তর্পণ

তর্পণ

ছেলেটি সত্যি  অভাগা । গান কবিতা নাটক নিয়ে থাকতো, পাগল ছেলে ,  শেখার ছিল প্রচন্ড আগ্রহ । অনুষ্ঠান করতে খুব ভালবাসতো সে। এই নিয়েই তার যত বায়নাক্কা। কোন অহংকার ছিল না, মিশতে পারতো সবার সাথে সহজে ভাবে। বয়স কত হতে পারে?  40-42।  ঘরে মিষ্টি একটা বৌ আর ফুটফুটে একটা ছোট্ট পরী । জীবনের যে সময়টা ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের আস্কারাতে  হৈ হৈ করে বেরায় সেই সময়েতে সে তার ক্যান্সার রোগাক্রান্ত মাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। অভ্যস্ত হাতে মায়ের শুশ্রূষা । বাবা বামপন্থী কর্মী তাই স্বভাবতই অভাবের সংসার । ছেলেটি মাকে নিয়ে ব্যস্ত ।ঔষধ হাসপাতাল আর শুশ্রূষা । একদিন অনেক রোগ ভোগের পর মা মারা গেলেন , তখনই বাবা ব্রেইন স্ট্রোকে শয্যাশায়ী । তারপর আবার যুদ্ধ । একসময়ে বাবাও মারা গেলেন । ততদিনে সে ঋণগ্রস্ত । ঘরে একটা বৌ এসেছে, এসেছে একটা মিষ্টি পরী । চিকিৎসার খরচ চালাতে চালাতে পৈতৃক ব্যবসা লাটে উঠেছে ।শেষমেষ একসময়ে বন্ধ । প্রচন্ড আর্থিক অনটন । খুব পরিশ্রম করতে পারতো, রেডিওতে ডিউটি, পত্রিকা অফিসে কাজ -- সংসারে দুবেলা ভাতের ব্যবস্থাতো করতে হবে । তারই ফাঁকে ফাঁকে কবিতা গানের অনুষ্ঠান । মাঝে মাঝে খুুুুব ক্লান্ত লাগতো ওকে । তবু উৎসাহে কোন ভাটা নেই। এরই ফাঁকে ভাগ্যক্রমে সেইলস্  একটা কাজ জুটলো । এবারে বুঝি ঠাকুর মুখ তুলে তাঁকিয়েছেন। তখনই আবার  ধরা পরলো বৌটিরও সেই একই রোগ, প্রাথমিক পর্যায়ে । মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত । ডাক্তার বলেছেন প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর চেন্নাই এই চেক আপ। বার তিনেক গিয়েও ছিল । সামর্থ্য কোথায় ?  ডাক্তার বললেন যখন গৌহাটি আসব ওখানে দেখিও । একটা সুরাহা হলো। এবারে অসুস্থ হলো সে নিজে ।বসন্ত । খুব বাজে ভাবে অসুস্থ ।প্রচন্ড জ্বর , কয়েকদিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ । সেই রাত্রে ও সে প্রচন্ড অসুস্থ ছিল  । ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিল, ডাক্তার চেম্বারে ছিলেন না  ।যখন এলেন তখন ওর যাবার মত শক্তি নেই । রাতে অনেক বারই বমি হবার পরে অচেতন হয়ে শুয়েছিল । বৌ অনেক রাত অবধি শুশ্রূষা করে ঘুমিয়ে আছে ভেবে যখন অন্য ঘরে শুতে গেল, তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে । মশারী সে কোনকালেই গুজতো না । ঘরে মশার উৎপাতে কয়েল জ্বালানো ছিল । কখন অসাবধানে মশারী ঝুলে কয়েলে লাগে কেউ বলতে পারে না । বাকিটা সবাই জানেন । ডাক্তাররা বলছেন কার্ডিয়াক এরেষ্ট । পরিবার বলছে হয়তো সে আগেই মারা গেছে নইলে বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা একটা অবশ্যই নিত। পত্রিকা বলছে অন্য কিছু । সার কথা মিহিরেশ আর আমাদের মধ্যে নেই ।
আজকাল যারা ওর বাড়িতে যাচ্ছেন, ওর ফুটফুটে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেন নি এমন ব্যাক্তি বোধহয় খুব কম। ডাকলেই ছুটে চলে আসে কোলে । গলায় ধরে শরীরের সাথে সাপটে থাকে। বুকটা জুড়িয়ে যায়। স্বামী হারিয়ে ওর সদ্য বিধবা বৌটি যখন কেঁদে কেঁদে স্মৃতিচারণ করে তখন ছোট্ট শিশুটি মাকে আদর করে চোখ মুছিয়ে দেয় । বলে , " কেঁদো না মা, কেঁদো না, কাঁদতে নেই যে ।" 

সুপ্রদীপ দত্তরায়

Comments