বিস্কুট
গুজরাট ট্যুরে বেরিয়েছি—মঙ্গলম ট্যুরিজমের সাথে।
গতকাল গির থেকে দ্বারকা এসেছি। যেখানেই যাচ্ছি, সেখানেই ভিখারীর ভিড়। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও ঝাঁক বেঁধে ছেঁকে ধরে—চোখে যেন কোনও প্রশ্ন নেই, শুধু অভ্যাস। মনে হল, ঘুম ভাঙা থেকে ঘুম নামা পর্যন্ত—এটাই তাদের রোজকার রুটিন।
রাজকোট থেকে বাস নেওয়া হয়েছিল, পুরো যাত্রাই এই বাসে। যদিও এয়ার কন্ডিশনড, তবু পথ এতটাই লম্বা যে ক্লান্তি জেঁকে বসে। উপরন্তু রাস্তার বেহাল দশা—একদিকে নির্মাণকাজ, অন্যদিকে দু’পাশে জঞ্জাল আর নোংরা ছড়ানো। দেখে দেখে চোখ যেন অবশ হয়ে গেল।
ইচ্ছে ছিল গতকাল সন্ধ্যাতেই দ্বারকাধীশজির আরতি দর্শন করব; কিন্তু দেরি আর ক্লান্তির কারণে তা সম্ভব হলো না।
সকালে ন’টায় রওনা। ট্যুর ম্যানেজার রুট ঘোষণা করলেন—নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, ভেট দ্বারকা, গোপী তালাব, তারপর রুক্মিণী মন্দির। কিন্তু অজানা কারণে বাস প্রথমেই সোজা রুক্মিণী দেবীর মন্দিরেই পৌঁছে দিল।
প্রাচীন মন্দির—দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো, মাঝে মাঝে সংস্কার হয়েছে। লোককথায় আছে, রুক্মিণী দেবীর তৃষ্ণা মেটাতে শ্রীকৃষ্ণ মাটিতে আঘাত করে গঙ্গাকে ডাকেন। কিন্তু অতিথি দূর্বাশা মুনিকে আগে জল না দেওয়ার অপরাধে তিনি অভিশপ্ত হন—তার সঙ্গে গোটা অঞ্চলও। সেই থেকে আজও এখানে পানীয় জলের সঙ্কট চরম।
মন্দিরে ঢুকতেই মাইকে ঘোষণা—জলদানের অনুরোধ। একদিনে হাজার টাকা, আধাদিনে পাঁচশো, ন্যূনতম দান দুইশো। সবাই দিচ্ছে, আমিও দিলাম।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম—রশিদের কোনও ব্যবস্থা নেই। চোখের সামনে টাকার স্তুপ—কিন্তু হিসেব? সবটাই লোক ঠকানো নয় তো? সন্দেহের কাঁটা বিঁধে রইল মনে।
ওখান থেকে ভেট দ্বারকা। সরাসরি কোনও বাস বা ব্যক্তিগত গাড়ি যায় না। অটো নিতে হয়। ভাড়া শুনে মনে হল—মানবতারও যেন আলাদা ট্যাক্স আছে এখানে। অটোওয়ালারা পথিমধ্যে আরও দুটি অখ্যাত মন্দির দেখিয়ে তারপর মূল মন্দিরে পৌঁছে দেয়—এটাই 'নিয়ম' এড়ানোর উপায় নেই। ঠাঠা গরমে, অটোতে ঠোক্কর খেতে খেতে যাত্রা সত্যিই অসহনীয়।
ওখান থেকে ভেট দ্বারকা। সরাসরি কোনো বাস বা ব্যক্তিগত গাড়িতে মন্দির প্রাঙ্গণে যাওয়া যায় না। বাস গিয়ে দাঁড়ায় দূরে এক স্যান্ডে যেখান থেকে ইচ্ছে করলেও পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয় । সেখানেই সার সার অটো—দশজন করে গাদাগাদি বসে যাত্রা। মাথাপিছু একশো টাকা। অটো গুলো দ্বারকা ছাড়াও আরও দুটো অখ্যাত মন্দির দেখিয়ে যথাস্থানে ফিরিয়ে দেয়। বিকল্প নেই—এভাবেই ‘নিয়ম’ করা হয়েছে। বিরক্তিকর ব্যবস্থা । ঠাঠা গরমে অটোতে ঠোক্কর খেতে খেতে চলা সত্যিই অসহনীয়।
প্রথম দুটি মন্দির মোটেও ইমপ্রেসিভ নয়—গিয়ে আফশোসই হল। শেষে যখন ভেট দ্বারকায় পৌঁছালাম, অনেকটাই দেরি। অটো থেকে নামতে গিয়ে চশমা খুলে পকেটে রাখতে রাখতে বিপত্তি।
নামতেই চারদিক থেকে আট-দশজন ভিখারি ঘিরে ধরল। এক পা ফেলার জায়গা নেই। মন্দির একটায় বন্ধ হয়—ঘড়িতে সাড়ে বারোটা। হাতে মাত্র আধঘন্টার সময়। ভিখারিগুলো এমন ছ্যাচড়ে যে তাড়ালেও সরছে না। কোনোমতে ওদের ঘেরাটোপ এড়িয়ে এগোলাম।
গরমে ও ঘামে শরীর চিটচিট করছে।
মেয়ে বিস্কুটের প্যাকেট আর জল বাড়িয়ে দিল—
“খেয়ে নাও। সকাল থেকে কিছু খাওনি। শরীর খারাপ করবে।”
কথাটা ঠিক। প্যাকেট খুলেছি—ঠিক তখনই ওদেরই একজন, ছয়-সাত বছরের অপুষ্ট একটা বাচ্চা, আমার পাঞ্জাবি ধরে টানাটানি শুরু করল। পেছনে আরও অনেক অভুক্ত পেট। বিস্কুটের প্যাকেটটাই ওদের চাই।
ধুলোমাখা, নোংরা হাতে আমার নতুন পাঞ্জাবিতে ঘিনঘিনে দাগ। মাথায় যেন আগুন ধরে গেল।
মুহূর্তে কষে একটা চড় বসালাম। দলের লোকেরা থামাল—না হলে দু’চার ঘা আরও পড়ত। এমনটা যে ঘটতে পারে বাচ্চাটির ধারণাতেও ছিল না। ধপাস করে দূরে গিয়ে পড়ল। তারপর কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর এগিয়ে আসার সাহস নেই। পাঞ্জাবির দাগটা দেখলেই রাগে চোখ জ্বলে উঠছিল।
এতসবের মধ্যেই আরও সময় নষ্ট। মন্দির গেটে প্রচণ্ড ভিড়, অসভ্যের মতো ধাক্কাধাক্কি। ছেলে-মেয়েদের আলাদা লাইন নেই। বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করছিল; কিন্তু উপায় নেই, এই ভিড় ঠেলে বেরোনো অসম্ভব।
অবশেষে দর্শন হল। কষ্ট হলেও মনে একটু শান্তি এলো। কথায় আছে—দ্বারকাধীশ ও ভেট দ্বারকা—দুটোর দর্শন না হলে নাকি দর্শন পূর্ণ হয় না। একটি তো হলো—সন্ধ্যায় আরেকটি হবে।
দর্শন শেষে অটোতে উঠছি—ঠিক তখনই দেখি, সেই বাচ্চাটাই আবার আমার পাঞ্জাবি টানছে!
সাহস দেখে অবাক হলাম। একবার মার খেয়েছে—তবুও শিক্ষা হয়নি, আবার এসেছে !
আমি কটমট করে তাকতেই সে পকেট থেকে কিছু বের করে দেখাল—
আমার চশমা!
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আঠারো হাজার দিয়ে কদিন আগে কিনেছি।
চিৎকার করে উঠলাম—
“এই বদমাশ! মেরা চশমা ওয়াপস দে ! চোর কাঁহি কা !”
ছুটে গিয়ে বোধহয় দু-চার ঘা বসিয়েই দিতাম, কিন্তু অটোওয়ালা মাঝে এসে বললে, "মত মারিয়ে সাব! উও চোর নেহি। আপকো যানেকা বাদ এক ঘণ্টা সে এহিপে খাঁড়া হ্যায়, চশমা লোটানে কে লিয়ে।”
আমি বললাম, “তুম নেহি জানতে - ইয়ে ভিখারি আসল মে চোর হতি হ্য় ।”
সে শান্ত গলায় বলল , “নেহি সাব। চশমা এহিপে গিরা হুয়া থা। ইয়ে বাচ্চা উটাকে রাখা, তবসে খাঁড়া হ্যায়।”
আমার তবু সন্দেহ দূর হল না। বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করলাম—
“কাঁহা মিলা তুমহে ইয়ে চশমা ?”
সে সেই জায়গাটা দেখাল—
ঠিক যেখানে আমি তাকে মেরেছিলাম।
হঠাৎই হুঁশ ফিরল। এই শিশুটি চোর হতে পারে না।
চুরি করলে কখনোই অপেক্ষা করত না।
নিজের ভুল বিদ্ধ করল আমাকে।
চশমা রুমাল দিয়ে মুছে চোখে লাগালাম—অক্ষত আছে।
চড় মারার জন্য প্রচণ্ড অনুতাপ হল। মনে হল, কিছু একটা দিয়ে ক্ষতিপূরণ করা উচিত। মানিব্যাগ থেকে একশো টাকার নোট বের করে তাকে ডাকলাম—ছেলেটা পাত্তাই দিল না। চলে যাচ্ছিল।
আমি ছুটে গিয়ে তার হাতে নোটটা গুঁজে দিলাম—
“কুছ খা লেনা, বেটা।”
বাচ্চাটা থামল। একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। মুখে নিস্পাপ হাসি— “নেহি চাহিয়ে…
হামে বিস্কুট মিল গয়া, সাব।”
মূহূর্তে নিজের গালে হাত বুলালাম— যেন কেউ কষে একখান বসিয়েছে। ছেলেটি নিঃশব্দে চলে গেল। টাকাটা আমার হাতেই রইল।
আমি তাকিয়ে দেখলাম— সে ধীরে ধীরে বড় হতে হতে ভিড়টাকে আড়াল করে সেই ভিড়ের ভেতরেই হারিয়ে যাচ্ছে।
আমি পাথরের মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম।
Comments
Post a Comment