যাযাবর

আমি যাযাবর

সহস্র যোজন পথ চলেছি
       বহমান কলংমার কুলে,
স্থায়ী আস্থানার খোঁজে।
আমার চলার পথ লক্ষীন্দরের ভেলা,
বিষধর সর্পের বিষে মৃতপ্রায় দেহ -
ভাসিয়েছি অনিশ্চিত ঠিকানায়।
আমিতো দোষী ন‌ই, ভাগ্যের পরিহাস
একচোখা মনসার কুটিল প্রয়াস ।

পথে যত ভৈরব সেতু
শত শত রাজাকার হায়না-
অবহেলায় দলেছে অবলারে, 
                    ওরা পাষন্ড ছিল।
আমি তবু পথ চলি ক্রমাগত, 
                 অসহায়, হীন, দুর্বল,
রাত্রি গভীর হয়েছে আমার সম্মুখে।
লক্ষ ললনার হাহাকার আর তীব্র আর্তনাদে।

ঘর, বাড়ি, উঠোন, তুলসীতলা,
ধান ভরা গোলা, গোয়ালে গাভী
যা ছিল আমার, সব ছেড়ে 
এক রাত্রে করেছি প্রস্থান,
মহাপ্রস্থান পথে। স্ত্রী, কন্যা, ভগনী,
একে একে লুন্ঠিত, ধর্ষিত হয়েছে 
                               বিবস্ত্র বাজারে, 
দেশ থেকে হয়েছি দেশান্তর। 
বাংলা ভাগ - রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা - 
মৌলবাদের জয় - টসবটাই ইতিহাস।
একাত্তরের বলি, কেউ বলছেন'শরনার্থী',
কেউ 'আপদ', 'উপদ্রব' । আমি যাযাবর,
মাথা পেতে নিয়েছি মেনে, অপমান অনাদর।
ছিলাম জমিদার, ডাক্তার, কিংবা খেলোয়াড়,
শিক্ষক, কেরানী, কেউ কোষাগার রক্ষক;
সর্বস্ব খুইয়ে একাকার সব, 
নতুন জাতির সৃষ্টি - শরনার্থী, শরনার্থী পরিচয়।
স্থানে স্থানে শিবিরেতে নিয়েছি আশ্রয়।
কেউ বিবেকের চাপে, কেউ অর্থের বিনিময়ে
কেউ মানবতায় আমাদের নিয়েছিলেন টেনে;
ছিলাম "কেরানী" হয়েছি " কামলা"
নিয়তির নিষ্ঠুর ক্রুর ছল।

তবু যাযাবর চলেছি পথ ক্রমাগত
                             ঠিকানাহীন ঠিকানায়।
যা পেয়েছি পথে, আঁকড়ে ধরেছি জেনেছি ভাগ্য
ছুড়ে ফেলে দিয়ে পিছনে অতীত
প্রাণপণে চিৎকার করে বলেছি, 
                                      ওদেশ আমার নয়।
ওখানেই আমি হারিয়েছি প্রিয়জন, আত্মীয়
স্বপ্ন, ভালবাসা - আত্মপরিচয়।
বুঝিয়েছি মন, মানিয়ে নিয়েছি এদেশে।
যা পেয়েছি, ঢের দিয়েছি, নিজেকে নিঃশেষে।
প্রত্যেকদিন প্রত্যূষে উঠি, জপ করি আমি,
               এ দেশ আমার, আমার আশ্রয়দাতা
এখানকার নরনারী "মাইবাপ" আমার
                                           দেবতা, বিধাতা।
আমার যা আছে আমি সর্বস্ব সঁপে দেব ঈশ্বর,
হাতে হাত রেখে গড়বো স্বদেশ -
হে ভাগ্যবিধাতা, তুমি উজানেতে বাও।
যদি পারো অতীতকে ভুলতে পারি 
সেই শক্তি চাই, শক্তি দাও আরো।

কালে কালে বহে যায় বহু জলধারা
কলংমার তীর সাজে নতুন পসরায়।
আশার কুঁড়ি ফোঁটে, স্বপ্নে মুকুল, 
ভাগ্যদেবী দেন বুঝি এইবার কোল।
গড়ে ঘর, পরিবার, লাউ-কুমড়া-লতা
ধানে আসে শীষ, লক্ষীর আশীষ 
সমুদ্রে শয্যা পাতা।
আঁকড়ে ধরে মাটি, বৃক্ষ গজায়,
হাঁসি ফোটে শিশু ঠোঁটে দিগন্ত ছড়ায়।

আজ আবারো একত্রিশের মধ্যরাত।
সাতচল্লিশের উচ্ছ্বাস, আতংক আর্তনাদ -
একাত্তরের নির্যাতন, আশীর উৎকণ্ঠা,
ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে নো ম্যান্স ল্যান্ড
সেই পুনরাবৃত্তি, পথচলায়, শিকড় নির্মূল।
কে আছো, হাত বাড়াও বন্ধু, 
বল এ পথ শেষ কোথায় ?
কোথায় আমাকে থামতে হবে ?
কি নাম স্বদেশভূমির ?


Comments