কনা


কনা,
কেমন আছিস মা
অনেক দিন হলো
তোর কোন ফোন নেই
না কোন মেইল,
ওয়াটস্আপে মেসেজ
নিদেনপক্ষে ছোট্ট করে
একটা গুডমর্নিং উইশ
নাঃ, কিছুই না।
শেষ কথা যখন হয়েছিল
তুই তখন ভিয়েনা
বলেছিলি চিকাগোতে যাবি,
সেখান থেকে সানা হয়ে আস্তানা ।
এখন যেন কোথায় আছিস মা
মাস্কাট , বাকু নাকি মানামা।
নাকি হেলসিংকি হয়ে প্রিস্টিনা।

কত অদ্ভুত রে জীবন তোদের,
এই যে ঘর -বাড়ি - পরিবার -,
সবই অর্থহীন, অসাড়,
অমূল্য জীবনে অতিরিক্ত মাত্রা ।
আসলে তোরা জানিস, শুধুমাত্র যাত্রা
অনির্দিষ্টকালিন কল্পপথে
নিরলস পরিক্রমা ।
একটা বিচিত্র কর্মকান্ডে
নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে
এদেশ থেকে ওদেশ
ঘুরছিস আর ঘুরছিস
যেমন অনন্ত কাল ধরে
ঘুরপাক খাচ্ছে সূর্য তারই
অদৃশ্য 'নাকা'র টানে
মহাসূর্যে বাঁধা।
তুইও তেমনি মা
কতদিন রথে তোর
চটি জোড়া রাখা ।

আচ্ছা মা ,
তোর কি একটিবারও
মনে পড়ে না
তোর মায়ের কথা ,
এই যে আমি টিপ কিংবা লতা
নাকি সবাই
অনেক আগেই
তোর এই যান্ত্রিক জীবনে
হারিয়ে গেছি স্মৃতির গহনে।
আর কালে কালে ,তার'পরে
পলতে পলতে পলির স্তরে
কখন যেন ফসিল হয়ে গেছি
তোর ঐ ভুবনজোড়া মনে
হয়তো তুই নিজেই জানিস না ।

ভাবছিস, এবার কি হলো ?
ঘুম ভেঙে সকাল সকাল
হঠাতই মেঘের কালো।
কোথায় হলো ভুল
যা নিয়ে তোর মায়ের শুরু
আবারো হুলুস্থুল ।

নারে তুই, ভাবিস না মা
এযাবৎ সবই আছে ঠিক ।
ওয়ারড্রোপে লংপ্লে রেকর্ড
ব্যালকনিতে ক্রিসেন্থিমাম ফুল
কিংবা তোর স্টাডি রুমে
থরে থরে সাজিয়ে রাখা
জয় শঙ্কর তসলিমা বনফুল ,
সবই যথাস্থানে সঠিক ।
বাড়ি ভাড়ার টাকা--
এন এস সি আর টার্ম ডিপোজিট
সবটাই ব্যাঙ্কে রাখা ।
টেলিফোনের বিল ,
হকার, মাদার ডাইরীর দুধ,
মিনুর মাসিক বেতন
এগুলো আমার টাকায় শোধ।
ও নিয়ে তুই ভাবিস না
আমি এতো টাকায় করবোটা কি?
খাইতো শুধু দুমুঠো ভাত
একা লোক , তাতেই কাটে রাত।
ওষুধ? সে আর ক'টাকারই খাই
সেইতো দুবেলা প্রেশারের, সঙ্গে গ্যাস
আর ঐটা, ঐযে এলার্জি নাকি রেশ
এতেই শেষ । এতে আর কটাটাকা চাই।
আমার তো মা অন্য চাহিদা নাই ।

ওসব নিয়ে তুই আর মাগো
মিথ্যে ভাবিস না।
যদিও শরীরটা সেই আগের মত
সুবোধ নয়, শাসন মানে না।
কথায় কথায় মেজাজ দেখায়
ভাবখানা তার লাটসাহেবের
আপোষ জানে না।
তবু বলি তোকে আমি ,
মোটেই ভাবিস না ।
যা কিছু তোর ছিল সবই সামলে রেখেছি
যেথায় যা রেখেছিলি , আমি সেথায় রেখেছি
সবই আছে চকচকে তোর,
ফিটফাট আর ঝিকিমিকি
শুধু জানিস, জীবনটা যে
অন্ধকারে গায়ের জোরে
দিচ্ছে আমায় ফাঁকি ।
আহা, হাসিস না , হাসির কথা নয়
বয়েস সেতো বাড়বেই , সেকি থেমে থাকার হয় ?
কিন্তু মনটা কেন বুড়িয়ে যাচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে
সেটাই ভাবার বিষয় ।
কোথায় যেন ফাঁক থেকে যায়;
মনের পাতায় ধুলোর স্তর
ফুরিয়ে যাওয়া প্রদীপ যেন
কাঁপছে সদাাই থরথর
ঝরো হাওয়ায় ক্ষণিক ভুলে
এই না নিভে যায়।
জানিস মা, মাঝে মাঝে হিসেব মিলাই
কিসের আশে টানছি জীবন
সঠিক করে কি চায় এই মন
কিসের ঘানি টানছি আমি
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে বাঁচার তাগিদটাই ।
বলতে পারিস কি নেই আমার ?
মনের মত গুছানো বাড়ি
বেড়াতে যাওয়ার দামী গাড়ি
নাইবা থাকলো কাড়িকাড়ি
বাঁচার জন্যে টাকা যা চাই, আছে অনেকটাই ।
সত্যি বলি কোথায় আমার কিসের ভুলে
হারিয়ে গেছে জীবন থেকে বাঁচার তাগিদটাই ।

আমারও জানিস স্বপ্ন ছিল, অনেক কিছু পাওয়ার
অনেক দেশ ঘুরে ফিরে অনেক কিছু দেখার ।
হারমোনিয়ামটা পড়েই রইলো শেখা হলো না
গানগুলো সব হারিয়ে গেছে শোনাই গেল না ।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো একটু বিরাম চাই
সব কিছুকে সরিয়ে পাশে, কোথাও দুরে যাই
ফেনিল সাগর, চপল ঝর্ণা খাজুরাহের গুহা
কিংবা ছুটি তাজমহলে, বেগম সাহেবা শোয়া ।
মনে আছে খেলার ননদ, টুম্পিমাসির মেয়ে
বাপের বাড়ি প্রথম ম্যারেজ , যাচ্ছি বর নিয়ে।
সবই ঠিক টিকিট কাটা , বোম্বে হয়ে পুণে
শাশুড়িমা পড়ে গেলেন বাথরুমের কোনে।
সবাই গেল , ফুর্তি হলো বিয়ে বলে কথা
আমি শুধু থেকে গেলাম, শাশুড়ি মায়ের ব্যাথা ।
ঝিনুক ওরা সিকিম যাবে, আমরাও তার সাথে
সব কিছু ঠিকঠাক, খবর এল রাতে
তোর ছোটপিসীর শরীর খারাপ, প্রথম বাচ্চা হবে
শ্বশুরবাড়ি লোক নেই, দায়িত্বটা কে নেবে
বাধ্য হয়ে টিকিট বাতিল, সবাই গেল চলে
আমি শুধু থেকে গেলাম, বড় বৌদি বলে।
জানিস, এমনি অনেক কথা
এখন মনে পড়ে, ছবির মত
চোখের সামনে ভাসে ।
কত বার নিজের মনের ব্যাথা
লুকিয়ে মনের অন্ধকারে
ফুটিয়ে তুলি মুখে খুশির ছটা।
সখের গলায় কাঁটা দিয়ে
আমি শুধুই বোঝাই টানি
সং সাজি এই সংসারে ।
সবুজ পাহাড় আমারও আছে
অনেক ডাকে , হাতছানি দেয়
স্বপ্ন দেখায়, মুগ্ধ করে
কাজের পাহাড় নয়
ঢেউয়ের পর ঢেউ আসে,
ইচ্ছেডানার লয়।

না থাক ওসব কথা, ভালো লাগে না
আসলে মা হাঁপিয়ে গেছি আর পারি না।
নিজের জন্য কি করেছি
কলুর ঘানি টেনেই গেছি
পথের শেষে ঘাটে এসে
কাঁধের ঝোলায় বৃথাই খুঁজি
খুশির খাজানা।

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments