খিলঞ্জিয়া
কাল রাত আধঘুম চোখে
ছেলে আমার প্রশ্ন করে
"বাবা এনআরসি টা কি? "
আমি অবাক হই, চমকে উঠি
বলি , কি হয়েছে বাবা?
মধ্যরাতে এমন প্রশ্ন ?
শরীর খারাপ লাগছে না তো ?
ওর মা বললে ও কিছু নয়
স্কুলেই হয়তো শুনলে ছোড়া --
খবর কাগজ টিভির পর্দা
এখন তো সব ওতেই ভরা
সেখান থেকেই নামটা শোনা
নইলে কোথায় তোমার এনআরসি
আর কোথায় এই বাবুসোনা ।
হয়তো তাই, আবার হয়তো নয়
আমি পিতা, আমায় তবুও বলতে হয়।
মধ্যরাতে বুঝিয়ে বলি
এনআরসি কি, কেন প্রয়োজন
কাদের স্বার্থে তৈরি হচ্ছে
দিই ,তার খানিক বিবরণ ।
ছেলে আমার সবটা শুনে
উদাস দুটো চোখে
সবশেষেতে প্রশ্ন করে
"বাবা, আমাদের কি হবে ?"
আমাদের কি হবে বোকা
আমরা তো সেই আদ্যিকালের ,
নাম ওঠেনি তাতে কি
পরের লিস্টে থাকবে খন।
বাবা ছিলেন মুক্তি যোদ্ধা
সেটা সেই কবে ছেষট্টি সন
ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী সাহস দিলেন
মুক্ত কন্ঠে অভয় দিলেন
তবেই আমরা সেদেশ থেকে এলাম ।
এসব কথা মিথ্যে নয় সত্যি জানিস
গ্রামের সবাই জানে সেসব কথা
আমাদের কেউ বিদেশী বলবে
সেই চিন্তাই বাতুলতা ।
ছেলে বলে তুমি জানো না বাবা
আমার বন্ধুরা সব জানে
ওরা বলছে সত্যি তাড়িয়ে দেবে।
আমরা নাকি খিলঞ্জিয়া নই
আমরা নাকি বিদেশী ---
চোরের মত এসেছি এদেশে
শরণার্থী বাংলাদেশী।
কি বললি লুকিয়ে এসেছি ?
চোরের মত ? কে বলে সেই কথা ?
অজান্তেই চিৎকার করি মধ্য রাত্রিবেলা ।
আমাকে বিদেশী বলে কার এত সাহস হয়;
স্ত্রী বলে শান্ত হও, এই রাত্রিতে উত্তেজনা নয় ।
ছেলে আমার কাঁদে, বলে যদি সত্যিই না ওঠে নাম
যদি সজ্ঞানে অজ্ঞানে ভুল থেকে যায়,
আমরা কি আর এই দেশেতে থাকব না বাবা --
আমার স্কুল, আমার পড়াশোনা
খেলার মাঠ, বন্ধু বান্ধব, টিউশন
আমাদের এই ফ্ল্যাট বাড়ি
তোমার ব্যবসা, মায়ের চাকরি
আমাদের কি হবে বাবা ?
আমি কি তবে মূর্খ থাকব
স্কুলের দরজা আমার জন্য থাকবে না আর খোলা ।
মধ্য রাতে ছেলে আমার কাঁদে ,
আমি নিমেষে বুকের মধ্যে টেনে
বলি কে বলছে তোকে ওসব কথা
এই সবই রাজনীতির খেলা
কাঁদিস না বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে ।
মুখে বলি বটে, সান্ত্বনা দিয়ে
বুকের মধ্যে মোঁচড় দিয়ে ওঠে
কি ঠিক হবে ? কিভাবে হবে ঠিক?
যদি সত্যিই নাম না থাকে
যদি নোটিশ দিয়ে ডাকে , তবে ?
কি হবে উপায়। অবাস্তব কিছু নয়।
জন্ম যার হয়েছে আজ শতবর্ষ পূর্বে
তার যদি স্থান হয় ডিটেনশন ক্যাম্প,
আমি তবে কোথাকার হরিদাস পাল ।
রাগ দুঃখ ক্ষোভ ক্রমে মাথাচাড়া দেয়
ভাবি, কি চায় ওরা,
বিয়াল্লিশ, সাতচল্লিশ, একষট্টি, একাত্তর --
আর কতো, হিসেব ছাড়া ।
কেন বারবার ওরা শান্তিটা কেড়ে নিতে চায় ।
কার স্বার্থে দেশভাগ আজ , কে করে লুটতরাজ
কার আত্মদানে আজ কে হয়েছে রাজা !
কারা জাতিতে জাতিতে লড়াই বাঁধায়
আড়ালেতে লুটে মজা ।
কে বলে এই দেশ ছাড়ো , কি তার অধিকার?
কার ভোটে জিতে সে চোখ রাঙানিতে
বিবেকেরে করে বলৎকার ।
কে নিজেরে খিলঞ্জিয়া বলে ?
কে দেয় সেই উত্তাপে আহুতি ,
কিসের প্রয়োজন ওরা আন্দোলন করে
ইতিহাস করে বিকৃতি । কার স্বার্থে ?
কার ঠোটে ঐ প্রচন্ড লালসা
কার দেহে আকন্ঠ বিষ।
তারা ক্ষমতার লোভে গুজব ছড়ায়
আসলেতে কিলবিস ।
মনে হয় চিৎকার করে বলি
ক্ষান্ত হও, আর নয় মিথ্যার আশ্রয়।
যদি কেউ সত্যিই খিলঞ্জিয়া হয়,
তবে শুধু অসমীয়া নয়
বাগানী, বাঙালি, বড়ো কুকী আদি
সবাই খিলঞ্জিয়া, নয়তো কেউ নয়।
ছেলে আমার কাঁদে বলে, বাবা --
কিছু একটা করো এইবেলা ।
সময় যে ক্রমে ক্রমে ক্ষীণতর হয় ।
ওগো বুদ্ধিজীবী বিজ্ঞজন
ব্রাত্যজনে করে আহ্বান
অনেক হয়েছে তথাগত সাজ
এবারে ইটে ইট দিয়ে হবে প্রতিদান।
অনেক হয়েছে মিথ্যা ভুমিকা
দাবী হোক বন্ধ করা জনতার হয়রানি
পঞ্জীকরণে নিরপেক্ষতা
এদেশ আমার, এদেশ সবার
এ হোক বীজমন্ত্র এবার,
মৈত্রীতে হোক মনুসংহিতা ।
Comments
Post a Comment