অসময়ে বৃষ্টি

শ্রাবণের বিকেল । সময়টা বর্ষাকাল, আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। সন্ধ্যা নামেনি তখনও, তবু আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে । মেঘেদের ব্যস্ত পায়ে এদিক ওদিকে ছুটো ছুটি । মাঝে মাঝে এ-ওর গায়ে ধাক্কা লাগতেই প্রচন্ড আওয়াজ তুলে তুলকালাম কান্ড। একটি ষাঁড় ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে ছুটছে পাগলের মতো । বিকেলের হাট ততক্ষণে ভেঙ্গে গেছে । যারা কাঁধের গামছাতে কেজি দুই চাল, একহাতে কেরোসিনের শিশি আর অন্য হাতে একটা মোরগ ঝুলিয়ে নিজেকে সেদিনের জন্যে রাজা বাদশা ভাবছিল, তারা পড়িমরি করে বাড়ি ছুট । একটা বুড়ি ছুটে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো, এ বাবু, আমার শাওলী গাইটাকে দেখলি গো ? কোন বাবুরই উত্তর দেবার সময় নেই । কেউ একজন ওপাশ থেকে বললো, এই বুধিয়ার মা, ঘরকে যা লো, ওই আপনে আপ ঘরকে আসবেক । দেখছিস নাই আকাশ কালা ক‌ইরেছে বারিষ আইসছে, যাঃ ঘরকে যা ।
বুড়ি যেতে যেতেই সেই কথার উত্তর দিল, হ রে বাপ, যাচ্ছি গো, যাচ্ছি । বহুত কালা ক‌ইরেছে রে । আজ হবেক, বুড়হা বাবার মাথা চ‌ইরেছে ।
-- হ রে মাই কার যে সত্তনাশ হবেক কী জানে । একটা বাজার ফেরৎ ব্যপারী পাশ দিয়ে যেতে যেতে মন্তব্য করলো । সত্যি একদম‌ই বিনা নোটিশে বৃষ্টি চলে এসেছে । মনে প্রাণে আমিও চাইছিলাম আরো কিছুটা সময় পরে বৃষ্টি আসুক, অন্তত যতটা সময়ে বাড়ি পৌঁছে যেতে পারি ততটা সময় পর। কিন্তু কোনদিন‌ই কোন কিছু আমার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী হয়নি । এবার‌ও তো তাই হবে মনে হচ্ছে ।
 ওদিকে বাতাসে সে কী আনন্দ ! কিছু শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজ আর পথে অবহেলাতে পড়ে থাকা ধুলোকণাগুলো আনন্দে আত্মহারা হয়ে হাওয়ায় ইচ্ছে মতন উড়ছে। একবার মাটি ছু্ঁয়ে আবার আবার শূন্যে উড়ছে, যেন অনেকদিনের শাসন শেষে আবার স্বাধীনতা পেলো ।

আমার অফিস থেকে বাড়ি অনেকেই পথ। পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। দু’পাশে চা বাগান, মাঝ বরাবর মেঠো পথ । ট্রাক্টর চলাচলের সুবাদে মাঝে মাঝেই রাস্তার অবস্থা শোচনীয় । বাগানের আর্থিক দৈন্যতার সাথে সাথে চাহিদাতেও দীনতা গা সওয়া হয়ে গেছে এতদিনে । আমি ফিরছিলাম অফিস থেকে বাড়ি ।

আকাশের অবস্থা মোটেই ভালো নেই । যে কোন সময়ে বৃষ্টি নামতে পারে । হাওয়ায় ভীষণ তেজ । দূরে নারিকেল গাছগুলো সমস্ত শক্তি দিয়ে পায়ে পা ঠেকিয়ে টিকে থাকতে ব্যস্ত । আমি দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছি । পথে বৃষ্টি এলে কোথাও একটু আশ্রয় নেবো, তেমন কোন ব্যবস্থা নেই । তাই ভিতরে ভিতরে একটা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা । আর ভাবতে ভাবতেই ডাকাত দলের মতো আকাশ কাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বৃষ্টি পৃথিবীর বুকে । হাতে একখানা ছাতা নেই যে মাথার উপর ধরি । তাই বৃষ্টি গায়ে মেখেই হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম আমি । হঠাৎই নজরে এলো বাগানের একটি দেহাতী মেয়ে এই ভরা বৃষ্টির মধ্যে গটগট পায়ে হেঁটে চলছে আর তার ঠিক পিছনেই ছাতা হাতে একটি ছেলে বয়েসে খানিকটা বড় হবে হয়তো আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেয়েটির মাথার উপর ছাতাটি ধরে রাখতে । যতবারই সে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির মাথায় ছাতা ধরে ততবারই মেয়েটি ছিটকে বেরিয়ে যায় । কারো মুখেই কোন কথা নেই । বুঝতে পারছি কোন একটা কারণে কোথাও সুর কেটে গেছে ওদের । ওদের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে আমার‌ও কেমন যেন নেশা ধরে গেছে । পায়ের গতি গেছে কমে ।আমি ধীর পায়ে ওদের পিছনে পিছনে এগিয়ে চলেছি । তখন‌ও বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম ।

 অনেকটা পথ চলার পর রাস্তা ঘেঁষে একটা দোচালা ছনের ছাপটা । এখানেই নম্বরে "পাতি" তোলার পর ওজন হয় । মেয়েটিকে দেখলাম ছুটে গিয়ে ওই ছাপটার নিচে আশ্রয় নিল, পিছনে পিছনে ছেলেটিও হাজির । আমিও পুরোপুরি ভিজে গেছি । কি করবো ভাবছি । কী এক সম্মোহনী মায়া, আমিও ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিলাম ওই ছাপটার তলায় । ছেলে মেয়ে দুটোই কাকভেজা কিন্তু কারোরই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই । মেয়েটি একটি কোণায় পিছন ফিরে দাঁড়ানো, ছেলেটি অনেকটাই নিরাপদ দূরত্বে । মেয়েটি উদাস, ছেলেটি অনুতপ্ত । মেয়েটির চোখে মুখে রাগ দুঃখ ক্ষোভ, অভিমান, ছেলেটি অপ্রস্তুত । আমি মাঝখানে এসে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো অনেকটাই জটিল হয়ে গেছে । ছেলেটি সাহস করে মেয়েটির কাছে যেতে পারছে না, যদি সে কোন বিরূপ আচরণ করে বসে, ভরসা নেই । আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না দেখার ভান করছি অথচ সবটাই লক্ষ্য করছিলাম ।

এদিকে বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ‌ই নেই । অনেকটা সময় কেটে গেছে তবু বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম ধারায় । আমি একটা দোটানার মধ্যে আছি । বৃষ্টি ভেজা শরীরে ঠান্ডা লাগছে ভীষণ অথচ এই রকম একটা ক্লাইমেক্সে ছেড়ে যেতেও পারছি না ওদেরকে । শেষ অবধি কি হয় দেখার ভীষণ ভীষণ ইচ্ছে । অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে একটা সময়ে ছেলেটা অনেকটাই সাহস নিয়ে মেয়েটির পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো । বহু দ্বিধা নিয়ে বললো, বহুৎ গুস্যা করলি রে ।
আহা, কী মিষ্টি অদ্ভুত কয়েকটি শব্দ, আমি চমকে উঠলাম ।কথাগুলো আমার বহু বহু চেনা । সৃষ্টির সেই প্রথম দিন থেকেই পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় কোণায় নানা ভাষায় মুকুন্দ মুরারি তার শ্রীমতীকে ঠিক এই কথাটাই বলতে শুনেছি । শব্দ কয়েকটি মেয়েটির কান ঘেঁষে প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে বাতাসে মিশে গেল । একটা কৃষ্ণচূঁড়া পাশে দাঁড়ানো অভিমানী রাধাচুঁড়াকে তক্ষুণি বললে, নারাজ হো ক্যায়া ? একটা কপোত তার কপোতীকেও ঠিক এই কথাটাই বললে । দিঘীর পাড়ে রাজহাঁসটি তার হংসিনীর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বললে, খুব রাগ হয়েছে বুঝি ? আমি শুনলাম, আর মনে হলো এতো সেই চন্ডীদাস আর রজকিনী ।

প্রথমবার মেয়েটি উত্তর দিলে না । দ্বিতীয়বার একই কথার পুনরাবৃত্তি হতেই মেয়েটি নিমেষে ঘাড় ফিরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালে । অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটির এই বৃষ্টি ভেজা শরীরের আগুন ছাপিয়ে দুচোখ জুড়ে কী প্রচণ্ড উত্তাপ ।অথচ চোখ জুড়ে উষ্ণ প্রস্রবণে বন্যা । চোখের কোণে স্পষ্ট গরম জলের স্রোত তবু হার মানতে রাজী নয় ।
-- তুই কাল কেনে আইলি নায় ? মেয়েটি ছেলেটিকে বললো । ছেলেটি তখন এক হাতে মেয়েটিকে কাছে টেনে নিয়ে পরম যত্নে চোখ দুটো মুছিয়ে দিতে ব্যস্ত । আর ঠিক তখনই সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে মেয়েটির বুকে জমে থাকা অভিমান কান্না হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলেটির বুকে । ওরা ভুলে গেল স্থান, কাল । ভুলে গেল আমার অস্তিত্ব, বৃষ্টির আদিখ্যেতা আর বাড়ি ফেরার তাগিদ । একটা অভিমানী মন প্রচন্ড অভিমানে আশ্রয় নিল তার ভালবাসার স্থানে । আর ভালবাসা ? ভালবাসা তখন পরম যত্নে তার শ্রীমতীর মান ভঞ্জন করছে ।

মিনিট পাঁচেক এমনি কেটে গেল । তারপর ওরা দুজনেই একজন আরেকজনকে কোমড়ে জড়িয়ে এক ছাতার নিচেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল স্থায়ী ঠিকানার উদ্দেশ্যে । আমি শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম অবাক বিস্ময়ে । মনে হলো মাঝে মাঝে এভাবেই বৃষ্টি যেন আমাদের প্রত্যেকের জীবনে আসে ।

Comments