সবে মাত্র পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে দীপঙ্করের । দুবারের চেষ্টায় এম বি বি এস ক্লীয়ার হয়েছে । এবার একবছর ইনটার্নশীপ করতে হবে বলভদ্রপুরে । এখানে পোস্টিং না হলে দীপঙ্কর জানতেই পারত না যে এই নামেও কাছাড়ে একটা গ্রাম আছে ।
বলভদ্রপুর যদিও গ্রাম, তবে সেদিনও শুধুমাত্র হাটের জন্য পরিচিতি ছিল। এখন বেশ কিছু ঘর বাড়ি তৈরী হয়েছে, একটা স্কুলও আছে ।
দীপঙ্করের ভাবনায় যতটা ছিল তার চেয়েও দুর্বল এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র। একজন নার্স - সবিতাদি, একজন কমপাউন্ডার সুদর্শন বাবু আর একজন ফোর্থ গ্রেড কর্মচারী পল্টু এই নিয়েই বলভদ্রপুর সেন্টার। ডাক্তারের একটা পোস্ট আছে ঠিকই কিন্ত কেউই স্থায়ীভাবে এখানে থাকেননি। যারাই পোস্টিং নিয়ে এখানে এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই সন্ধ্যা ছটা বাজতেই স্টেশন লিভ করতেন । রাতে কোন ডাক্তারই থাকতে চাইতেন না । বছর পাঁচেকআগে একজন ডাক্তার এখানেই কোয়ার্টারে থেকেছিলেন কিন্ত কোন কারণে মাথায় গোলযোগ দেখা দেওয়ায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন । সেই থেকেই এখনও কোয়ার্টার খালি । সত্যি বলতে বাস্তবিকই এখানে রাত কাটানোর মত পরিবেশ নেই ।
দীপঙ্করের বাড়ি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে দুই রাত্রি দূরত্বে, আসা যাওয়া করার প্রশ্নই ওঠে না । কাছে পিঠে শহরতলিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে গেলেও খরচ আছে অনেক । তারচেয়ে নিখরচায় কোয়ার্টার পাওয়া যাচ্ছে, সাথে সবিতাদির বাড়ির ডাব্বা ব্যবস্থাটি মন্দ মনে হল না দীপঙ্করের। প্রথম রাতটা সুদর্শনবাবুর বাড়িতেই কাটাতে হয়েছে । খুব আন্তরিক ভদ্রলোক, কিন্ত পরিবার বড় । স্থায়ীভাবে ওখানে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া নিজস্ব একটা স্বাধীনতা থাকা চাই।
পরদিনই লোক লাগিয়ে সাজানো হল কোয়ার্টার। হাসপাতালের লোকেরাই সব ব্যবস্থা করে দিলেন । একা থাকতে গেলে যা কিছু জিনিসপত্রের প্রয়োজন হয়, সবিতাদি নিজেই লিস্ট করে সবটা আনিয়ে নিয়ে একটা একটা করে সাজিয়ে দিলেন ঘরটা।
বলভদ্রপুর গ্রামটিকে অজপাড়াগাও বললেও বেশি বলা হয় । আসলে আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের সেন্টারে এই হাসপাতাল বলা যেতে পারে । তবে এই হাসপাতালের কাছে পিঠে কোন জনবসতি নেই। এককালে চাবাগান ছিল, সাহেব ডাক্তার থাকতেন। তখনকার দিনে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার নেটিভ ইন্ডিয়ানদের গা ঘেঁষে, অসম্ভব। কিছুতেই হতে পারে না । এখন সাহেব নেই, কোয়ার্টারেরও হতশ্রী চেহারা কিন্ত দূরত্বটুকু আজও বজায় আছে । তবে আশেপাশের হাসপাতালে ডাক্তার না থাকায় এখানে সকালের দিকে বেশ ভীড় হয় । দিন বাড়ার সাথে সাথে সব ফাঁকা । সন্ধ্যার পর সময় কাটানো সমস্যা । কুপি নিয়ে গল্প করার লোক খুঁজতে হয় । আসলে সন্ধ্যার পর খুব বেশি রাত সাতটা, তারপর সবাই যে যার ঘরে চলে যায় ।তখন গ্রামটা নিঃস্তব্ধপুরী । ফাঁকা হাসপাতালে শুধু সুদর্শনবাবু ছাড়া কেউ থাকেন না। রাত সাড়ে সাতটায় একজন রোগী আসেন প্রেসার পরীক্ষা করাতে, ওইটুকু হয়ে গেলেই উনি বাড়ি চলে যান । দীপঙ্করের যাবার কোন জায়গা নেই। কোয়ার্টারের বারান্দায় বসে সময় কাটানো ছাড়া । মাঝে মধ্যেই গ্রামের কেউ কেউ আসেন "খুশগল্প" করতে, নিয়ম করে নয় । তাও ওই সাতটা অবধি । তারপর সব ফাঁকা । দীপঙ্করের প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তিবোধ হত, এখন আর হয় না । বই পড়ে, গান শুনে সময় কেটে যায় । তাছাড়া পিজির প্রস্তুতি নিতে বিস্তর পড়াশোনার প্রয়োজন। এখানে আসায় সেই অবসরটুকু ভীষণ ভাবে কাজে লাগাতে পারছে সে । মন্দ কাটছে না দিনগুলো ।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে একমাস সময় । সেদিন ছিল রাখীপূর্ণিমা । ঘড়িতে তখনও সাতটা বাজেনি । দীপঙ্কর বারান্দাতে বসে একটা বই পড়ছিল । এমনি সময়েই সুদর্শনবাবু এসে হাজির ।
দীপঙ্কর অনেকদিনই অনেকবার ওনাকে বুঝিয়েছে, এতরাত অবধি হাসপাতালে একা থাকার কোন মানে হয় না । কিন্ত ভদ্রলোক তবু ওই একটা পেশেন্টের জন্য শেষ অবধি রোজই থেকে যান । প্রেসার দেখা এমন কোন ব্যপার নয়, এটুকু কাজ দীপঙ্কর নিজেই কর নিতে পারে । কিন্ত ভদ্রলোক যেহেতু স্বেচ্ছায় দিতে রাজি নন, দীপঙ্কর কয়েকবার বলার পর আর বিশেষ পীড়াপীড়ি করেনি । আজ হঠাৎই সুদর্শনবাবু এসে হাজির।
বসতে বলায় বসলেন না । দীপঙ্কর বুঝতে পারছে উনি কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্ত বলতে পারছেন না ।
জিজ্ঞেস করায় বেশ ইতস্তত ভাবেই বললেন, স্যার আজ আমাকে আধ ঘন্টার জন্য একটু বাইরে যেতে হবে । আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি সাড়ে সাতটার আগেই ফিরে আসতে । তাও যদি দেরী হয়ে যায় - আপনি কি একটু হাসপাতালে বসবেন ?
-- নিশ্চয়ই , এতে এত ইতস্তত করার কি আছে ? শুধুই তো ওই লোকটার প্রেসার দেখে দেওয়া, সে আমি দেখে দেবোখন। আপনাকে আবার কষ্ট করে আসতে হবে না ।
-- না স্যার, আমি আসবো । দীপঙ্করকে থামিয়ে দিয়ে সুদর্শনবাবু জোর দিয়ে বললেন তিনি আসবেনই।
দীপঙ্করের কিছু করার নেই। কেউ আসতে চাইলে বাঁধা দেবার সে কে ?
-- কিন্ত স্যার, একটা কথা ছিল-
-- বলুন-- । দীপঙ্কর অবাক, আবার কি কথা থাকতে পারে ।
-- আপনি শুধু ওর প্রেসারটাই দেখবেন স্যার, এর বেশি আর কিছুই করতে যাবেন না ।
-- বেশ ।
-- আর লোকটা যখন জিজ্ঞেস করবে সব ঠিক আছে কিনা, বলবেন, সব ঠিক আছে ।
-- এটা কি ধরণের কথা হল সুদর্শনবাবু ? ঠিক না থাকলে তো আমি ঠিক বলতে পারবো না ।
-- প্লিজ স্যার, বোঝার চেষ্টা করুন, ওকে ঠিকঠাক বলেও কোন লাভ হয় না । আসলে লোকটা একটু অন্য প্রকৃতির।
-- ওষুধ লিখে দিলে খায় তো !
-- মনে হয় না স্যার। ওকে শুধু শুধু ঘাটাতে যাওয়া বা ওর সম্পর্কে কৌতুহল প্রকাশ করতে গিয়ে আগেও হিতে বিপরীত হয়েছে । তাই স্যার প্লিজ -
-- ঠিক আছে , মনে থাকবে । দীপঙ্কর আর কথা বাড়াতে চায় না ।
ট্রাউজার পড়া অবস্থাতেই একটা সার্ট গায়ে চাপিয়ে হাতের বইটা নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় গিয়ে বসে দীপঙ্কর ।
হাসপাতাল ছোট হলেও খুব সাজানো গোছানো । সিঁড়ি থেকে নামতেই দুপাশে সুন্দর বাগান। দেখাশোনা সবটাই পল্টুর নিজে করে থাকে । আসলে লোকটা খুবই পরিশ্রমী, আর গাছ ভীষণ ভালবাসে । হাসপাতালে বিশেষ কাজ না থাকলে অবসর সময়টা সে ওখানেই কাটায় ।
এই মূহুর্তে বাগানে হাসনুহারা ফুটেছে ।সারা ক্যাম্পাস গন্ধে মোমো করছে । দীপঙ্কর বারান্দায় বসা রোগীর অপেক্ষায় ।
ঘড়িতে তখন সাতটা সাতাশ, দীপঙ্কর দেখতে পেল দূরে একটা লোক অনেকটাই লম্বা, মাথায় হেট, গায়ে কোট চাপিয়ে ধীরে ধীরে হাসপাতালের গেট দিয়ে ভেতরে আসছেন। লোকটা হালকা পাতলা তবে শিরদাঁড়া একদম টানটান। তবু সাবধানতার জন্য হাতে একটা স্টিক । উনার জুতোর সাথে হাতের লাঠি একটা অদ্ভুত তাল ঠুকে ঠুকে এগিয়ে আসছে ।
ভদ্রলোক সামনের চেয়ার নিজেই টেনে নিয়ে বসে একটা অস্বস্তিকর খসখসে গলায় বললেন, একটু প্রেসার দেখে দেবেন?
দীপঙ্করের মন হল, কথাটা মূহুর্তের মধ্যেই প্রতিধ্বনি তুলে প্রথমে বাগান তারপর আরও, আরও দূরে চলে যাচ্ছে । একটা পেঁচা কাছেই কোন একটা গাছে বসা ছিল, হয়ত ভয় পেয়েই একটা কর্কশ আওয়াজ তুলে মূহুর্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দীপঙ্কর তৈরি ছিল । প্রেসারের ব্যান্ডটা লাগিয়ে নার্ভ দেখতে সবে হাতটা ধরেছে, ধরতেই চমকে ওঠে দীপঙ্কর। বরফের মত ঠান্ডা হাত । এত ঠান্ডা কারো হাত হতেই পারে না, যেন লাশ ঘরের কোন লাশ ! দীপঙ্কর লক্ষ্য করল লোকটার মুখে মিটমিট হাসি । প্রেসার মেশিনে চাপ দিতেই দীপঙ্করের প্রায় ভিমড়ি খাবার অবস্থা । পারদ কিছুতেই চড়ছে না । দীপঙ্কর অবাক, অদ্ভুত লাগছে সবকিছুই। অথচ আজ সকালে এই মেশিন দিয়েই সে অনেকের প্রেসার পরীক্ষা করেছে । গোলমাল ঠিক কোন জায়গাতে দীপঙ্কর বুঝতে পারছে না । মেশিনটা খুলে নিয়ে আরও একবার লাগিয়েও সেই এক রেজাল্ট। পারদ যেন পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে । দীপঙ্কর অবাক। হাসপাতালে অন্য কোন মেশিন নেই যা দিয়ে এই মূহুর্তে পরীক্ষা করা যেতে পারে ।
হঠাৎই মনে হল, নিজের প্রেসার নিজেই এই মেশিন দিয়ে পরীক্ষা করলে বোঝা যেতে পারে মেশিন ঠিক আছে কিনা । সঙ্গে সঙ্গেই নিজেই নিজের প্রেসার পরীক্ষা করল দীপঙ্কর। ঠিকই আছে । ভদ্রলোক চুপচাপ শান্ত, স্থির। বসে বসে সব লক্ষ্য করছেন।
দীপঙ্কর এবার আরও একবার প্রেসার পরীক্ষা করল কিন্ত সেই এক রিডিং । পারদ শূণ্য থেকে একচুলও নড়ছে না । দীপঙ্কর রীতিমত ঘামছে । রুমাল দিয়ে মুখ, কপাল বারকয়েক মুছে নিল সে। মাথা কিছুতেই কাজ করছে না । একটা লোকের প্রেসার শূণ্য হয়ে গেলে কি করে বেঁচে থাকতে পারে ? শুধু তাই নয়, দিব্যি এতটা পথ হেঁটে এসেছেন, শরীরে কোন সমস্যা নেই-- কি করে হতে পারে ? দীপঙ্করের ডাক্তারী শাস্ত্রে কোন ব্যাখ্যা জানা নেই।
লোকটার সাথে চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোক মিটমিট হেসে সেই খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কি ডাক্তার, সব ঠিক আছে তো ?
দীপঙ্করের মনে পড়ে গেল সুদর্শনবাবুর সাবধান বাণী । বারবার বলে দিয়েছেন, প্রেসার যা খুশি থাক বলতে হবে সব ঠিক আছে ।
কিন্ত, কিন্ত আজকের পরিস্থিতি একদমই আলাদা । লোকটার প্রেসার অস্বাভাবিক ভাবে ফল করেছে । যে কোন মূহুর্তে যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে । এমন একটা লোককে কি করে সব ঠিক আছে বলা যায় !
দীপঙ্কর ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আপনি সঙ্গে কাউকে নিয়ে আসেননি কেন ?
ভদ্রলোক ঠিক এই কথাটাই শুনতে চাইছিলেন মনে হয় । প্রচন্ড জোড়ে খসখসে গলায় এক পৈশাচিক হাসি হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক। হাসির শব্দে দীপঙ্করের শরীরের সমস্ত রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে প্রায় । খুব, খুব অপ্রস্তুত দীপঙ্কর, সেই সঙ্গে খানিকটা অজানা ভয় ।
ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, কেন ডাক্তার, সব ঠিক নেই বুঝি ?
দীপঙ্কর বলেই দিত, না কিছুই ঠিক নেই। কিন্ত সেই সময়েই হঠাৎই সুদর্শনবাবু উপস্থিত। দীপঙ্করকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেই প্রেসার দেখতে লাগলেন। তারপর খুব আস্তে করে বললেন, সব ঠিক আছে ।
ভদ্রলোক যেন খুব হতাশ হয়েছেন। মুখটা মূহুর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, ওহ্, তাই ! ঠিক আছে । কথাটা শেষ করেই ভদ্রলোক হনহন করে বেরিয়ে গেলেন হাসপাতাল থেকে ।
দীপঙ্করের খুব অপমান লাগল । প্রথমত লোকটার প্রেসার ঠিক নেই, তা সত্ত্বেও বলা হয়েছে সব ঠিক আছে । তার উপর সুদর্শনবাবু ঠিক যেভাবে হাত থেকে প্রেসার মেশিন কেড়ে নিয়েছেন, দীপঙ্করের তা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে । সুদর্শনবাবুর কাছ থেকে এধরণে আচরণ সে কোনদিনই প্রত্যাশা করে নি । কিন্ত মুখে কোন শব্দ উচ্চারণ করল না দীপঙ্কর।
চুপচাপ চলেই যাচ্ছিল দীপঙ্কর, সুদর্শনবাবু পেছন থেকে ডেকে বললেন, স্যরি স্যার।
দীপঙ্কর কোন উত্তর দিল না ।
সুদর্শনবাবু আবারও বললেন, স্যরি স্যার। আসলে লোকটা সত্যিই ঠিক না। আজ আট বছর ধরে আমি এই লোকটাকে দেখছি, ঠিক একই রকম। উনিশ-বিশ হয় না ।
-- তাই বলে আপনি মিথ্যে কথা বলবেন?
-- কিন্ত স্যার, আমাকে প্রথম দিন থেকেই বলা হয়েছে এই উত্তরটাই দিতে । আমিও সেই থেকে একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছি ।
-- কে আপনাকে শিখিয়ে দিয়েছে এসব?
-- তুলারামবাবু স্যার, আমার আগে যিনি এখানে কমপাউন্ডার ছিলেন ।
দীপঙ্করের কথাগুলো বিশ্বাস হল না । তার দৃঢ় বিশ্বাস সুদর্শনবাবুর এখানে কোন একটা 'ঘাপলা' আছে ।
তখনকার মত বিষয়টা এখানেই শেষ করে দিয়ে দীপঙ্কর কোয়ার্টারে ফিরে গেল।
পরদিন সকালে অনেকটা কৌতুহল বশেই লগ বুকে টেনে ভদ্রলোকের কেস হিস্ট্রি দেখতে গিয়ে দীপঙ্কর অবাক । ভদ্রলোকের কোন কেস হিস্ট্রি এখানে উল্লেখ নাই। অবাক লাগল বিষয়টা । একটা লোক রোজ রোজ, বছরে তিনশ পয়শট্টি দিন হাসপাতালে এসে তার প্রেসার দেখাচ্ছে অথচ হাসপাতালের খাতায় তার নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই।
সুদর্শনবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন, কি লিখব স্যার, লিখতে গেলে অসুবিধা আছে ।
-- তাই বলে কোনও নোটিং থাকবে না ?
সুদর্শনবাবু নিরুত্তর।
-- কি নাম ওর ?
সুদর্শনবাবু এবারও নিরুত্তর।
-- নামটা অন্তত বলুন, আমিই লিখে নিচ্ছি । দীপঙ্কর বিরক্ত হয়ে বলে ।
-- কাল রাতের ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলুন স্যার। ভুলে যান।
-- কেন ?
-- এই হাসপাতালের এইটাই নিয়ম ।
-- তাই ! তা নিয়মটা কে বানিয়েছে শুনি ।
-- আমি জানি না, তবে শুরু থেকেই এই নিয়মটাই কঠিন ভাবে মেনে চলা হচ্ছে ।
দীপঙ্করের বুঝতে অসুবিধা হল না, এখানে কিছু একটা বিষয় আছে যা ওরা খুলে বলতে চাইছে না ।
সুদর্শনবাবুকে জিজ্ঞেস করে এর বেশি কিছু জানা যাবে মনে হয় না । দীপঙ্কর পরদিন সবার অলক্ষ্যে সুযোগ বুঝে সিস্টার সবিতাদির কাছে প্রসঙ্গটা তুলতেই ভদ্রমহিলাও প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলেন । মূহুর্তে মুখ শুকিয়ে কাঠ । প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, আমি কিছুই জানি না স্যার, দয়া করে আমাকে এসব কিছু জিজ্ঞেস করবেন না ।
অদ্ভুত লাগল পুরো ব্যাপারটাই দীপঙ্করের কাছে, কিন্ত মুখে কিছুই প্রকাশ করল না । বিষয়টা সবটুকু না জানা অবধি দীপঙ্কর যে শান্তি পাচ্ছে না ।
বাড়ি যাবার আগে সবিতাদি আবার এলেন দীপঙ্করের কাছে । তারপর চারদিক ভাল করে দেখে ফিসফিস করে বললেন, এই লোকটার কথা ভুলে যান স্যার। ওর সম্পর্কে যে কৌতুহল দেখিয়েছে তারই ঘোর বিপদ ঘটেছে । আমারা কেউ ভুলেও ওর নাম উচ্চারণ করি না ।
-- কিন্ত কি নাম ওর ?
সবিতাদি শিউরে উঠলেন । বললেন, দোহাই স্যার, আপনি বোঝার চেষ্টা করুন।
-- ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনি এখন যেতে পারেন। দীপঙ্কর প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টেনে দেয় ।
এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যায় । দীপঙ্কর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, কবে সুযোগ আসে। মাথায় যে বিষ চড়েছে তা না নামানো অবধি শান্তি নেই যে । ইতিমধ্যে কেটে গেল আরেকটা মাস।
বলভদ্রপুর যেন আগের চেয়েও নিঃস্তব্ধ হয়ে উঠেছে। সুদর্শনবাবু আর কখনও দীপঙ্করের সঙ্গে সেই রোগীর প্রসঙ্গ তোলেননি। সবিতাদি আরও গুটিয়ে গেছেন নিজের মধ্যে। দীপঙ্করও বাইরে কিছু বলেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার মধ্যে কেমন একটা টানপোড়েন চলতে থাকে। ভেতরে ভেতরে খোঁজ নিতে থাকে দীপঙ্কর। পুরনো ফাইল, হাসপাতালের রেজিস্টার এক এক করে কোন কিছুই বাদ রাখে না সে। কিন্ত কোথাও কোন হদিস নেই। প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছে এমন সময় স্টাফদের কিছু ব্যক্তিগত ফাইলে তার হাত লেগে যায় । ফাইল তো নয় যেন ডায়েরি। একটা একটা দিনের কথা বিস্তারিত ভাবে লেখা । দীপঙ্কর ফাইলগুলো লুকিয়ে কোয়ার্টারে নিয়ে যায় । যত পড়ে ততই বিষ্ময় । সারারাত অনিদ্রায় কাটে দীপঙ্করের । এক সময়ে একটা জায়গাতে এসে দীপঙ্করের চোখ স্থির হয়ে যায় ! দীপঙ্করের মনের ভিতর তখন তুফান চলছে ।
সকাল হতেই সুসংবাদ। সুদর্শনবাবু অসুস্থ সাথে সবিতাদি ও ছুটিতে । দীপঙ্কর মনে মনে তাই চাইছিল আজ । সারাটা দিন ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যায়। কিন্ত দীপঙ্করের কোন অসুবিধা নেই বরং একটা উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে তার মন, কখন সন্ধ্যা হয় ।
সন্ধ্যা সাতটা বাজতেই দীপঙ্কর তৈরি । সময় যেন কাটতে চায় না । আজ সমস্ত রহস্যের সমাধান হতে চলেছে । একটা চাপা উত্তেজনায় দীপঙ্কর ঘনঘন অস্থির পায়চারী করতে থাকে ।
ঠিক সাতটা সাতাশ মিনিটে সেই শব্দ, জুতোর সাথে লাঠির ঠকঠক আওয়াজের অদ্ভুত সংমিশ্রন । একটা পেঁচা ঠিক সেদিনকার মত কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। দীপঙ্কর লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে ভদ্রলোক একটু একটু করে এগিয়ে আসছেন। সে তখন মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত । কিভাবে শুরু করবে, কি কি প্রশ্ন করতে হবে মনে মনে শেষবারের মত ছক কষা হয়ে গেছে ।
ভদ্রলোক প্রতিদিনের মত ঠিক সামনের চেয়ারটি টেনে নিয়ে সেই হাড় হিম করা খসখসে গলায় বললেন, একটু প্রেসারটা দেখে দেবেন ?
আজ দীপঙ্করকে ভয় পেলে চলবে না । চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে ধরে বললে, অবশ্যই মিস্টার জেকব হ্যারিসন এন্ড ওয়েলকাম টু ইওর হসপিটাল স্যার।
দীপঙ্করের কথাটা তখনও শেষ হয়নি, সশব্দে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। সেকি পৈশাচিক হাসি ! দীপঙ্করের মূর্ছা যাবার উপক্রম। এত করে গুছিয়ে রাখা প্রশ্নগুলো নিমেষে তালগোল পাকিয়ে গেল একলহমায়। দীপঙ্কর সব কথা হারিয়ে ফেলেছে ।
ভদ্রলোক হাসতে হাসতেই বললেন, এট লাস্ট ইউ হ্যাব আইডেন্টিফাড মি মিস্টার দীপঙ্কর ঘোষ, কংগ্রুচুলেশন।
দীপঙ্কর কথা হারিয়ে ফেলেছে । তার অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল। এই মূহুর্তে কিছুই মনে আসছে না ।
হঠাৎই ভদ্রলোক হাসি থামিয়ে বললেন, আমার যে আরও অনেক পরিচয় আছে দীপঙ্কর। আমিই ডক্টর হটন, আমিই ডক্টর জেকব আর কাল থেকে আমিই --
কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে ভদ্রলোক প্রচন্ড জোরে আবারও হেসে উঠলেন।
-- জানো দীপঙ্কর, ইটস এ লঙ ওয়েট ফর থার্টি সেভেন ইয়ারস। ইউ কেনট বিলিভ ইট। সামটাইমস আই গট ফ্রাস্টেটেড । আহ্, দীর্ঘ সাইত্রিশ বছরের অপেক্ষা, শুধু এইদিনটির জন্য। থ্যাঙ্ক ইউ দীপঙ্কর, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ।
কথাগুলো বলতে বলতে ভদ্রলোক ঠকঠক শব্দ করতে করতে যেদিক থেকে এসেছিলেন ওই দিকেই হারিয়ে গেলেন। সারা হাসপাতাল জুড়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতা ।
পরদিন সকাল থেকেই আবারও সেই ব্যস্ততা । ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সুদর্শনবাবু হাসপাতালে বসা ।
গেট খুলে একজন ট্রাউজার আর সার্ট পড়া ভদ্রলোক মাথার টুপিটা একটু বেশিই সামনের দিকে ঝোলানো, সোজা চলে আসে চেয়ারে বসে থাকা সুদর্শনবাবুর সামনে।
ঠিক সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে একটা অস্বাভাবিক খসখসে গলায় বলে ওঠে—
“আমার প্রেসারটা একটু দেখে দেবেন?”
সুদর্শনবাবু উঠে দাঁড়াতে গিয়েও কেঁপে ওঠেন। হাতের প্রেসার মেশিনটা মাটিতে পড়ে গিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে বিকল ।
অন্ধকার বারান্দা জুড়ে যেন কেবল সেই প্রতিধ্বনি বাজে— " আমার প্রেসারটা একটু দেখে দেবেন?"
Comments
Post a Comment