ভেবো না ভূত


সকাল নয়টা পঁচিশ। আকাশ থম মেরে আছে — ঠিক যেন কথাবার্তা বন্ধ করে রাখা একটা গ্রামীণ বিদ্যালয়ের মাঠ, যেখানে মাঝেমাঝে হাওয়া এসে চুপিচুপি ছোঁ মেরে যায়।
বাসটা যখন নিবেদনপুর মোড়ে থামল, ড. শ্রীময়ী রায় জানালার ধারে বসে। চোখ তুলে চারপাশ আরও একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বাস থেকে নামল শ্রীময়ী ।

খুব পরিচিত দৃশ্য — অচেনা গ্রাম, অচেনা মানুষ, আর কোথাও একটা লুকিয়ে থাকা কিছু… যাকে চট করে ভাষা দেওয়া যায় না। হাতে একটা ব্যাগ, ফাইলে নতুন নিয়োগপত্র, আর মাথার ভেতরে নানা হিসেব—

মনভূমি মেন্টাল রিহ্যাব সেন্টার-এর নতুন সাইকোলজিস্ট এখন ডঃ শ্রীময়ী রায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য: শহরের উদ্বিগ্ন, অবসাদগ্রস্ত মানুষদের প্রকৃতির ছায়ায় রেখে পুনরুদ্ধার। এই পদের জন্য প্রতিযোগিতা ছিল বিস্তর। কিন্তু ইন্টারভিউ-এর মাধ্যমে তাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে।

রোদ কম, আলো ঝাপসা।
ডানদিকে মাঠের ভিতর, সাদা রঙের একতলা-দোতলা ঘরগুলোর মাঝখানে লালচে একটা বিল্ডিং — মনভূমি।
সাইনবোর্ডে লেখা:
"মনের মধ্যে জীওনকাঠি, মনেই মৃত্যুকুপ ।"

প্রবেশপথে ঢোকেই ডানদিকে অফিস ঘর । একজন মহিলা রিসেপশন কর্মী হাসিমুখে এগিয়ে এল শ্রীময়ীর দিকে।
-- আপনি নিশ্চয়ই ড. রায়? সব ব্যবস্থা করা আছে। চলুন, আপনাকে ঘরটা দেখিয়ে দিই ।

বিশাল ইউ পেটার্নের বাড়ি । শ্রীময়ীর জন্য নির্দিষ্ট ঘরটা  একদম কোণার দিকে। সিঁড়ি ঘেঁষে, আলো আর অন্ধকারের মিশ্রণ । ভেতরে সাদা দেয়াল, কাঠের টেবিল-চেয়ার, একটা বইয়ের তাক। জানালা ঘেঁষে একটা চৌকি পাতা, তাতে সাদা বেডকভার দিয়ে ঢাকা টানটান বিছানা । বিছানার ঠিক মাথার কাছে দেয়ালের গায়ে অদ্ভুত বেশ কয়েকটি দাগ, যেন কিছুদিন আগে কেউ নখ দিয়ে আঁচড় কেটে গেছে । যেন দেওয়াল জুড়ে ধস্তাধস্তির চিহ্ন।  আবার নাও হতে পারে । হাতের কোন ছাপ নেই, নেই পাঁচটি আঙুলের চিহ্ন। আছে শুধু দেওয়াল জুড়ে বেশ কয়েক জায়গাতে  তিনটি মাত্র গভীর রেখা। ঘরে ঢোকা মাত্রই সমস্ত দৃষ্টি কেড়ে নেয় এই আঁচড়ের দাগ।

শ্রীময়ী চোখ ফিরিয়ে নেয়। নতুন জায়গা, নতুন চ্যালেঞ্জ। এভাবেই তো শুরু হয় সবকিছু।
রিসেপশনিস্ট চলে যাওয়ার আগে বলে যায়, আপনি একটু ফ্রেশ হয়ে নিন মেডাম। চা আর কিছু খাবার বলে দিচ্ছি, এই বেলা রুমেই সেরে নিন । সাড়ে দশটায় আপনার চেম্বার শুরু ।
শ্রীময়ী জানলার বাইরে তাকায়। দূরে মাঠের কোণায় কয়েকজন রোগী হাঁটছেন, মুখে একধরনের শান্তি। একেবারেই শান্ত পরিবেশ । শহরের জনজঙ্গল থেকে বেড়িয়ে এসে মন্দ লাগছে না তার। 

শ্রীময়ীর চেম্বার,  অফিস বিল্ডিংএর দোতলায় । পাশাপাশি বেশ কয়েকটি চেম্বার। একটা বাদে সব কটাই বন্ধ। শ্রীময়ীর জন্য বরাদ্দ তিন নম্বর কোঠা । শ্রীময়ী লক্ষ্য করল দেওয়ালে ছোট্ট করে লেখা --"অনুগ্রহ করে ভূত প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলুন।”
শ্রীময়ী লেখাটা পড়ে মনে মনে হাসে । এখানে সব কিছুই একটা অদ্ভুত যেন । শ্রীময়ী জানে ভুত আসলে মনের ভুল । মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যাবার আগে সে প্রমান করে যাবে এই সত্যটা ।
ঘড়িতে তখন ঠিক এগারোটা একান্ন । প্রত্যেক দিন প্রত্যেক রোগীরই একটা রুটিন চেক আপ হয় । এক এক করে শ্রীময়ীর রোগী দেখা প্রায় শেষ ।  দরজায় একবার কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল, তারপর ধীর পায়ে প্রবেশ করল একজন পুরুষ — মাঝবয়সী, রুগ্ন গড়নের, গায়ে ঢিলেঢালা একটা হালকা ধূসর পাঞ্জাবি, চোখে ফ্রেমহীন চশমা। হাতে এক টুকরো সাদা কাপড় চেপে ধরে আছে — যেন ঘাম মুছে, বা কিছুকে ঢেকে রাখছে।
শ্রীময়ী ফাইলে দেখতে পেল নাম শুভঙ্কর বিশ্বাস। বয়স সাত চল্লিশ। হিসেব করে দেখলে এখানে অবস্থান তিন বছর সাত মাস । চোখদুটো অস্বাভাবিক স্থির। যেমন করে নদীর পাশে বসে থাকা কাঁকড়ে তাকিয়ে থাকে—না দৃষ্টি সরায়, না ঝাঁপ দেয়।
শ্রীময়ী উঠে দাঁড়িয়ে বললে, -- বসুন, শুভঙ্করবাবু। কেমন আছেন আজ?
শুভঙ্কর হাসল না, কেবল বলল, আজ আমি একা এসেছি। ওকে বলিনি। তারপর চেয়ারে বসে, টেবিলের দিকে না তাকিয়ে, জানালার বাইরে দেখতে দেখতে বলল— আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন?”
প্রশ্নটা শ্রীময়ীর জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু এত সরাসরি আসবে ভাবেননি। হালকা হেসে বললে, আমাদের মূল লক্ষ্য হল আপনি কী ভাবেন সেটা বোঝা, আমি কী ভাবি সেটা নয়। তবে আপনার ইচ্ছা হলে… না, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না।
শুভঙ্করের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রেখা দেখা দিল — হাসি না অভিমত, বোঝা গেল না। -- আপনি বিশ্বাস করেন না বলেই ও আপনাকে পছন্দ করেছে।
কথা বলার ধরণ কেমন যেন অস্বাভাবিক।  আওয়াজ শুনলে গা ছমছম করে । শ্রীময়ীরও ঠিক তেমনটা অনুভব হল । তবু গলায় স্বাভাবিক স্বর বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলে, কার কথা বলছেন ?
-- আপনার সাথে পরিচয় নেই বুঝি ।
-- আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনি কার কথা বলতে চাইছেন। শ্রীময়ী নিজের পয়েন্টে স্টিক করে । 
শুভঙ্কর এবার হাতের কাপড়টা মুঠো করে ধরল, চোখ নিচের দিকে। বললে, যার ভয় নেই, তাকেই সে বেছে নেয়। কারণ যার মনে ভয় নেই, তার ভিতরে ফাঁকা জায়গা বেশি। সেখানে ঢোকা সহজ।
চেম্বারে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা।
শ্রীময়ী পেশাগত কায়দায় বললে, -- আপনার এই ‘ও’ কারও একটা প্রতীক, হয়তো আপনার ট্রমা, অথবা একধরনের ভয়। আপনি ওকে কবে থেকে দেখতে পাচ্ছেন?”
শুভঙ্কর চোখ তুলে তাকাল, চোখে জল । বললে, আমি কখনো ওকে দেখিনি। শুধু জানি, আমি ওর গল্প বলতে শুরু করলেই, সে চলে আসে আমার পাশে ।
একটা অদ্ভুত ঠান্ডা অস্বস্তিকর পরিবেশ । দুটো শালিক জানালার গা ঘেঁষে গাছটায় বসে ছিল । একটা ভয়ার্ত স্বরে আওয়াজ তুলে নিমেষে অদৃশ্য হল। 
শ্রীময়ী মাথা নত করে লিখতে লাগল, Patient displays delusional referencing. Constructs a second-person entity (‘ও’)...
শুভঙ্কর তখন ধীরে ধীরে বলে চলেছে —এই ঘরে যারা এসেছে, সবাই প্রথমে বলেছেন, ভূত নেই। তারপর কয়েকদিন পর তারাই বলেছেন — ‘আমার ঘাড়ের পিছনে কার নিঃশ্বাস?’”
শ্রীময়ীর কলম থেমে গেল এক মুহূর্তে। সে নিজেও এবার অনুভব করল—ঘরের তাপমাত্রা যেন হঠাৎ একটু কমে গেছে।
--আপনি ঘাড়ে নিঃশ্বাস টের পান? — শ্রীময়ী খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করল শুভঙ্করকে ।
শুভঙ্কর মুখে উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ। তারপর  তাকিয়ে থাকে, একটানা খানিকটা সময় । ঘরে পিন ফেলা নিঃস্তব্ধতা । তারপর উঠে দাঁড়ায় শুভঙ্কর । চেম্বার ছাড়ার আগে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল একটাই কথা, -- আপনি যদি একদিন নিজের কলম ছাড়া কিছু আর নাড়াতে না পারেন… তখন বুঝবেন ওর বিশ্বাসের কতখানি ওজন।”
দরজা বন্ধ হয়ে যায় । কয়েক মূহুর্ত লেগে যায় শ্রীময়ীর,  নিজেকে সামলে নেবার জন্য।  মনে মনে সে ঠিক করে যে, শুভঙ্করের কথায় কান দেবে না সে কিছুতেই।

রাত নামতেই হাসপাতালের চারপাশ আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পাখির ডাক থেমে গেছে অনেক আগেই । এখন শুধু থেমে থেমে পেঁচা কর্কশ কন্ঠ আর দূর বহুদূর থেকে ভেসে আসা বিড়ালের অদ্ভুত কান্না ।
শ্রীময়ী কোণের ঘরে ফিরে দরজা ভেজিয়ে বিছানায় বসে। রাতের খাবার খাওয়া শেষ । এখন বিশ্রামের সময় ।শহরের ক্লান্তি এখনো পুরোপুরি যায়নি, কিন্তু শুভঙ্করের কথাগুলো বারবার কানে বাজছে শ্রীময়ীর। 
"যার মনে ভয় নেই, তার ভিতরে ফাঁকা জায়গা বেশি। সেখানে ঢোকা সহজ।"
নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে শ্রীময়ী, এগুলো সবই মানসিক রোগীর অবাস্তব ভয়। তার পেশাগত কাজ এই ধরনের ভুল ধারণা দূর করা।
ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে দশটার দিকে। শ্রীময়ী ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়ে। বিছানার চাদরটাও যেন হিমশীতল । ঘুম আসছিল না। দেওয়ালে চোখ রাখতেই, দিনের বেলায় শুকনো ও বিবর্ণ আঁচড়গুলো তাজা রক্তের মতো গাঢ় লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে।

হঠাৎ কানে এলো, দেয়ালের ও-পাশে যেন কেউ খুটখাট করছে। প্রথমে মনে হল ইঁদুর বা কুকুর হবে। কিন্তু শব্দটা থামল না — বরং দেয়ালের ভেতর থেকে যেন কেউ তিন আঙুলে খুঁড়ে চলেছে, আঁচড়ের শব্দ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে ক্রমশ।

শ্রীময়ী উঠে আলো জ্বালাতে যাবে — এমন সময় স্পষ্টভাবে অনুভব করল ঘাড়ের কাছে শীতল, ভিজে নিঃশ্বাসের মতো কিছু একটা। কাঁধের কাছে শিরদাঁড়া বেয়ে হিম স্রোত বয়ে গেল। যেন কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছে। সে ভয়ার্ত হাতে আলো জ্বালিয়ে বিছানার পাশে তাকাতেই — কিছু নেই। দেয়ালের আঁচড়গুলো তখনো তাজা, ভিজে, আর যেন সামান্য দুলছে।

পরদিন ঘুম ভাঙ্গতেই দেওয়ালে চোখ পড়ল শ্রীময়ীর। স্পষ্ট খোদাই করে লেখা, "আর মাত্র ছয়দিন, সাহস, নাকি ঘোড়ার ডিম ।" 
শ্রীময়ী চমকে ওঠে । রাতের অন্ধকারে কে ঘরে এসে এমন কাজটি করে যেতে পারে । মনে মনে সে সমস্ত ভয় থেকে মুক্ত হবার শপথ নেয় । 
অফিসে রিকিউজিশন পাঠিয়ে প্রত্যেকটি রোগীর কেস হিস্ট্রি পড়তে শুরু করে সে । সঠিক চিকিৎসার জন্য কেস হিস্ট্রি জানা ভীষণ জরুরি । একে একে সব ফাইল শেষে শুভঙ্করের ফাইলে এসে হোঁচট খায় শ্রীময়ী ।
রেকর্ড অনুযায়ী শুভঙ্কর আসলে একজন লেখক । তার কিছু মৌলিক লেখা আছে বটে, কিন্ত মূলত সে ভৌতিক গল্প লিখে থাকে। সেই নিয়ে সেই সময়কার পত্রিকাতে অনেক লেখালেখি হয়েছে । খুব জীবন্ত ছিল তার প্রতিটি গল্প । শেষ লেখা ছিল “ঘাড়ে নিঃশ্বাস” নামে এক অসমাপ্ত ভৌতিক গল্প। গল্পটা তার শেষ করা হয়নি, তার আগেই তাঁর মানসিক সমস্যা শুরু হয়ে যায়।
পান্ডুলিপিটাও অদ্ভুত, কোন ধারাবাহিকতা নেই । জায়গাতে জায়গাতে টুকরো টুকরো কথা আর পাতার পর পাতা জুড়ে অদ্ভুত লাল আঁচড়ের দাগ । একটা জায়গাতে লিখা — “যার ঘাড়ে নিঃশ্বাস পড়ে, সে আর কখনো নিঃশ্বাস ফেরাতে পারে না…”
শ্রীময়ীর সমস্ত শরীর সিরসির করে ওঠে এই একটা লাইনে । নিজের অজান্তেই ঘাড়ে হাত বেলায় শ্রীময়ী।

সারাটা দিন ব্যস্ততায় কেটে যায় । সন্ধ্যার পর শুরু হয় সব সমস্যা । প্রতিটি রাতেই নতুন নতুন কান্ড কারখানা । রাতে ঘুম আসে না চোখে । লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকতে হয় । ঘর অন্ধকার হলেই মনে হয় ঘরে কেউ একজন ক্রমাগত পায়চারী করছে । শ্রীময়ী তার প্রতিটি শ্বাসের শব্দ শুনতে পায় । অন্ধকারে শ্রীময়ীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয় । কিন্তু আলো জ্বলে ওঠা মাত্রই সব ভ্যানিশ। 
প্রতিদিন সকাল হতেই দেওয়াল লিখনে একটা দিন করে কমতে থাকে । শ্রীময়ীর নিজের বিশ্বাস ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে । যতই সে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চায়, ভয়ের অনুভূতিটা ততই যেন মনের ফাঁকফোকরে ঢুকে যেতে শুরু করেছে। সাইকোলজিস্ট হিসেবে সে জানে এভাবেই ভয় তৈরি হয়, কিন্তু বারবার ঘাড়ের কাছে হিমশীতল স্পর্শ অনুভব করতে করতে তার যুক্তি ভেঙে খান খান।

 কয়েকদিনের মধ্যেই শ্রীময়ী আরও কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে, সব কয়টা রোগীর ভিতর একটাই ভয় কাজ করছে । কিন্ত কেউই মুখ খুলতে নারাজ । প্রসঙ্গ উঠতেই সবার চাহনিটা পাল্টে যায় । ভয়ার্ত চোখে অদৃশ্য কারো দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। সমস্ত শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায় ।

একটা একটা করে  দিন কাটে, ভয় যেন পাথরের মত ঘাড়ে চেপে বসে শ্রীময়ীর। পাঁচ নম্বর দিনে শ্রীময়ী অফিসের সকল স্টাফদের ডেকে প্রতিটি রাতের পূঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনার বিশ্লেষণ দেয় । শ্রীময়ী লক্ষ্য করে প্রত্যেকের চোখে ভয় । শ্রীময়ী বুঝতে পারে ওরা প্রত্যেকে এই বিষয়ে অবগত কিন্ত মুখ ফুটে কেউ বলতে নারাজ। ওদের সাহায্য প্রত্যাশা করাই বৃথা । শ্রীময়ী সিদ্ধান্ত নেয় রাতে সে আজ নিজের কোঠায় না শুয়ে চেম্বারেই  রাত কাটাবে । এতে যদি পরিস্থিতির খানিকটা পরিবর্তন হয় ।
রাত গভীর হতেই একটা চাদর আর বালিশ নিয়ে সে তার চেম্বারে চলে যায় । এখান থেকে পুরো ক্যাম্পাসের অনেকটাই স্পষ্ট । আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শ্রীময়ী সরাসরি সামনের খোলা মাঠের দিকে তাকায় । লক্ষ্য করে অনেকগুলো লোক সারা মাঠময় ঘুরে বেড়াচ্ছে । কেউ কারো সাথে কথা নেই, শুধুই উদ্দেশ্যহীন পায়চারী । শ্রীময়ী ওদের আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করে, কিন্ত কাউকেই আলাদা করে চিনতে পারে না । প্রত্যেকটি লোকের গড়ন যেন শুভঙ্কর । শ্রীময়ী যত চেষ্টা করে ততই সে বিভ্রান্ত হতে থাকে । একটা সময়ে দেখতে দেখতে শ্রীময়ীর ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে আসে ।
আর ঠিক  তখনই ঘুমের ঘোরে শ্রীময়ীর মন হয় কেউ যেন ঠিক তার পিছনে গা ঘেঁষে শুয়ে আছে । তার প্রতিটি শীতল নিঃশ্বাস শ্রীময়ী স্পষ্ট অনুভব করছে ।  লোকটা যেন তার কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলতে চায় । শ্রীময়ীর ঘুম ভেঙ্গে যায় । তাকিয়ে দেখে জানালার প্রতিটি পাটে একটি শুভঙ্কর দাঁড়িয়ে । তাদের হাতে মাত্র তিনটে আঙুল।  সেই আঙুল দিয়ে জানালার কাঁচে ক্রমাগত আঁচড় টানছে শুভঙ্করেরা।  শ্রীময়ী প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে লাইট জ্বলিয়ে দেয় । আলো জ্বলতেই সবকিছু ফাঁকা । শ্রীময়ীর সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে । বুকের ভেতর প্রচন্ড ধুকধুকানি। গলা শুকিয়ে কাঠ । কোণায় রাখা বোতল থেকে টানা দুই গ্লাস খায় সে । তারপর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে স্থির হয়ে বসে ।
তখনই চোখে পড়ে দেওয়ালে খোদাই করে স্পষ্ট লেখা 
-- "আর মাত্র একরাত, তোমার তুমি কুপোকাত। "
লেখাটা পড়া মাত্রই শ্রীময়ীর বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে যায় তৎক্ষণাৎ । ভোরের আলো তখন ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু হয়েছে । শ্রীময়ীর বুঝতে বাকি নেই যে আজকের রাতটুকুই তার জীবনের অন্তিম রাত । এর থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে একটা পথ খুঁজে বের করতেই হবে । এই মূহুর্তে শ্রীময়ীর মাথা কাজ করছে না । সে ভীষণ ক্লান্ত ।

একটা চিরকুট পাঠিয়ে সকাল বেলাতেই চেম্বার বন্ধ রাখার কথা জানিয়ে দিল শ্রীময়ী । আজ অনেক কাজ । এই সাতদিনের পুরো অভিজ্ঞতাটুকু মেইল করে হাইয়ার অথরিটিকে জানিয়ে দিতে হবে । যাতে তার অবর্তমানে যারাই আসবে তাদের যেন পুরোপুরি মানসিক প্রস্তুতি থাকে ।
শ্রীময়ী ল্যাপটপ নিয়ে লিখতে শুরু করে । লিখতে গিয়ে অনেক স্মৃতি। হাসপাতাল,  ফেলে আসা কলেজ, বন্ধু বান্ধব, পরিবারের সদস্য-- শ্রীময়ী কেমন একটা ইমোশনাল হয়ে যায় । সে জানে তার মৃত্যু স্থির।  হাতে আর কয়েক ঘন্টা সময় মাত্র। 
শ্রীময়ীর এখন কিছুই ভাল লাগে না । ওয়াটসআপে অনেকগুলো মেসেজ জমে আছে । দেখতে ইচ্ছে করছে না । ফেইসবুক,  ইন্স্টাগ্রাম একবার চোখ বুলিয়ে বন্ধ করে দেয় সে। তখনই নজরে আসে চ্যাটজিপিটি।  
শ্রীময়ীর মনে হঠাৎই বিদ্যুত খেলে যায় । তার মনে হয় যখন বুদ্ধি কাজ করে না তখন আর্টিফিশিয়েল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নেওয়া উচিত। 
যেমনি ভাবা, শ্রীময়ী তার সমস্ত রিপোর্ট আপলোড করে প্রশ্ন রাখে এখন তার কী করা উচিত। 
মূহুর্তে উত্তর আসে, সাহস ফিরিয়ে আনুন। 
শ্রীময়ী আবার লিখে, সাহস কি করে ফিরিয়ে আনা যায় ?
তক্ষুণি উত্তর আসে , মন স্থির হলে ।
-- মন কি করে স্থির করা যায় ?
উত্তর আসে, মেডিটেশনে। 
শ্রীময়ী কয়েক সেকেন্ড ধরে চেয়ে রইল সেই উত্তরের দিকে।
“মন স্থির হলে।”
হ্যাঁ, এ কথাটা সে বারবার রোগীদের বলে এসেছে। কিন্তু নিজের জন্য আজ অবধি বলেনি।

ল্যাপটপ বন্ধ করে শ্রীময়ী সোজা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ভোরের আলো তখন পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। দূরের মাঠে শিশিরে ভেজা ঘাস, কয়েকটা পাখি উড়ছে ধীরে ধীরে। সব যেন আগের মতোই স্বাভাবিক।

সে চোখ বন্ধ করল।
গভীর শ্বাস নিল একবার। তারপর ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল। আবার। আরেকবার।
মন শান্ত করার চেষ্টা করল। মনে মনে বলল —
"ভয় আমার মধ্যে নেই। ভয় আমার মনের বাইরে। আমি ভয় নই। আমি শ্রীময়ী।"

সন্ধ্যা হতেই শ্রীময়ী তৈরি। স্নান সেরে নিজের চারপাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে স্থির হয়ে বসে সে। অন্ধকার ঘর, সামনে মোমের নড়মড়ে আলো, চারপাশ নিস্তব্ধ। সে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস নিতে শুরু করে। শ্রীময়ী পদ্মাসনে বসা । আগেও মেডিটেশন করার অভিজ্ঞতা তার আছে । মোমবাতির শিখার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে প্রদীপের শিখাটি বুকের ঠিক মধ্যখানে প্রতিস্থাপন করতে চেষ্টা নেয় । কাজটা ভীষণ কঠিন কিন্ত অসম্ভব নয় । মন ভীষণ চঞ্চল,  কিছুতেই স্থির হতে চায় না । 
প্রথমে মনে হয়, কিছুই হচ্ছে না । মোমবাতির শিখা বাতাসে কাঁপছে, দেওয়ালের আঁচড়ে টাটকা রক্তের রঙ । 
কিন্ত শ্রীময়ী আজ বদ্ধপরিকর। আজ তাকে জিততেই হবে । একদৃষ্টিতে মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। মনের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে শ্রীময়ী । ধীরে ধীরে মোমের শিখা ক্রমশ স্থির হয়, দেওয়ালের আঁচড়গুলোও চুপ। শ্রীময়ীর মুখ পাথরের মতো শক্ত। সে ফিসফিসিয়ে বলে,আমি শুদ্ধ, আমি সুস্থ, আমি নির্ভয় ।
শ্রীময়ী লক্ষ্য করে দেওয়াল জুড়ে কালো ছায়া। ক্রমশ সেই ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে । শ্রীময়ী নাভি থেকে বজ্র কঠিন স্বরে উচ্চারণ করে, আমি ভয় পাই না । আমি নির্ভয় ।  
দেওয়ালের কালো ছায়া কালো ধোঁয়ার আকার নেয় । সেই কালো ধোঁয়া মোমবাতির ফাঁকফোকর গলিয়ে তার পায়ের চারপাশে জড়িয়ে ধরে। শীতল, ভেজা কুয়াশার মতো সেই অদৃশ্য ধোঁয়া, পা বেঁধে ফেলে তার। শ্রীময়ীর কোমড় বেয়ে ক্রমশ ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠছে। ভেতরের ভয় ক্রমশ জমাট বাঁধছে, কিন্তু এবার সে ভয়কে আর ঠেকানোর চেষ্টা করছে না। বরং তাকে স্বাগত জানাচ্ছে — ঠিক যেমন মেডিটেশনের সময় সমস্ত চিন্তাকে আসতে দেওয়া হয়।

শ্রীময়ী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে। শ্বাসটাকে গভীর ও মৃদু করে। মনকে শুধুই নিজের ভেতর টেনে আনার চেষ্টা। দেওয়ালের আঁচড়, রাতের খুটখাট, ঘাড়ের ভিজে নিঃশ্বাস — সবকিছুর কথা মনে আসছে, তবু সে নিজের ভেতরে জোরালোভাবে বলছে — “এসো। আমি ভয় পাচ্ছি না। আমার ভেতর তোমার জায়গা নেই।”

কতক্ষণ কেটে গেল শ্রীময়ীর জানা নেই। হঠাৎ যেন চারপাশে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। ঘাড়ের কাছে সেই শ্বাস। এবার চোখ খুলল শ্রীময়ী।

দেয়ালের গায়ে ধূসর আলোয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে এক ছায়ামূর্তি। তিন আঙুলের লম্বা হাত, ফ্রেমহীন চশমা, আর সেই অচেনা-চেনা মুখ। শুভঙ্কর? নাকি কিছু আরেকটা?

শ্রীময়ী তার দিকে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে বলল,
— “তুমি কেবল আমার মনের ভেতরের ভ্রান্ত ধারণা। আমি তোমাকে ডেকে এনেছি, তাই তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ।  আমি চাইলেই যেমন তোমায় ডেকে আনতে পারি, তেমনি আমি চাইলেই তোমাকে বিদায়ও দিতে পারি।”
অন্ধকার, আর শুধু মোমবাতির কম আলোয় ঘর জ্বলজ্বল করছে এখন। শ্রীময়ী জানে, আজ তাকে ভয়ের সম্মুখীন হতে হবে। পালালে চলবে না। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিতে থাকে। মনে মনে জপ করতে থাকে—
“ভয় মনের, শরীরের নয়। ভয় আমার নয়। ভয়কে জয় করতেই হবে।”
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল, সে জানে না। হঠাৎ ঘরের বাতাস আবার হিমশীতল হয়ে আসে। পিছন থেকে সেই শ্বাস, সেই ভিজে ঠান্ডা নিঃশ্বাস যেন গলায় এসে জমে যায়। কিন্তু এবার সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
ছায়াটা ফিসফিস করে বলে—
“আর একরাত… তোমার তুমি কুপোকাত…”
ছায়ামূর্তির চোখদুটো যেন আগুনের মত জ্বলে উঠল। সে শেষ কামড় দিতে প্রস্তুত। শ্রীময়ীর, হাতে গুচ্ছ জলন্ত মোমবাতি । ধীরে ধীরে সে ছায়ার দিকে এগিয়ে যায় । মোমবাতি থেকে মোমের ফোঁটা কালো ধোঁয়ার উপর পড়তেই স্থানে স্থানে আগুনের ফুলকি । 
শ্রীময়ী শীতল অথচ শান্ত গলায় বলে— আমাকে ভয় দেখিও না । আমি এখানে রোগী নই, আমি চিকিৎসক। 

ছায়াটা থমকে যায়। যেন তার স্বর কেঁপে ওঠে। শ্রীময়ীর মনে হয় ঘরটা একটু উষ্ণ হয়ে আসছে। কালো ধোঁয়া ক্রমশ  ধীরে ধীরে, হাওয়ার মতো মিলিয়ে যেতে থাকে। শীতলতা সরে যাচ্ছে, দেয়ালের আঁচড়গুলো ম্লান হতে থাকে।

মোমবাতির আলোয় চারদিক আবার যেন স্বাভাবিক।
শ্রীময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ভোরের আলো ফুটছে। ঘাড়ে আর কোনো নিঃশ্বাস নেই।

শ্রীময়ী জানে, লড়াই এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু সে বুঝে গেছে — ওটা তারই ভেতরের ভয়, যাকে জিততে হবে।
শ্রীময়ী চোখ বন্ধ করে আরেকবার গভীর শ্বাস নেয়। আরও এবার চোখ খোলার পর সে দেখে — ঘর ফাঁকা। দেওয়ালে লেখা নেই, আঁচড়ও নেই। শুধু মোমের গন্ধ আর নিজের শান্ত নিঃশ্বাস।

সকাল হয়। দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই চারপাশের সব রোগীর মুখে এক অদ্ভুত বিস্ময় আর মৃদু হাসি। শুভঙ্করের আজ সব টেস্ট নেগেটিভ এসেছে । ভোরের গাড়িতে সে মনভুমি ছেড়ে চলে গেছে ।
একজন বৃদ্ধা শ্রীময়ীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আপনি পেরেছেন… আপনিই ওকে ফেরত পাঠিয়েছেন।”

শ্রীময়ী কিছু বলে না। শুধু হালকা হাসে।

কাছের মাঠের বাতাসে এবার আর শীতলতা নেই। রোদ পড়ছে, উজ্জ্বল আর উষ্ণ।

শ্রীময়ী মনে মনে ভাবে—

ভেবো না ভূত কিংবা একরাশ ভয়। ও আসলে শূন্যতা। আর শূন্যতাকে পূর্ণ করা যায়… নিজের সাহস আর স্থিরতায়।

বুকে ভর করে আসে এক অজানা শক্তি।
আর সেই প্রথম বার, শ্রীময়ী সত্যিই মুক্ত বোধ করে।

নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় শ্রীময়ী । তখনই হঠাত নজরে পরে টেবিলের উপর ছোট্ট একটা চিরকুট।  -- আমি আছি, আমি থাকবো, মনে,  বনে, অন্ধকারে ।
মূহুর্তে শ্রীময়ীর মনে খটকা দেখা দেয় । তবে কি সে সত্যি আছে, ঠিক ঘাড়ের পাশে ! শ্রীময়ী চমকে পিছন ফিরে তাকায় ! দেখে সেই কালো জমাট বাঁধা ধোঁয়া ঠিক তার পিছনে । তার দিকে তাকিয়ে হাসছে !

Comments