বিশ্বাস


বেলগাছিয়া মেট্রো থেকে সবে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি । এবার শ্যামনগর যাব । একটা গাড়ি বুক করতে হবে । একা হলে মটো নিতাম, কিন্ত সাথে আমার স্ত্রী ।
যাত্রী সাথী এপে অনেক কসরত করার পর একটা গাড়ি জোটে । প্রচন্ড গরম, তাই জেনে শুনেই এসি সিডান বুক করেছি, কিন্ত গাড়ি এসে থামতেই মন খারাপ হয়ে গেল । গাড়িটা পুরনো, সারা বডিতে স্ক্রেচ। উইনডোগুলো ম্যানুয়াল। শালা ! আমার কপালটাই এমন ! বাইরে ভ্যাপসা গরম, ভেতরেও তাই ।
আমি সাধারণত সবসময়ই সামনের সিটে বসি । আজও তাই করলাম। সিট ব্যাল্ট লাগাতে লাগাতে শুনছি, আমার স্ত্রী বলছেন, এসিটা চালিয়ে দিন ।
-- এই দুমিনিট ম্যাডাম, সামনের পেট্রোল পাম্প তেল ভরে চালিয়ে দিচ্ছি ।
তারপর এক মিনিট বিরতি দিয়ে সরাসরি আমাকে বললেন, স্যার আপনি কি টাকাটা ক্যাশ পেমেন্ট করতে চান নাকি জিপেতে ?
--কিসে আপনার সুবিধা ? আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম । 
-- স্যার, জিপে হলেই ভাল হয় ।
আমার মনে একটা দ্বিধা ছিল। গন্তব্যে এখনও পৌঁছাইনি। আগেই ভাড়াটা দিয়ে দিলাম তারপর বললে যাবে না । তারচেয়ে জিপেতে একটা প্রমাণ থাকে । আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে সেইমত পেমেন্ট করে দিলাম।
লোকটা ব্যালেন্স চেক করল। পেমেন্ট ঢুকেছে কিনা দেখে নিশ্চিত হল।
তবুও তার অস্বস্তি কিছুতেই কাটছে না।
দেখি, ফোনে কাউকে কল করার চেষ্টা করছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার?”
লোকটা আমার প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে ফোনে ওপ্রান্তে থাকা লোকটাকে বলছে, ভাই তোর কাছে পাঁচশ টাকা হবে ? একঘন্টার মধ্যেই ফিরিয়ে দিচ্ছি ।
তারপর ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, চেষ্টা বৃথা।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার?”
লোকটা ইতস্তত করে বলল, “দেখুন স্যার, আমার কাছে টাকা নেই তা নয়। দেখুন—আপনার টাকা যোগ হলে এখন আমার একাউন্টে দুই হাজার পাঁচশ ছিয়াত্তর টাকা আছে।”
সে একটু থেমে বলল, “কিন্তু আমার মেয়ের টিউশন ফি বাবদ এখনই আড়াই হাজার টাকা দিতে হবে। আজ না দিলে বড় বিপদে পড়ব।”
সে আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কত চাই?
-- আপনি দেবেন স্যার ?
-- না হয় দিলাম, এক ঘন্টা পর ফিরিয়ে দিও ।
-- তাহলে স্যার তিনশ টাকা দিন ।
আমি আবারও যথারীতি জিপেতে টাকাটা দিলাম ।
-- আপনি যে আমার কি উপকার করলেন স্যার -
-- ঠিক আছে , কোন ব্যাপার না । আমি প্রসঙ্গ চাপা দিতে চেষ্টা করলাম। 
লোকটা ততক্ষণে পেট্রোল পাম্প ঢুকে তেল ভরছে। আমি মনে মনে ভাবছি কাজটা ঠিক হল তো ! যদি লোকটা টাকা ফেরত না দেয় ? আবার নিজেই মনকে বোঝালাম, মোটে তো তিনশ টাকা মাত্র।  এই অল্প টাকার জন্য যদি মানুষকে অবিশ্বাস করতে হয়, সেটা সত্যিই দুর্ভাগ্য। মনের মধ্যেই একটা দন্দ্ব চলছে ।
গাড়ি চলছে নিজস্ব গতিতে । কারো মুখেই কোন কথা নেই। গাড়ি চালানো অবস্থাতেই লোকটা মাস্টারের সাথে কথা বলে সঙ্গে সঙ্গেই টাকাটা পাঠিয়ে দিল । এবার তাকে অনেকটাই টেনশন ফ্রি মনে হচ্ছে ।
একটা ক্রসিংএ গাড়ি থামতেই লোকটা বললে, স্যার, আপনার মোবাইল নম্বরটা যদি দিতেন--
-- কেন ?
-- আমি একঘন্টার মধ্যেই আপনাকে টাকা ফেরত দিয়ে দেব স্যার, বিশ্বাস করুন।
-- ঠিক আছে , কিন্ত আমার নম্বর তো আপনার কাছে আছেই ।
-- তবু স্যার --
-- ঠিক আছে লিখে নিন ।
-- আপনি আমার নম্বরে একটা মিস কল দিতে পারবেন স্যার ?
তাই করলাম। নামার মূহুর্তে আবারও এক প্রস্ত কৃতজ্ঞতা জানালো লোকটা । মনে মনে একটা তৃপ্তি বোধ, হয়ত আমার ছোট্ট সাহায্য ওর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিল ।
বাড়িতে ফিরতেই মনটা ফুরফুরে । কাপড় ছেড়ে দুই কাপ কফি বানালাম। একটা নিজের জন্য আরেকটা আমার স্ত্রীর । আসলে আজকাল আমার কফি খাওয়া হয় না । ডাক্তারের নিষেধ আছে । কিন্ত আজকের দিনটা একটু ব্যতিক্রমী । এই দিনটা একটু সেলিব্রেট করা উচিত। বহুদিন পর টিভিতে একটা পুরো সিনেমা দেখলাম।
ঘন্টা তিনেক পর হঠাৎই একাউন্ট চেক করার ইচ্ছে হল ।
লক্ষ্য করলাম টাকাটা ঢোকেনি । এক মূহুর্ত থামলাম। লোকটা তাহলে টাকাটা দিল না ? মাত্র এই কটা টাকার জন্য এমনটা কেউ করতে পারে ? পর মূহুর্তেই মনে হল এক ঘন্টা মানেই যে ঘড়ি ধরে একঘন্টা - তা তো নয় । হয়ত রাতে বাড়ি গিয়ে পাঠাবে, হয়ত তখন একটা ফোনও করতে পারে ।
সে রাতে আর কোন ফোন বা টাকা কিছুই এল না ।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই একাউন্ট চেক করলাম। নাঃ, নেই।
যাত্রী সাথী এপের দৌলতে তার নামটা আমি জানতাম। ট্রুকলারে ওর নম্বরটা আছে কিনা চেক করে নিলাম। দেখলাম আছে ।
পরদিন পুরো দিনটাই উৎকন্ঠায় কাটে । তিনশ টাকার জন্য নয় । আসলে এত অল্প টাকায় কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে এই কথাটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না । বারকয়েক ফোন করতে গিয়েও নিজেকে সংযত রাখি । আরও খানিকটা সময় ওকে দিচ্ছিলাম।
আসলে যখন টাকাটা ধার হিসেবে দিয়েছিলাম, ফেরত নাও পেতে পারি জেনেই দিয়েছিলাম। তাছাড়া আমি ওর ঠিকানা জানি না, না দিলে কী করতে পারি ? এই টাকা আদায় করতে যদি আইনি পথ ধরতে হয় তবে খাজনার চেয়ে বাজনা অনেক বেশি হয়ে যাবে । 
কিন্ত এই মূহুর্তে আমি মনে প্রাণে চাইছিলাম লোকটা টাকা ফিরত দিয়ে দিক । এখানে টাকার পরিমাণ কোন বিষয় নয় আসল হচ্ছে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস, মূল্যবোধ কিংবা আস্থা !
তৃতীয় দিন মন স্থির করলাম—আজ একটা ফোন করব।
সকালের চায়ের কাপ শেষ করে প্রথমেই ফোনটা তুলে নিলাম।
বার দু’বার চেষ্টা করার পর, বেলা আটটার দিকে ওপাশ থেকে এক মহিলার গলা শোনা গেল—
“কে বলছেন?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি জ্যোতির্ময় বিশ্বাসের ফোন নম্বর?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি?”
একবার মনে হল সব কথা খুলে বলি।
কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আমাকে আপনি চিনবেন না।”
“কিন্তু আপনি?”
“আমি ওর মেয়ে বলছি। বাবা পরশুদিন বাগুইহাটির কাছে এক্সিডেন্টে…”
“এক্সিডেন্ট? সেকি কখন?”
“পরশুদিন সন্ধ্যেবেলা।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিন্তু সেদিনই তো উনি আমাকে শ্যামনগর নামিয়ে গিয়েছিলেন!”
“হয়তো তখনই ফেরার পথে…”
“ও মা! সেকি! এখন কোথায় আছে?”
“নেই… পোস্টমর্টেমের পর কালই সব শেষ হয়েছে।”
-- হে ঈশ্বর! নিজের কানকে নিজের বিশ্বাস হচ্ছিল না । জলজ্যান্ত মানুষটার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে । কতবার যে সেদিন লোকটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিল -
মনটা খারাপ হয়ে গেল। লোকটাকে নিয়ে কত বিরূপ ভাবনা ভেবেছি । নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। বললাম, এখন তোমার পড়াশোনা ?
-- এই মূহুর্তেই কিছু বলতে পারছি না । আগে সব কাজ মিটে যাক । তবে চেষ্টা করব বাবার স্বপ্ন যাতে সফল হয় ।
বললাম, আমি যদি তোমাকে কিছু টাকা দেই , নেবে ?
-- আপনি কেন মিছেমিছি টাকা দিতে যাবেন ? না তার কোন প্রয়োজন নেই।
-- আমি জানি তোমার বাবা কতটা কষ্ট করে তোমাকে পড়াচ্ছিলেন । তোমাদের ওই জিপে একাউন্টে দিলে তুলতে পারবে তো ?
-- পারবো ।
-- ঠিক আছে, দুহাজার টাকা পাঠাচ্ছি, তোমার বাবার কাজে লাগিয়ে দিও ।
-- ঠিক আছে জেঠু।
মেয়েটির জেঠু ডাকে কেমন একটা আপন করা ভাব । সারাটা দিন মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত ।
সেই রাতে ঘুম এল না। তিনশ টাকার জন্য কত সন্দেহ করেছি লোকটাকে, অথচ মানুষটাই আর নেই…
মোবাইলের স্ক্রিনে ট্রানজ্যাকশনের ‘সাকসেসফুল’ মেসেজটা একটানা দেখতে লাগলাম। মনে হল, হয়তো এই টাকাই জ্যোতির্ময়ের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখবে।
জানি না মেয়েটা কতদূর যাবে, কিন্তু অন্তত একবার বিশ্বাস রাখার আনন্দটা আজও রয়ে গেল।

তারপর কেটে গেছে আরও দুই মাস । মধ্যমগ্রাম থেকে ফিরছি বাড়ি, সেই শ্যামনগর। যাত্রীসাথীতে অনেক কসরত করে গাড়িটা বুক করার পর ড্রাইভারের নামটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম।
নামটা খুব পরিচিত। এক নামে দুজন লোক, কি করে সম্ভব?
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই গাড়ি এসে হাজির। সেই খাটারা গাড়ি । দরজা খুলে ড্রাইভারকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, তুমি ?
ড্রাইভার হেসে বলে, হ্যাঁ স্যার আমি জ্যোতির্ময় ।
আমি হতভম্ব, -- কিন্ত... তোমার যে এক্সিডেন্ট ...
ড্রাইভার চোখ নামিয়ে বলে, আমার যে মরেও মুক্তি নেই স্যার। এত ঋণ ...

আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি । হঠাৎই ড্রাইভারের কথায় চমক ভাঙ্গল, তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে বসুন । এখানে দাঁড়ানো যাচ্ছে না ।
মনের ইতস্তত ভাব নিয়েই ভেতরে ঢুকে বসলাম। ভাল করে ড্রাইভারকে লক্ষ্য করতেই ভুল ভাঙ্গল, এই লোকটা সেই জ্যোতির্ময় নয় । বুকের ওপর একটা পাথর চাপা ছিল, মূহুর্তের একটা দীর্ঘশ্বাসে হালকা হয়ে গেল। 

Comments