সেরোগেট মা

সেরোগেট মা

ছোটবেলা থেকেই জানি, 
আমি সেরোগেট বেবি, স্বাভাবিক ন‌ই।
আমার জন্মটা অন্য একটি
                           গর্ভ ভাড়া নিয়ে। 
অনেক টাকার বিনিময়ে। আমি জানি।
একজন মহিলা যিনি দশ মাস দশ দিন
তিলে তিলে প্রাণে স্পন্দন এনে আমাকে,
শুধু মাত্র টাকার বিনিময়ে ছেড়ে যেতে পারেন
তাকে লোকে যাই বলে বলুক ,
                     শ্রদ্ধা করতে পারি না --
এমনটাই ভাবনা ছিল আমার।

আমার এখন যিনি মা, নিজের শরীরটাকে
মাখনের মতো মসৃণ রাখতে আমাকে
ছেড়ে দিয়েছিলেন ওই মহিলাটির‌ই গর্ভে।
আমি জানতাম।
আমার সেরোগেট মা, ওকে আমি চিনি,
ছবি দেখেছি বটে, মনে ছবি আঁকিনি কখনো,
আমার‌ই দোষ,খানিকটা ক্ষোভ 
                      আর অবশ্য‌ই অভিমানে।
আমাদের বাড়িতেই কাজ করতেন উনি,
দেখতে সুন্দর, ছিমছাম পরিছন্ন,
অভাবের সংসারে যতটা সম্ভব, ছিলেন ,
একটা আশ্চর্য মমতা ছিল মুখে।
আমার জন্ম নিয়ে জটিলতা ছিল শুনেছি,
      তাই নিয়ে কষ্ট‌ও পেয়েছেন অনেক।
ডেলিভারির পর অনেকদিন, ছিলেন শয্যাশায়ী।
তারপর আর খোঁজ নেই।
প্রয়োজনে যশোদা মাকে পেয়েছি পাশে,
দেবকী আমার খোঁজ রাখেননি কোনদিন।
আমি সেটাই জানতাম।
আজ তিন বছর ফাইন আর্টসে মাস্টার্স করেছি
ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার ছিল বিষয়।
বর্তমানে বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি।

সেবার মন্ত্রীমশাইএর বাড়িতে দুর্গাপূজা হবে
মন্ত্রীমানুষ, ব্যাপার স্যাপার একটু আলাদা
সবকিছুতেই ব্যতিক্রম চাই।
আমার তাই ডাক পড়েছিল প্রতিমা গড়ার।
আদেশ নয় অনুরোধ, আদেশ থেকেও বড়,
না বলার ধৃষ্টতা আমার মেরুদণ্ডে কোথায় ? 
একটা শর্ত দিয়েছিলাম শুধু, ছোট্ট একটা--
কাজটি আমি বাড়িতে করতে চাই, মন্ডপেতে নয়।
মন্ত্রীমশাই তাতেই রাজি,  খুশিতে সহমত ।

মন্ত্রীবাড়ির মূর্তি হবে, ঝক্কি আছে অনেক,
ভালো হলে, দেখতে সুন্দর, মন্ত্রী নেবেন ক্রেডিট,
আর যদি কাজটা খারাপ হয় ---, থাক।
অনেক যত্ন নিয়ে, নাওয়া খাওয়া ছেড়ে,
সৃষ্টি নিয়ে মেতে উঠলাম আমি।
একটু করে খড় বাঁধছি, মাটির প্রলেপ,
কাপড় সেঁটে ফাটল দিলাম ঢেকে।
ধীরে ধীরে আকৃতিটা নিল । রঙ চড়াতেই
             মায়ের মুখটি ভাসে। 
এত সুন্দর আমার হাতের কাজ !
মাগো, কত যত্নে ফসল তুলছি মা,
ঘরটা যেন ভরেছিল আলোয়।
অবশেষে মহাষষ্ঠি এলো আমার দোরে।

মন্ত্রীমশাই কথা রেখেছিলেন,
গাড়ি পাঠালেন, সঙ্গে একটা খাম।
দশটা মুটে কাঁধে তুলে নিল
                    টেনে তুললো গাড়িতে,
বাজলো সানাই, আতসবাজি
সঙ্গে একশো ঢাক।
মা চলেছেন সেজেগুজে মন্ত্রীবাড়ি আজ।
শতকন্ঠ গর্জে উঠে "দুর্গা মা কি জয় " ।
বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো
                            গলায় কান্নার দলা,
আর পারি না, আর পারি না, একি হলো !
আর একটু দাঁড়া, একটু দেখি,
আমার সন্তান, আমার সৃষ্টি, আমার "আত্মজা",
শেষ বারের মত আমায় একটু দেখতে দে,
ঘরটা আমার শূণ্য করে আলো কাড়িস না। 

পায়ের নিচে শক্ত মাটি আটকে রাখে পা
 আমার ঘর আঁধার করে শয়তানের‌ই ছা।
বোবা কান্নায় বাতাস স্তব্ধ, আমি ঘরে একা,
সেরোগেট বেবি এবার সেরোগেট মা।



Comments