কুয়ো

বটতলার মাঠের শেষে মাহাতোর বাড়ি। উঠোনের একপাশে তিন পুরুষের প্রাচীন বাঁধানো কুয়ো। একসময় গ্রামে কুয়ো বলতে এই একটাই ছিল। সূর্য উঠলেই ভীড় জমত— লোকে বলত, “এই কুয়োর জল নাকি খুব ভালো!”

এখন আর কেউ ভুল করেও আসে না। কুয়োটা শুকিয়ে গেছে বহুদিন।
শুধু বুড়ো গোপাল ভোরে ভোরে আসে। চুলে কলপ, ধোপদুরস্ত সাজ, হাতে পেতলের লোটা— ফাঁকা। মিনিট কুড়ি দড়িতে লোটা বেঁধে নিচে ফেলে আবার তোলে, দেখে— তলায় একফোঁটা জলও জমলো কিনা।

গ্রামের লোক হাসে,
“ও বুড়ো পাগল, শুকনো কুয়োতে জল খোঁজে!”

গোপাল চুপচাপ বসে থাকে, উত্তর দেয় না।

বছর পঁচিশ আগে এই কুয়োর ধারে ওর বৌ ফুলমণি জল তুলতে এসে হেসে বলেছিল—
“এই কুয়োটা একদিন তোর মতোই বুড়ো হয়ে যাবে।”
—“আর তুই?”
—“আমি তো তখন থাকবোই না ! বুড়োর সঙ্গে কে ঘর করে?”
দুজনেই সেদিন হেসেছিল খুব।

পরদিন আকাশ কালো, ঝড় এলো বলে।
ফুলমণি গেল জল আনতে, ওরা ছিল তিন জন — ঠিক তখনই বজ্রপাত!
কুয়ো শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু ফুলমণি আর ওঠেনি।

তারপর থেকে গোপাল প্রতিদিন ফিটফাট সেজে আসে। কুয়োর দিকে তাকিয়ে ভাবে—
“যদি একফোঁটা জল ফিরে আসে,
হয়তো ফুলমণিও ফিরে আসবে সাথে !”

মাস যায়, বছর যায়।
গ্রামের লোক শোক ভুলে যায়, গোপাল ভুলে না।

একদিন সকালে দড়ির গায়ে ফোঁটা ফোঁটা জল।
গোপাল কান পাতে কুয়োর গায়ে—
কার স্বর শোনা যায়!
ফুলমণি? সত্যি ফুলমণি?

গলা কাঁপে, গোপাল চিৎকার করে ওঠে — “যাই...”
নিমেষে ঝাঁপ!

লোকে বলে, ভোর হলে নাকি এখনও ফুলমণিরা আসে।
কুয়োর জলে কারা হাসে, কারা ডাকে—
কেউ জানে না।

Comments