেরি ভেরি লাভলি সী ওয়াজ । সী অলসো ডাইড উইথ দ্যট ক্যারোল টিম।" বলে বুড়োটা চোখ মুছতে মুছতে পকেটের পার্স থেকে একটি গীটার হাতে ২৫-২৬ বছরের মেয়ের ছবি আমার সামনে মেলে ধরলে । ফটোটি দেখে আমি চমকে উঠলাম । আধো আধো আলোতে আমি বুড়োর মুখটি দেখার চেষ্টা করেও পারলাম না । কিন্তু বারবার মনে হল লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি ।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments