হলুদ খাম



উবেরের ভাড়া চুকিয়ে এক মূহুর্ত গেটে দাঁড়ায় রুদ্র ।গেট পেরিয়ে লন তারপরই বিশাল আবাসন । আজ তিনদিন, রুদ্রের নতুন ঠিকানা - ১৮সি, নন্দিনী হাইটস, রাজারহাট, কলিকাতা ।
দিনগুলো যেন কুয়াশায় মোড়া। অফিসের ক্লান্তি, ট্রাফিকের হোঁচট, আর নিঃশব্দে ফোঁটা একাকীত্ব— এই নিয়েই রুদ্রের দিনচক্র।
 প্রতিদিনের মত চিঠির বাক্স খুলতেই পত্রিকাগুলোর ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে একটা হলুদ খাম— অচেনা, অস্বাভাবিক, যেন সময়ের ভুলে এখানে এসে পড়েছে। ভেতরে , পাতলা কাগজে গোলাপি কালিতে হাতের লেখা চিঠি 

"প্রিয় অরণ্য,
আজ তোর কথা বড় মনে পড়ছে রে ! জানিস, তুই যে রকমভাবে আমার হাসি পড়ে ফেলতে পারিস, সে রকমভাবে কেউ পারে না...", 

এই চিঠি রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে নয় । সে তো অরণ্য নয়, অরণ্য অন্য কেউ। তবে যিনি লেটারবক্সে রেখে গেছেন তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই কারণ খামের উপর কারো নাম লেখা না থাকলেও স্পষ্ট করে লিখা - ১৮সি, নন্দিনী হাইটস, রাজারহাট, কলিকাতা । চিঠিতে প্রেরকের কোন নাম, ঠিকানা নেই তবে তিনি যে মহিলা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অবাক লাগে রুদ্রের ।

চিঠিটা রুদ্রের কাছে অর্থহীন। সে অরণ্য নয় বা এই নামে কাউকে সে চেনেও না । কিন্তু চিঠিটা এমন আন্তরিক, এমন সহজ, যেন এক বন্ধুত্ব থেকে জন্ম নেওয়া প্রেম। বারবার পড়তে ইচ্ছে করে । সে চিঠিটা ফেলে দিতে চেয়েও শেষ অবধি পারে না।

তারপর এক সপ্তাহ কেটে গেছে । রুদ্র দৈনন্দিন ব্যস্ততায় চিঠির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল তখনই প্রায় এক সপ্তাহ পর আরেকটি চিঠি। সেই হলুদ মুখবন্ধ খাম। চিঠিটা হাতে নিতেই একটা নিষিদ্ধ উত্তেজনা রুদ্রের মনে । ভেতরে আবারও সেই পাতলা কাগজে গোলাপি কালিতে হাতের লেখা -

"প্রিয় অরণ্য, 
খুব না -- । মান অভিমান বুঝি তুই একাই করতে পারিস, আমি পারি না ? আমার বুঝি কষ্ট হয় না রে ! আমার কষ্ট হলে তোর কোন কষ্ট হয় না অরণ্য ? বুকে হাত দিয়ে বল !"

ছোট্ট চিঠি, কিন্ত পড়তে গিয়ে মন খারাপ হয়ে যায় রুদ্রের। মেয়েটা জানে না যে তার অরণ্যের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিগুলো বারবার বেহাত হয়ে যাচ্ছে । একটা কাঁটার মত অপরাধবোধ খচখচ করতে থাকে রুদ্রের মনে— যেন সে এক নিষিদ্ধ দরজায় উঁকি মেরেছে। অন্যের চিঠি এভাবে পড়া উচিত হচ্ছে না তার । 

ইন্টারকমে গেটের সিকিউরিটিকে কানেক্ট করে রুদ্র । ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে
-- গুড ইভিনিং স্যার। কি ব্যাপার ? কিছু চাই ?
-- গুড ইভিনিং, আমার একটা ছোট্ট কৌতুহল ছিল ?
-- বলুন স্যার--
-- আচ্ছা, আমার আগে এই ফ্ল্যাটে কারা থাকতেন আপনাদের জানা আছে কি ?
-- কেন স্যার ? কোন ডেমেজ বা --
-- না, না সেসব কিছুই নয়, জাস্ট ফর কিউরিসিটি-- । রুদ্র ওকে থামিয়ে দিয়ে প্রসঙ্গটা হালকা করার চেষ্টা করে ।
-- হ্যাঁ স্যার, আপনার আগে এই ফ্ল্যাটে - একমিনিট স্যার, দাঁড়ান দেখে বলছি ।
-- ওকে, ইটস ওকে । রুদ্র লোকটাকে সময় দেয় ।
-- আপনার আগে স্যার দুই বছর সাত মাস থেকেছেন সতীনাথ ভাদুরী ।
-- গুড তার আগে ?
তার আগে পাঁচ মাস খালি ছিল। তারও আগে থাকতেন অনিতা সীতারমন। 
-- অরণ্য নামে কেউ ? রুদ্র সরাসরি পয়েন্টে চলে যায় ।
-- আজ্ঞে না স্যার, আমার জানা নেই ।
রুদ্র অবাক হয় । -- আচ্ছা আমাদের কমপ্লেক্সে অরণ্য নামে কেউ আছেন কি ?
-- না স্যার, অপরেশ আছেন, অনিন্দ্য আছেন, আর - আর --হ্যাঁ, অলকানন্দা মেডাম আছেন- কেন স্যার ?
-- না, তেমন কিছু না । ঠিক আছে রাখছি । রুদ্র দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় । রুদ্র এবারও চিঠিটা তুলে রেখে দেয় ।
পরের সপ্তাহে আবারও এক চিঠি ।
"প্রিয় অরণ্য 
কাল তোকে দেখতে পেলাম অফিস থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিস, তখন কটা হবে, সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা - সঙ্গে ফর্সা মত একটি মেয়ে, কেরে এই মেয়েটা ? ওর জন্যেই তুই বুঝি আজকাল আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাস না ? তুই এতটাই বদলে গেছিস অরণ্য !
বিশ্বাস কর, তোকে খুব মিস করি রে আমি !"

চিঠিটা পড়তে পড়তে চমকে উঠল রুদ্র। কাল সত্যি সত্যিই রুদ্র আর মরমী একসাথে অফিস থেকে বেড়িয়েছে । ওকে বাড়িতে ড্রপ করে সে বাড়ি ফিরেছিল । কিন্ত এই মহিলা তা জানলেন কি করে ? তবে কি তাকে টুয়েন্টি ফোর ইনটু সেভেন ফলো করা হচ্ছে ? 

পরের সপ্তাহে আবারও একটি চিঠি। সব চিঠিই একজন "অরণ্য"কে লেখা, আর সব চিঠিতেই এক অদেখা মেয়ের নিঃশব্দ ভালোবাসা, গোপন অভিমান, কখনও হাসি, কখনও চোখের জল। কিন্ত কি এক অদৃশ্য জাদুতে সবটাই রুদ্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ।

"প্রিয় অরণ্য, 
কাল কফি হাউসে তোকে দেখলাম। একা একা কফি খাচ্ছিস । আমি তোর খুব কাছেই বসেছিলাম, আমাদের সেই কোণার টেবিলটাতে । তুই একবার ফিরেও তাকালি না । খুব অন্যমনস্ক লাগছিল তোকে । তোর মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে ।তোর কি খুব কষ্ট রে !

এবারও সবটাই সত্যি । সত্যি সত্যিই সে গতকাল কফি হাউসে গিয়েছিল। রুদ্র ইন্টারকমে আজ আবারও সিকিউরিটিতে ফোন লাগায় ।
-- আচ্ছা আমার বক্সে একটা হাতে দেওয়া চিঠি পাচ্ছি, কে দিয়ে গেছেন বলতে পারেন ?
-- হ্যাঁ, স্যার, একজন ভদ্রমহিলা --
-- নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার ?
-- না স্যার, যারা ভেতরে যান, শুধু তাদের নাম ঠিকানাই লিখে রাখা হয়ে থাকে । আপনার চাই কি স্যার?
-- হ্যাঁ, পেলে খুব ভাল হতো । কিন্ত-
-- উনি তো দুদিন দিন পর পরই এসে খোঁজ নিয়ে যান, আপনি চিঠির উত্তরে কোন চিঠি দিলেন কিনা ।
-- তাই ! কিন্ত আপনারা তো আমাকে কিছুই জানান নি ।
-- সরি স্যার।  
-- ঠিক আছে, আমি কাল সকালে একটা চিঠি দিয়ে যাব, উনি এলে দিয়ে দেবেন। কথাটা শেষ করেই রুদ্র টেলিফোন কেটে দেয় । রুদ্র চিঠি লিখে --

"-- কি দিয়ে সম্বোধন করি জানি না । যদি বন্ধু মনে করেন তবে তাই। আপনার তিন তিনখানা চিঠি বেহাত হয়ে আমার কাছে এসেছে । ঠিকানাটা আমার থাকায় খুলে পড়েছি । যদি অপরাধ করে থাকি, ক্ষমা করবেন। যোগাযোগের ঠিকানা দেওয়া থাকলে আপনাকে এত কষ্ট করতে হত না । ভাল থাকবেন। --
রুদ্র।" 

চিঠিটা লিখে নিজেকে খুব হালকা লাগছিল রুদ্রের । সেই সঙ্গে মনের সুক্ষ কোণে একটা কষ্ট, একটা যন্ত্রণা । রুদ্র জানে এই চিঠি পাওয়ার পর আর কোন হলুদ খাম আসবে না রুদ্রের কাছে । এই কটা দিনে অজান্তেই একটা অদ্ভুত টান তৈরি হয়ে গেছে রুদ্রের। 

চিঠির আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল রুদ্র কিন্ত ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় আবার চিঠি এল । এবারের চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই-

"আজ আমি আমার সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হলাম নাকি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নতুন বন্ধনে জড়ালাম, আমি জানি না । আমি বোধহয় তুই বলার অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছি আজ । আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে এখন।
আমি খুব বিরক্ত করেছি জানি, কিন্ত এতটা নিষ্ঠুর না হলে কী এমন ক্ষতি হত ! না হয় আমি মিথ্যার জগতেই থাকতাম, তবু বেঁচে থাকার একটা প্রেরণা তো থাকতো ! এখন আমি কী নিয়ে বাঁচি ! ঠিকানার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, তবু দিলাম। 
বন্যা ।"

মন খারাপ করা চিঠি । রুদ্র অচেনা সেই রমণীর প্রতি একরকম টান অনুভব করতে লাগল। সে চিঠির উত্তর দিল, 
"বন্যা,
আমি অরণ্য নই। কিন্তু তোমার প্রতিটা শব্দ আমি পড়েছি। পড়ে, ভালোবেসে ফেলেছি।"

এক সপ্তাহ কেটে যায়, কোন উত্তর আসে না।
তার পর, এক সন্ধ্যায়, চিঠির বাক্সে আবার একটা খাম।

"তুমি অরণ্য নও, জানি। কিন্তু আমি তোমার চিঠিটাও পড়েছি বারবার। আর ভাবছি, আমরা কি ভুল ঠিকানাতেই সঠিক ঠিকানা খুঁজে পেলাম?"

শেষ লাইনটা পড়ে রুদ্র থমকে যায়। এক ভুল চিঠির পথ ধরে, দুটি মানুষ যেন সময়ের ভুল ঘরে এসে দেখা করল।


চিঠির সেই লাইনটা পড়ে রুদ্র অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। বুকের ভিতর অদ্ভুত এক টান, যেন কোনও পুরনো কথা, অথচ নতুন লাগছে।

সে এবার নিজেই চিঠি লেখে।

 “বন্যা,
আমি জানি না একে কী নামে ডাকি, শুধু জানি—তুমি না থাকলে একটা শূন্যতা হাঁ করে থাকে আমার চারপাশে। আমরা কি দেখা করতে পারি?”

চিঠিটা নিজের হাতে তুলে দেয় গেটের সিকিউরিটিকে।
দুদিন পর — দরজা খুলতেই রুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে একজোড়া চোখ।

– “আমি বন্যা।”
সোজা, স্থির কণ্ঠ।
রুদ্র কথা হারিয়ে ফেলে।

– “তুমি আমায় দেখতে চেয়েছিলে। তাই এলাম। তবে বেশিক্ষণ থাকব না।”

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ । তারপর হেসে বলে “তুমিই তো একের পর এক চিঠি লিখে গেলে...” 
বন্যা হাসে । একটু থেমে বলে, তুমি পড়বে বলেই তো লিখেছিলাম। তখন জানতাম না, তুমি অরণ্য না হয়েও আমার একমাত্র ঠিকানা হয়ে উঠবে।

রুদ্র আপন মনে বলে,
---আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়উৎস হতে ।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে 
     বিরহবিধুর নয়নসলিলে 
         মিলন মধুর লাজে --
পুরাতন প্রেম নিত্য নতুন সাজে ।...

-- মানসী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বন্যার চোখ দুটো উজ্জ্বল ।
-- একদম ঠিক। 
বন্যা সশব্দে হাসে । বলে, তাহলে বলুন --
 -- মোরা আর জনমের হংসমিথুন ছিলাম 
ছিলাম নদীর চরে, যুগল রূপে,
এসেছি গো আবার মাটির ঘরে -- 

ওই সন্ধ্যে থেকেই ওদের কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ শুরু ।
রুদ্র বন্যাকে নিয়ে বেরোয়, হাঁটে, গল্প করে, সিনেমাতে যায় । সে ভাবে, এটাই হয়তো ভালোবাসা । এখানে চাওয়া নেই পাওয়া নেই শুধু মূহুর্তগুলো ভাগ করে নেওয়া । শব্দে আর নিঃশব্দে উদযাপন । বিকেল হতেই রুদ্রের ব্যস্ততা শুরু । না চাইতেই কেউ এসে পড়েছে তার জীবনে, ভুল ঠিকানায় ভুল চিঠির অছিলায় ।

বন্যা রুদ্রের গল্প শুনতে চায় । রুদ্র খুলে দেয় তার স্মৃতির কপাট । তার শৈশব তার যৌবন সব খোলা চিঠির মত পাঠ করে শোনায় সে বন্যাকে একে একে । বন্যা তাকে স্বপ্ন দেখায় ময়ূরপঙ্খী নাও-এর। যেখানেই স্বপ্নরা সব হাতের ছোঁয়ায় সত্যি হয়ে যায় ।
রুদ্র এবার বন্যাকে বলে, এবারে তোমার গল্প শুনি ।
বন্যার মুখ শুকিয়ে যায় । ছলছল চোখে বলে, আমার গল্প নেই। 
-- তবু --
-- বললাম যে, আমার কোন গল্প নেই, আমার গল্পে কোন সত্যি নেই। আমার অতীত নেই আবার ভবিষ্যতও নেই। 
রুদ্রের কাছে সব কটা কথা ধোঁয়াটে লাগে । বলে , তোমার কি খুব কষ্ট বন্যা ?
-- একসময়ে ছিল, এখন নেই। তারপর একটু থেমে বলে, আমার অতীত যদি অন্ধকার হয়, তুমি কি মুখ ফিরিয়ে নেবে রুদ্র ?
রুদ্র বন্যার হাত চেপে ধরে বলে, আমি তোমাকে হারাতে চাই না বন্যা !
বন্যা আলতো করে বলে, আমিও ।


দু’মাস এভাবেই কেটে যায়। সবকিছু স্বপ্নের মত এগোচ্ছে।
এক সন্ধ্যায় কফির পেয়ালা হাতে রুদ্র বিনা ভুমিকায় বলে – বন্যা, আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। সবসময়ের জন্য।
বন্যা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে । চোখ দুটো নিমেষে ঝাপসা হয়ে ওঠে । বলে, প্লিজ রুদ্র, ওকথা থাক ।
-- কেন, থাকবে কেন? আমরা এভাবে আর কতদিন ভেগাবন্ডের মত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াব ? তোমার কী ইচ্ছে করে না আমরা একসঙ্গে থাকি ?
– “আমি পারব না, রুদ্র। আমায় অসুবিধা আছে, বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ।”
কথায় কথায় কথা বাড়ে । রুদ্র বুঝতে চায় না।
বন্যা উঠে দাঁড়ায় । রুদ্রের পাশে গিয়ে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে একটা হাত রেখে বলে, আমরা এখন সম্পর্কের সীমান্তে পৌঁছে গেছি রুদ্র। এখানেই আমাদের সব কিছু শেষ । সম্পর্ক যখন চাওয়া-পাওয়ার চোরাস্রোতে ভাসে , ভালবাসার সেখানেই চিরসমাধি ঘটে ।
রুদ্র ওর হাত ধরে বলে— আমি মানি না বন্যা । তুমি শুধু আমার আর একমাত্র আমার, এটাই শেষ কথা ।
-- আমি যে সব বাঁধনের উর্ধ্বে রুদ্র। তুমি ভালো থেকো। আমাদের ঠিকানাটা ভুল ছিল না। তুমি ঠিক পথেই এসেছিলে। কিন্তু... অনেক দেরি হয়ে গেল।
কথা শেষ করেই বন্যা নিঃশব্দে ধীর পায়ে বেড়িয়ে যায় ।

সেই রাতেই বন্যার ফোন সুইচ অফ। পরের দিন একই অবস্থা । রুদ্র ঘনঘন ফোন করে, নো রেসপন্স । বিকেলে কফি হাউসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে রুদ্র, কিন্ত বন্যা আর আসে না।
একদিন, দুই দিন, তিনদিন, রুদ্রের পাগলের মত অবস্থা । অনেকগুলো আশঙ্কা ক্রমশ তার মাথাটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ।
রুদ্র বাড়ি ফিরে পাগলের মতো চিঠিগুলো এক এক করে পড়ে । তার কাছে সব কটা চিঠি তুলে রাখা আছে। রুদ্র খুঁজে খুঁজে চিঠি থেকে বন্যার ঠিকানা টুকে নেয় -- ৪/বি, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ।

রুদ্র সেখানে যায়। পুরনো এক দোতলা বাড়ি। একটু খোঁজাখুজির পর সামনের চায়ের দোকানের কেউ একজন বললেন —“বন্যা সেন? ও তো প্রায় দশ বছর আগেই মারা গেছে। একটা ট্র্যাজেডি ছিল — প্রেম, প্রতারণা, নাকি অবসাদ —। শুনেছি বিষ খেয়ে...”
রুদ্রের মুখ থমথমে। সে সবটাই শোনে, কিন্ত বিশ্বাস হয় না তার । বিশ্বাস না হবারই কথা । তার হাতে বন্যার লেখা অসংখ্য চিঠি । সেই হলুদ খাম, গোলাপি কালিতে লেখা .. ।
রুদ্রের মনটা খারাপ। সে একে একে কফি হাউস, পার্ক, রেস্তোরাঁ এমনকি গেটের সিকিউরিটি সব জায়গাতেই খোঁজ নেয়, কিন্ত--

রুদ্রের চোখে ঘুম আসে না । রাতের পর রাত কাটে অনিদ্রায় । অফিস যেতে ইচ্ছে করে না ।আজ নিয়ে অফিস কামাই চলছে আটদিন ।
বিকেল হতেই রুদ্র একের পর এক পুরনো জায়গাগুলোতে ফিরে ফিরে যায় যদি বন্যা ফিরে আসে, যদি ওর অপেক্ষাতে বসে থাকে একা একা ..

রাত গভীর হলে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে রুদ্র।
টেবিলে রাখা বন্যার অসংখ্য চিঠি । রুদ্রের ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাঁদে । একটা একটা চিঠি খুলে আবারও পড়তে থাকে রুদ্র। প্রতিটি মূহুর্ত যেন জীবন্ত। হঠাৎই নজরে আসে একটা খাম এখনও খোলা হয়নি । রুদ্র অবাক হয়, এমনটি তো হবার কথা নয় । সে খামটা খোলে 
ভেতরে একটা ছোট্ট চিরকুট —

"তুমি অরণ্য নও। কিন্তু তুমিই আমার সেই ঠিকানা —
যাকে ভুল ভেবেছিলাম, অথচ ঠিকই খুঁজে পেয়েছিলাম।
ওরা যা বলে বলুক, তুমি তো জান আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি আজীবন তোমারই থাকবো ।
ভালো থেকো।
বন্যা।”

হঠাৎই কাঁধে পড়ে এক ঠান্ডা, শান্ত হাত। রুদ্র চমকে ওঠে না। সে জানে। ভেতর থেকে এক নিঃসন্দেহ নিশ্চয়তা বলে—বন্যা ফিরে এসেছে, নীরবে, তার পাশেই। এই মূহুর্তে বন্যা তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে । নিজের হাতটা বাড়িয়ে সে সেই হাতটা শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি জানি বন্যা তুমি আছো, সব সময়ই, এই আমার পাশে পাশে । আমার নিঃশ্বাসের মত । কিন্ত ওরা যখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তখন ....
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারে না রুদ্র, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ।
রুদ্র অনুভব করে কেউ যেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । ঠান্ডা শীতল সেই অনুভূতি । টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য ঔষধ ।আজ অনেক দিন পর রুদ্রের চোখে ঘুম আসছে । রুদ্র শেষবারের মত শক্ত হাতে বন্যার হাত চেপে ধরে । যদি ঘুমের ঘোরে বন্যা আবারও হারিয়ে যায় ।

অবশেষে ১৮সি, নন্দিনী হাইটসে নেমে আসে শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা ।
ভোর হবার আগেই রুদ্র আর বন্যা হাত ধরাধরি করে বেড়িয়ে যায় । আজ ওরা গঙ্গার ঘাটে যাব । ওখানে সারাদিন শুধু ভাটিয়ালি গান আর গান, কোনও কথা নয় !





Comments