জানালা

আকাশদীপ এপার্টমেন্ট টাওয়ার ওয়ানের আঠাশ নম্বর তালার পশ্চিম জানালায় দাঁড়িয়ে সুচিন্তন । দৃষ্টি ছোঁয়া দূরত্বে, ঠিক উল্টো টাওয়ারে সঙ্গিনীর ফ্ল্যাট। আজ তিনদিন বিক্রি হয়ে গেছে । অনেকদিন পর সে এই জানালায় দাঁড়িয়ে । এখান থেকেই তার সমস্ত গল্প বোনা শুরু - সুখ, স্বপ্ন আর তৃপ্তির । এখানে দাঁড়িয়েই সঙ্গিনীকে প্রথম দেখা, প্রেমের সূত্রপাত। শুধু দূর থেকে চোখের দেখা আর তীর্থের কাকের প্রতীক্ষা ।

সঙ্গিনীই প্রথম আগল ভেঙ্গেছিল ।বুদ্ধি করে দীপাবলির রাতে ব্যালকোনিতে দশটা হ্যাঙ্গারে মোমবাতি - সংখ্যা এক একটা ফোন নাম্বার। আইডিয়াটা দারুণ। প্রথমটায় সুচিন্তন বোঝেনি, হিন্টসটা পেতেই ফোন— তারপর ইতিহাস।

 জানালায় দাঁড়িয়ে আনমনে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সুচিন্তন মনে মনে একটা হিসাব নিল, গত সপ্তাহে দীপাবলিতে ওদের সম্পর্কের আট বছর পূর্তি হয়েছে। প্রতিবছর এই দিনটিতে সঙ্গিনী কেক নিয়ে আসে । সারাদিন এখানেই কাটায় । খাওয়া দাওয়া, আগুনে খেলা সবই সবিস্তারে হয় । এইবারই প্রথম ব্যতিক্রম। 

ইদানিং সঙ্গিনীদের অবস্থা ভাল নয়। বাবার দুর্ঘটনা, মায়ের ট্রমা— একার পক্ষে সঙ্গিনীর টানা- খুব কষ্ট হচ্ছিল। সুচিন্তন পাশে থেকেও দূরে গেছে। সম্পর্কটা এখন লাভের নয়, ভারের। তাই এই ইচ্ছাকৃত দূরত্ব। এবারের দীপাবলি কেটেছে শিখার ফ্ল্যাটে। সঙ্গিনী আঁচ পেয়ে, চেষ্টা নিয়েছিল, - সুচিন্তন আমল দেয়নি কিছুতেই ।

শিখা সঙ্গিনীর মতো নয়— বেপরোয়া, আগুনে, প্রচণ্ড ক্ষুধা - সর্বাবস্থায় একটা নিষিদ্ধ আকর্ষণ। সঙ্গিনী জানে তবু উদাসীন, অন্তত সুচিন্তনের তাই ধারণা । আসলে ওকে ইদানিং একটা শক্ত খোলসে ঢাকা শামুক ছাড়া কিছুই মনে হত না ।

 ফ্ল্যাট বিক্রির আগে একবার দেখা করতে চেয়েছিল সঙ্গিনী, সুচিন্তন কাজের অজুহাতে এড়িয়ে গেছে। নিজেকে সে দুর্বল দেখতে চায় না । সে নিশ্চিত, তার সিদ্ধান্ত সঠিক । হালকা টানে সুচিন্তন পশ্চিমের জানালাটা বন্ধ করে মোবাইলে একটা মেসেজ লিখল শিখাকে, "দূরত্বটা শত্রু যেন, আমি কি এখন আসতে পারি ?"

দুটি সিগারেট শেষে মোবাইলের পর্দায় শুধু নীরবতা। মেসেজটা ‘সিন’, তবু কোনো উত্তর নেই। একঘণ্টা পর এল রিপ্লাই—
 "ভালবাসা আর প্রেম - দু'টোতে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। কাল মঙ্গলাচরণ। ছেলেটি সব জেনেই সম্মতি দিয়েছে । তোমার জন্য সঙ্গিনী রইল। নিমন্ত্রণের আশা করো না । ভাল থেকো ।

অনেকক্ষণ স্থবির বসে রইল সুচিন্তন। দক্ষিণের জানলাটা - এবার এটাও বন্ধ হয়ে গেছে । কোনটিই খোলার কোন চান্স নেই। সুচিন্তনের সমস্ত বুক জুড়ে ঘাম, তার সত্যিই খুব শ্বাস কষ্ট ।




Comments