লিচি


বাস থেকে নেমে মোড়টা পার হতে হয়। সেখান থেকে গুনে গুনে ঠিক তিনটে গেট পেরিয়ে চার নম্বর গেটটাই অনন্যাদের বাড়ি । চিনে নিতে কোনো অসুবিধা নেই, সদর ফটকে জ্বল জ্বল অক্ষরে বাড়ির তিনজন সদস্যের নাম স্পষ্ট ভাবে লেখা । কোথাও ভুল হবার যো নেই। তবু কিনকিনি গেটে এসে থেমে গেল । হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছোট্ট এনড্রয়েড ফোনটিতে অভ্যস্ত হাতে চটপট নম্বরটা টাইপ করতেই
অনন্যার ছবিটা মোবাইলে ফুটে উঠছে । রিং হচ্ছে, কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কিনকিনি খুব সাবধান, বাড়ি থেকেই ঠিক করে এসেছে কিছুতেই গেটের ভিতরে পা রাখবে না । অনন্যাদিটিও ঠিক অমনি, কাজের সময়ে কক্ষনো ফোন তুলবে না। কিনকিনি একবার আড়চোখে হাত ঘড়িটা দেখে নিল । এখনো হাতে পাক্কা একঘন্টা সময়। কাছেপিঠে কোথাও যে যাওয়া যাবে তেমন কোন নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না । অগত্যা আবার সেই চেষ্টা । হঠাৎই  ওপার থেকে উত্তর ভেসে এলো ।
-- হ্যাঁরে  কিনকিনি বল ।
--- চট্ করে তৈরি হয়ে নীচে নেমে এসোতো।
--- কেন ? কি হয়েছে ? কারো কোন বিপদ  ?
--- নারে বাবা,  একটু আড্ডা মারবো ।
-- বেশ তো , চলে আয় ওপরে ।
--- কে ? আমি  ?  না বাবা তবে চললাম ।
--- আহা, আহা কিনকিনি, কথাটা শোন লক্ষ্মীটি , চলে আয় ওপরে । কতদিন তোর সাথে আড্ডা দেই নি। অনন্যার গলায় আকুতি ।
--- না বাবা, প্লিজ ও কাজটা আমার দ্বারা হবে না অনন‍্যাদি।
--- কেন রে, কেউ তোকে কিছু বলেছে ?
--- ছিঃ তা কেন?  তোমাদের ওইটা আছে না ?
--- ওইটা মানে ?  অনন্যা অবাক ।
--- আরে ওইটা গো । ওই যে গো  , কি যেন নাম, লুচি না কি ।
--- প্লীজ কিনকিনি, ওর নাম লুচি না লিচি ,লিচি  মানে হচ্ছে লিটল চাইল্ড।
--- ওই ষন্ডা মার্কা লুচিটা তোমাদের লিটল চাইল্ড ! সত্যি তোমরা পারো বটে অনন্যাদি ।
--- আমি সত্যি খুব খারাপ পাচ্ছিরে কিনকিনি, কতবার বলেছি ওটা লুচি না লিচি ।
--- ওই একই কথা অনন্যাদি, লুচি বা  লিচি । যতদিন ওই জন্তুটা তোমাদের  বাড়ি আছে, আমি তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি না ।
টেলিফোনে কথা চলার ফাঁকেই অনন্যা হন্তদন্ত হয়ে  গেটে চলে আসে ।
--- ওমা, তৈরি হয়ে আসোনি । কিনকিনির গলায়  বিশ্ময় ।
--- তোকে নিতে এসেছি তো,  চল ভিতরে চল ।
--- না না প্লীজ, আমার ভীষণ ভয় করছে। কিনকিনির অকপট স্বীকারোক্তি ।
--- একদম ভয় পাবি না , ভয়ের কোনকিছু নেই। আমাদের লিচি জানিস আপাদমস্তক ভদ্রলোক । কারো ক্ষতি করে না । দেখতে গায়ে গতরে একটু বড়, আর হবে নাইবা কেন , জাতটা কি ?  জার্মান শেফার্ড , যাকে বলে কিনা সাহেবের বাচ্চা ।
-- সে সাহেবের বাচ্চা হোক কিংবা নিগ্রোর, আমি যাচ্ছি না ভেতরে ।
--- লক্ষ্মী সোনা বোন আমার, একবার ভেতরে চল । আজ যদি ও তোকে কামড় দেয়, তবে আর কোনদিন তোকে আসতে বলবো না।
অনন্যা রীতিমত হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দেয় । ওদিকে গেট খোলার শব্দ পেয়ে ভিতর থেকে বিপুল গর্জন আসছে । ভয়ে পাদুটো নড়তে চাইছে না । কিনকিনি ভয়ে ভয়ে বলে, একবার যদি কামড়ে দেয় , তাহলে এমনিতেও আর আসতে হবে না অনন‍্যাদি।
অনন্যাও নাছোড়বান্দা, ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়।  নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে । বলে, আমি কথা দিচ্ছি তোকে ও যদি তোকে কামড় দেয় কিংবা দাঁঁত ছোয়ায় , তবে আমি কান কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেব।
---- তাতে আমার কি লাভ হবে।
---এবারে কিন্তু বেশিবেশি হয়ে যাচ্ছে কিনকিনি । অনন্যার গলায় রীতিমত বিরক্তি ।
---- তুমি শুনতে পাচ্ছো না, ওটা কি বিশ্রী ভাবে ডাকছে ।
--- ওটাই ওর স্বভাব কিনকিনি। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখিস, লিচি না, ভীষণ বাধ‍্য। আমাদের কথার একচুলও এদিক ওদিক করে না। মানুষের বাচ্চাগুলোও এতটা ওবিডিয়েন্ট হয় না, যতটা ওবিডিয়েন্ট আমাদের এই লিটল চাইল্ডটা ।
কিনকিনি ভীষণ ফ্যাসাদে ফেঁসে গেছে । যেতেও পারছে না, আবার মনেও সাহস পাচ্ছে না । ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভয়। একসময়ে টানাপোড়েনের শেষে ভেতরে যাওয়াই সাব্যস্ত হয় । কিনকিনি নিরুপায় হয়ে বলে, তাহলে তোমার লিচি কে এটলিস্ট বেঁধে রাখতে বলো , যাতে অন্তত আমার কাছে আসতে না পারে ।
---- ওই টেনশনটা তুই নিস না তো কিনকিনি। ওকে এমনিতেই বেঁধে রাখা হয় ।
--- তবু ?
--- বললাম তো, ও বাঁধা আছে ।আর যদি ছাড়াও থাকে তবে আমাদের ইশারা ছাড়া লিচি কক্ষনো তোকে টাচ পর্যন্ত করবে না , মিলিয়ে নিস।
--- বেশ, তবে চলো ।
অগত্যা প্রথমে অনন্যা, তারই আড়ালে পিছনে পিছনে কিনকিনি গেটের ভিতরে ঢুকে । ভিতরে যাচ্ছে ঠিক‌ই কিন্তু জোর করে মনে কিছুতেই সাহস আনতে পারছে না । কিনকিনি চারদিকে খুব সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে ওটা ভিতরে‌র দিকে কোথাও বেঁধে রাখা । অনন্যা কিনকিনিকে অন্য পথে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল ।
--- আচ্ছা তুই লিচিকে এত ভয় পাস কেন বলতো ?
--- তোমার লিচি বলে কোন কথা নয় , জন্তু জানোয়ার নিয়ে আদিখ্যেতা আমার একদম পছন্দ নয় ।
--- আমাদের লিচিটাতো আর দশটার মত নয়, তুই বিশ্বাস কর, আমরা ওকে আলাদা ভাবে ট্রেনিং দিয়েছি। তুই কিছু দিলে খাবে না। ওর খাবারের বহরই আলাদা । এক খাবার পরপর দুবেলা দিলে কক্ষনো মুখে তুলবে না।
--- তাই ?
--- হ্যা , শুধু কি তাই। প্রত্যেকবেলা ওর মাংস চাই। যে থালে ওকে খেতে দেওয়া হয় তাতে নোংরা লেগে থাকলে সেই বেলা অভিমান করে মুখে কুটোটিও তুলে না।
--- ও বাবা, এত দেখছি লাটসাহেব ।
--- তবে আর বলছি কি ?  বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে পা না মুছে কক্ষনো ঘরে ঢুকবে না ।যেখানে সেখানে নোংরা করাতো অনেক দুরের ব্যাপার, একটু ময়লা থাকলে কখনোই সেখানে বসবে না। আমরা ওকে সবসময়ই বিছানাতে নিয়ে শুই, কোনদিনই বিছানা পত্তর নষ্ট করেনি। পটি পেলে তোমাকে বুঝিয়ে দেবে, কিন্তু ঘরদোর নষ্ট করা, কক্ষনোই না।
--- কিন্তু  আমি সে জন্য না, আমার ভীষণ ঘেন্না লাগে, খাবার দাবার সব কিছুতেই লোম --- আমার ঠিক ভালো লাগে না । কিনকিনি নিজের সপক্ষে যুক্তি টেনে বোঝাতে চেষ্টা করে ।
--- নারে লোম কোথায় ?  প্রতিদিন দামী  সাবান দিয়ে স্নান করানো হয়। ওর জন্য একটা আলাদা লোক ঠিক করা।
কিনকিনি বুঝতে পারে, এখানে কোন যুক্তিই ধোঁপে টিকবে না। কথা বলতে বলতে ওরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে । প্রথম কোঠাটিতে বিশাল বিশাল সোফা । দুটো জায়গাতে সেন্টার টেবিল ঘিরে দুদুটো বসার ব্যবস্থা । অত্যাধুনিক সব আসবাবপত্র, দেওয়ালে দামী দামী ছবি, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুরে দেওয়াল জুড়ে বিশাল একটা টিভি টাঙানো । কেউ একজন ওখানে সোফায় বসে টিভি দেখছেন। কিনকিনির দিকে পিছন দিয়ে বসা, তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না । তবে টাক দেখে অনন্যার বাবা বলেই মনে হলো।
--- তুই বরং আমার ঘরে চল, এখানে বেশিক্ষণ এসি চালানো যাবে না। বাবার আবার এসিতে এলার্জি । -- অনন্যা কিনকিনিকে পাশেই একটা কামরায় নিয়ে যায় ।
--- আরাম করে বিছানাতে বস, একদম সংকোচ করবি না । বল কি খাবি।
--- কিচ্ছু না, তুমি একদম ব্যস্ত হবে নাতো । আমি খেয়ে এসেছি। কিনকিনি অনন্যাকে আশ্বস্ত করে ।
--- তাতে কি , তুই মোটেই আপত্তি করবি না । এক মিনিট বস, আমি আসছি । অনন্যা কিনকিনিকে ঘরে বসিয়ে চট করে কাজের লোককে কিছু একটা বলে আসে । ঘরের দরজা ভেজানো, তাই এত ভয় পাবার কিছু নেই । অনন্যা ফিরে আসতেই আড্ডা জমে ওঠে । একথা ওকথা চলতে চলতে এক সময়ে কিনকিনি প্রায় ভুলেই গেছে ওই প্রাণীটির কথা। আর বিপত্তিটা ঠিক তখনই ঘটার ছিল। কাজের মেয়েটি--- সুভদ্রা -- ট্রেতে  দুই গ্লাস ঠান্ডা সরবত আর একটা প্লেটে  বেশ কিছু কাজুবাদাম নিয়ে ঢোকে। অনন্যাই ব্যস্ত হয়ে ওকে বিছানাতে রাখতে বলে । কিনকিনি মনে মনে খুশি হয়। এই মুহূর্তে এইরকমই একটা কিছু আশা করছিল কিনকিনি। অনন্যার বলার অপেক্ষা না করেই একমুঠো কাজুবাদাম হাতে তুলে নিল সে। ঠিক তখনই লক্ষ্য করলো দরজা দিয়ে ঢুকছে জন্তুটা । নিমেষে কিনকিনির গলা শুকিয়ে কাঠ । তখন‌ও কাজুগুলো মুখে দেওয়া হয়নি, ন‌ইলে গলায় আটকে যেত। কিনকিনি চিৎকার করে এক লাফে বিছানার উপরই অনন্যার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। আর এই লাফালাফিতে সরবতের গ্লাস উল্টে সবটা সরবত‌ই বিছানাতে । ওদিকে সেই বিশাল জন্তুটাও বিছানার উপর উঠে এসেছে একেবারে কিনকিনির মুখোমুখি । কি লজ্জার কথা , লোকের বাড়িতে এসে কিসব অস্বস্তিকর কান্ড। কিন্তু কিনকিনির এসবে নজর দেবার উপায় নেই। সামনে জলজ্যান্ত যমদূত। কিনকিনির আর সরে যাবার জায়গা নেই । একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকানো । এদিকে হঠাৎ করে সরবতটা পড়ে যাওয়াতে অনন্যা সুভদ্রার সাথে বিছানা থেকে জল ঝাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । কিনকিনির গলা থেকে গোঙানি ছাড়া কিছুই বেরুচ্ছে না ।
জন্তুটা ক্রমশ কিনকিনির গা ঘেষে সমস্ত শরীরে মুখ ঠেকিয়ে বিশ্রীভাবে গন্ধ শুঁকছে। আর প্রতিবার মুখ ঠেকাতেই, কিনকিনির মনে হচ্ছিল  যেন এই বুঝি ওটা কামড়ে দিচ্ছে । ওর মুখ থেকে জায়গাতে জায়গাতে জিভ থেকে লালা লাগছে , অথচ কিনকিনির কিছুই করার নেই । শক্ত হয়ে দাড়িয়ে মনে মনে মঙ্গলচন্ডীকে ডাকতে শুরু করলো। খুব জাগ্রত দেবতা। একবার মনে হয়েছিল এক মুহুর্তে মনে হলো বিপদনাশিনীকে ডাকলে হয়তো ভালো ছিল। কিন্তু বারবার ঠাকুর দেবতা পাল্টানো কি ঠিক হবে ? সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । মাথা কাজ করছে না । কতটা সময় এভাবে কেটেছে বলা মুশকিল, একসময়ে ওই প্রাণীটির কি‌ংবা হয়তো মঙ্গলচন্ডীর দয়া হলো। হঠাৎই কিনকিনিকে ছেড়ে অনন্যার জামা ধরে টানাটানি শুরু। ততক্ষণে বিছানাতে থেকে যতটুকু জল পরিষ্কার করা সম্ভব ততটুকু কাজ হয়ে গেছে । অনন্যার নজর পরলো লিচির দিকে ।
--- লিচি --- এসব কি হচ্ছে, নটিবয় , যাও ভিতরে যাও, দেখতে পাচ্ছো বাড়িতে অতিথি এসেছে, একদম দুষ্টুমি না। এই দিদিটা কি ভাববে বলো দেখি ।
কিনকিনি মনে মনে ভাবে শেষ পর্যন্ত কুকুরের দিদি। কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে এতকিছু বলা তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । একটানা জামা ধরে টেনে চলেছে , আর পেছনের পা দুটো তুলে লাফাচ্ছে ।
---দিদি চারটে বেজে গেছে, ওর এখন বেরোনোর সময়। পাশ থেকে সুভদ্রা মনে করিয়ে দিলে ।
---ও হ্যাঁরে তাইতো, আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম । তারপর‌ই সুভদ্রাকে বললো,  -- যা তো মনা, একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আয় । ও বেচারা খুব কষ্ট পাচ্ছে । বুঝতেই পারছিস, আমি একটু কিনকিনির সাথে গল্প করি, প্লিজ।
--- তোমার কোথাও যাওয়ার থাকলে তুমি যেতে পারো অনন‍্যাদি, আমাকে এখন যেতে হবে । কিনকিনি এবার সত্যি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো ।
--- সে কি আমি কোথাও যাচ্ছি না, তুই বসতো ।
--- কিন্তু ওই যে বললে কোথায় ঘুরতে যাবার কথা ।
এবারে অনন্যা সশব্দে হেসে উঠলো । বললে, ধুর বোকা, ও কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেনি । আসলে লিচির এই সময়ে পটি পায় । ওই জন্যেই এত টানাটানি করছিল ।
--- তার মানে  ?
--- আহা লিচি তো বাড়ি নোংরা করে না । ওভাবেই ওকে শিখিয়েছি । আমাদের বাড়ির চতুর্সীমানায় সে পটি করবে না। ওকে ওই সময়টাতে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে হয়, সে ঝড়‌ই আসুক আর বৃষ্টি তুফান যাই থাকুক, সময়ের নড়নচড়ন নেই ।ওখানে সে তার পছন্দ মতো কোন এক জায়গাতে পটি সেরে আবার বাড়ি ফিরে আসবে। ভেরি ডিসিপ্লিনড ।
--- সেকি ?  নিজের বাড়ি ছেড়ে পটি করতে অন‍্য বাড়ির দরজাতে ! সত‍্যি, মানতে হবে অনন‍্যাদি ।

Comments