একরাতে প্রতিরাতে

এবারে শারদীয়া সাহিত্য পত্রিকাগুলির মধ্যে স্নিগ্ধা নাথদের "আমাদের সমকাল ", কাশীদাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকা ও প্রণব দাসের "সাহিত্য সম্ভার "এ আমার লিখা প্রকাশিত হয়েছে । আমাকে এই সম্মান জানানোর জন্য আমি তাদের প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞ । আপনাদের উৎসাহ ও সাহসের ভর করে প্রাপ্ত এই সম্মানের আপনারাও সমান অধিকারী।
নীচে সাহিত্য সম্ভারে প্রকাশিত আমার গল্পটি প্রণব দাসের অনুমতিতে আপনাদের জন্য তুলে ধরলাম ।

একরাতে প্রতিরাতে

যারা দিনের আলোয় বা সন্ধ্যা রাতে আলোর রোশনাইএ এই শহরের সাথে পরিচিত হয়েছেন কিংবা একটু ঘনিষ্ঠতা, একটা আত্মীয়তাবোধে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন তাদের অনেকের কাছেই আমার বিশ্বাস, রাতের এই শহরটি  একটা সম্পূর্ণ অচেনা জগত, যার আলো আঁধার মাখানো প্রতিটি রাত এক একটি বিস্ময় ভরা উপন্যাস । এখানে  প্রতিটি পরতে পরতে রহস্য, উৎকণ্ঠা আর বহু আকাঙ্ক্ষিত নিষিদ্ধ আনন্দ । ছোটবেলায় ঠাকুরমার ঝুলিতে যেভাবে পরীরা  পৃথিবীর বুকে নেমে এক মায়াবী জগত সৃষ্টি করতো,  কল্পনার জাল বুনে স্বপ্নের ভেলায় অচিন পথে পা বাড়াতো, এখানেও ঠিক তেমনি প্রতি রাতে তৈরি হয় একটা অদ্ভুত পরিবেশ । ফারাকটা শুধু একটিই  জায়গাতে। এখানে ঠাকুরমার ঝুলির মত অন্তিমে কোন নির্মল প্রশান্তি নেই , আছে উদ্বেগ, ভয়, লোকাছুপি, আর অন্তিমে সীমাহীন ক্লান্তি। দিনের পর দিন চলছে একই নাটকের পুনরাবৃত্তি । সময় , কলাকুশলী কিংবা চরিত্র এই নাটকের মোটামুটি একই ।আগে কখনো এরকম ছিল না । আজ বছর বিশেক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে । কাশীরামের সব কিছুই জানা । প্রতিরাতে  একই ছবি দেখতে দেখতে মুখস্থ । বিড়িতে শেষ সুখটান দেওয়া হয়ে গেছে, এবারে হাতে ছ্যাঁকা লাগার সম্ভাবনা বেশি  । তাই  আঙুলের ঠোকায় আদরের বস্তুটিকে দুরে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে  লাঠিটা হাতে তুলে নিল কাশীরাম । বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে এমাথা থেকে ওমাথা একবার ঘুরে আসা প্রয়োজন । মহল্লাবাসী সবাই জানুক ওদের ভরসার লোকটি এসে গেছে । যদিও দোকানপাট সবগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, দুই একটা পানের দোকান এখনো খোলা ,তবু  রাস্তায় আলোর জৌলুস অনেকটাই কম। স্থানে স্থানে জমাট বাঁধা অন্ধকার । লোকজনের চলাচল নেই বললেই চলে । হুটহাট দামী গাড়িগুলি ততধিক দামী মালিকদের নিয়ে ছুটে যাচ্ছে  একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে । মাঝে মাঝে দুরন্ত গতিতে একটা দুটো  বাইক বিকট আওয়াজ তুলে নিরুদ্দেশে ছুটছে,  আর তারই সাথে পাল্লা দিয়ে বাইকচালকদের অদ্ভুত চিৎকার সমাজের ঘা গুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ।  ঘড়িতে রাত আনুমানিক সাড়ে দশটা । রামলাল তার রিক্সার পিছনে বাঁধা প্লাস্টিকের থলিতে কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিক বোতল ভরে একটু আগে চলে গেছে । রোজই সে নিয়ম করে নয়টা থেকে দশটা এই পাড়ায় আসে কাজে। কাজ  বলতে রাস্তা , নালা আবর্জনার স্তুপ থেকে প্লাস্টিকের বোতল কুড়ানো। আয় মন্দ হয় না, দুশো থেকে তিনশো । উৎসবাদিতে পাঁচশো টাকার বেশি হয়। দিনের শেষে এটা একটি উপরি আয় । থলি ভর্তি হয়ে গেলে মহিমের দোকান থেকে একটা প্যাকেট বিড়ি কিনে একটু সময় কাশীরামের সাথে বসে জিরিয়ে নেয়।  দুইজন একসাথে বসে আয়েস করে দুটো বিড়ি জ্বালায়, টুকটাক সুখদুঃখের কথা হয়। তারপর পুরো প্যাকেটটি কাশীরামের হাতে তুলে দিয়ে রিকশা নিয়ে বাড়ির পথ ধরে রামলাল । কাশীরাম এই এক প্যাকেট বিড়ির পরিবর্তে অন্য কোন রিকশাওয়ালাকে এই অঞ্চল থেকে বোতল কুড়াতে দেয় না । গিভ এন্ড টেক পলিসি । কাশীরাম একে ঠিক ঘুষ বলতে নারাজ । ঘুষ তখনই হবে যখন অন্যায়ভাবে কাউকে কিছু পাইয়ে দেওয়া হয় । কাশীরামের মতে এ  এক যৌথ উদ্যোগ। যাক রামলাল চলে গেছে তার পথে। কালি পুজো হয়ে গেছে আজ কয়েকদিন । আকাশে একফালি চাঁদ উদাস চোখে প্রহর গুনছে । সোয়েটার গায়ে চাপানোর মত শীত নয়, তবু শেষ রাতে ঠান্ডা লাগে । হাতের কম্বলটা দোকানের বাঁধানো সিড়ির  এককোনে রেখে কাশী লাঠি হাতে উঠে দাঁড়ায়। একবার পুরো এলাকাটি সরেজমিনে দেখে নেওয়া প্রয়োজন । কাশী একে একে প্রত্যেকটা দোকানের তালা পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো । রোজকার রুটিন মাফিক কাজ , দিনকাল পাল্টে গেছে, কাউকে বিশ্বাস নাই । কে যে কখন কিভাবে ফাঁসিয়ে দেবে বলা মুশকিল । কাজের ব্যাপারে কাশী অত্যন্ত সচেতন ।

--- " ও --- কাশীদা একটা  বিড়ি দ্যাওনে,  গাটা একটু গরম করি ।"

রাস্তার পাশে ডাস্টবিন থেকে নিষ্ঠার সাথে টুকিটাকি দরকারি জিনিস জড়ো করতে করতে সীতার মা কাশীরামের  কাছে একটা বিড়ি চাইলো।

--- " চুপ কর মুখপুড়ী, লাজ লইজ্জার মাথা খাইছস। মাইয়া মানুষ হইয়া বিড়ি চাস লইজ্জা করে না ।"

--- " যাক একজনে তো স্বীকার করলা যে আমি মাইয়া মানুষ ।"

--- " মাইয়া মানুষ তো মাইয়া মানুষই হয়, এতে স্বীকার না করার কি আছে ।"

--- " তা কই নাই দাদা, সংসারের ঘানি টাইনতে টাইনতে আমি নিজেই যে ভুইলা গেছি, আমি কি। তুমিওতো মাইয়া মানুষ  কইয়া একটা দিন নরম হইয়া কথা কইলা না । কইছ কও ? "

--- " চুপ কর । বুড়ির শখ দ্যাখো । তিনকাল কাইট্যা শেষ কালে ঠেকছে । এখন বুড়ির সঙ্গে আমি সোহাগের কথা পাততাম । জামাইটারে খাইছস, এখন আমার মাথাটা খাইস না । যা বিড়ি নিয়া ভাগ।" কাশীরাম প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে দেয় । নিজেও একটা নেয় । বিড়ি হচ্ছে নেশার জিনিস, কাউকে খেতে দেখলে খেতে ইচ্ছে হয় । দাঁত দিয়ে সরু প্রান্তটি কেটে কাশী নিজের বিড়িটা জ্বালিয়ে সীতার মার দিকে আগুন বাড়িয়ে দেয়।

সীতার মা অনেক রাত অবধি এপাড়ায় ঘোরাফেরা করে । সমস্ত শহর যখন ঘুমায় তখন কতগুলো বাড়ি আছে যেখান  থেকে কিছু লোক চুপচাপ  এসে সারাদিনের জমানো আবর্জনা নিমেষে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে যান । সীতার মা সেইসব আবর্জনা থেকে পিচবোর্ড, কাচের বোতল বা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় মুল্যবান জিনিস কুড়িয়ে জমিয়ে রাখে।  সকালে মহাজনকে দিয়ে দিলে চলে যাওয়ার মতো টাকা পাওয়া যায়। আগে শুধু রাতেই অনেক টাকা রোজগার হতো। ইদানিং দুই শিফ্টে কাজ করতে হয়। আজকাল দিনের বেলা প্রত্যেকটি পাড়াতে গাড়ির ব্যবস্থা আছে । সেই সব গাড়ি দিয়ে নিয়ম করে প্রায় বাড়ি থেকে আবর্জনা নিয়ে যায়। সীতার মা দিনের বেলা সেইসব গাড়ি থেকেও জিনিস কুড়িয়ে রাখে। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে দিনের বেলা কষ্ট বেশি । বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েদের সাথে পেরে উঠা যায় না । রাতে সেই সমস্যা নেই । বরং রাতে দোকানের আবর্জনা বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া শিশু থেকে যুবতী কারো পক্ষেই বেশি রাতে কাজ করা সম্ভব নয়। শিয়াল কুকুরের সমস্যা আছে । সীতার মা সেই বয়েস  পেরিয়ে এসেছে ।

হাতের কাজ রেখে সীতার মা বিড়িতে একটা জোরে টান দিল। তারপর সদর রাস্তার একপাশে বসে বললে, " দাদাগো, আর বুধহয় বেশি দিন এই কাজ কইরতে পারুম না ।"

--- " কেনেরে, শরীল খারাপ নি ?"

--- "এই শরীলে এত পরিশ্রম সইয্য হয় নাগো দাদা ।"

--- " ঠিকই কইছস, ছাইরা দে ।শরীলটারে বাঁচাইয়া চলতে লাইগবো । আমিও ভাবতেছি কি করা যায়।"

--- "ছাইরা দে কইলেই কি ছাইরা দেওয়া যায় কও। আগে পাছে ভাবতে লাগবো না। সীতার বাপটাতো মইরা বাচছে । আমার সীতার কি হইব কইতে পারো ?"

--- " চিন্তা কইরো না সব ঠিক হইয়া যাইবো ।" কাশীরাম সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।

--- " হাসাইও না দাদা , তিনকাল কাইট্যা গেছে এখনো ওই এক আশাতে  আছি - "সব ঠিক হইয়া যাইবো "।  আমি মইরলে তবে সব ঠিক হইবো জাইন্যো ।" সীতার মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা  দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । হাতের বিড়িটা ছুড়ে ফেলে কিছু সময়  চুপচাপ বসে থাকে সীতার মা । হয়তো পুরনো কোন স্মৃতি মনে পড়ে । তারপর হঠাৎই সম্বিত ফিরতে আরো একটা বিড়ি চাইলো কাশীরামের কাছে ।

--- " এত বিড়ি খাস না রে। " মুখে বললো বটে, কিন্তু পকেট থেকে একটা বিড়ি দিতে কৃপণতা করলো না কাশীরাম ।

বিড়িতে  আগুন ধরিয়ে যেন পুরনো আমেজ ফিরে এল সীতার মা  । কাশীর একটু কাছে ঘেঁষে বললে,  " দাদাগো, তোমারে একটা কথা জিগানোর আছিল ।"

--- " কও ----"

--- " তোমাদের পাড়ার জয়বাবু নাকি আজকাল বৌটার সাথে থাকে না ?"

--- " কি জানি আমি এইসব জানি না ।"

--- " সব জানো কিন্তু কইতা না। "

--- " কইলাম তো জানি না । ভাগ এইখান থেকে --।"  কাশীর  এইসব মেয়েলি ব্যাপারে কোন উৎসাহ নাই । অপ্রাসঙ্গিক কথা এড়াতে নিজেই উঠে দাঁড়ালো।

--- " আহা রাগ করো কেনে দাদা, বসো। আমার পাশে বইসলে তোমার বদনাম হইতো না ।" বলে হাতে ধরে টেনে আবার বসিয়ে দিল । কাশী বসতেই সীতার মা পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসে ।

--- " আচ্ছা মিতালি বৌদিরে তুমি চিন ?

--- " কোন মিতালি?  আমি কোন মিতালিরে  চিনি না ।"

--- "খুব চেনো দাদা । ঐযে গো , গান বাজনা করে। কেনে গতকাল রাইতেওতো  একটা থেকে দেড়টা সময় জয়বাবু যে আইছিল তুমার মনে নাই ।  মিতালি বৌদিরে  বাড়িতে নামাইয়া দিতে আইয়া  রাস্তার মধ্যে  জড়াইয়া ধরিয়া  সেকি বেলাল্লিপনা। তুমি না পারতে শেষমেশ  বাঁশি ফু দিলা । কও এটাও মিথ্যা কথা ?"

--- " তোরে কে কইছে ক? "

-- " সেইটা দিয়া তুমি কি করবা ? শুধু জাইন্যা রাখো , আমরা সব জানি। এও জানি লোক জানাজানি যাতে না হয় তারজন্যে জয়বাবু তুমারে যখন তখন কিছু টাকাও দেয়। কালকেও দিসে।"

--- " তুই কি কইতে চাস ?" কাশীরাম  চমকে উঠে ।

--- " কিচ্ছু না দাদা, চলি ।" সীতার মা উঠে চলে যায়। কাশীরাম ভাবতে থাকে, সীতার মা  কি বলতে চায়। হঠাৎই কেন এই প্রসঙ্গটা টেনে আনলো। এত কথা সে জানলেই বা কিভাবে । তারমানে  কি আরো কেউ তাদেরকে লক্ষ্য রাখছে । কাশীরামের কপালের ভাঁজ দীর্ঘায়িত হলো। এই পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস নাই কাশী তার অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছে। আনমনা পায়ে কাশীরাম তার নিজের বসার জায়গাতে ফিরে এল । জায়গাটি আসলে একটি দোকানের বারান্দা , একটু অন্ধকার তবে এই জায়গাটা থেকে পুরো অঞ্চলে নজরদারি করা যায় । রাত অনেক হয়েছে, এতক্ষণ যে ক’টি দোকান খোলা ছিল সবই বন্ধ হয়ে গেছে । মহিমও চলে গেছে অনেকক্ষণ । এই অঞ্চলে সবশেষে ওর দোকান বন্ধ হয়। লোকে বলে মহিমের পানের ব্যবসা রমরমা । আসলে পান নয়, পানের ব্যবসার আড়ালে অন্য কিছুর ব্যবসা । রাত্রি যত ঘন হয়ে আসে, লোকের আনাগোনা তত বাড়তে থাকে । তড়িতকর্মা ছেলে,  সব দিক গুছিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে । কাশীর থেকে অবশ্য মহিম কখনো পান বিড়ির দাম নেয় না । একটা হৃদ্যতা হয়ে গেছে । সেই মহিমও চলে গেছে অনেকক্ষণ । এখন আর রাস্তায় লোকজন নেই । কাশীরাম দোকানের শাটারে পিঠ লাগিয়ে আরাম করে বসলো। আজকাল পুরো রাত জাগতে কষ্ট হয় । এত অত্যাচার শরীর মেনে নিতে চায় না । ঘড়িতে কাটা এগিয়ে চলেছে । চোখে বোধকরি একটু তন্দ্রা এসে গেছিল, কিন্তু একটা মারুতি ওয়াগনারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো । মনে হলো ভেতর থেকে কোন রুগী কিংবা কোন মেয়েলি চিৎকার শুনতে পেয়েছে। গাড়িটা দ্রুত গতিতে চলে গেল । কাশী ক্ষিপ্রতার সঙ্গেে গাড়ির নম্বরটা দেখার চেষ্টা নিল কিন্তু হলো না ।গাড়ি দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেছে । তারই মধ্যে   যতটুকু দেখতে পেয়েছে ,  কাশী সেইটা তার ছোট্ট নোটবই এ লিখে রাখলো। সেইসঙ্গে গাড়ির রঙ, কি গাড়ি আর সময়টা ।  এসব ব্যাপারে সে খুব সচেতন । অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে লিখে রাখতে। গাড়িটি দুরে চোখের আড়ালে চলে যেতেই কাশী মাথাটা শাটারে এলিয়ে দিল।  

দুরের আকাশে অজস্র তারা জ্বল জ্বল করছে। কাশী উদাস হয়ে তাকিয়ে দেখে তারাগুলিকে ।  কম দিন তো আর নয় , অনেক দিন । বছর পঞ্চাশেরও বেশি । সেই কবে এই কাজ নিয়ে এখানে এসেছিল , তখন তার বিয়ে থা হয় নি। এই কাজ করতে করতেই তার বিয়ে, দুই মেয়ের জন্ম। এখন সেই মেয়েদের ছেলে মেয়েরা রোজগার করে খায় । লোকে বলে  মৃত্যুর পর নাকি মানুষ আকাশে তারা হয়ে জ্বলে । কাশী বুঝতে পারে না  মানুষ কি করে এত নিশ্চিত হয়ে এসব কথা বলে । আজ দুইযুগ পেরিয়ে গেল, কোথায়, কাশীতো আজও তার বৌটাকে খুঁজে পেল না । তবে হ্যাঁ, কাশী বিশ্বাস করে, একদিন ঠিক  তার বৌ তারা থেকে নেমে আসবে, কাশীর পাশে বসবে। সেদিন হয়তো এতদিনের জমে থাকা কথাগুলো বিনা কারনেই ভাষাহীন হয়ে যাবে ।  যদি তাই হয় তবে যায়,  যাবে, যাক না, ক্ষতি কি । কাশী জানে চোখে চোখ রেখে  অনেক কথা বলা যায়। হাতে হাত রেখে যদি ওর মনের কথা না বুঝতে পারে তাহলে কিসের সংসার পেতেছিল  কাশী। অনেকটা সেই অপেক্ষাতেও  কাশী রাতে ঘুমাতে চায় না, যদি ওর বৌ এসে ফিরে যায় ।

কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল কাশী । হঠাৎই একটা বাচ্চার কান্নায় সম্বিত ফিরে আসে । তাঁকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে কেঁদে কেঁদে ওর মাকে খুঁজছে । এত রাতে একাএকা একটি বাচ্চা মেয়ে এভাবে কেঁদে ঘুরে বেড়ানো মোটেই নিরাপদ নয় , কত কি হয়ে যেতে পারে । আজকাল শিশু পাচার চক্রগুলিও  ভীষণ সক্রিয় । কাশী মেয়েটিকে নানা ভাবে  বুঝিয়ে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে আসে। আদর করে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বাচ্চা মেয়েটি আরো জোরে কেঁদে উঠল । কাশী অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বারবার জিজ্ঞেস করে, "কিরে, কি হইছে , খুইল্যা কো। কেনে কানতেছস  ?"

--- "আমার মারে দেখছো ?"

--- " নাঃ , কই গেছে তোর মা ?"

--- " ঔষধ আনতে ---। বাবার খুব শ্বাসকষ্ট তো, আমি আর মা পাড়ার দোকান থেকে ঔষধ আনতে গেছিলাম ।"

--- " এত রাত্রে দোকান খুলা আছিল? " কাশী আসলে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছিল ।

--- " না, দোকান বন্ধ কিন্তু আমরা বাসা চিনিতো । বাসাত গেলেও ঔষধ পাওয়া যায়।"

--- " তারপরে--- ? ঔষধ  পাইছস ?"

---" না, আমরা খালি বাসায় থেইকা একটু দুরে গেছি , হঠাত পিছের থেইকা একটা গাড়ি আইছে । আমরা রাস্তার  কিনারোই আছলাম,  তবু তারা আমারে ধাক্কা মারছে, মারে মুখ চিপা মারিয়া গাড়িত তুইল্যা লই গেছে গিয়া । মায় কত চিৎকার করছে ছারি দিবার লাইগ্যা , এরা কেউ শুনছে না ।"

নিমেষে কাশীর সেই মারুতি ওয়াগনারের কথাটা মনে পড়ে গেল । বুঝতে অসুবিধা হল না ওর মার সাথে কি হয়েছে । কিন্তু এই বাচ্চাটাকে কি বোঝানো যায় । অনেক ভেবে নিজের কম্বলটা দোকানের বারান্দাতে  পেতে দিয়ে বাচ্চাটাকে শুতে দিয়ে বললো , "তোমার নামটা তো কইলায় না দাদুভাই ।"

--- "পুতুল -----।"

---" খুব সুন্দর নাম । আচ্ছা পুতুল, আমার একটা কথা শুন দাদুভাই, এখন তুমি এখানে  শুইয়ে থাক তো দেখি।  এই অন্ধকারে তোমার মারে তো খুজা যাইত না , সকাল হইলেই তুমি  আর আমি একসঙ্গে খুজতে যাইমু । এখন ঘুমাও , তুমি না ঘুমাইয়া যদি কান্নাকাটি কর তাইলে তোমার মাও খুব গুসা করবো তো। এরপরে আর আইত না।"

বাচ্চাটাকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে কাশী ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো । অল্প সময়ের মধ্যেই বাচ্চাটা কাশীর চোখের শেষ ঘুমটুকু শুষে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল । চারপাশে আবার শ্মশানের নিস্তব্ধতা । শুধু কাশী ঘুমহীন চোখে জেগে রইলো ভোর হবার অপেক্ষায়। সকাল হলেই নানা সমস্যা, কি উত্তর দেবে এই শিশুটিকে,  কোথায় খুঁজে পাবে ওর মাকে, কাশী ভেবে কুল পায় না । কিন্তু কিছু একটা তাকে করতে হবেই, নিদেনপক্ষে থানায় একটা ডাইরী। যদিও সে ভালো ভাবেই জানে এটা শুধুই নিয়ম রক্ষার ব্যাপার , কাজের কাজ কিছুই হবে না, শুধু হয়রানি ছাড়া । নিজের কাছেও রাখা যাবে না , অনেক সমস্যা । কাশী এই উড়ে এসে জুড়ে বসা সমস্যায় আকাশ পাতাল ভাবনা ভাবতে লাগলো। এদিকে ঘড়ির কাঁটা নির্বিকার ।

কি করে যে ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেছে বোঝা গেল না । একটা উদ্বেগ, একটা উৎকণ্ঠা নাকি একটা  অস্বস্তি বোধ ক্রমাগত কাশীরামের ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে । বাচ্চাটার প্রতি একটা দায়বদ্ধতা আবার নিজের অক্ষমতায় নিজের প্রতি একধরনের ক্ষোভে , কেমন যেন একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাশীরামের ভিতরে । ভোর হতে তখনো অল্প বাকি। অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি , পুব আকাশে হালকা রক্তিম আভা । দুুুুরে দেখা গেল একজন মহিলা এদিকে হেঁটে হেঁটে আসছেন । কাশীর কেন যেন মনে হল এই মহিলাটিই পুতুুুলের মা । মনে মনেে একবার ঈশ্বরকে স্মরণ করে নিল । হে ঠাকুর যেন তাই হয়। মহিলাটি যত কাছে আসতে লাগলো তত সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল । খুব বেশি বয়স নয় মেয়েটির, কাশীর বড় মেয়ের বয়সের হবে হয়তো । কাপড় চোপড় অগোছালো, সারা শরীরে অত্যাচারের ছাপ , চলছে যেন উদ্ভ্রান্তের মত। আশেপাশের জগত সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন । কাশীর বুকটা মুুুচড়ে  উঠলো । আহা রে , কার ঘর ভাঙলো কে জানে । মেয়েটা কেমন যেন একটা  অন্যমনস্ক হয়ে কিছুু খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলেছে । এদিকে যে কাশী বা কাশীর পাশে পুতুল ঘুমিয়ে আছে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । ধীরে ধীরে  কাশীকে অতিক্রম করে চলে গেল মেয়েটা । তবে কি এই মেয়েটা পুতুলের মা নয়। কাশীর মনে সন্দেহ জাগলো। নাও হতে পারে । হঠাৎই কি মনে হতে কাশী গলার স্বর উঁচুতে তুলে মেয়েটিকে শুনিয়ে পুতুলকে ডেকে  বললো, " পুতুল তোর মা যার গিয়া, উঠ তাড়াতাড়ি ।"

অবাক কান্ড, পুতুল নামটা শোনা মাত্রই মেয়েটি চমকে উঠে পিছন ফিরে দাঁড়ালো , আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুতুলের উপর। পুতুলকে  কাশীর কোল থেকে কেড়ে নিয়ে সেকি বুকফাটা কান্না । মা কাঁদছে, মেয়েও কাঁদছে একজন অন্যকে জড়িয়ে। যেন কত যুগ পর তারা একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে। কাশী কিছুক্ষণ  চুপচাপ বসে রইল পাশে । কাঁদতে দিল ওদেরকে । তারপর ধীরে ধীরে বলল, " কাঁন্দিস না মা , কাঁন্দিস না । ইটার নাম হইছে শহর। ইট কাঠ পাথরর তৈরি শহর। ইখানো কাঁন্দিয়া কুনু লাভ নাই ।"

--- " আপনি জানইন না, সারারাইত ধরিয়া এরা আমার লগে কিতা করেছে --- ।" মেয়েটি হয়তো কাশীকে আরো অনেক কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু কাশী সেই সুযোগ না দিয়েই বলল, " আমি সব জানি ।" একটু থেমে আবার বলল," আমি সব জানি, তবু কইতেছি কাঁন্দিস না মা। ইখানো কাঁন্দিয়া লাভ নাই । দেখবে একটু পরেই ইখানো লোক জড়ো হইতে থাকবো, তোরে লইয়া রসাল গল্প তৈরি হইব । কেউ কেউ তোরে হয়তো সহানুভূতিও দেখাইবো  কিন্তু কুনু সুবিচার পাইতে না মা। তারচেয়ে আমি অটো ডাইক্যা  দিতেছি,  বাড়িত  যা। যা হারানির হারাইলাইছস  আর নতুন কইরা কিচ্ছু হারাইছ না । আর শুন মা, একটা কথা কই, তুই ভুলি যা  গতকালকে রাত্রের কথা । আমি আমার অভিজ্ঞতা থেইকা  কইতেছি , ভুলি যা। আমরা যে বড় অসহায় রে মা ।"

কাশী লোক জানাজানি হবার আগেই পুতুল আর পুতুলের মাকে একটা অটো গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজেই পকেট থেকে ভাড়াটা গুনে দিল । সূর্য তখনও লজ্জায় পুব আকাশে মুখ লুকিয়ে বসা।

সুপ্রদীপ দত্তরায়।।।।

Comments