চরণ দাস গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে একা থাকে। দোচালা ঘর, এদিকে-ওদিকে ভাঙাচোরা চেহারা, তবু ঘরটা এখনও টিকে আছে। তারই একটা অংশ কেটে ছোট্ট বারান্দা—চালে ছাউনি বহুদিন হয়নি। চরণের তাতে কিছুই আসে যায় না।
চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে একাই থাকে চরণ। সকাল হতেই মাটি দিয়ে ছাঁচের কাজ করে। সন্ধ্যা নামলে ওই বারান্দায় বসে হারমোনিয়াম বাজায়—
“গুরু ভজ রে, ও মন গুরু ভজ রে,
সময় যাবে নদীর জলে,
তুমি যাবে চলে, ও মন গুরু ভজ রে...”
ঘরের গা ঘেঁষে এক বিশাল নিমগাছ। সারাদিন আলো আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। চরণ কখনো তার ডাল কাটে না। সবাই জানে, চরণ বুড়ো নির্জন মানুষ, সংসার নেই, কারো সাতে পাঁচে থাকে না। কিন্তু কেউ নিমগাছের ডালে হাত দিলেই চৌদ্দ পুরুষের শাপ-শাপান্ত করে।
অদ্ভুত ব্যাপার—প্রতি বছর পিতৃপক্ষের একাদশীতে ভোর হতেই নিমতলায় দুটো পিঁড়ি পেতে রাখে চরণ। সেদিন সে অনেক কিছু রাঁধে। তারপর দুটো থালায় গামছা পেতে ভাত, তরকারি, মিষ্টি সাজিয়ে রাখে দুইজনের জন্য।
একজন খায় না, আরেকজন নেই।
সেদিন চরণ অন্য কোনো কাজ করে না—শুধু লাঠি হাতে কুকুর-বিড়াল তাড়ায়।
লোকমুখে শোনা, বহু বছর আগে ওর ছেলে বউ নিয়ে শহরে চলে গিয়েছিল; আর ফেরেনি কোনোদিন। তবু চরণ আজীবন জোর দিয়ে বলত,
“ওরা খায়, আমি টের পাই... বাতাসটা গরম হয়ে ওঠে।”
গত বছর সেই চরণও চলে গেল। ওর হারমোনিয়ামের সুর বাজিয়েই গাঁয়ের লোক তার কাষ্ঠাদি করেছিল। এখন বাড়িটা পোড়াবাড়ি হয়ে পড়ে আছে।
কিন্তু এ বছরও পিতৃপক্ষের একাদশী সকালে গ্রামের লোক দেখে—
নিমতলায় যথারীতি দুটো পিঁড়ি পাতা। সামনে গামছা পেতে হরেক রকম তরকারি সাজানো, দুটো গরম ভাতের থালা।
সকালের রোদ যখন ছায়া ছুঁয়েছে নিমতলা, তখনও পিঁড়িতে ধোঁয়া উঠছে। নিমের হাওয়া অকারণে দিনভর শিরশিরানি জাগায়।
লোকে বলে, ভর দুপুরে পিঁড়ির ওপর আলতা পড়া তাজা পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছিল।
অনেকেই নাকি স্পষ্ট দেখেছে তা।
কিন্তু ওই একটা দিনই—পিতৃপক্ষের একাদশী তিথি ।
Comments
Post a Comment